বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বনাম ইসলাম – ১

শামান সাত্ত্বিক
Published : 22 April 2017, 06:36 PM
Updated : 22 April 2017, 06:36 PM

স্কুল পাঠ্যপুস্তকে একটা বিশেষ ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করার জন্য ধর্মগত সাম্প্রদায়িকতার পক্ষে পরিবর্তন দেখে বুঝেছিলাম এই প্রসংগে একটা লেখা লিখতে হবে। কিন্তু হাতে থাকা প্রজেক্টের পর্বটা শেষ না করা পর্যন্ত অন্য কোন দিকে সেভাবে মন দিতে পারি নি। এখন পহেলা বৈশাখ উদযাপন নিয়ে যে পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে, পরাজিত ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি তাদের প্ল্যান 'বি' ধরে খুব সফলতার ভাবনা নিয়েই এগুচ্ছে এবং আত্মতৃপ্তির পথে রয়েছে।

ধর্মীয় মৌলবাদের সবচেয়ে সুবিধাজনক অস্ত্র হলো, তাদেরকে কোন কিছুর ব্যাখ্যা দিতে হয় না। 'যেখানে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু', সেখানে তর্ক কি খাটে? আজ পর্যন্ত এমন কোন মুসলমান ধার্মিককে পেলাম না, যে আমাকে যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা দিতে পারে, কেন শুকরের মাংস খাওয়া হারাম, অথবা এটা খেলে বিরাট কি সমস্যা হতে পারে (সব কিছু অশুদ্ধ হয়ে যাবার মত)? এই পৃথিবীর মুসলমান জনগোষ্ঠী ছাড়া, অন্য সব জনগোষ্ঠী তো শুকরের মাংস খুব মজা করে খাচ্ছে, তারা কি সবাই পৃথিবীতে ইবলিশের দাসত্ব বরণ করেছে? নাকি সবাই পৃথিবীকে অশান্তিময় করে তুলেছে? এখনো এসবের জবাব মেলেনি। শুকুরের মাংস ভক্ষণ করুক বা না করুক, বদলোক সব ধর্ম বর্ণে গোত্রে আছে, এটা অনস্বীকার্য। আর তারাই এই পৃথিবীর শান্তি বিনষ্ট করছে। তাহলে মুসলমানদের শুকরের মাংস না খাওয়ার দায়টা নিতে হয় কেন?

ঠিক একইভাবে হালাল মাংস ভক্ষণ নিয়ে আমার একই প্রশ্ন। ইসলাম ধর্মে বলা আছে বলে, হালাল মাংসই খেতে হবে। কিন্তু কেন? এসবে যে উত্তরগুলো পাই, সবগুলোই ধর্মীয়ভাবে পক্ষপাতিত্বমূলক, যুক্তিগুলো যথেষ্ট জোরালো নয়। কোন উল্লেখযোগ্য গবেষণা বা প্রতিষ্ঠিত গবেষণা পত্রিকায় এসব নিয়ে কোন অভিসন্দর্ভ তৈরি/ছাপা হয়েছে কী না, জানা নেই। আজ পর্যন্ত ক'জন মুসলমান স্কলার/পন্ডিত এই বিষয়গুলোকে বিজ্ঞান-যুক্তি-তত্ত্ব-তথ্য দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পেরেছেন? গরুর মাংসে কোলেষ্টেরল বেশি বলে হৃদরোগের শংকায় অনেক মুসলমানই এখন তা খাওয়া থেকে নিজেদের দূরে রাখেন। অথবা সীমিত বা স্বল্প আকারে ভক্ষণ করেন। যে কোন প্রাণীর মাংস ভক্ষণে এরকম সমস্যা আছেই তো!

বাংলাদেশে একটা কথা শুনতাম, মুসলমান, আবার গরুর মাংস খান না! জানি না, এখন এমন কথা ক'জন বলেন! মুসলিম বিশ্ব বাদে বাকি বিশ্ব হাজার বছর ধরে শুকর বা না-হালাল (কি হারাম?) মাংস খাওয়াতে কী বড় ক্ষতি হয়ে আসছে, তা এখনও আমি অনুধাবন করতে পারছি না। বরং উল্টোটাই দেখছি, এসব খেয়ে মুসলমানদের চেয়ে বরং ভাল অবস্থায়ই তারা থেকে আসছে।

এতক্ষণে আমার এই লেখাটা পড়ে অনেক মোমিন মুসলমান যথেষ্ট ক্রোধান্বিত। সমস্যাটা এইখানেই। কিন্তু আমি যদি আমার প্রশ্নের যথার্থ উত্তর না পাই, কোন কিছুর ভাল-মন্দ পঞ্চ-ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব না করি, তবে যতই আমাকে দোষানো হোক না কেন, আমি তবুও বলবো না দোষটা একান্ত আমার। এক কথায়, আমার প্রশ্নের যুক্তিসংগত, বিজ্ঞানসম্মত, অর্থপূর্ণ উত্তর চাই-ই চাই।

