কারাবন্দি লেখক দিবস

আনিসুর রহমান
Published : 1 Jan 2012, 12:46 PM
Updated : 14 Nov 2019, 06:01 PM

১৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক কারাবন্দি লেখক দিবস। ১৯৮১ সালে লেখকদের সংগঠন 'আন্তর্জাতিক পেন' এই দিবসটি উদযাপন শুরু করে। লন্ডনভিত্তিক এই সংস্থার শাখা বিস্তৃত বিশ্বের শতাধিক দেশে। এমন কি বাংলাদেশেও এর দুটি কেন্দ্র ক্রিয়াশীল রয়েছে। যদিও বাংলাদেশের পেন কেন্দ্রগুলোর কারাবন্দি লেখকদের বিষয়ে দেশে এবং দেশের বাইরে কিছু একটা করার দৃষ্টান্ত রয়েছে কী না আমার জানা নাই।

সে যাক গে, আন্তর্জাতিক পেন এর এরকম একটি দিবস পালনের উদ্দেশ্য কী? সারা বিশ্বে অসংখ্য লেখক প্রতিবছর কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। কারও কারাবন্দি জীবন দশক ছাড়িয়েও যায়। তাই এসব বিপদগ্রস্ত লেখকদের স্মরণ করা এবং তাদের মুক্তির ব্যাপারে জনমত গঠনই এই দিবসটিকে পালনের মূল উদ্দেশ্য । পেন আরও একটি কাজ করে এই দিবসকে ঘিরে। এই কার্যক্রমের প্রতি সহমর্মী ও সমব্যাথী লেখক পাঠক সকলে মিলে দুনিয়ার নানা প্রান্তের বন্দি লেখকদের কারাগারের ঠিকানায় তাদের নামে শুভেচ্ছা কার্ড পাঠিয়ে থাকে।

নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ উদ্যোগ। আমাদের দেশে দীর্ঘদিন যাবৎ পেন এর কেন্দ্র কার্যকর থাকলেও এই দিবসটি ঘিরে তাদের তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম আছে কী? আমাদের দেশে এটি মূলত ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকার অভিজাত শ্রেণির প্রতিনিধিত্বই করেছে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠিত অবসরে যাওয়া, না যাওয়া আমলা-কূটনীতিক-শিক্ষক-সাংবাদিকদের কব্জায় থেকেছে সংগঠনটি, এক ধরনের ড্রইংরুম সর্বস্ব সংস্থার মতই। বিভিন্ন সরকারের আমলে অনেক লেখক দৌড়ের উপর থেকেছেন, কারাগারে গিয়েছেন বিপদগ্রস্ত হয়েছেন। পেন এর বাংলাদেশ কেন্দ্র কোন শব্দটি কি করেছে? উদাহরণ দিয়েই বলি।

১৯৮০'র দশকে সাময়িক স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে এদেশের কবিরা শামসুর রাহমানের নেতৃত্বে পেন এর বাইরে। ওই পুরো দশকে পেন বাংলাদেশ এর মহোদয়-মহোদয়াগণ টু শব্দটিও কি করেছেন? তারপর বিএনপি জামাত-জোট শাসনামলে নানা সময়ে শাহরিয়ার কবির, মুনতাসির মামুন, এনামুল হক চৌধুরী, প্রিসিলা রাজ, হুমায়ুন আজাদসহ অনেকেই নানাভাবে বিপদগ্রস্ত হয়েছেন, কারাবন্দি হয়েছেন। ওই ঘোরতর সময়ে পেন বাংলাদেশ কেন্দ্রের ভূমিকা কী? এমন কি হাল আমলে সাংবাদিক শফিক রেহমান, ফরহাদ মজহার এর বিষয়েও তারা যথারীতি নীরব রয়ে গেলেন কেন? আইনি দিকগুলো আইনজ্ঞরা আর আদালত নির্ধারণ করবেন। কিন্তু সহকর্মী আর সহমর্মী ভ্রাতৃত্ব শব্দগুলোর মানে কী? বাংলাদেশের পেন এর বন্ধুরা সেটা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবেন এইটুকু আশা আমরা করতেই পারি।

