শিক্ষক দিবসের গল্প

ফাতিহুল কাদির সম্রাট
Published : 4 Oct 2015, 06:00 PM
Updated : 4 Oct 2015, 06:00 PM

(আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা। এর আগেও গ্রুপে শেয়ার করেছি।সময়ের প্রয়োজনে এটা আবার শেয়ার করা প্রয়োজন অনুভব করলাম।)

বিসিএস-এ মাস্টারির চাকরিটা জুটে ফেঁসে গেলাম যেনো। ঢাকায় ভালোই ছিলাম সাংবাদিকতা নিয়ে। মাস্টারিতে বেতন নেমে গেল অর্ধেকে, তার ওপর রিমোট গ্রামে পোস্টিং, তাই খুশি না বেজার হলাম বলা মুশকিল। আমার নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। সরকারি চাকরিতে মুগ্ধ, বলা যায় অন্ধ। সবার উপদেশ-আদেশে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতে হলো মাস্টারিতে। পোড়খাওয়া সিনিয়র সাংবাদিক ভাইয়েরা তো রীতিমতো তাড়া করে পাঠালেন।

কর্মস্থলে যাওয়া বড়ই কষ্টকর। ব্রেক জার্নি। ঢাকা থেকে ১১০ কি. মি. গিয়ে তারপর অন্য পথ। পরের পথ ২৯ কি. মি. হলেও সেটা পাড়ি দেয়া হিমালয় পাড়ি দেয়ার সমান কঠিন। টিঙটিঙে সরু পথ। দুপাশে জলোভূমি। দিনের বেলা দুটো মিনিবাস মুখোমুখি হলে একটাকে চিতল মাছের মতো কাঁত হয়ে থাকতে হয়। গড়িয়েও পড়ে অনেক সময়। রাত আটটার পর পথ যানশূন্য। তখন তস্কর ষন্ডাদের অভয়ারণ্য সে পথ। ছিনতাই রাহাজানি নিত্যকার ব্যাপার।

একদিনের ঘটনা। যাচ্ছি কলেজে। পরদির পরীক্ষা কাজেই আগের দিনই রওনা হয়েছি। রাস্তায় কী জানি ঝামেলার কারণে রাত হয়ে এলো। ২৯ কি. মি. সামনে রেখে যখন নামলাম, তখন রাত ৯টা। আধা অমাবশ্যার ঘোর। কোন যানবাহন নেই। অচেনা জায়গা। অসহায়ভাবে ঘোরাঘুরির সময় দেখলাম এক খাবার দোকানের সামনে একটি বেবি ট্যাক্সি (তখনো তার নাম সিএনজি হয় নি), তাতে লোক বসা কয়েকজন। যাত্রীদের চেহারা দেখে বুকটা দুম করে উঠে। সবাই মাস্তান গোছের তরুণ। বিপদে পড়লে সাপ আর মানুষ একসাথে জড়াজড়ি করে থাকে। বন্যার সময় সেটা দেখেছি নিজের চোখে। সে অভিজ্ঞতার সাহসে দুরু দুরু বুকে জানতে চাইলাম, তারা যাবে কোথায়। তাদের গন্তব্য আমার কলেজ যেখানে, সেখানেই। তাদের অনুরোধ করলাম আমাকে সাথে নিতে। তারা ছিল পাঁচ জন। জায়গা হয় না। তবু নিজেদের মধ্যে আলাপ করে তারা বাহন শেয়ারে রাজি হলো। তাদের মধ্যকার শলাপরামর্শটা বুকের ধুকপুকানি বাড়িয়ে দিল, তবু উঠে বসলাম। যাত্রা করল বেবি।