এখানে এত কথা বলার উদ্দেশ্য, আমাদের পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভা যাত্রা নিয়েও একই রকমের বাড়াবাড়ি উৎপাত, জনগণের মৌলিক স্বাধীন অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। জনগণ কীভাবে কী পালন করবে, প্রকাশ করবে সেটা জনগণের নিজস্ব, স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার, তাতে কেউ হস্তক্ষেপ করার অধিকার অর্জন করে না। সুপ্রিম কোর্টের সামনে 'জাস্টিসিয়া'র ভাস্কর্য থাকলে ক্ষতিটা কি? সেটাও উপলব্ধির মধ্যে আসে না। ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিকোণে ধর্মের ধ্বজাধারীরা এসব নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন, কিন্তু কোন জোরালো যুক্তি তাদের নেই। কোরআন ও হাদিস বলেছে, এটাই যথেষ্ট, তার উপরে আর কোন কথা নেই।

ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের পর হাজার বছরের উপর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। ধর্মের সেই পুরোনো দৃষ্টিভঙ্গির নতুন অর্থ চাই, ব্যাখ্যা চাই। আধুনিক বা উত্তর-আধুনিক বা বর্তমানের প্রেক্ষাপটে জানতে চাই, এসব ভাস্কর্য, মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের মনোজগতে, চিন্তার জগতে, শারীরিক জগতে, সামাজিক জগতে, রাষ্ট্রীয় জগতে কী এমন যথেচ্ছাচার করছে বা নচ্ছার হয়ে উঠছে, যাতে করে 'গেল গেল' রব উঠছে। কোন উপযুক্ত উত্তর এই মৌলবাদী অসুস্থ চিন্তা-চক্রের কাছ থেকে কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না। বরং যা পাওয়া যাবে এই চক্রের কাছে তা হিংসা ও ঘৃণার এক প্রত্যাখ্যাত। এরা আসলেই কি ইসলাম নামের ধর্মটাকে বোঝে? না বোঝে মানুষের সভ্যতার বিবর্তন? তাদের মাথা এবং চোখ ঠিকই হাজার বছরের পশ্চাতে পড়ে আছে। কিন্তু আরাম-আয়েশের ক্ষেত্রে একেবারে এই যুগের সবটুকু উপভোগে উদগ্রীব।

একটা ধর্ম যদি বর্তমান এবং বাস্তবতাকে আত্মীকরণ করতে না পারে, তার দায়-দায়িত্ব কি সে ধর্মের? না কি সে ধর্মাবলম্বীদের? এই চলমান, পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্নটি ভীষণ গুরত্ববহ।

হেফাজতে ইসলাম নামক অসৃজনশীল মোল্লা সংগঠনটি তার যাত্রার প্রাক্কালে মুক্তচিন্তার ব্লগারদের নাস্তিক ব্লগারের ট্যাগ লাগিয়ে তাদের একটা তালিকা প্রস্তুত করেছে। যে হেফাজত 'বোলোগ দিয়ে ইন্টারনেট চালায়', নাস্তিক ব্লগারদের তালিকা প্রস্তুত করা, আর যা-ই বলা হোক না কেন, তাদের দ্বারা সম্ভব নয়। হেফাজত যাদের 'বি' টিম হয়ে খেলাধূলা করছে, এই তালিকা তৈরির পথে অগ্রদূত হলো, সেই দুশ্চরিত্র হিংস্র মৌলবাদী, ঘাতক-যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবির চক্রের বাংলা ব্লগের বুদ্ধিজীবীরা। তার সাথে যুক্ত হয়েছিল, এক পথভ্রষ্ট বুদ্ধিজীবী, এবং মৌলবাদীদের সহযোগী এক পত্রিকার কুচক্রী-দালাল সম্পাদক।

বর্তমান সরকার তার এই শাসনামলে প্রগতি ও উন্নতির কথা বলতে গদ গদ। কিন্তু যে ধর্মীয় পশ্চাৎপদ গোষ্ঠী জগদ্দল পাথর হয়ে এই উন্নতিকে পিছে টেনে ধরে রাখতে চাইছে, সরকার তার ভোট চিন্তায় আদৌ তা উপলদ্ধি করতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, বাংলা নামক সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধ্যুষিত দেশটা একটা মেরুকরণে এসে গেছে। একদিকে আছে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানীকৃত ইসলাম ধর্মের কট্টর-উগ্রবাদী ধারা, যারা বাঙালি সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্যকে পদে পদে অপমানিত বা বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে এসে পশ্চাৎপদতাকে লালন করে আসছে। অন্যদিকে আছে, নিজের বাঙালি সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে, সাদরে লালন করে নিজস্ব ধর্মপালনের সাথে সংঘাত তৈরি না করে এগিয়ে যাওয়া।

