হুমায়ুন আজাদ: বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময়

সৈকত ইকবাল
Published : 13 August 2012, 05:03 AM
Updated : 13 August 2012, 05:03 AM


হুমায়ুন আজাদ। যাঁর পরিচয় ছিলো বাংলাদেশের প্রধান প্রথাবিরোধী, সত্যনিষ্ঠ, বহুমাত্রিক লেখক হিসাবে। তিনি একাধারে ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, ভাষাবিজ্ঞানী, গবেষক, সমালোচক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার, কিশোর সাহিত্যিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগের অধ্যাপক ও সভাপতি।

এই ক্ষণজন্মা মানুষটি ২৮ এপ্রিল, ১৯৪৭ সালে বিক্রমপুরের রাড়িখাল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বাঙলা একাডেমীর একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে মৌলবাদী জঙ্গীরা চাপাতির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে হুমায়ুন আজাদকে। সমস্ত শরীর, বিশেষত মুখমণ্ডল ক্ষতবিক্ষত করে হিংস্র হায়েনার দল। হুমায়ুন আজাদ নয়, সেদিন যেনো ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলো বাঙলার মুখ। তাঁর উপর মৌলবাদীদের আক্রমণের প্রতিবাদে সেই সময় সারা বাংলাদেশ অভূতপূর্বভাবে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিলো। হুমায়ুন আজাদ আবার আমাদের মাঝে ফিরে এসেছিলেন। আবার হয়তো তাঁর লেখনী কাঁপন ধরানোর অপেক্ষায় ছিলো সকল ধর্মান্ধ-প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। বিচারহীনতার এই দেশে প্রতিক্রিয়াশীলরা আবারো সক্রিয় হয়ে উঠে। আবারো হুমায়ুন আজাদ ও তাঁর পরিবারকে হুমকি-ধামকি ও মেরে ফেলার পরোয়ানা জারি করে অপশক্তি। ফলে এক প্রকার বাধ্য হয়েই দেশ ছাড়েন তিনি। ৭ আগস্ট ২০০৪ সালে জার্মানীর পেন (PEN) এর আমন্ত্রণে কবি হাইনরিশ হাইনের ওপর গবেষণার জন্য বৃত্তি নিয়ে তিনি জার্মানী যান। জার্মান যাওয়ার মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় ১২ আগস্ট মিউনিখের ফ্ল্যাটে নিজ কক্ষে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় তাঁকে। হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অবসান ঘটে এই বাঙলার এক অদম্য সাহসী বহুমাত্রিক প্রতিভার অমূল্য সব লেখনীর।

হুমায়ুন আজাদের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৬০টি। এরমধ্যে আমার বিবেচনায় অসাধারণ কিছু গ্রন্থের মধ্যে গবেষণাগ্রন্থ নারী (১৯৯২), শামসুর রাহমান/নি:সঙ্গ শেরপা(১৯৯৩), মানুষ হিশেবে আমার অপরাধসমূহ(১৯৯৬), সম্পাদনা- আধুনিক বাঙলা কবিতা (১৯৯৪), অনুবাদ গ্রন্থ দ্বিতীয় লিঙ্গ, মূল: সেকেন্ড সেক্স, সিমোন দ্য বোভোয়ার (২০০১), আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম(২০০৩), কিশোর সাহিত্য লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী (১৯৭৬), কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী (১৯৮৭) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের গবেষণার অধীত বিষয় ছিলা ভাষা বিজ্ঞান। অনেকের বিবেচনায় ভাষা বিজ্ঞানী হিসাবে দুই বাঙলাতেই তিনি ছিলেন সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা বিজ্ঞানের ওপর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে বাঙলা ভাষার শত্রুমিত্র (১৯৮৩), বাক্যতত্ত্ব (১৯৮৪), বাঙলা ভাষা-প্রথম খন্ড (১৯৮৪), বাঙলা ভাষা-দ্বিতীয় খন্ড (১৯৮৫), তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান(১৯৮৮), ভাষাশিক্ষা ও ভাষাবিজ্ঞান পরিচিতি(১৯১০) ইত্যাদি।

বহুমাত্রিক হুমায়ুন আজাদ নিজেকে কবি বলতেই যেনো স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন। তাঁর কবিতার বই অলৌকিক ইস্টিমার(১৯৭৩), সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে(১৯৮৫), আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে(১৯৯০), কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু (১৯৮৮), কাব্যসংগ্রহ(২০০৪) ইত্যাদি কবিতার গ্রন্থগুলোতে কবি হিসাবে হুমায়ন আজাদ আমাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেন।
কিশোরদের জন্য পূর্বে উল্লেখিত অসাধারণ দুটি গ্রন্থ ছাড়াও আব্বুকে মনে পড়ে, বুকপকেটে জোনাকিপোকা, আমাদের শহরে একদল দেবদূত ইত্যাদি আজকের শিশুকিশোরদের জন্য অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত।

হুমায়ুন আজাদের উপন্যাসের মধ্যে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল, সবকিছু ভেঙ্গে পড়ে, রাজনীতিবিদগণ, পাক সার জমিন সাদ বাদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এখানে বলা প্রয়োজন হুমায়ুন আজাদের পাক সার জমিন সাদ বাদ উপন্যাসটির জন্যই প্রতিক্রিয়াশীলরা তাঁর ওপর আক্রোশে ফেটে পড়েছিলো- যার চূড়ান্ত বহি:প্রকাশ ঘটিয়েছিলো তার ওপর শারীরিক আক্রমণ করে। মৌলবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীলরা কখনোই লেখার জবাব লেখনীর মাধ্যমে দেয়ার যোগ্যতা রাখেনি কোনোকালে। হুমায়ুন আজাদের ওপর আক্রমণ তারই জঘন্যতম নিদর্শন।

প্রচলিত রীতিতে সাক্ষাতকার গ্রহণেরর সকল প্রথাসিদ্ধতা ভেঙ্গেচুরে তিনি বাঙলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, অধ্যাপক আহমদ শরীফ, কবি শামসুর রাহমান ও শওকত ওসমানের এর সাথে আলাপচারিতা তুলে এনে এক অনন্যসাধারণ গ্রন্থ উপহার দিয়েছেন। এছাড়া তিনি নিজেও বহু সাক্ষাতকার দিয়েছেন, যেগুলোও মূল্যবান হয়ে আছে সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য ও শিল্পকলা অনুরাগীদের জন্য। হুমায়ুন আজাদের আরো দুটি বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থ সীমাবদ্ধ সূত্রধর্মানভূতির উপকতা ও অন্যান্য প্রবন্ধ লেখকের স্বকীয়তা ও মৌলিকত্ব অসাধারণভাবে ফুটে উঠেছে।

হুমায়ুন আজাদ ও তার সৃষ্টিকর্ম সম্পর্কে আমরা যেনো আরো বেশী মনোযোগী হয়ে উঠি- এই প্রত্যাশা থেকেই এই লেখার অবতারণা। হুমায়ুন আজাদের বহুমাত্রিক ও বিপুল সৃষ্টিকর্ম অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে বাঙলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে যথার্থ শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাবো- সকলের প্রতি এই প্রত্যাশা।

তথ্যসূত্র:
হুমায়ুন আজাদ- এর বিভিন্ন গ্রন্থাবলী
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
লিংক:
বাবাকে নিয়ে হুমায়ুন আজাদের মেয়ে মৌলী আজাদের লেখা