ভাঙাগড়ার অম্লান স্মৃতির শহীদ মিনার

আনোয়ার কবির
Published : 24 Oct 2011, 02:29 PM
Updated : 21 Feb 2017, 11:09 AM

২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, বৃহষ্পতিবার। বাঙালির ইতিহাসে রক্তের অক্ষরে লেখা দিন। ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে অন্ততপক্ষে ৮ জন শহীদ হন। ২২ ফেব্রুয়ারি মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নেন যে, যে জায়গায় গুলি বর্ষিত হয়েছে সেখানেই রাতারাতি এই অমর শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে শহীদ মিনার গড়ে তুলতে হবে। স্বতঃস্ফুর্তভাবে গড়ে উঠেছিল এর পরিকল্পনা– দলমতনির্বিশেষে সকল ছাত্র শহীদ মিনার তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

সাঈদ হায়দারের নকশা ও ঢাকার মেধাবী মেডিকেল ছাত্র বদরুল আলমের লেখার উপর ভিত্তি করে ২২ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে শহীদ মিনার তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ২৩ তারিখ সকাল থেকে শুরু করে সারারাত কার্ফু থাকা সত্ত্বেও সেখানে কাজ হয়। ইট-বালির অভাব ছিল না।

২৫ ফেব্রুয়ারি নুরুল আমীন সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শহরের সমস্ত ছাত্রাবাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। ২৬ ফেব্রুয়ারি দুপুর ও অপরাহ্নের মধ্যেই সর্বত্র থমথমে পরিস্থিতি অবস্থায় নাজিমুদ্দিন-নুরুল আমীনের মুসলিম লীগ সরকারের সশস্ত্র বাহিনী আক্ষরিকভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেয় বাঙালির অন্তরের প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ শহীদ মিনারটি। কিন্তু এরই মধ্যে সমস্ত বাঙালির অন্তরে গেঁথে গিয়েছিল এই স্মৃতির মিনার। যার পরিস্ফুটিত রূপ পাওয়া যায় তৎকালীন সময়ে আলাউদ্দিন আল আজাদের লেখায়:

স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু
আমরা এখনো চার কোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তো! যে ভিৎ কখনো কোন রাজন্য পারেনি ভাঙতে
….. …..
ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক। ভয় কি বন্ধু
আমরা জাগরী চার কোটি পরিবার।

১৯৫২ সালের পর থেকে প্রতি বছরই ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসরূপে পালন শুরু হয়। ১৯৫৪ সালে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট সরকার। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে আবুল হোসেন সরকারের মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে বর্তমান শহীদ মিনারের স্থান নির্বাচন ও ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপিত হয়। কিন্তু কাজ বিশেষ অগ্রসর হয়নি। কারণ সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ার দিকে তাঁর নেতৃত্বাধীন কৃষক-শ্রমিক পার্টির মন্ত্রিসভার পতন ঘটে।

ইতোমধ্যে, ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সংবিধানে বাংলাকে উর্দুর সঙ্গে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আবুল হোসেন সরকারের পতনের পর ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ আতাউর রহমান খানের মুখ্যমন্ত্রিত্বে প্রথম আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হলে, বাংলা একাডেমি এবং শহীদ মিনারের কাজ শুরু হয়। প্রাদেশিক সরকারের তদানীন্তন চিফ ইঞ্জিনিয়ার আবদুল জব্বারের উপর একটি স্থায়ী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে।

সেই অনুসারে পরিকল্পনা আহ্বান করা হয়। শিল্পী হামিদুর রহমান তখন বিদেশে শিল্পকলায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর দেশে ফিরে এসেছেন। শিল্পী জয়নুল আবেদিনও প্রধান প্রকৌশলী হামিদুর রহমানকে শহীদ মিনারের পরিকল্পনা পেশ করতে অনুরোধ করেন। এর প্রেক্ষিতে হামিদুর রহমান শহীদ মিনারের একটি পরিকল্পনা, বায়ান্নটি নকশা ও একটি মডেল পেশ করেন। বিভিন্ন শিল্পী এবং স্থপতিও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু শিল্পী জয়নুল আবেদিন, গ্রিক স্থপতি ডস্কিয়াডেস ও প্রধান প্রকৌশলী আবদুর জব্বার সমন্বয়ে গঠিত নির্বাচক কমিটি শিল্পী হামিদুর রহমানের নকশাটি গ্রহণ করেন।

