সামাজিক অটো ইম্মিউন ডিজিজ

শাকিল মনজুর
Published : 5 Dec 2011, 07:43 AM
Updated : 5 Dec 2011, 07:43 AM

বেড়ায় ক্ষেত খায়, এই প্রবচন পুরনো ও প্রচলিত। এটা এমন একটা পরিস্থিতির রূপক যেখানে রক্ষা, সুরক্ষা বা প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত বা নিয়োগকৃত ব্যক্তি বা সিস্টেম নিজেই ক্ষেত নামের সম্পদ নষ্ট করে অর্থাৎ খেয়ে ফেলে! এটা নূতন কিছু নয়। বরং বেড়ায় বেড়া খাওয়ার কথা তুলনামূলক ভাবে কম শোনা গেলেও তা এক্কেবারে অশ্রুতও নয়। পরের কথাটির ঈঙ্গিত বুঝতেও খুব একটা বেগ পেতে হয় না আমাদের। যুক্তির খাতিরে বলছি বেড়ায় ক্ষেত খেলে তুলনামূলক ভাবে কিছুটা কম ক্ষতি হয়। অন্যদিকে বেড়ায় বেড়া খাওয়ার ফলশ্রুতিতে রক্ষাবুহ্য অবশিষ্ট না থাকার কারনে বর্হিশত্রুর আগ্রাসনে ক্ষেত উজাড় হবার সম্ভাবনা অনেক বেশী। তবে নিঃসন্দেহে উভয় ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি অব্যবস্থার বর্হিপ্রকাশ এবং নৈরাজ্যকর ও হতাশাময়। নিরাপত্তাবাহিনী যেমন প্রতিরক্ষা বাহিনী, পুলিশ, ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সদস্যবৃন্দ যখন অর্পিত দায়িত্ত্ব পালনে ব্যর্থ হয়ে নিজেরাই উল্টো এমন অনৈতিক কাজে জড়িয়ে যায় যাকে আমরা বেড়ায় ক্ষেত খাওয়ার সাথে তুলনা করতে পারি তখন তা হয় দুর্ভাবনার বিষয়, দুঃখজনক। আমাদের দেশে, সমাজে পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মীগন জনগনের সেবক হবার পরিবর্তে জনগণের ভয়ের কারন হয়ে আছে আর এর ভয়ের মাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে সাথে সাথে ভীতদের সংখ্যাও। পুলিশ কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদের এর উপর নির্যাতন, র্যা ব কর্তৃক লিমন এর উপর অত্যাচার, সাভারের আমিনবাজারে পুলিশের উপস্থিতি ও নিসক্রিয়তায় ছয়-ছয়জন ছাত্রের গনপিটুনিতে করুন মৃত্যু, নোয়াখালীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে পুলিশের উস্কানিতে সৃষ্ট গনপিটুনীতে কিশোর মিলনের মৃত্যু সকলের বিবেক কে নাড়া দিয়েছে। দেশীয় পরিমন্ডলের বাইরে আন্তর্জাতিক ভাবেও এই সব ঘটনা সমালোচিত হয়েছে। মিডিয়ার কল্যানে এখন মুহুর্তেই দেশের খবর বিদেশে বসে সব বাঙ্গালীরাই তা দেখতে পড়তে পারে। সরকার ও দেশের ভাবমূর্তি এতে দারুন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এটা আমরা সবাই বুঝি,
মানি।

