বাকস্বাধীনতা থেকে বাকযুদ্ধ এবং আমাদের বাকযোদ্ধারা

সালেহ নোমান
Published : 6 June 2012, 04:31 PM
Updated : 6 June 2012, 04:31 PM

খৃষ্টপূর্ব ৬'শ থেকে ৫'শ শতাব্দী সময়ে এথেন্স ডেমোক্রেটিক আইডোলজি থেকে সম্ভবত বাক স্বাধীনতা বিষয়টির উৎপত্তি। বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষনার অর্টিকেল ১৯ অনুযায়ী প্রত্যেক্যের মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি স্বীকৃত। তবে একই আইনে অন্যের সম্মান এবং স্বাধীনতার বিষয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতাতেও কিছু সীমা রেখে টেনে দেয়া হয়েছে।
আর এই সীমাবদ্ধতা'র অন্যতম নিমায়ক হচ্ছে নৈতিকতা।

বাকস্বাধীনতা কিংবা ব্যক্তিস্বাধীনতা আমাদের মত দেশে বিশেষ করে যাদের শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটেছে পরাধীনতায় তাদের কাছে পরম এক আরধ্য বিষয়। কথা বলার স্বাধীনতা নিশ্চিত ও নিজের ভাষা রক্ষার জন্য ১৯৫২ সালে আমাদের পূর্ব পরুষরা তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে আমাদের গৌরবান্বিত করে গেছেন। বিশ্বের বুকে আমাদের মাথা উচূ করেছেন। ভাষার জন্য রক্ত দেয়ার ছয় দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। এই ষাট বছরে আমরা কথা বলেছি নিজের ভাষায়, নিজের মত। অবশ্য, পাকিস্তান আমল ও পরে বাংলাদেশ আমলের উল্লেখযোগ্য সময় অবশ্য আমরা সব কথা বলতে পারিনি। সামরিক শাসন এবং অনান্য কারনে।

১৯৯১ সাল থেকে অবশ্য আমাদের স্বাধীনভাবে কথা বলার নতুন যুগ বলা চলে। গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অনিবার্য অংশ হিসেবে আমরা স্বাধীনভাবে কথা বলছি। আর কথা বলতে বলতে এমন জায়গায় নিজেদের নিয়ে গেছি যে সেখান থেকে ফিরে পাওয়ার পথ হারিয়ে ফেলেছি যেন।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে কথা বলার স্বাধীনতার বেশি বেশি চর্চ্চা হচ্ছে। বাক স্বাধীনতা রূপ নিয়েছে বাক যুদ্ধে । প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বাকস্বাধীনতার মাত্রাতো পুরানো বিষয়। এই স্বাধীনতার পথ ধরে এক দল আরেক দলের নেতা নেত্রীদের চোর ডাকাত থেকে শুরু করে সব কিছু বলে বসেন। যা এক পর্যায়ে বাকযুদ্ধে রূপ পেল। রাজনীতিবিদদের এই বাকযুদ্ধ থেকে রা পাচ্ছেন না আমাদের প্রয়াত নেতারাও। এই বাকযুদ্ধের কারনে আমাদের রাজনীতি এখন রীতিমত ঘূর্ণিঝড় আর টর্নেডোতে পরিনত হয়েছে।

সমুদ্রে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় যেভাবে দিক পরিবর্তন করে তেমনি বাকযুদ্ধও দিক পরিবর্তন করে মাঝে মাঝে। দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের অনুকরনে বাকযুদ্ধে ব্যস্ত এখন আমাদের আদালত আর জাতীয় সংসদও। যেহেতু এই যুদ্ধে হারজিতের প্রয়োজন নেই, সময়সীমা নেই, তাই যার যখন খুশি তখন শুরু করছেন এই যুদ্ধ।

কয়েকদিন আগে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বাক যুদ্ধ চালিয়েছেন নোবেল বিজয়ী ড. ইউনুসের বিরুদ্ধে আর সম্প্রতি তিনি তা করছেন টেলিভিশন টক শোর মূল চরিত্র সুশীল সমাজের বিরুদ্ধে। অবশ্য ড. ইউনুস এখনো নিয়মিত বাক আক্রমনের শিকার হন সরকবারি দল ও এর পাশের মানুষদের দ্বারা।

কয়েকদিন আগে সরকারি দলের এক এমপি হাসানুল হক ইনু বাকযুদ্ধ চালিয়েছিলেন বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়াকে মাইনাসের কথা বলে। এমন ফ্যাসিষ্ট বক্তব্য রাখার অল্প কয়েকদিন পর ইনু সাহেব আবার আক্রমন সানিয়েছেন মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে। ভাগ্য ভালো ইনু সাহেবের, ফ্যাসিষ্ট বক্তব্য রাখার অভিযোগে কেউ তার নামে নালিশ করেনি বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিকের বেঞ্চে।