হামিদুর রহমানের নকশাটি গ্রহণ করা হলেও কখনও এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটেনি। সাংবাদিক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর শিল্পী হামিদুর রহমানের সঙ্গে একটি সাক্ষাতকারভিত্তিক প্রতিবেদনে প্রকাশ করেন তৈরিকৃত শহীদ মিনারটি মূল নকশার একাংশ। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়:

"… পরিকল্পনায় ছিল এই স্তম্ভগুলোর মধ্যে অজস্র চোখের নকশা থাকবে। লেবু হলুদ আর গাঢ় নীল রংএর স্টেইন্ট গ্লাসে তৈরি হবে চোখগুলো… মিনারের সামনে প্রশস্ত জায়গাতে থাকার কথা ছিল মার্বেল পাথর। এই পাথরের স্টেইন্ট গ্লাসের বিভিন্ন রঙিন চোখের আলোকিত প্রতিফলন পড়লে সূর্যের সাতরঙা বর্ণালী রঙ মেঝেতে সৃষ্টি হত। পুরো মিনারটির সামনে একটি রেলিং থাকার কথা ছিল। রেলিংটা আগাগোড়া বর্ণমালা দিয়ে তৈরি হবে। 'একুশে ফেব্রুয়ারি, তোমায় কি ভুলিতে পারি'– এই কথাটা বারবার রেলিংয়ে লেখা থাকার কথা ছিল… যে প্রশস্ত জায়গাটি মিনারের সামনে রয়েছে সেখানে বেশ কিছু রক্তমাখা পায়ের ছাপ শহীদের স্মরণে, আর কিছু বিশাল কালো পায়ের ছাপ দানবের প্রতীক হিসেবে থাকার কথা ছিল।

… আর এই মিনারের পাশেই থাকবে একটা বাংলা সাহিত্যের পাঠাগার… সেই পাঠাগারের দেয়ালে তৈলচিত্র থাকার কথা ছিল। মিনারের সামনে থাকার কথা ছিল সুন্দর এক ঝর্ণা। চোখের মতো অনেকটা দেখতে হবে এর আকৃতি। কালো বিরাট চোখটাই একটা ঝর্ণা। অনবরত অশ্রুর মতো ঝরবে। সেই পানি আবার জমা থাকবে। মনে হবে যেন মহাকাল থেকে ঝরছে এই অশ্রুধারা।

এই ঝর্ণার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় ভবনটির প্রায় পাঁচিল ঘেঁষে আবার মিনারের মতো একটা উঁচু বেদি উঠে যাবার কথা। যাতে দুইদিকে ঢেউয়ের প্রতিক্রিয়া থাকে এবং একটা বিশাল এলাকাজুড়ে শহীদ মিনারের অস্তিত্বটা টের পাওয়া যায়। মিনারগাত্রে স্টেইন্ট গ্লাসের চোখ থেকে মেঝের মার্বেল পাথরে যে বর্ণালী ছটা পড়বে তাতে রঙের একটা কাল্পনিক ঘড়ি শিল্পী হামিদুর রহমানের করা শহীদ মিনারের মূল নকশা খাড়া করা যেতে পারে। যেমন আটটা বাজলে বেগুনী রং, বারটাতে নীল, পাঁচটায় কমলা রং এমনি। দেখতে দেখতে ঘড়ির রং পরিচিত হয়ে যেত।

আর একটা ঘড়ি থাকার কথা ছিল উঁচু টাওয়ার ঘড়ি… সময়গুলো বাংলা সংখ্যায় লেখা হত। শহরের একটা প্রধান সময় দেখার কেন্দ্র… মিনারের ঘড়ি দেখা একটা দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হয়ে যেত। এক হাজার স্কোয়ার ফুটের একটি ম্যুরাল পেইন্টিং যেটা মিনারের ভিতরের কুঠুরিতে থাকার কথা…

যদি এই পেইন্টিংটা হত তাহলে এটা হত পৃথিবীর দীর্ঘতম পেইন্টিংগুলোর অন্যতম… পেইন্টিংটার দুটো স্তরের কাজ মাত্র বাকি ছিল।"

