আমাদের সংবিধানে জীবন ধারণের জন্য স্বাস্থ্যসহ আরও চারটি অতিজরুরি অনুষঙ্গকে (অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও বাস্থাসন) মৌলিক চাহিদা হিসেবে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। অর্থাৎ, বিষয়গুলো জীবনধারণের জন্য মৌলিক মনে করলেও সেগুলোকে অধিকার হিসেবে স্বীকার করা হয়নি। কিন্তু কেন?
এ বিষয়ে কোনও রেডিমেড উত্তর নাই। যতদূর জানা যায়, তাতে জনশ্রুতি আছে- যাঁরা সংবিধান প্রণয়ন ও অনুমোদনে যুক্ত ছিলেন তাঁরা বিবেচনা করেছিলেন- একটি সদ্য স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সেই সামর্থ্য নেই যে ঐসকল মৌলিক চাহিদাকে আইনগত দিক থেকে পূরণ করতে পারবে। আর খুব সম্ভবত সে কারণেই ওই পাঁচটি বিষয় সংবিধানে 'মৌলিক অধিকারের' বদলে 'মৌলিক চাহিদা' হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে (সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশের ১৫ অুনচ্ছেদ দেখুন)। ফলে-মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ে শতকরা প্রায় ৮২ শতাংশ দরিদ্র মানুষের জন্য মৌলিক এই অত্যাবশ্যকীয় বিষয়গুলোর কোনও আইনগত সুরাহা পাওয়া গেল না।
এত বিপুল সংখ্যক মানুষ অন্ন-বস্ত্র-চিকিৎসার-শিক্ষা ও আশ্রয়ের মতো মৌলিক চাহিদাকে নিজ গরজে মেটানোর দায় নিয়ে স্বাধীন দেশটিকে পথচলা শুরু করেছিল। সেই পথচলা আজও চলছে। আজ শনৈঃ শনৈঃ উন্নয়নের কথা শোনা গেলেও এখনও মানুষের ওইসব মৌলিক চাহিদা মেটানোর দায় রাষ্ট্র নিল না!
আজ করোনাভাইরাস সংক্রমণে খাবি খেতে থাকা এ অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতায় স্বাস্থ্য অধিকারের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসাটা অসঙ্গত হবে না মনে করি। সাথে এও মনে করি- ''অধিকারের দর্শনটি"বুঝতে হলে এটিকে দেশভিত্তিক সাংবিধানের আঁটোসাঁটো ফ্রেমে না দেখে বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃতি সর্বজনীন মানবাধিকারের ক্যানভাসে দেখা সঙ্গত।
১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার সনদ গ্রহণ করা হয়েছিল সেখানে অন্ন-বস্ত্র-স্বাস্থ্য-শিক্ষা-বাসস্থান মতো মৌলিক বিষয়গুলোকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে। মানবমুক্তির সেই মহাসনদে ওই পাঁচটি বিষয়ই নয়, বরং তার ৩০টি ধারাতে আরও অনেক অনেক আবশ্যিক বিষয়কে ধারণ করা হয়েছে যা মূলত একজন মানুষের সভ্য জীবন যাপনের জন্য জরুরি।
সর্বজনীন মানবাধিকার সনদে শুধু মানুষের 'বাঁচার অধিকার'-ই স্বীকৃত হয়নি, স্বীকৃত হয়েছে মানুষের 'সুরক্ষা'র, 'বিকাশে'র আর 'অংশগ্রহণে'র অধিকারও। আর বাঁচা-সুরক্ষা-বিকাশ আর অংশগ্রহণ-কে একেকটি অধিকারগুচ্ছ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে প্রত্যেকেটির জন্য প্রয়োজনীয় অধিকারসমূহে সুনির্দিষ্টভাবে স্বীকার করা হয়েছে।
এই সনদের অনুচ্ছেদ-১ এ বলা হয়েছে- ''প্রতিটি মানুষ একটি স্বাধীন জীবন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং সে কারণে প্রতিটি মানুষই মর্যাদা ও অধিকারের জায়গায় সমান। আর সে কারনে মানুষে মানুষে সম্পর্ক হবে ভাতৃত্বমূলক।"
অনুচ্ছেদ-২ এ বলা হয়েছে, ''প্রতিটি মানুষ এই সনদে উল্লিখিত প্রতিটি অধিকার প্রাপ্তিতে সমান বলে বিবেচিত হবে। সেখানে কাউকেই জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, শিক্ষাগত যোগ্যতা, ভৌগলিক অবস্থান, লিঙ্গভেদে ভিন্ন করা যাবে না।"
অনুচ্ছেদ-২ এ উল্লিখিত স্পিরিট ধারণ করেই সদস্য দেশসমূহ তাদের স্ব-স্ব সংবিধান রচনা করবে এটাই ছিল জাতিসংঘের প্রত্যাশা। কিন্তু কষ্টকর হলেও সত্য, একটি সদস্য দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মানবাধিকারের সেই মহান দর্শন পুরোপুরি ধারণ করতে পারেনি। আমাদের যে সংবিধান যা নিয়ে আমাদের অহংকার, সেখানে মৌলিক চাহিদা আর মৌলিক অধিকার বিষয়ে কি বলা হয়েছে তা প্রসঙ্গক্রমে একটু দেখে নেওয়া যাক।
বাংলাদেশের মহান সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে- ''আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, "আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা-যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।"
রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি অংশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ে বলা হয়েছে-''প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।"
