বিশ্ব এইডস দিবসে প্রাসঙ্গিক ভাবনা

শাকিল মনজুর
Published : 1 Dec 2011, 01:54 PM
Updated : 1 Dec 2011, 01:54 PM

পহেলা ডিসেম্বর বিশ্ব এইডস দিবস। UNAIDS বিশ্বব্যাপী এইদিনটিকে মরণব্যাধি এইডস এর সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য পালন করে আসছে ১৯৯৫ সাল থেকে। UNAIDS সারা বছর ধরেই এই কাজটি করে যাচ্ছে তথাপিও পহেলা ডিসেম্বরকে বিশেষ ভাবে পালন করা হয়। এই দিনে বিশ্বময় সভা হয়, সেমিনার হয়, গোলটেবিল বৈঠক হয়, পত্রিকাগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র বের করা হয়। এইচআইভি/এইডস সম্পর্কে চলমান প্রচার বেগবান হয় এই দিনে। মিডিয়াগুলো গুরুত্ব সহকারে রিপোর্টিং করে, টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রাইমটাইম নিউজের প্রথম খবর হয়ে আসে-আজ বিশ্ব এইডস দিবস। সব মিলিয়ে দিবসটি বেশ প্রচার পায়। এই দিবসটির কল্যাণে মানুষ ভুলে যেতে যেতেও ভুলতে পারেনা এইডস বলে একটা মারাত্মক রোগ পৃথিবীতে আছে। সারা বছর ভুলে থেকে যা ক্ষতি হয় তা এই একদিনের উপচে পড়া প্রচার ও প্রোপাগান্ডায় কতটা পুষিয়ে নেয়া যায় আমি জানিনা। এই একদিনে অসংখ্য পত্রিকার ক্রোড়পত্রের চেয়ে বছর ব্যাপী পরিকল্পিত প্রচার অনেক বেশী এই বিষয়টিকে মানুষের মস্তিষ্কে জাগরুক রাখবে। মিডিয়া বিশেষজ্ঞরা ভাল বলতে পারবেন কোনটা বেশী ইফেক্টিভ? আমার সাধারন জ্ঞানে মনে হয় সারা বছর এইডস এর সচেতনতার প্রচারনা চলতে পারে। এখন যে তা চলছেনা তা কিন্তু বলা যাবে না। তবে তা খুব বেশী কি আপনার, আমার নজর কাড়ে? প্রপার ডোজ বলে একটা কথা ডাক্তারী পরিভাষায় প্রচলিত আছে। প্রতিটা ঔষধের সঠিক ডোজটাই কেবল কার্যকরী। কম খেয়েছেন তো কাজ করবে না অর্থাৎ রোগ ভাল হবে না। বেশী খেয়েছেনতো আরও মারাত্মক পরিস্থিতি হতে পারে। রোগ তো ভাল হবেইনা বরঞ্চ তার পার্শ্বপতিক্রিয়া হয়ে জটিল অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। ঠিক এমনটিই আমার মনে হয় এখানে ঘটছে। কেন যারা এই ক্ষত্রে কাজ করছেন তারা শুধু একটি দিবস ভিত্তিক অতি প্রচারণা চালাবেন আর সারা বছর ঢিমে তালে চালাবেন?

আপনারা হয়তো লক্ষ্য করবেন দৈনিক পত্রিকাগুলো মাঝে মাঝে, সম্ভবত সপ্তাহের একদিন, স্বাস্থ্য বিষয়ে একটি পাতা বা তার অংশ নানাবিধ রোগ বালাই এর উপর লেখালেখি করেন। বেশীর ভাগ ডাক্তারসাহেবগন এই পৃষ্ঠাগুলোর লেখক এবং সেটাই স্বাভাবিক। রোগতত্ত্ব বা স্বাস্থ্য বিষয়ে লিখতে যথাযথ জ্ঞান এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকাই বাঞ্চনীয়। আচ্ছা আপনারা কেউ কি পত্রিকার স্বাস্থ্য পাতায় এইডস সম্পর্কে লেখা দেখেছেন বা পড়েছেন কখনো? মনে কি পড়ছে। সম্ভবত দেখেননি। সম্ভবত বলছি এই কারনে যে আমি দেখিনি। অনেকের কাছেই জানতে চেয়েছি তারাও না বোধক উত্তর দিয়েছেন। তবে কখনো কোন ফাঁকে আমাদের দৃষ্টির অগোচরে দু-একটি লেখা যদি কখনো ছাপানো হয়ে গিয়ে থাকে তা হলে আবার কেউ চ্যালেঞ্জ ছূঁড়ে দিতে পারেন। কিন্তূ কেন? দেশে কি এই রোগের বিশেষজ্ঞ বা ডাক্তার নেই? বাস্তবতা আসলে এই যে সাধারনত মিডিয়া বিশেষকরে প্রিন্ট মিডিয়া এই সম্পর্কে খুব বেশী লেখালেখি করে না। এর কয়েকটা কারন যা আমি মনে করেছি তা হলো এইডস রোগের প্রচারণা প্রধানত ডোনর নির্ভর। এই কাজে অনেক গুলো আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে আর্থিক সহযোগীতা পায় সংশ্লিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান গুলো। যার ফলে কেবল মাত্র সেই সব প্রতিষ্ঠান গুলোই এইডস এর সচেতনতার প্রচারনার কাজ করে যায়। অন্যরা এমনকি মিডিয়া গুলোও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই ক্ষেত্রে কোন কাজ করে না। তার বসে থাকে কখন ঘুরে ফিরে সংশ্লিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান গুলির কাছ থেকে তারা প্রচারের কাজ, মানে বিজ্ঞাপন পাবে! মিডিয়া গুলোর পরিচালকদের মনে এক ধরনের অভিমান বা ক্ষোভও কাজ করে বলে আমার ধারণা হয়েছে। বলা আবশ্যক মিডিয়া সংশ্লিষ্ঠ অনেকের সাথে কথা বলেই আমার এই ধারণা হয়েছে। তাদের কেউ কেউ বলেছে এইডস এর জন্য এত টাকা আসে আমারা (পত্রিকা) তো এর কোন অংশ পাইনা। পেলে আমরাও সাধ্যমত প্রচার করতাম। কথাটা বিবেচনায় নেয়ার দাবী রাখে। মরণ ব্যাধি এইডস থেকে বাঁচতে আমাদের এর সম্পর্কে এমন ভাবে প্রচারনা চালাতে হবে যা হবে সর্বাত্মক আর সকলের অংশগ্রহনের মাধ্যমে। কিছু প্রতিষ্ঠান বা এনজিও কেবলে এর অর্থ-সমৃদ্ধ প্রচার সত্ব পাবে তা কেন হবে?