আরেক বাকযোদ্ধা সালাউদ্দিন কাদের নিয়মিত আক্রমন সানাচ্ছেন কোর্টের বিচারক আইনজীবি আর সাীদের । মুক্ত থাকার সময় তিনি প্রায় সময় বিচিত্র ভাষায় আক্রমন সানাতেন প্রতিপ রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে। তার বাকযুদ্ধের শিকার হয়েছিলেন বেচার প্রবীন আইনজীবি ব্যারিষ্টার রফিকুল হক, বাদ যাননি তার দলের নেত্রী খালেদা জিয়া পর্যন্ত। সাকা চৌধুরী …. বাইরে যেমন ভেতরেও তেমন।

বাকযুদ্ধে কম যাননি দেশের প্রধান দুই নেত্রীর আদালত ভরসা ব্যারিষ্টার রফিকুল হকও। ড. ইউনুসকে আক্রমনের জবাবে আ্ওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আর শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ূয়াকে একবারেই বেকুব বানিয়ে ছেড়েছেন তিনি।

আরেক বাকযোদ্ধা রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত সরকারের শেষ সময়ে এসে শিকে ছিড়তে পেরেছিলেন কিন্তু গলা ছালিয়ে। রেল মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পেয়ে কালো বিড়াল ধরার গল্প দিয়ে সূচনা করেছিলেন যে যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত সেই যুদ্ধেই তিনি নিজেই কুপোকাত। আজম্ম বাকযোদ্ধ দাদা সুরঞ্জিত যখন অভিযোগ করলেন তিনি মিডিয়ার বাক যুদ্ধের শিকার তখন তার জন্য মায়া হয়েছিলো বটে।

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বাকযুদ্ধ শুরু করেছেন, পুলিশ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আর এটিএন বাংলার মালিক মাহফুজুর রহমান। গত ছয় মাসধরেই বলতে গেলে সাংবাদিকরা তটস্থ বাকযুদ্ধ আর লাঠিযুদ্ধে।

জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্যদের বাকযুদ্ধের শিকার হয়েছেন শ্রদ্ধেয় শিক আবদুল্লাহ আবু সাঈদ। দেশের মানুষের বইপড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে বলতে গেলে সারাজীবন রীতিমত যুদ্ধ করে গেছেন তিনি। দেশের আইন সভায় বাকযুদ্ধের শিকার এই শিক হারে হারে টের পেয়েছেন আসলে দেশের মানুষ কতটুকু সভ্য হয়েছে। দেশের মানুষকে সভ্য করতে বই পড়ানো ছাড়া আর কি করা যেতে পারে তা নিয়ে এখন তিনি চিন্তা ভাবনা করবেন বলে আশা করছি।

এক পলকে আবু সাঈদ স্যারের বিষয়টি চাপা পড়ে গেল আদালত বনাম সংসদের বাকযুদ্ধে। আদালতে বিচারকের বাকযুদ্ধের শিকার হয়েছেন স্বয়ং স্পীকার আবদুল হামিদ। দুই দফা দেশের জাতীয় সংসদের প্রধান ব্যক্তি হয়ে অনেক বাকযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী তিনি। জানিনা কখনো সংসদের এইসব বাকযুদ্ধকে বিনোদন হিসেবে উপভোগ করেছিলেন কিনা শ্রদ্ধেয় রাজনীতিবিদ আবদুল হামিদ। নাহলে এই বয়সে রাষ্ট্রদ্রোহি খেতাব কেন তাকে অর্জন করতে হল?

এই বাকযুদ্ধের অনিবার্য পরিনতি পাল্টা বাকযুদ্ধ থেকে রেহায় পাননি বিচারপতি সামসুদ্দিন। এই বাকযুদ্ধ এখন তার জন্য রীতিমত চাকুরী বাচানোর যুদ্ধে পরিনত হয়েছে। এরআগে বিচারপতি সামসুদ্দিন সাহেবের বাক যুদ্ধের শিকার হয়েছিলেন অনেকেই। কিন্তু কেন জানি সেইসব আক্রমনের জোরালো কোন পাল্টা আক্রমন ছিলোনা। তবে একবার সংসদে বিএনপি'র এমপি আশরাফি পাপিয় এবং রেহানা কবির রানু এই বিচারপতির প্রতি বাক আক্রমন চালিয়েছেন।

আগেই বলেছি, যেহেতু এই যুদ্ধে হারজিতের প্রয়োজন নেই, সময়সীমা নেই তারপরও অপেক্ষায় থাকলাম এই বাকযুদ্ধের পরিনতির জন্য।