জনস্বাস্থ্য বিষয়ে একই অংশে বলা হয়েছে- ''জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন।" কিন্তু জেনে রাখুন- সেটা অধিকারের জায়গা থেকে নয়।
সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মূলত মৌলিক অধিকার সম্পর্কে ২২টি অনুচ্ছেদ (২৬-৪৭) সন্নিবেশিত হয়েছে। এখানে বিবৃত করা হয়েছে একজন নাগরিক হিসেবে আমাদের ন্যায্যহিস্যা, অধিকারসমূহকে। যা না পেলে বা যার কোনোরূপ ব্যত্যয় হলে একজন নাগরিক আইনের দ্বারস্থ হতে পারেন। আলোচ্য শিরোনামের সাথে উক্ত ২২টি অনুচ্ছেদে কোনও সুষ্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায় না। শুধু অনুচ্ছেদ-২৭ এ আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিক সমান এটি বলা আছে।
সেটাকে যদি আমরা স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি সূচক হিসেবে বিবেচনায় নিতে চাই তাহলে কী দাঁড়াবে? শুধু কী নাগরিক হওয়ার কারণে একজন সমান সুযোগ পাবেন? বিদ্যমান বাস্তবতা তা কোনোভাবেই সমর্থন করে না। যেখানে অর্থ, পদ-পদবী, রাজনৈতিক সংশ্লেষ, ভৌগলিক ভিন্নতা, জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ পরিচয় অধিকাংশ কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে সেখানে একজন দরিদ্র, একজন নারী, একজন পাহাড়ি বা সমতলের সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষ অথবা একজন অস্পৃশ্য-দলিত কীভাবে সেবার আওতায় আসবে?
করোনাভাইরাসের যে ভয়াবহতা চলছে তা অকল্পনীয়। যেভাবে মিডিয়া মারফত দেখা যাচ্ছে- উন্নত দেশগুলোতেও মৃত্যুর মিছিল সেখানে বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দরিদ্র দেশে (অনেকেই এখন আর দেশকে দরিদ্র ভাবতে নারাজ, আমি না ভাবতে পারলে নিশ্চয় খুশিই হতাম) মানুষের নিরাপত্তা কোথায়? কে দেবে আশা, কে দেবে ভরসা?
আজ আড়াই মাস পার হলো উহানে করোনা আক্রমণ আঘাত হানে। সেই থেকে বিগত ৮০দিনেরও বেশি সময় সরকারের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গৃহীত ব্যবস্থা কী কী? যারা করোনাভাইরাস আক্রান্ত দেশগুলো থেকে দেশে আসছে তাদের পৃথক করে রাখার ব্যবস্থা কী? যারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের আইসোলেশন ও চিকিৎসা কোথায় কীভাবে হবে (যদিও পাঁচটি হাসপাতালকে নির্ধারিত রাখা হয়েছে কিন্তু ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা তো ভিন্ন বলে শোনা যাচ্ছে)? টেস্টিং কিট কি পর্যাপ্ত আছে? চিকিৎসকদের নিরাপত্তার প্রস্তুতি যথেষ্ট পরিমাণ আছে তো? হ্যান্ড সেনিটাইজার এবং মাস্কের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসের জোগান ও মূল্য বাজারে কে পরিবীক্ষণ করবে? এমনতরো অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে সাধারণ মানুষ। যাদের ঘরে বয়স্ক মানুষ আছেন, যারা নানারজম ক্রনিক রোগে ভুগছেন, যারা পেশাগত কারনে নিত্য বাড়ির বাইরে যেতে বাধ্য, যারা জনাকীর্ণ বা পাবলিক প্লেসে কাজ করেন তারা তো চিন্তায় অস্থির হয়ে দিনাতিপাত করছেন।
চীন, ইটালি, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, সৌদি আরব, কাতার, আরব-আমিরাত, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান প্রভৃতি দেশ যেভাবে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে এই করোনা ভাইরাসকে মোকাবেলায় নেমেছে সেভাবে কি আমরা নামতে পেরেছি? আমরা কি বিদেশ ফেরত প্রবাসীদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে পারছি? আমরা কি পালিয়ে যাওয়া বা আত্মগোপনে যাওয়া বিদেশ ফেরতদের চিহ্নিত করতে পেরেছি বা পারছি? আমরা কি অজানা আশংকায় মজুদ করার প্রবণতা যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে পারছি?
এখন পর্যন্ত যে অভিজ্ঞতা তাতে উপরোক্ত প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরই হবে আংশিক বা পূর্ণ 'না'। তাহলে কী হবে, কে নেবে সুরক্ষার দায়? এদেশের শাসন ব্যবস্থার দুর্বলতা, ব্যক্তি মানুষের অসচেতনতা, চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, জনসংখ্যার ঘণত্ব, ব্যক্তি মানুষের পেশার ধরণ ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে এই আপনাকেই নিতে হবে আপনার সুস্থ থাকার দায়িত্ব। শুধু রাষ্ট্রের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করে আমরা কেউই নিরাপদ থাকতে পারবো না।