গলওয়ে কিনেল : নশ্বরতার অধিবিদ্যার কবি

তাপস গায়েন
Published : 20 August 2013, 12:41 PM
Updated : 20 August 2013, 12:41 PM

কফিশপ, পানশালা, রিভারওয়াক, সমুদ্রসৈকত, বইঘর, ইত্যাদি নিয়ে জনারণ্যে জেগে থাকে নির্জন, একাকী মানুষ। সেই নির্জন মানুষ প্রায়ই খুঁজে ফেরে তারও অধিক নির্জন মানুষদের, এইসব বইঘরে। সিলিকন ভেলির পড়ন্ত এক বিকালে আমি সেই নিঃসঙ্গ, একাকী মানুষ– অনেকটা আবিষ্কারের মতো করে, এক বইঘরে পেয়ে যাই কবি গলওয়ে কিনেলের কাব্যগ্রন্থ, দি বুক অফ নাইটমেয়ারসকে [১], যদিও গলওয়ে কিনেল আমার কাছে তখন সম্পূর্ণভাবে অপরিচিত এক কবির নাম। এক দশকেরও আগের সেইদিনে তাঁর এই কবিতার বই পড়তে গিয়ে আমি অনুভব করেছিলাম, যেভাবে দার্শনিক ভিটগেনস্টাইন অনুভব করেছিলেন কবি ট্রাকলকে পড়তে গিয়ে, 'আমি তাঁর কবিতা বুঝি না, তবে তাঁর কবিতার সুরধ্বনি আমাকে আনন্দ দেয়।' এই কাব্যগ্রন্থটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে রবার্ট মেজেই লেখেন, "এর সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, বাহ্যতই এটি একটি চিরায়ত সাহিত্যকর্ম। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে ভালো কাজ এমনই প্রশংসনীয়, যা উৎকৃষ্ট কবিতা পড়তে গিয়ে আমি অনুভব করেছি। এটি যদি একটি প্রধান কাজ না হয়, তবে আমি জানি না এই শব্দবন্ধটি কী অর্থ ধারণ করে।"


কবি কিনেলকে পাঠেরও প্রায় এক দশক আগে রিল্কে এবং জীবনানন্দের কবিতা পড়তে গিয়ে আমি একই বোধে তাড়িত হয়েছি। অনেকদিন অতিবাহিত হয়ে গেলে, আমি প্রায়ই ভেবেছি, এই তিন কবি কী একই মাতৃ-জরায়ু থেকে জাত? সেই প্রশ্ন এবং বিস্ময় আজ অবধি অমীমাংসিত থেকে গেছে, কিন্তু অনুমানে বুঝে নিয়েছি, সময়, জন্ম, মৃত্যু, এবং ভালোবাসা– এইসব ভাবনা এই তিন কবিকে উন্মদনায় রেখেছে। প্রায় বছরতিনেক আগে নিউইয়র্কের ইউনিয়ন স্কয়ারে 'বার্নস এন্ড নবেল'-বুকস্টোরে কবি গলওয়ে কিনেলের কবিতা পাঠের আসরে কবিকে পেয়ে যাই আমি। তাঁকে জানাই, তাঁর দি বুক অফ নাইটমেয়ারস পড়তে গিয়ে আমি রিল্কে-কে নিয়ে ভেবেছি। তাঁর অতিব্যস্ত সময়ের মধ্যে আমার কথা এবং অস্থির ভাবনাকে খুব সম্ভবত তিনি বুঝে উঠতে পারেননি, বরং জানতে চেয়েছিলেন আমার নাম এবং আমার দেশের নাম, অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন আমার কেনা তাঁর কবিতার বইয়ে।