সকলের অংশগ্রহনে প্রচারের একটা গ্রহনযোগ্য ও কার্যকর মডিউল বা ধরন থাকা দরকার। দীর্ঘদিন এদেশে প্রচার চলেছে কি কি করলে এইডস হয়না। যেমন একই পুকুরে বা গোসলখানায় গোসল করলে, এক সাথে খাবার খেলে, একই টয়লেটে পায়খানা করলে বা মশার কামড় থেকে এইডস হয়না। প্রশ্ন হচ্ছে কি কি করলে এইডস হয়না তার তালিকা অনেক দীর্ঘ করা সম্ভব। মানুষের বরং জানা দরকার কি কি করলে এইডস হতে পারে। এইডস না হওয়ার জন্য কি কি সাবধানতা অবলম্বন করা উচিৎ বা এইচআইভি আক্রান্ত হলে কি করতে হবে, এইডস আর এইচআইভি সংক্রমণের মধ্যে কি ফারাক। এসব সরাসরি বলতে হবে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বললে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ যারা কম শিক্ষিত তারা ঠিক বুঝবে বলে মনে হয় না। আশার কথা চলমান প্রচারের মাঝে বহুদিন পর হলেও এই পজিটিভ লিষ্টটা এসেছে। এখন একটু একটু করে বলা হচ্ছে কি কি কারনে এইচআইভি সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে। যা আমার বিবেচনায় অনেক আগেই বলা যেত এবং তাতে সচেতনতা বেশী হতো বলেই আমার বিশ্বাস।

এবার আসি এইচআইভি/এইডস কি তার সম্পর্কে একটু আলোচনা করা যাক। এইচআইভি (HIV) মানে Human Immunodeficiency Virus. এই ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে কেবল মাত্র রক্ত, লালা বা শরীরের অন্যান্য রস বা স্যালাইভা থেকে। রক্ত, ঘাম, মুখের লালা, মায়ের দুধ বা মহিলাদের ব্রেষ্ট নিঃসৃত রস, পুরুষদের সিমেন ও মহিলাদের যৌনি রস এর অন্তর্ভুক্ত। প্রশ্ন হলো এসবের মাধ্যমে যাতে এই রোগের ভাইরাস কারো শরীরে প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য কি সাবধানতা অবলম্বন করা উচিৎ। রক্তের কথাই ধরুন, রক্তের মাধ্যমে একজন আক্রান্ত ব্যাক্তির কাছ থেকে সুস্থ মানুষের দেহে এই ভাইরাস যেতে পারে যখন আমরা কোন প্রয়োজনে রক্ত নেই। রক্ত নেবার আগে সেই রক্ত পরীক্ষা করে নিলেই এর থেকে বাঁচতে পারবেন। তা ছাড়া হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ ব্যাবহার করতে হবে। মনে রাখবেন ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ তো ব্যবহার করবেনই, ব্যাবহারের পর সেই নিডিল ধ্বংস করা হলো কিনা তাও নিশ্চিত করবেন। তা না হলে সেই নিডিল পুনরায় ব্যাবহার হতে পারে। যারা শিরায় ইঞ্জেকশান এর মাধ্যমে মাদকে আসক্ত তারা একই সিরিঞ্জ বার বার ব্যাবহার করে বলে সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে। ডাক্তার বিশেষ করে শৈল্য চিকিৎসকগন এবং যারা টেষ্টের জন্য রক্ত নেন তারাও এই ঝুঁকিতে আছেন বিধায় সাবধানতার সাথে কাজ করতে হবে যাতে অসাবধানতায় অঘটন না ঘটতে পারে।