এখন প্রশ্ন হলো একজন লেখক কারাবন্দি হবেন কেন? এই বিষয়ে আমি দিনেমার দার্শনিক সৌরেন কিয়ের্কে গার্ড এর শরণ নেব। তিনি বলে গেছেন, সত্য প্রকাশ মানে আগুনে হাত দেওয়া। আর আগুনে হাত দেয়া মানে হাত পুড়ে যাবে। লেখকের কাজ হচ্ছে সত্য প্রকাশ করা। আর যে সমাজে রাষ্ট্রে লেখকের হাতকে আগুন থেকে বাঁচানোর রক্ষা কবচ থাকে না সেখানে লেখকেরা কারাবন্দি হয়ে থাকেন। এরকম কারাবন্দি হবার ঘটনা নতুন কোন বিষয় নয়।

গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস তার বড় নিদর্শন। তিনি সত্য প্রকাশ করে কারাবন্দি হয়েছেন, শেষতক মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত মেনে নিয়েছেন। তবুও সত্য থেকে বিচ্যুত হননি। এখানেই শেষ নয়, সত্য প্রকাশের দায়ে কাজী নজরুল ইসলামসহ কল্লোল যুগের লেখক কালি-কলমের মুরলীধর বসু এবং শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় কারাবন্দী হয়েছেন। এমনকি খড়গ রবীন্দ্রনাথের দিকেও তাক করা ছিল। তবে সেই সময়ের সত্য প্রকাশের ধাঁচ আর হাল আমলের প্রবণতা এক জিনিস নয়।

উদাহরণ দিয়ে পরিষ্কার করি। পেন এর সদর দপ্তর বিলেতে। সেই বিলেতেই উইকিলিক্সের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের সঙ্গে যা করা হচ্ছে, তা তো সমর্থনযোগ্য নয়। সেখানে পেন কি আশাব্যাঞ্জক কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছে? অন্যদিকে এডওয়ার্ড স্নোদেন আমেরিকায় ফেরারি আর রাশিয়ায় মতপ্রকাশের নায়ক। উদাহরণ আরো আছে। ইরাক যুদ্ধের জোরালো সমর্থক হয়েও চীনের নাগরিক লিও জিয়াবাও নরওয়ে থেকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আর চীনে কারাবন্দি রয়েছেন দীর্ঘ বছর যাবৎ। আবার রাশিয়ার অনেক লেখক সেদেশে কারাবন্দি হয়েছেন নানা সময়ে আর ইউরোপ-আমেরিকায় আশ্রয় নিয়েছেন। এই ঘোরটেপের রাজনীতিও প্রশ্নের বাইরে থেকে যেতে পারে না।

আদতে ক্ষমতার চরিত্র হচ্ছে যতক্ষণ কর্তার মর্জি মাফিক কলম চলবে ততক্ষণ 'আহা বেশ! বেশ!'

এরকম 'আহা বেশ! বেশ!' সভাকবি রাজদরবারে যেমন অতীতে ছিল, বর্তমান জামানাতেও ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা মানুষদের মর্জিকে পুঁজি করেই টিকে থাকেন আর নিজেদের অবস্থা রমরমা করেন। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নবজাত কর্পোরেট গোষ্ঠি। এই রকম সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বিশেষ বিশেষ গণমাধ্যমে সত্য প্রকাশে 'বন্ধা' মহল এক শ্রেণির লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীকে 'যেমনি নাচাও তেমনি নাচে'। তাদের কোনও দোষ থাকে না, যেমন পুতুলের কোন দোষ থাকতে নাই। ক্ষমতাকে সালাম করে চলার প্রবণতা কোন পর্যায়ে যেতে পারে তার একটা উদাহরণ দিব। ২০০৭-২০০৮ সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক শাসনামলে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ছিলেন একজন ডাকসাইটে উপদেষ্টা। সেই সময়ে মতপ্রকাশের কী ত্রাহি অবস্থা- তা আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনোয়ার হোসেন এবং সদরুল আমিনের কারাবন্দি জীবন আর তাদের উপর নির্যাতনের কথা আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি। সেই সময় বাংলাদেশের কোনও গণমাধ্যমে এই ঘটনার জেরে জোরালো কোন বক্তব্য বা প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের ভূমিকা নিয়েছে কী? এবার একটু এগিয়ে আসি।