সে যাই হোক, ডিজাইন অনুমোদিত হওয়ার পর বাস্তবায়নের সময় শিল্পী হামিদুর রহমান কর্তৃপক্ষকে জানান যে, তাঁর পক্ষে বাসায় অবস্থান করে শহীদ মিনারের কাজ করা সম্ভব নয়। তাই মিনারের কাছাকাছি দুটো বেড়ার ঘর তৈরি করা হয়। একটিতে তাঁর থাকার ব্যবস্থা ছিল এবং অপরটি ছিল কারখানা। চব্বিশ ঘণ্টা কাজের সুবিধার জন্যেই এই ব্যবস্থা করেন তিনি।

সাতান্ন সালের নভেম্বরে শিল্পী হামিদুর রহমান ও নভেরা আহমদের সহযোগিতায় শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ শুরু হয়। একটানা কাজের মধ্য দিয়ে আটান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারির মধ্যে শহীদ মিনারের ভিত, মঞ্চ ও তিনটি স্তম্ভ নির্মিত হয়। এর মধ্যে ভাষা আন্দোলনের ওপর হাজার বর্গফুটের একটি ম্যুরাল চিত্রের দুই স্তরের কাজ হামিদুর রহমান শহীদ মিনারের বেদির নিচের ঘরে সমাপ্ত করেন। একাত্তরের মার্চ মাসের শেষের দিকে পাকিস্তানি বাহিনী শহীদ মিনার ধ্বংস করার সময় ওই মূল্যবান ম্যুরালটি ধ্বংস করে দেয়।

এছাড়া পরিকল্পিত শহীদ মিনারের জন্যে শিল্পী নভেরা আহমেদ তিনটি ভাস্কর্যের কাজও এই সময়ে শেষ করেন। একাত্তরের ধ্বংসযজ্ঞের পরও এই অবিস্মরণীয় ম্যুরালের কিছু অংশ অবশিষ্ট ছিল যা বাহাত্তরের মিনার পুননির্মাণের সময় কে বা কারা সম্পূর্ণ মুছে ফেলে।

শিল্পী হামিদুর রহমানের তত্ত্বাবধানে সাতান্ন সালের নভেম্বর থেকে আটান্ন সালের মার্চ মাস পর্যন্ত দ্রুতগতিতে বিরামহীনভাবে কাজ এগিয়ে চলে। এর মধ্যে আটান্ন সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত হয় অসমাপ্ত শহীদ মিনারের ছায়ায়।

সাতান্ন সালের মার্চ মাসে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে শহীদ মিনারের নির্মাণকাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হয়। অক্টোবরে আইউব খানের সামরিক অভ্যুত্থানের প্রথম দিনই শিল্পী হামিদুর রহমানকে শহীদ মিনার প্রাঙ্গন থেকে বহিষ্কার করে স্টুডিও ঘরে একটি বড় তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। আটান্ন থেকে বাষট্টি, এই পাঁচ বছর অসম্পূর্ণ শহীদ মিনারেই প্রতি বছর পালিত হয়েছে শহীদ দিবস।

বাষট্টি সালের সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল আজম খান শহীদ মিনারের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মাহমুদ হাসানকে সভাপতি করে চৌদ্দ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটিতে অন্যান্যের সঙ্গে ছিলেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মমতাজ উদ্দিন আহমদ, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ মুহাম্মদ আবদুল হাই, ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, বাংলা একাডেমির পরিচালক সৈয়দ আলী আহসান, ইসলামিক একাডেমীর পরিচালক আবুল হাশিম এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব প্রদান করা হয়।

এই কমিটির কর্মপরিধির অন্যতম শর্ত ছিল, বাষট্টি সালের ১ মে তারিখের মধ্যে শহীদ মিনার নির্মাণ সম্পর্কে সুপারিশ পেশ। কমিটি হামিদুর রহমানের মূল নকশা অনুসারে সহজ ও সংক্ষিপ্ত আকারে শহীদ মিনারের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার সুপারিশ করে।

কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী দ্রুত নির্মাণকাজ শুরু হয়ে যায় এবং পরবর্তী শহীদ দিবসের আগেই অর্থাৎ ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৩ সমাপ্ত হয় শহীদ মিনারের কাজ। তড়িঘড়ি ঠিকই সমাপ্ত হয় কাজ, কিন্তু বাদ পড়ে যায় অনেক কিছু। তবু মন্দের ভালো হিসেবে গৃহীত হয় এই মিনার। মূল পরিকল্পনায় চোখের নকশা নবনির্মিত শহীদ মিনারে বাদ পড়ে এবং সে সব জায়গায় লোহার শিক ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। আরও বাদ পড়ল সূর্যের প্রতিফলন ভাস্কর্য ঝর্ণা ঘড়ি এবং ম্যুরাল।