জীবনানন্দ এবং রিল্কের তাবৎ কাজের মধ্যে যে কাব্যভাবনা এবং দার্শনিকতা পরিব্যাপ্ত, আপাতভাবে গলওয়ে কিনেলের, দ্য বুক অফ নাইটমেয়ারস-এর মধ্য সেই একই ভাবনা বিধৃত হয়েছে। অতি সম্প্রতি কিনেলের সঙ্গে এগারোটি সাক্ষাতকারের উপর ভিত্তি করে বই, ওয়াকিং ডাউন দি স্টেয়্যারস [২] পড়তে গিয়ে আমি জেনেছি কবি রিল্কের ডুইনো এলিজি কী গভীরভাবেই না কবি গলওয়ে কিনেলের দি বুক অফ নাইটমেয়ারসকে প্রভাবিত করেছে। এই বইয়ের দার্শনিক এবং আধ্যাত্মবাদ এবং তার শরীরের বিন্যাসও তুমুলভাবে ডুইনো এলিজি দিয়ে প্রভাবিত।

গলওয়ে কিনেল দি বুক অফ নাইটমেয়ারস উৎসর্গ করেছেন তাঁর শিশুকন্যা 'মউদ' এবং শিশুপুত্র 'ফার্গুস'কে। এখানে বলে রাখা ভালো, কবি ইয়েটসের দুই সন্তানের নাম ছিল যথাক্রমে 'মউদ' এবং 'ফার্গুস'। কাব্যসাধনার প্রাথমিকপর্বে কবি গলওয়ে কিনেল সর্বতোভাবে ইয়েটস হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন, এবং সেই ভালোবাসার তিনি জানান দিয়েছেন তাঁর সন্তানদের নাম ইয়েটেসের সন্তানদের নামের সমাঙ্গ করে রাখার মধ্য দিয়ে।

রিল্কের কবিতাকে, '…..মৃত্যু এবং মৃত্যুর সমগ্রতা, যার শুরু হয়েছে জীবন শুরুরও আগে, ধরে রাখে সযত্নে সবকিছুকে,…যা বর্ণনার অতীত'– তিনি এই কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গ পদ্য করেছেন। মৃত্যুভাবনাই পরিব্যাপ্ত তাঁর দি বুক অফ নাইটমেয়ারস কাব্যগ্রন্থে, যা এক অর্থে, 'নশ্বরতার অধিবিদ্যা'।

ডুইনো এলিজির মতো দি বুক অফ নাইটমেয়ারস-এ আছে দশটি কবিতা, যা রিল্কের প্রতি তাঁর ভালোবাসা থেকেই উৎসারিত, যদিও প্রতিটি কবিতা সাতটি পর্বে বিভক্তির ভাবনা একান্তই গলওয়ে কিনেলের নিজস্ব, যা তিনি তাঁর দীর্ঘ কবিতায় করে আসছিলেন দীর্ঘদিন যাবৎ।

দীর্ঘ কবিতা নিয়ে গলওয়ে কিনেল ভেবেছেন এবং এই ফর্মে এজরা পাউন্ডকে তিনি প্রধান পুরোহিত বলে মান্য করেছেন। নিতান্তই ক্যাটালগিং নয়, যা অনেক প্রধান কবি, এমন কি তাঁর অতিপ্রিয় কবি হুইটম্যান সম্পর্কেও প্রযোজ্য; বরং সময়ের উদ্ভব এবং কবিতার মধ্য দিয়ে সময়ের বেড়ে ওঠাকে তিনি দীর্ঘ কবিতার প্রধান বিষয় বলে ভেবেছেন, যেভাবে পৃথিবীতে প্রাণের প্রতিষ্ঠা হয়। ডুইনো এলিজির মতো তাঁর এই কবিতার বই প্লটবিহীন, তবু এর প্রতিটি কবিতার শুরু এবং শেষ– এই দুয়ের মধ্যে এক অসামান্য পারম্পর্য রয়ে গেছে।