গত '৮০-র দশকেই কারো কারো কাছে স্পষ্ট হয়ে আসছে, আমাদের এখানের এই ইসলাম ধর্ম চর্চা নিয়ে বাঙালি সত্ত্বার একটা সংঘাত তৈরি হতে যাচ্ছে। যখন নিজের বাঙালি সত্ত্বার চাইতে ধর্মীয় পরিচয়টা বড় হয়ে উঠে, তখনই সংঘাতটা স্পষ্ট হয়ে উঠে। বাঙালি সত্ত্বাটা যথেষ্ট প্রশ্বস্থ, স্থিতিস্থাপক, অনেক কিছুকেই মানবিক মূল্যবোধ থেকে মেনে নিতে পারে, ধারণ করতে পারে। কিন্তু ধর্মীয় সত্ত্বায় আমাদের যে পরিচয়, তা ততটা প্রশ্বস্থ বা স্থিতিস্থাপক নয়। তা কঠিন নিয়ম-কানুন, বা আইনের জোয়ালে আবদ্ধ। এখানে ভুল হলে, যে শাস্তিটা প্রাপ্য হয়, তা অধিকাংশ সময়েই অমানবিক। আর তাতে করে মানুষের পরিচয়টা সংকীর্ণ হয়ে আসে।

নিজস্ব ঐতিহ্যকে আঁকড়িয়ে না ধরে কোন ভূ-খন্ড/দেশ তাদের উন্নতি সাধিত করতে পেরেছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। আরব থেকে আগত ইসলাম ধর্মও সে সময়ে, সে ভূ-খন্ডের সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে আত্মীকরণ করেছে। আর বাংলাদেশি কট্টর মুসলিম সম্প্রদায় তাদের বাঙালি ঐতিহ্যকে বরাবরই হেলা-ফেলার বিষয়ে পরিগণিত করেছে। এইখানেই তাদের প্রকৃত শিক্ষার সমস্যা। আসলেই যতদিন তারা তাদের বাঙালিত্বকে গুরুত্ব দিতে না জানবে, আত্মীকরণ করে উঠতে পারবে না, ততদিনই তাদের শিক্ষা বা জ্ঞানার্জন অপূর্ণতায় পর্যবসিত হবে। পূর্বপুরুষদের দ্বারা সমৃদ্ধ সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে অবহেলা করা, বিদ্বেষ পোষণ করার অপর নাম আত্মাহুতি ছাড়া কিছু নয়।

'৭১ পূর্ব মূলতঃ পাকিস্তানপন্থীরা (বাঙালি এবং অবাঙালি নির্বিশেষে) বাঙালি সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি বলে 'দূর দূর' করেছে। বাঙালির পূর্ব পরিচয়ের সাথে অবশ্যই হিন্দুত্বের গভীর যোগাযোগ আছে। কারণ, বাঙালিরা এক সময়ে অখন্ড ভারতীয় সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ হয়েই ছিল, এখনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রয়েছে। সেটাকে ধর্মের লেবাস পড়িয়ে বিতাড়িত করার প্রচেষ্টা এবং মানসিকতা, শুধু হাস্যকরই নয়, চরম নিন্দনীয়ও বটে। ইসলাম যদি নবী মুহাম্মদের মাধ্যমে আরবীয় জাতীয়তাবাদ এবং এর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে, তবে বাঙালি মুসলমানরা কেন তাদের ভূ-খন্ডের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করবে না, বা তা লালন-পালন করবে না? আরবীয়রা তাদের মত করে ইসলামকে নিলে, বাঙালিরাও বাঙালিদের মত করে ইসলামকে গ্রহণ করবে। ভিন্ন ভূ-খন্ডে বেড়ে উঠা এক ধর্মকে নিজস্বতায় বাঙালিত্ব দিয়েই আত্মীকরণ করতে হবে। ধর্মের মর্মবাণীগুলো আমাদের ভেতরেই অকৃত্রিমভাবে বেড়ে উঠা উচিত। তা নইলে কৃত্রিমতা দিয়ে শুধু আস্ফালনই সম্ভব, মানুষের মন জয় করা যায় না।

এই কারণেই কট্টর মৌলবাদী বাংলাদেশের মুসলমানদের মনে হয় না, তারা এই ভূ-খন্ড জাত বা সত্যিকার অর্থে এই ভূ-খন্ডকে তাদের চেতনায় ধারণ করে। ধর্মের নামে বিজাতীয় আরবীয় সংস্কৃতিকে নিজেদের সংস্কৃতির উপরে গুরুত্ববহ করে তুলে। চেতনা এবং আত্মসম্মান যদি কোন উদ্দেশ্যে জিম্মি হয়ে পড়ে, তখন আর নিজের কিছুই থাকে না। বিবেকের মৃত্যু হলে হৃদয়ের ভেতর বসবাসকারী মানুষটি আর নিজেকে চিনতে পারে না। মাতৃভাষাকেও অবলীলায় একসময় আর নিজেদের ভাষা বলে মনে হয় না।

***