মায়ার খাতায় স্বপ্নের আঁকিবুঁকি…

আহসান হাবীব কাজল
Published : 15 August 2012, 04:32 PM
Updated : 15 August 2012, 04:32 PM

লেখার খাতাটায় ধুলোর পুরু আস্তর পড়ে গেছে, মলাটটাতে মনে হয় খানিকটা মলিন আভা ফুটে উঠেছে, এককোণে শুধু নি:সঙ্গ কলমটাকে দেখেই মনে হচ্ছে যেন বহু প্রহর ধরে আমার অপেক্ষায় অমলিন তাকিয়ে আছে। বহুদিন পড়ে আজ আনমনে লেখার খাতাটায় কয়েক বিন্দু স্বপ্ন আঁকতে ইচ্ছে করছে। আমার খাতা, কলম আর আমিতে সবচেয়ে মজার যে খেলাটা খেলি তার নাম হল স্বপ্নের আঁকিবুকি খেলা। আজ খেলাটা খেলতে ইচ্ছে হতেই হঠাৎ মেঘভাঙ্গা এক ঝলক রোদের মত অঞ্জন এর কথা মনে পড়ে গেল।স্বপ্নবাজ অঞ্জন, উহু স্বপ্নবাজ শব্দটা ঠিক যায়না বলা চলে স্বপ্নের ফেরীওয়ালা।

কথা বলার ব্যপারে আমাকে বোধহয় কেউ হারাতে পারবেনা, একবার বকতে শুরু করলে বকতে থাকি, আমার কথার তুবড়ী ছোটানো সুন্দরবন এক্সপ্রেসের মাঝে অঞ্জনের পরিচয়টা দিয়ে দেয়া যাক। অঞ্জন, স্বপ্ন ভাঙ্গা গড়ার কারখানা ঢাকা শহরের এক কোনায় গড়ে ওঠা অভিজাত সেগুনবাগিচা বস্তির নি:স্ব, অসহায়, ঠিকানাবিহীন ফুটফুটে শিশু, পদার্থবিজ্ঞানের আপেক্ষিক তত্ত্ব মতে তার বয়স ৫০/৬০/১০০ কিন্তু প্রকৃত বয়স ১২। আমাদের অঞ্জন, আমাদের!!!!!!!!!

বোধ করি কুলীন সমাজের কাছে অদ্যাবধি একগাধা প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে, খেলাটা যেহেতু আমি খেলছি তাই দর্শক হিসেবে কুলীন সমাজকে খেলার নিয়মটা বোঝানো আমার দায়িত্বের মাঝে পড়ে আর কি। আপনারা হয়তো ভাবছেন বস্তি সেও আবার অভিজাত, গরীবের ঘোড়ারোগ আর কাকে বলে? আসলে আমি অভিজাত বলেছি এই ভেবে যে এই একটা মাত্র বস্তি যেখানে মুদ্রার এপিঠ আর ও পিঠ এত কাছ থেকে দেখা যায় যা এ ভূ-মণ্ডলে আর কোথাও দেখা যায় কিনা তা নিয়ে আমার অন্ত:ত সংশয় আছে। সেগুনবাগিচা মূল সড়ক দিয়ে একেরপর এক দামী গাড়ী ছুটে চলে আর তার একপাশে নামকরা হাউজিং এর নির্মাণ করা সারি সারি সুখ অট্টালিকা আর রাস্তার এপারে দু:খের ঘনবসতি। মাঝে মাঝে এ অধমের যখন এ রাস্তা দিয়ে যাবার সৌভাগ্য হয় আমার যৎসামান্য জ্ঞানে একটা কথাই মনে পড়ে, মানিক বন্দোপাধ্যায় তার বিখ্যাত পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে অতি সত্য একটি কথা বলেছিলেন, বোধ করি ঈশ্বর বাস করেন ঔ ভদ্র পল্লীতে, দু:খী শিশুর করুণ আর্তনাদ এপার হতে বিধাতার কানে গিয়ে পৌছায় না কোনদিন। সঠিকভাবে আমার উক্তিটি মনে নাই তাই শেষাংশ নিজে বানিয়েই কাছাকাছি গোছের করে ঝেড়ে দিলাম। ক্ষমা করবেন মানিক বাবু।

আরো একটি শব্দ নিয়ে হয়তো ওজর আপত্তি উঠতে পারে, তা হল ফুটফুটে। বস্তি অভিজাত তাও না হয় মেনে নেয়া যায় কারণ গোলাপ ফুল গাছের গোড়ার মাটির ঘ্রাণও তো গোলাপের মত হয়। কিন্তু ফুটফুটে!!! এ কি করে হয়? আসল সত্যটা হল, আমাদের অঞ্জন এর গায়ের রং টা একটু ধবল প্রকৃতির, কিন্তু বাস্তবতার নির্মম ময়লাগুলো জমে সে ধবল রং খানিকটা নিকষ হয়ে গেছে, নিত্যনতুন পণ্যাদি আর আরাম আয়েশের ব্যবস্থা থাকলে, সোজা কথায় রাস্তার এপার হতে ওপারে নিয়ে রাখলেই হয়তো ফুটফুটে শব্দটা অঞ্জনের জন্য কম হয়ে যেতো।