এই সরকারের আমলে আইন-শৃংখলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অনেক মামলা হয়েছে। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের ঘটনায় আদালত স্বতঃপ্রনোদিত হয়ে মামলা করেছে। রাস্তাঘাটের দুরবস্থা, পরিবেশের ধ্বংস, খাদ্যে ভেজাল সহ অনেক জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ঠ বিষয়ে আদালত ও বিভিন্ন সংগঠন আইনী প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহন করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা যাবে যে এসব হচ্ছে আইনের স্বাধীনতার বর্হিপ্রকাশ। আবার এভাবেও কি দেখা যায় না যে আইন-শৃংখলার পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয়েছে যে আদলত বা সচেতন মহল এমন ভুমিকা পালনে বাধয হয়েছে? সাদা পোষাকে আইন-শৃংখলা বাহিনীর হাতে বেশ কিছু মানুষ আটক হয়ে নিখোঁজ আছে। পত্রিকান্তরে জানা গেছে এক ঘটনায় এমন সাদা পোষাকধারী ব্যক্তিগন অভিযান চালানোর সময় ওই পথদিয়ে যাওয়া সেনাবাহিনীর সদস্যগন তাদেরকে ঘটনা সর্ম্পকে জানতে চাইলে তারা নিজেদের পরিচয় পত্র জাতীয় কিছু একটা দেখালে সেনাবাহিনীর সদস্যরা চলে যান। রাতপর সাদা পোষাকধারীরা তিন জন কে উঠিয়ে নিয়ে যান যাদের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে অন্যত্র। এধরনের ঘটনায় সাধারন জনগন ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেই চলেছেন। বিরোধীদল তো সরকারের প্রতি দেশকে পুলিশিরাষ্ট্রে পরিনত করার অভিযোগও এনেছেন একাধিকবার। অর্থাৎ তাদের মতে দেশে এখন চলছে পুলিশের শাসন! অবশ্য এটা অনেকেই বিএনপির একান্ত ও দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ বলে মনে করেন। আর আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে সরকারী ও বিরোধীদল দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-নেত্রীদের দেয়া বক্তব্যে এমন কথা এমন সূরে বলে চলেছেন যা অনেক সময় হাস্যকর, জাতীর জন্য বিব্রতকর, জাতীয় সম্মান বিধ্বংসী, জনগনের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারি, সমাজে উত্তেজনা সৃষ্টিকারি এবং অশালীন। দলের সর্বোচ্চ অবস্থান থেকেও এহেন বক্তব্য দেয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

যাহোক ফিরে আসি যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম, বেড়ায় ক্ষেত খাওয়ার বিষয়। আমাদের বেড়া অর্থাৎ পুলিশ, বিশেষ বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যগন স্ব-স্ব দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ বা অপারগ হয়ে ক্ষেত খাওয়ার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি করেই চলেছেন যেখানে সাধারন জনগন, যাদের জন্য এইসব আইন-শৃংখলা বাহিনীর প্রয়োজন তারাই এখন আইন-শৃংখলা বাহিনীর কাছ থেকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। অবশ্য একথা এদেশে অনেক আগেই চালু হয়ে গিয়েছিল যে পুলিশে ধরলে আঠেরো ঘা, যা থেকে পুলিশের সম্পর্কে সাধারন মানুষের প্রচলিত সাধারন ধারনার প্রমান মেলে। পুলিশ একটি প্রশিক্ষন প্রাপ্ত সুশৃংখল বাহিনী হওয়া স্বত্বেও এই নেতিবাচক ইমেজ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারার মূল কারন হয়তো আইন-শৃংখলা বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবের আওতায় রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য ব্যবহার যা সব সরকারই করেছেন তাদের ইচ্ছামাফিক কোন সমালোচনার তোয়াক্কা না করে। অনেকের ধারণা পুলিশের একটি বড় অংশ এখন দলীয় ক্যাডার আর নির্দলীয় পুলিশ সদস্যের সংখ্যা শূণ্যের কোঠায় না হলেও যে তারা সংখ্যালঘুতে পরিনত হয়েছেন তা সহজেই অনুমেয়। এতো গেল বেড়ায় ক্ষেত খাওয়ার উদাহরন। তবে ডিবির ইন্সপেক্টর দের এনএসআই এর সদস্যদের হাতে আটক ও মারধরের শিকার হওয়ার সাম্প্রতিক ঘটনায় এখন মনে হচ্ছে বেড়ায় বেড়া খেতে শুরু করেছে কিনা? এই খাওয়া খাওয়ি যদি বন্ধ না হয় তাহলে আম জনতার কি হবে? আমি ডাক্তার নই তবে সাধারন জ্ঞান হিসাবে জানি মানবদেহে রোগ প্রতিরোধ করে চলেছে আমাদের ইম্মিউন সিস্টেম। এই সিস্টেম নানারকম রোগ-জীবানু থেকে আমাদের রক্ষা করে। কিন্তু একধরনের রোগ আছে যাকে বলে অটো-ইম্মিউন ডিজিজ। এই সব ডিজিজে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিজেই তাকে ধ্বংস করে। আর রোগী ক্রমান্বয়ে রোগপ্রতিরধ ক্ষমতা হারিয়ে অধিকতর অসুস্থ হয়ে পড়ে বা মৃত্যু মুখে পতিত হয়। জটিল এই রোগের চিকিৎসা খুবই দুঃসাধ্য। সামাজিক এই অটো-ইম্মিউন ডিজিজ থেকে বাঁচার উপায় কি? সমাজ বিজ্ঞানীরা ভাবছেন কি?

শাকিল মনজুর
১৮/১০/১১