সম্প্রতি মাসুদা ভাট্টিকে উদ্দেশ্য করে মইনুল হোসেনের আপত্তিকর মন্তব্যের জেরে একাধিক মামলা হয়েছে, প্রতিবাদ হয়েছে। তিনি কারাবন্দি হয়েছেন, শাস্তি ভোগ করেছেন। এমনকি তার বিরুদ্ধে ৫৫ জন সম্পাদক আর উর্দ্ধতন সাংবাদিক তার বিচার চেয়ে সোচ্চার হয়েছেন। বেশ! আমার প্রশ্ন হল ২০০৭-২০০৮ সালে এই ৫৫ জন কোথায় ছিলেন? ওই সময়ে মইনুল হোসেনের কোন বাড়াবাড়িই কি তাদের নজরে পড়েনি? লেখক-সাংবাদিকের কলম যদি সুযোগ আর হুজুগ বুঝে চলে, তাহলে সর্বনাশ! কারাবন্দি লেখক দিবস উপলক্ষে এই সত্যটাও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।

২০১৯ সালে এসেও কয়েকশ লেখক সাংবাদিক দুনিয়ার নানা কারাগারে বন্দি আছেন। তার মধ্যে সব থেকে দীর্ঘ সময় কারাগারে বন্দি আছেন এরিত্রিয়া-সুইডিশ নাগরিক দাবিত ইসাক। তার কারাগার জীবন বিশ বছরের কাছাকাছি। দুনিয়ার কূটনীতি, রাজনীতি, ইউরোপিয়ন ইউনিয়ন, জাতিসংঘ আজও কূল কিনারা করতে পারেনি। তিনি কী আদৌ বেঁচে আছেন? এই প্রশ্নের উত্তরটাও কেউ দিতে পারেনি এখনো পর্যন্ত। তার রেখে যাওয়া শিশুসন্তান আজ শৈশব, কৈশোর কাটিয়ে সাবালক জীবনে পদার্পণ করেছেন বাবার কোন খবর এবং দর্শন ছাড়াই।

কারাবন্দি লেখক দিবস উপলক্ষে আরো একটি সত্য মনে করিয়ে দিতে চাই। আদতে লেখক হওয়া মানেই বিবেক আর সত্যের কাছে বন্দি হওয়া। মানবিকতা একজন লেখকের ধর্ম। রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় ইঙ্গিত করেছেন, লেখকও কখন কখনও দেশপ্রেমিক নাও হতে পারেন, তবে মানবিক তাকে হতে হয়।

প্রসঙ্গক্রমে এখানে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। এ বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানের সুইডিশ কবি টমাস ট্রান্সট্রয়মার আর আমাদের কবি শামসুর রাহমানের উপর তুলনামূলক সংলাপ হচ্ছিল। সংলাপে সভাপতিত্ব করছিলেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক শামীম রেজা, আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন অধ্যাপক আহমেদ রেজা, হামীম কামরুল হক, গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী।

সেখানে শিক্ষার্থীদের মাঝ থেকে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন এসেছিল। তার মধ্যে একটি ছিল, একজন লেখকের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের গুরুত্ব কতটুকু?