এই কাব্যগ্রন্থটি তাঁর অটোবায়োগ্রাফি নয়, তবু তাঁর কন্যাসন্তান, 'মউদ'কে নিয়ে লিখেছেন 'আন্ডার দি মউদ মুন।' শিশুকন্যাদের নাম 'ম্যাটিলডা'র সংক্ষিপ্ত ফর্ম হোল 'মউদ'; অন্যদিকে, উন্মাদ কবি আলফ্রেড লর্ড টেনিসন তাঁর অতিপ্রিয় কবিতা, 'মাস্ট আই ঠু ক্রিপ টু দি হোলো….?' তিনি তা আবৃত্তি করেছেন একাধিকবার, যেখানে 'মউদ' শব্দটি উঠে এসেছে।

কে রেডফিল্ড জেমিসন, তাঁর টাচ্ড উইথ ফায়ার [৩] গ্রন্থে 'মউদ' শব্দটিকে 'ম্যাডনেস'-এর সমাঙ্গ করে নিয়েছেন (পৃ ১৯৬)। সেই সূত্র ধরে আমি কিনেলের প্রথম কবিতা 'আন্ডার দি মউদ মুন'-এর শিরোনাম দিয়েছি 'উন্মাদ চাঁদের নিচে।' কবি ভাবছেন তাঁর কন্যাসন্তানের জন্ম, তার অকাল মৃত্যু, দুঃসময়ে কীভাবে মউদ পৃথিবীর মুখোমুখি হবে, ইত্যাদি বিষয়কে।

চার বছরের অধিক কালের ভেতরে এই কাব্যগ্রন্থটি লিখতে গিয়ে তিনি দেখেছেন তাঁর শিশুপুত্র, 'ফার্গুস'-এর জন্ম, যার প্রসঙ্গ এসেছে দশম কবিতায়, 'অবশেষ অন্তিমে'। তাঁর দুই সন্তানের জন্মের ভেতরে তিনি বেঁধে দিয়েছেন তাঁর এই কাব্যগ্রন্থটিকে। তিনি মনে করেন, বিঠোভেনের সুর যেমন অদৃশ্যকে দেখাতে চায়, যেমন অশ্রুতকে শ্রূয়মাণ করতে চায়, রিল্কের কবিতাও যেন সেই অভীলক্ষ্যে ছুটেছে, এবং কবি নিজে এই কাব্যগ্রন্থে সেই বিশ্বাসে আস্তিক হয়ে উঠেছেন ; এবং সেইসূত্রে তিনি কিং জেম্সের বাইবেল এবং 'হুইটম্যানের কবিতা'র কাছে তাঁর ঋণ স্বীকার করে নিয়েছেন।

মৃত্যুচিন্তায় অবলুপ্তির ধারণা যেমন সত্য, তেমনি মহাবিশ্বে লীন হয়ে যাওয়ার চিন্তাটিও সমানভাবে লক্ষনীয় কবি গলওয়ে কিনেলের এই কাব্যগ্রন্থে। প্রচলিত ধর্মচিন্তা, এমনকী অধ্যাত্মবোধ তাকে আপ্লুত করে না; বরং তিনি মনে করেন, প্রতিটি কবিতা মিথ হয়ে উঠতে চায়, তবে পৌরাণিক কাহিনি হিসেবে নয়, বরং মহাবিশ্বের সঙ্গে প্রতিটি মানুষের যে সংলাপ আছে, সেই অর্থে; তাঁর চিন্তায় কবি সেই সংলাপকে সম্ভব করে তোলেন মাত্র। নশ্বরতা এবং মহাকালকে বুঝতে গিয়ে তিনি অনুভবে বুঝে নিতে চেয়েছেন কীভাবে, 'একটি শবদেহকে ধরে নদীর উপরে ভেসে যায় মহাবিশ্ব।' এবং 'এই শরীরে এই নীলাভ বস্তুপুঞ্জে-মাংসে– যখন তা/ শায়িত, দেখো, তুমি দেখতে পাও কী না/একটি নীল মাছি, যা হাসছে' যেমন সত্য, তেমনি করে নশ্বরতার অধিবিদ্যায় আমাদের জেনে নিতে হয়, "ভালোবাসাই মৃত্যুর মজুরি।' সেইসূত্রে শুনি পুলিৎজার বিজয়ী আমার অতিপ্রিয় আমেরিকান কবি গলওয়ে কিনেলের (১৯২৭- ) অমোঘ উচ্চারণ, 'চুম্বন করো সেই মুখে, যেখানে উচ্চারিত হয়, এইখানে, ঠিক এইখানেই পৃথিবী। এই মুখ। এই হাসি। ললাটের এই অস্থি।"