রক্তের পর আসছে যৌনরস যা থেকে বাঁচতে চাই নিরাপদ যৌনাচরন। কেবল মাত্র দাম্পত্য সঙ্গীর সাথে বিশস্ত থাকা আর ঝুঁকিপুর্ন যৌনকর্মে সর্বদা ল্যটেক্স কনডম ব্যবহার করে এইচআইভি সংক্রমণ থেকে বাঁচা সম্ভব। মূখমেহন (যৌনাচারে মূখের ব্যবহার) ও ঝুঁকিপূর্ন। চুম্বন, বিশষ করে গভীর চুম্বনের মাধ্যমে এই ভাইরাস একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে প্রবেশ করে।

এর পর আলোচনা করবো মায়ের ব্রেষ্ট ফিডিং এর ব্যাপারে। আক্রান্ত মায়ের কাছ থেকে মাতৃদুগ্ধের মাধ্যমে সহজে এই ভাইরাস শিশুর শরীরে চলে যায়। আক্রান্ত মহিলাদের স্তন নিঃসৃত যে কোন রসেই এই ভাইরাস থাকতে পারে। সুতরাং সেই বিষয়েও সাবধান হতে হবে।

মনে রাখতে হবে উপরের বিষয় গুলিরে ক্ষেত্রে যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন করলে এইচআইভি থেকে সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব। এই ভাইরাসটি মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে সাধারনত কয়েকদিনের সাধারন জ্বর-সর্দি, মুখের অভ্যন্তরে ঘা এবং শরীরের বিভিন্ন অংশের গ্ল্যান্ড ফোলাই এর লক্ষন যা কোন এন্টিবায়োটিকে সারবে না। তবে দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে আবার এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে। অর্থাৎ নীরব ঘাতক শরীরে প্রবেশ করে গেল। তবে এইচআইভি ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার মানেই এইডস নয়। বরং এই অবস্থায় আমরা বলতে পারি কেউ এইচাইভি ভাইরাসে সংক্রমিত হলো। যাকে সাধারন ভাবে সবাই এইচাইভি পজিটিভ বলে থাকি। এইচাইভি ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে আমার তাকে বলি একিউট ইনফেকশন। সেকেন্ডারী ইনফেকশন হতে দুই সপ্তাহ থেকে বিশ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। শরীরে প্রবেশ করা ভাইরাস ক্রমে ক্রমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কে ঘায়েল করে এক সময় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর জয়ী হয় এবং একে একে শরীরের সমস্থ সিষ্টেম আর প্রয়োজনীয় অঙ্গ গুলোকে ধ্বংস করে ফেলে এবং এক পর্যায়ে রোগীর করুণ মৃত্যু ঘটে। তবে এই অবস্থায় পৌঁছার পূর্বে ভাইরাস আক্রান্ত হবার পর অনেক বছর স্বাভাবিক কর্ম কান্ড করতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তি নিজে সাবধান হলে অন্যের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা প্রায় থাকে না বললেই চলে। শুধু উপরে বর্ণিত বিষয়গুলি মেনে চললেই হবে।

আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকলে বা নিশ্চিত হতে পারলে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনূযায়ী চললে রোগীকে পজিটিভ পর্যায় থেকে এইডস পর্যায় পর্যন্ত যাওয়ার সময়টাকে দীর্ঘায়িত করা সম্ভব এবং রোগ ছড়ানোর ক্ষেত্রে সচেতন ও সাবধান হওয়া সম্ভব। এইচাইভি পজিটিভ ব্যক্তি সমাজে স্বাভাবিকভাবে কাজ-কর্ম করতে পারে।এই রোগ ছোঁয়াচে নয় বলে এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তির সাথে সাধারন ও স্বাভাবিক মেলামেশায় কোনই ঝুঁকি নেই। আক্রান্ত মানুষের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রদর্শনের কোনই যুক্তি নেই। এই রোগে আক্রান্তদের একসময় খারাপ চোখে দেখা হতো এই কারনে যে সাধারন ভাবে মানুষ মনে করতো কেবলমাত্র যৌনাচার বা ব্যাভিচার থেকে এই রোগ হয়। কিন্ত বাস্তবে আমরা দেখি অনেক কারনেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ হতে পারে এমনকি একজন নির্দোষ মানুষও দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ভাইরাসাক্রান্ত হতে পারে। আর তা হতে পারে আপনার আমার যে কারো বেলায়। আসুন আমরা এইচাইভি সহ অন্যন্য রক্তবাহিত বা সেক্সুয়ালী ট্রান্সমিটেড ডিজিজ (STD) সম্পর্কে জানি আর নিজেকে সুরক্ষিত রাখি আর সমাজকে রক্ষা করি রোগ বালাই থেকে।

শাকিল মনজুর
২০০৭ সালে UNAIDS মিডিয়া এওয়ার্ডপ্রাপ্ত