পেছনের সিটে তারাই তিনজন।আমি সারপ্লাস।কিন্তু সিটে তারা বসালো আমাকেই। আমি মাঝে দুপাশে ওদের দুজন। বাড়তি ছেলেটার বসার ব্যবস্থা হলো দুজনের রানের ওপর। তার একটি রান আমার। একজনের কোলের ওপর বসা শোভন নয়, তা ছাড়া কষ্টও বেশি, তাই তারাই শেয়ারিংয়ের ব্যবস্থাটা করল। একজনের ভর ভাগ হলো দুজনের ওপর। বাজে রাস্তার বিশ্রী ঝাঁকুনিতে থেতলে যাচ্ছিল রান, কিন্তু কোন কষ্ট বোধ হচ্ছে না আমার। কারণ আমার মনে তখন জীবনের ভয়। প্রাণ না থাকলে রান দিয়ে কী করব? মনে দোয়াদরুদের ঝড়। যাত্রীদের মাঝে কী সব আকার-ইংগিতের কথা। এতে ভয়টা কেবল গভীর হয়।

মাঝপথে যাত্রীদের একজন মুখ খুলল। গন্তব্য ও পরিচয় জানতে চাইল আমার। আমার দম আটকে যাবার যোগাড়। তবু সাহসে ভর করে বললাম, অমুক কলেজের শিক্ষক আমি। অমুক পাড়ায় থাকি। কথাগুরো বলার সাথে সাথে বিস্ময়ের সাথে দেখলাম, আমার রানের ওপর থেকে ভার উঠে গেছে। ছেলেটা ঝুলছে বেবি ট্যাক্সির বডি ধরে। শত ঝাঁকুনির মাঝেও সে তার পশ্চাৎদেশ লাগতে দিচ্ছে না আমার রানে।আমি বুঝলাম ব্যাপারটা। বাবা-ভাই বলে অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও ঝুলেই রইল ছেলেটি।

একটু পর বেবি রাস্তার মাঝখানে থামাল ওরা। পেছন দিকে একটা গাড়ির আলো দেখা যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা মাইক্রো এসে থামল। ছেলেরা বীরদর্পে মাইক্রোতে উঠিয়ে দিল আমাকে। ড্রাইভারকে কড়া ভাষায় নির্দেশ দিল, আমাকে যেন একেবারে ঘরের সামনে নামিয়ে দেয়। মাইক্রো ছুটে চলল।

ড্রাইভারের কাছ থেকে আমি যা শুনলাম তাতে আমার বিস্ময় বাঁধ ভাঙে। এই ছেলেরা সবাই সরকারি দলের। তারা সকালে সাড়ে তিন হাজার টাকায় মাইক্রোটি ভাড়া নিয়ে ঢাকার এমপি হোস্টেলে গিয়েছিল স্থানীয় এমপির কাছে। এমপি হোস্টেলে ঢুকে তারা হয়ে গিয়েছিল হাওয়া। সারাদিন অপেক্ষা করেও তাদের দেখা না পেয়ে বেচারা সন্ধ্যার দিকে এক আত্মীয়ের কাছ থেকে তেলখরচ ধার করে ফিরে আসছে। সাড়ে তিন হাজার টাকা পাবার সম্ভাবনা শূন্য।

ঘটনা শোনার পর আমার উপলব্ধির জগতে রীতিমতো ঝড় উঠল। যে ছেলেরা এমন প্রকৃতির, তাদের মনেও শিক্ষকদের প্রতি এতটা শ্রদ্ধা থাকতে পারে? শিক্ষকতায় আসা নিয়ে যে হতাশা ছিল মন জুড়ে তা মুহূর্তে উবে গেল। আজ আমি যদি শিক্ষক না হয়ে পুলিশ কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট হতাম, তাহলে পরদিন ভোরের আলো দেখার সৌভাগ্য আমার হত না, আমি নিশ্চিত।আমাকে পাওয়া যেত পথপার্শ্বে, নিথর দেহে। আমি শিক্ষকতা পেশায় এসে মোটেই ভুল করি নি। নিজেকে শিক্ষক ভেবে বুকটা গর্বে ভরে উঠে নিজের অজান্তেই। মনে মনে একটি দায়িত্বের কথাও অনুভব করলাম, আমার তথা শিক্ষকদের প্রতি মানুষের চেতনায় এই বদ্ধমূল শ্রদ্ধা তা তো শুধু মাস্টারির চাকরি করলে ধরে রাখা যাবে না। আমাকে শিক্ষক হয়ে উঠতে হবে মনেপ্রাণে।