আজও রাতের নিভৃতে কবি গলওয়ে কিনেলের দি বুক অফ নাইটমেয়ারস কাব্যগ্রন্থটি আমার একান্ত পাঠ্য হয়ে ওঠে, আর ভাবি কেন এই কবি আমার এত প্রিয়?

[পুনশ্চ : এই কাব্যগ্রন্থের তিনটি কবিতার আংশিক অনুবাদ এখানে বিধৃত হল]

উন্মাদ চাঁদের নিচে

এক

পথের মাঝে
প্রজ্জ্বলিত ছিল অগ্নি
তার পাশে সিক্ত ভূমিতে
পড়ে আছে কালো ছাই, কালো পাথর,
যেখানে পায়ে-হাঁটা প্রাণী হাঁটু গেড়ে বসে
হয়তো জলের প্রবাহে রেখেছিল মুখ,
অভিশপ্ত রুটি খেয়ে হয়েছিল অপবিত্র,
ছোট্ট প্রজ্জ্বলিত অগ্নিতে উষ্ণ হতে ব্যর্থ–

দাঁড়াই আমি,
জড়ো করি ভিজে কাঠ,
কেঁটে রাখি তার জন্য শুকনো কাঠের ফালি,
যার অবয়ব আমি ধরেছিলাম আমার দুহাতে,
কিছুক্ষণ আগে, তাকে আমি বিসর্জন দিয়েছি; এখন
নিতান্তই ধরে রাখি সেই অবলুপ্ত ভূমি, যেইখানে ছিল সে,

বৃষ্টির ভিতরে
আমি জ্বালাই ছোট্ট আগুন।

কালো কাঠ
হয়ে উঠে লাল, আর তার ভিতরে মৃত্যুঘড়ি
যার শুরু হয়েছে সময় ফুরিয়ে যাবার। আমি দেখি-
মৃত– আলিঙ্গনাবদ্ধ যার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ–
পুনরায় যিনি আকাঙ্ক্ষা করেন এই বিশ্ব, কাঠের গভীরে আমি শুনি
একই আলিঙ্গন পুনঃপুনঃ ভেঙে পড়ার উত্থান-পতনের ধ্বনি
বৃষ্টির বিন্দু নেভাতে চায়
প্রজ্জ্বলিত এই অগ্নি
আগুন গভীরে নামে বৃষ্টি
হয় তার পরিবর্তন- ভেঙে পড়ে শপথ,
পৃথিবী এবং আকাশ, শরীর আর চেতনার মধ্যে নির্মিত শপথ
পুনরায় ভেঙে যায়, নতুন করে শপথের জন্ম হবে বলে
মেঘের মধ্যে পুনঃপুনঃ জন্ম হয় শপথের, নিতান্তই
পুনরায়, পুনরপি এই পৃথিবীতে ভেঙে পড়বে বলে।

তিন

গোল মুখাকৃতির শিশুকন্যা
জেগে ওঠে তার দোলনায়।
চোখের সবুজ জল আন্দোলিত,উন্মুক্ত,
সুক্ষ কিংবা আড়ম্বরপূর্ণ এই চোখের জল-
যেন ফুটে আছে নীল ফুল।

এবং এই সেই শিশুকন্যা যার হয়েছে জন্ম,
যে গান গায় এবং কাঁদে
হয়েছে যাত্রার শুরু যার,
তার হয়েছে চুলের উদ্গম,
উদ্গত দাঁতের মাড়ি,পৃথিবীতে তার প্রথম বসন্ত,
কুয়াশা যেন ঝুঁকে আছে
তার মুখাবয়বে, যে রাখে
হাত তার পিতার মুখে- পিতার গান
বুঝে নিতে।