১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ আবুল বরকতের মা বাহাত্তর বছর বয়স্ক হাসিনা বেগম মিনারটির উদ্বোধন করেন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭১, এই নয় বছর শহীদ মিনারই ছিল বাঙালির প্রাণকেন্দ্র, সংগ্রামে অনুপ্রেরণার উৎস। আর তাই স্বাধীনতার প্রথম লগ্নে, ছাব্বিশ ও সাতাশে মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ভারী গোলাবর্ষণ করে শহীদ মিনারের স্তম্ভগুলো ধ্বংস করে দেয়। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক প্রয়াত শিল্পী আমিনুল ইসলামের কাছ থেকে জানা যায় (বর্তমান লেখকের সঙ্গে ১৯৯৭ সালে গৃহীত সাক্ষাৎকার), পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে শহীদ মিনারে 'মসজিদ' লিখে একে ধর্মীয় উপাসনালয়ে পরিণত করেছিল।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। একদিন যে শহীদ মিনার কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বাঙালির সংস্কৃতি, কৃষ্টিরক্ষার আন্দোলন– বাংলাদেশের সৃষ্টি তারই বাস্তব রূপ। তাই শুরু হয় শহীদ মিনার পুননির্মাণের নব পর্যায়। সে জন্য জানুয়ারি ১৯৭২এ রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে সভাপতি করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি বিধ্বস্ত শহীদ মিনারটি মহান ও উপযুক্তভাবে পুননির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। জাতীয় প্রতীক হিসেবে বৃহত্তর পরিবেশে মিনারটি প্রতিষ্ঠিত করতে আরও জমি অধিগ্রহণ করা হয়। দেশীয় স্থপতিদের মধ্যে আহ্বান করা হয় ডিজাইন প্রতিযোগিতার। এই উদ্দেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবকে সভাপতি করে গঠিত হয় প্রতিযোগিতা সাব-কমিটি। এ কমিটি প্রতিযোগিতার বিধিমালা প্রণয়ন করে। ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ বিজয়ী প্রতিযোগিতার নাম ঘোষণার তারিখ নির্ধারিত হয়।

পত্রিকার ঘোষণা পড়ে শিল্পী হামিদুর রহমানও সাড়া দেন। নিজে স্থপতি না হওয়ায় ঢাকার অন্যতম পুরাতন একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা অংশীদার স্থপতি এমএস জাফরের সঙ্গে একটি যৌথ কোম্পানি গঠন করেন তিনি। এই কোম্পানি প্রচুর পরিশ্রম করে প্ল্যান, ডিজাইন ও মডেল প্রস্তুত করে যা হামিদুর রহমানের মূল পরিকল্পনা অনুসারেই করা হয়। কারণ আদি শহীদ মিনারের রূপ ও আঙ্গিক জাতীয় চেতনায় গাঁথা হয়ে যাওয়ায় নতুন মিনারটি তার আবহ থেকে বিচ্যুতি করা কারও আকাঙ্ক্ষিত ছিল না। আরও সতের-আঠার জন প্রতিযোগীর সঙ্গে ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ কোম্পানিটি তাদের প্ল্যান জমা দেয়। নির্দিষ্ট সময়ে বিজয়ীর নাম আর ঘোষিত হল না।

এসে যায় স্বাধীনতার পর প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারি। ভগ্ন শহীদ মিনারেই উদযাপিত হয় প্রথম একুশ। অবশেষে তিয়াত্তরের ৫ মে তৎকালীন পূর্ত সচিবের অফিস কক্ষে অনুষ্ঠিত এক সভায় হামিদুর রহমান ও এমএস জাফরের পেশকৃত নকশাটি অনুমোদন করা হয়। এটির কাজ সম্পন্ন হয় এরশাদ আমলে। তবে এই শহীদ মিনারেও মূল পরিকল্পনার পুরোপুরি প্রতিফলন ঘটেনি।

কবি-উপন্যাসিক আলাউদ্দিন আল আজাদ শিল্পী হামিদুর রহমানের কাছ থেকে জানতে পারেন যে, শহীদ মিনারের স্তম্ভগুলো মা ও সন্তানের প্রতীক। অর্ধবৃত্তাকারে মা তাঁর শহীদ সন্তানদের নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। যাঁরা তাঁর মর্যাদা রক্ষার জন্যে প্রাণ দিয়েছেন, তাদেরকে যেন অনন্তকাল ধরে রক্ষা করছেন। তাঁর মাথা একটু ঝুঁকে আছে। আত্মত্যাগের মহিমায় চারটি সন্তানের মধ্য দিয়ে যেন তিনি লক্ষ কোটি সন্তানকে দেখছেন।