আমার উত্তরটা ছিল এরকম- নোবেলজয়ী জার্মান লেখক গুন্টার গ্রাস ফেইসবুক ব্যবহার করতেন না। তার এক নাতির ফেইসবুকে বন্ধুর সংখ্যা ছিল ৬২৫। এ প্রসঙ্গে গুন্টার গ্রাস বলেছিলেন যার ফেসবুকে বন্ধুর সংখ্যা ৬২৫ জন, আসলে তার কোন বন্ধু নাই। আসল কথা হল একজন লেখক সামাজিক নাও হতে পারেন, তাঁকে মানবিক হতেই হবে।

কারাবন্দি লেখক দিবসে আরো কয়েকটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে চাই। কারাগার হচ্ছে একজন লেখকের এক ধরনের সুযোগও বটে। তার মানে এই নয় আমি একজন লেখককে কারাগারে ঢুকে যেতে বলব। এই কারাগারে ঢুকেই কারো কলমে বেরিয়ে আসে দুনিয়ার ধ্রুপদি সাহিত্যের অনন্য সৃষ্টি। উদাহরণ- কারাবন্দি জওহরলাল নেহেরু তার মেয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে যে চিঠিগুলো লিখেছিলেন সেগুলোর সঙ্কলন। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং কারাগারের রোজ নামচার কথা উল্লেখ করতে চাই।

আবার কেউ কেউ কারাগারে ঢুকে লেখক হয়ে বের হয়। উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় দলিত লেখক মনোরঞ্জন বেপারী।

এবার আরবি ভাষাভাষী দুনিয়ার জনপ্রিয় কবি আমার বন্ধু ফরাজ বাইরাকদারের কারাবন্দি জীবনের গল্প বলেই লেখাটি শেষ করব। ফরাজ দীর্ঘ চৌদ্দ বছর দামেস্কের জেলে বন্দি ছিলেন। তাঁর অপরাধ তার লেখালেখিতে, কবিতা ও গদ্যে সাম্যবাদের চেতনার প্রভাব প্রতীয়মান হয়েছিল। কারাগারে তাঁর পড়াশোনা আর লেখালেখি নিষিদ্ধ ছিল। তবে ছবি আঁকা আর সিগারেট খাওয়ার অনুমতি ছিল। তাঁকে কাগজ আর বই সরবরাহ করা হত না।

শেষে তিনি সিগারেটের কাগজে কাব্যচর্চা চালিয়ে গেলেন। আর ছবি আঁকার ছলে শিশুসুলভ ছবি আঁকলেন। ছবির ফ্রেমের ভেতরে লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেটের প্যাকেটে লেখা কবিতা কারাগার থেকে বাইরে পাচার করা শুরু করলেন। তিনি ছবিগুলো আঁকতেন তাঁর মেয়ের জন্যে। তাঁর মেয়ে কারাগারে দেখা করতে গেলে ফ্রেমে বাঁধাই ছবিগুলো দিতেন আর মেয়েকে বলে দিতেন ছবিগুলো যতœ করে রক্ষা করতে। তিনি ২০০০ সালে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার চাপে জেলখানা থেকে ছাড়া পান। একই সঙ্গে কবিতাগুলোও ছবির কাঠামোর ভেতর থেকে বের করলেন। কারাগারের 'অন্ধপ্রকোষ্ট ১৩ থেকে পত্র নামে' বই আকারে প্রকাশ পেল। বইটি আজ নানা ভাষায় অনূদিত আর সমাদৃত। তাঁর এই বইয়ের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে নাটক ও প্রামান্যচিত্র। সেই ফরাজের কারাবন্দী জীবন নিয়ে কোন খেদ নাই। ফরাজের কাছে জীবনের পুরোটাই এক পরম সৌভাগ্য, এমন কি চৌদ্দ বছরের কারাবন্দী জীবনও।  ফরাজের ভাষ্য জীবন তো এমনই।