সাত

যখন ছিল ঠান্ডা
আমাদের পাহাড়ের সানুদেশে এবং অন্ধকারে
দোদুল্যমান দোলনায় তুমি কেঁদেছিলে, যেন
ছুরি দিয়ে কাঠে খোদিত হাসি– এমনই এক ব্যথা
আমাদের হাসির থেকেও অদ্ভুত, অচেনা-যার সকলই

অন্য এক পৃথিবী থেকে উৎসারিত,

আমি প্রায়ই এসেছি তোমার কাছে,
বসেছি পাশে
এবং তোমার কাছে করেছি গান। তুমি তা জানোনি,
তবু, জেনে যাবে তুমি একদিন
তোমার মস্তিস্কের নিভৃত কুঠুরিতে
এক অপচ্ছায়া, ভুতুড়ে পূর্বপুরুষদের এক
অপার্থিব উত্তরাধিকার রাতের গভীরে করেছিল গান–
এই গান নয় দেবদূতীর উজ্জ্বল চুলের মধ্য দিয়ে
তরঙ্গের কাছে আলোর কথন,
বরং এ হোল জিহ্বায় প্রস্ফুটিত
কর্কশ, অন্ধকারাচ্ছন্ন গান।

যখন ধরেছিল উজ্জ্বলতা উন্মাদ চাঁদ
সেইসব উন্মেষ রাত্রে,
এবং শায়িত তীরন্দাজ
পান করেছিল নক্ষত্রের দোলনায়
প্রথম হিমায়িত দুগ্ধ মহাবিশ্বের।

গিয়েছি নদীর তীরে আমি
হামাগুড়ি দিয়ে, এবং
তাদের মর্ম্মরধ্বনির উন্মেষ ও অবশেষ, জলাভূমি অবধি,
যেখানে ঠান্ডা জলের রেখায় পৃথিবীর মৃদু বুদ্দুদ
স্পর্শ করে এই বিশ্ব,
মৃদু উজ্জ্বলতার
উন্মেষ,
এবং সেখানেই শিখেছি আমার একমাত্র গান।

এবং সেইসব দিনে
যখন নিজেকে জানবে একাকী– এতিম,
জানবে আলোহীন, বাতাস সংগীতবিহীন
জিহ্বার আস্বাদে জাগবে অভিশপ্ত রুটি,

হয়তো তখন উঠবে জেগে
একটি কণ্ঠস্বর
ভুতুড়ে, ডাকবে তোমাকে
সহোদরা !
উদ্ভুত হবে, সেই সবকিছু থেকে যা নশ্বরতায় বিদ্ধ।

এবং তখন
তুমি খুলবে
এই বই, যদিও এই হোল দুঃস্বপ্নের বই।

চাঁদের আলোয় ছোট্ট মাথায় গজিয়ে উঠছে চুলে

এক

দুঃস্বপ্ন থেকে তুমি জেগে ওঠো সুতীব্র চিৎকারে।

স্বপ্নচারিতায়
যখন আমি যাই তোমার কক্ষে, এবং তুলে ধরি তোমাকে,
এবং ধরে রাখি তোমাকে প্লাবিত জোৎস্নার দিকে, তুমি জড়িয়ে ধরো আমাকে
শক্তভাবে, যেন তোমার আলিঙ্গনই
বাঁচিয়ে রাখবে আমাদের দুজনকে। আমি জানি-
তোমার চিন্তায়
আমার কোনো মৃত্যু নেই ; আমি জানি, তুমি ভাবো,
আমি নক্ষত্রের মতো স্থায়ী কিংবা ধুঁয়ার মতো ব্যাপ্ত, যদিও
তোমাকে ঘিরেই সজীব হয়ে উঠে আমার ভাঙা হাত।