শহীদ মিনার সর্বদা আমাদের সমস্ত প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ছিল। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের সময় উত্তাল আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শিল্পী ইমদাদ হোসেন, মোস্তফা মনোয়ার, রফিকুন নবী, আনোয়ার হোসেন শহীদ মিনারে 'বিদ্রোহী বর্ণমালা' শিরোনামে সিরিজ করেছিলেন। স্বাধীনতার পর সর্বশেষ ১৯৭৫এ করা হয় 'বিশুদ্ধ বর্ণমালা'। ১৯৭৫এর পর শহীদ মিনারের কার্যক্রম সরকারের তরফ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু হলে এর প্রতিবাদে শিল্পী সমাজ ১৯৭৬এ শহীদ মিনার থেকে আলাদা হয়ে টিএসসি চত্বরে এর আয়োজন ভিন্নভাবে করেছিল।

কালের বিবর্তনে আজ এটি অবহেলায় শেষ হয়ে গেছে। প্রয়াত শিল্পী ইমদাদ হোসেন আমাকে (১৯৯৭ সালে বর্তমান লেখকের সঙ্গে) এক সাক্ষাতকারে জানান, শহীদ মিনার পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব পূর্ত মন্ত্রণালয়ের। আর এর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। এই দুটি সংস্থার কোনোটি কি তাদের দায়িত্ব পালন করছে? সেদিন ক্ষোভের সঙ্গেই কথাগুলো উচ্চারণ করেছিলেন তিনি।

ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক প্রয়াত শিল্পী আমিনুল ইসলামের ধারণা, (বর্তমান লেখকের সঙ্গে ১৯৯৭ সালের সাক্ষাতকারে) বর্তমান প্রজন্মকে শহীদ মিনার এখন আর ততটা উদ্বীপ্ত করে না। আর তাই হয়তো বিশেষ দিন ব্যতীত শহীদ মিনারের প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করেন না।

শিল্পী কাইয়ূম চৌধুরীর মন্তব্য অবশ্য ছিল একটু ভিন্ন রকমের। তাঁর মতে, শহীদ মিনার এখনও আমাদের জাতীয় চেতনা অনুপ্রাণিত করে। প্রতীক হিসেবে এটি আমাদের মননে ঢুকে গেছে। আর তাই দেশের সর্বত্র আনাচে-কানাচে শহীদ মিনারের অনুসরণে শ্রদ্ধার জন্যে শহীদ মিনার গড়ে উঠেছে।

রাশিয়ার রেড স্কোয়ারের কথা বলব। লেনিনের সমাধি রেড স্কোয়ারের সামনেই বাংলাদেশের শিখা চিরন্তনের মতো স্থাপিত রয়েছে প্রতীক, 'মনুমেন্ট অব আননোন সোলজারস'। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ দেওয়া নাম-না-জানা শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে তৈরি এই চিরন্তন প্রতীক প্রতিদিন ফুলে ফুলে ভরে যায়। নববিবাহিত দম্পতিরা বিবাহের পরই উপস্থিত হন এই মনুমেন্টে, ফুল দেন সেখানে। সামাজিক রীতি হিসেবে প্রচলিত হয়ে গেছে এই ফুল দান। হৃদয়ের শ্রদ্ধাঞ্জলির ফুলই বর্ষিত হয় প্রতিদিন এই মনুমেন্টে।

ভাষাশহীদদের স্মৃতিসৌধ শহীদ মিনার প্রাঙ্গন যাদুঘর হিসেবে আকর্ষণীয়ভাবে সাজানো যেতে পারে। সক্রিয় সরকারি উদ্যোগ, শহীদ মিনারকেন্দ্রিক বিভিন্ন পরিকল্পনা, বিদ্যালয়কেন্দ্রিক বাৎসরিক একাধিক প্রোগ্রাম ও সর্বোপরি সতর্ক নজরই রাশিয়ান 'মনুমেন্ট অব আন নোন সোলজার'এর মতো মূল্যবান করে তুলতে পারে আমাদের শহীদ মিনারটিও।