পাঁচ

একদিন যদি এমনই ঘটে
তুমি পেয়ে গেছ তাকে, তুমি ভালোবাসো যাকে,
পন্ট মিরাব্যুর কোনো এক ক্যাফের
একপ্রান্তে, জিঙ্কবারে
যেখানে সাদা মদ উচ্ছ্বসিত, উন্মুক্ত লম্বমান দীর্ঘ গ্লাসে,

এবং, তুমি যদি ভুল করো, যেমন করেছি আমরা
চিন্তার ভ্রান্তি,
একদিন এইসব হয়ে যাবে স্মৃতি,
শিখে নাও,
এই যে তুমি দাঁড়িয়ে
এই ব্রিজের একপ্রান্ত যা বক্রতা পেয়েছে,
ভালোবাসা থেকে জেনে নাও দীর্ঘতর ভালোবাসা,
শিখে নাও
মর্ম্মের গভীরে অনাগত যে ব্যথা, জেনে রেখো স্পর্শে
অবয়বের নিচে প্রায় কাল্পনিক সেই অস্থি, আর শুনতে উন্মুখ
কালো পাথরে ব্যাপ্ত বাতাসের সেই গোঙানি।
চুম্বন করো সেই মুখে, যেখানে উচ্চারিত হয়, এইখানে
ঠিক এখানেই পৃথিবী। এই মুখ। এই হাসি। ললাটের এই অস্থি।

সেই প্রায় অমুদ্রিত সুরপ্রবাহের বিলুপ্তি।

ছয়
আমি তোমার চোখে দেখছি সেই হাত
যা একদিন আমার পিতার চোখে ছিল উদ্বেলিত
এই আলোয় চাঁদ ফিরিয়ে দিচ্ছে
একটি ছোট্ট ঘুড়ি, যা
তাঁর শেষ দৃষ্টির গোধূলি আলোয় ছিল উর্ধ্বমুখী,অস্থির:

এবং নশ্বরতায়বিদ্ধ সকল সত্তার দেবদূত
অবশেষে ছেড়ে দেয় রজ্জু।

সাত
অবশেষে ফিরে যাও, তুমি, তোমার দোলনায়।

শেষ কালোপাখি তার আলোকিত সোনালি পাখায় লিখে রাখে : বিদায়
ঘুমের গভীরে,
তোমার মস্তিষ্কে বুজে আসে তোমার চোখ। ইতিমধ্যে
তোমার স্বপ্নে সময় গান গেয়ে উঠে।

চন্দ্রালোকে ছোট্ট ঘুমন্ত মাথায় গজিয়ে উঠছে চুল,
ফিরে আমি আসব যখন,
একসঙ্গে বের হব আমরা তখন
দশ হাজার বস্তুপুঞ্জের মধ্য দিয়ে
যুগপৎ হেঁটে যাব আমরা,
প্রত্যেকেই আঁচড় কাটছে দেরি করে, এমনই জ্ঞানে–
জেনে যাই, ভালোবাসাই মৃত্যুর মজুরি।

অবশেষ অন্তিমে

এক

ক্ষীণ জলপ্রপাত,
খুব উঁচু থেকে নেমে আসা তাদের বিক্ষিপ্ত পথ
পাহাড়ের কিনারে আঘাতপ্রাপ্ত, উক্ষিপ্ত এবং বিচূর্ণিত।

আমার পেছনে ছোট্ট প্রজ্জ্বলিত অগ্নি
বৃষ্টির মধ্যে, পরিত্যক্ত ছাইয়ের গাদায়, এখনও দীপ্যমান।
কার জন্য নির্মিত হয়েছিল এই অগ্নি, তা এখন অবান্তর
দীপ্যমান অগ্নিশিখা,
যা উষ্ণ করে রাখে প্রতিটি সত্তাকে,
যারা অগ্নি বলয়ের বিকিরণের মধ্যে ভ্রাম্যমান-
একটি বৃক্ষ, পথভ্রষ্ট প্রাণী এবং সমূহ পাথর,

কারণ মৃতের জগতে প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল এই অগ্নি।

তিন

আমি এগিয়ে যাই নদীর উপরে ঝুলন্ত প্রস্তরখণ্ডের দিকে
চিৎকার করে ডাকি আমি পাথরের দিকে
এবং পাথর ফিরিয়ে দেয় আমার চিৎকার,
অজস্র উপলখণ্ডের মধ্যে প্রবাহিত কণ্ঠস্বর
আমার কানে এসে বাজে।

দাঁড়াও।
এই যেমন তুমি এগিয়ে যাও প্রতিধ্বনিময় পাহাড়ের দিকে
তুমি অনুমানে জানো বিভাজন রেখা, যেখানে
পাহাড়ে প্রতিধ্বনিময় ডাক
আর ফিরিয়ে দেয় না উত্তর,
কেবলি হয়ে ওঠে শিলা,এবং কিছুই আসে না ফিরে।

এইখানে, উত্তর এবং শূন্যতার মাঝে
আমি দাঁড়াই, পুরাতন জুতার উপর দিয়ে
হেন-ওয়েলের রংধনু প্রবাহিত,
প্রতিটি জুতো ধরে আছে অস্থি
যা পদক্ষেপের যোগসূত্রতায় ঢেউ তুলে,
এবং যা পদাঙ্গুলির সম্মুখে উন্মুক্ত, যখন
পায়ের পাতা ভবিষ্যতের দিকে দ্রবীভূত।

এলকের খুড়ের শব্দ।
উর্ধ্ব গোলার্ধ কী
শূন্য করছে নিজেকে? এই কী সত্য
যা আছে তা হোল এই পৃথিবী, আর এই পৃথিবী কি চিরব্যাপ্ত নয়?

একটি শবদেহকে ধরে নদীর উপরে ভেসে যায় মহাবিশ্ব।

দাঁড়াও।
দাঁড়াও এইখানে
জীবন তোমাকে মৃত্যুর কাছে নিয়ে আসে, যেখানে
নেই আর কোনো ১০।

চার

এই দশম কবিতা
এবং এই শেষ। শেষাবধি
এই ঠিক, সেই এক
এবং শূন্য
হেঁটে যায় একসাথে,
এইসব পাতার শেষপ্রান্তে,
একটি প্রাণ
শূন্যতার পাশাপাশি হেঁটে যায়

অন্তিম হল দীপ্তি,
আর এই সেই দীপ্তি, সেই উজ্জ্বলতা,
যা ধরে রাখে তাদের যারা চলে গেছে আগে।
এবং যখন তার সমাপ্তি হয়
তখন কিছুই নেই, অবশিষ্ট থাকে না কিছুই,

পুরাতন গাড়ির মরচে পড়া জীর্ণতায়
তীরন্দাজের শরীরে দীর্ণ করা ছিদ্রে
নদীর কুয়াশা ঘ্রাণে আনে পাথরে ব্যাপ্ত ক্লান্তি,
যে মৃত সে শায়িত,
শুরুতেই শূন্যতায় পূর্ণ–

এবং তার মুখ নিঃসৃত
প্রথম উচ্চারণ পুনরায় আকাঙ্ক্ষার কথা বলে।

সাত

সাঞ্চো ফার্গুস! কেঁদো না!

অথবা, কাঁদো!

এই শরীরে
এই নীলাভ বস্তুপুঞ্জে, মাংসে, যখন তা
শায়িত—দেখো, তুমি দেখতে পাও কিনা
একটি নীল মাছি, যা হাসছে।

নিউইয়র্ক, জুলাই ১৫-আগষ্ট ১৭, ২০১৩

————————————————————
তথ্যপঞ্জীঃ
[1] Galway Kinnell, The Book of Nightmares, Houghton Company, 1971
[2] Galway Kinnell, Walking Down the Stairs [Selections from Interviews], The University of Michigan Press, 1995.
[3] Kay Redfield Jamison, Touched with Fire, First Free Press Paperback Edition, 1993.