সব প্রশ্নের মোটামুটি একটা যুতসই উত্তর মিললেও একটি প্রশ্নের কিন্তু উত্তর কোনভাবেই খুজে পাওয়া যাচ্ছে না, সেটা হলো, সব না হয় হল, কিন্তু আমাদের অঞ্জন, আমাদের অঞ্জন বলা হচ্ছে কেন? শেষমেশ তেল জল কি তাহলে মিলে গেল, রসায়ন বিদ্যা বোধহয় এবার পুরোপুরি দ্রবীভূত হয়ে গেল। আসলে আমার ধারণা, স্বপ্ন গুলো জমা হবার জন্য একটা মাঠ আছে, আর সেই মাঠে সকলের সমান অধিকার, আঁকিবুকি খেলায় কারো স্বপ্ন জিতে যায় আর কারোটা হারে, আবার কিছু স্বপ্ন মাঠে নামার সুযোগই পায়না। যেহেতু স্বপ্ন নিয়ে খেলছি, তাই স্বপ্ন দেখবো বলে অঞ্জন কে আমার সাথেই নিয়ে চললাম, এতে ভদ্র সমাজ যদি আমার সাথে আঁকিবুকি খেলাটা নাও খেলে তবুও কোন আপত্তি নাই।

অনেক হয়েছে জ্ঞানের ফুলঝুড়ী, এবার আসল কথায় আসা যাক, অঞ্জনের জন্ম পরিচয়টা আমার ঠিক জানা নাই, ওর সাথে আমার পরিচয় শাহবাগ মোড়ে, বিশ্ববিদ্যালয় বাসে করে যাচ্ছিলাম, সেদিন বারডেম হাসপাতালের সামনে জ্যামে পড়তেই দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন নিয়ে এক পিচ্চি বাস এর গেট দিয়ে লাফ দিয়ে উঠে পড়লো। এখানে একটু বলে রাখা ভালো যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে আমরা যারা ভাগ্যদোষে কাকঝোলা হয়ে যাই তারা খুব সচেষ্ট থাকি বাসের নিরাপত্তা অক্ষুন্ন রাখার ব্যপারে কারন এতে দু'ধরনের উপকার হয়। এক, একটু ক্ষমতা ক্ষমতা ভাব দেখানো হয় অন্য ছেলেদের সামনে আর নীচতলায় বসা মেয়েদের সামনে একটু হিরোইজমও ফোটে বৈকি। স্বভাবসুলভ ক্ষিপ্রতায় সেদিন সেই পিচ্চিকে টান মেরে বাসের গেটে আটকে দিয়েছিলাম আমি এবং আমার সাথে বাদুরঝোলা গোটাকয়েক নগুরে হিরো। পিচ্চিটা থেমে গিয়ে আমার মুখের দিকে এমন একটা করুণ চাহনি দিয়ে বললো যে, ভাইয়া কয়টা প্যাপার বেচি? সকালে নাস্তা করুম। জানিনা পিচ্চির বলা কথাগুলো আর সেই নিষ্পাপ চাহনিটা সহজাত অভিনেতার নিখুঁত অভিনয় ছিলো নাকি সত্যিকারে বাস্তবতা ছিলো, কিন্তু আমাকে কেন যেন সেদিন ভীষণ নাড়া দিয়ে গিয়েছিলো। কলারটা ছেড়ে দিয়ে বললাম, যা বেচ, কিন্তু দ্রুত, ও কে ? তারপর পিচ্চির দেয়া সেই হাসিটা যদি নিলামে ওঠানো যেত তবে তার মূল্য দিয়ে আমি এ ধরা কিনে নিতে পারতাম। এক কথায় যদি বলি স্বর্গীয় সে হাসি।

পিচ্চির পেপার বিক্রি করতে করতেই সিগন্যাল ছেড়ে দিলো। একটানে বাস টি.এস.সি। বাস থামতেই পিচ্চি একলাফে নেমে গেলো। পেছন থেকে কোন এক অজানা মায়া যেনো তার তীব্রতা দিয়ে আমার ক্লাস করার তীব্রতাকে মেরে ফেললো।
পেছন থেকে ডেকে বললাম, অ্যাই শোন্ ।
কি? ভ্রুকুটি ভরা উত্তর পিচ্চির।
এইদিকে আয়, ডাকলাম আমি। তুই না বললি সকালে নাস্তা করবি, চল তোরে নাস্তা করাবো। চল্, বললাম আমি।
ভেবেছিলাম বাংলা ছবির মত একটা ভাব নিয়ে বলবে, না
কিন্তু কিসের না সোজা বলে বসলো, চলেন।

সেদিন আমি আর পিচ্চি হাকিম চত্বরে অনেকটা সময় বসেছিলাম। তখনই জানতে পারলাম, ওর নাম অঞ্জন। এত কঠিন আর বই পুস্তকের নাম কে রেখেছে তা তার জানা নাই। তবে নাম বটে একখান, অনেকে তো থমকে যায় এই ভেবে যে, এই নাম এর সাথে এলো কি করে? কথা বলতে বলতেই জানতে পারলাম, বাবা মা এর কথা অঞ্জনের মনে পড়ে না, বাবা- মা কেমন হয় এটা নিয়ে তার খুব একটা ভাবাবেগ ও নাই। ও শুধু জানে ক্ষুধা লাগলে তার মাথা ঠিক থাকে না। দুনিয়া আন্ধার লাগে। আর মাঝে মাঝে অমাবস্যার রাইতে ঘুমানের সময় ডর লাগে কারন আকাশটারে খুব কালো দেখায়, পাশের সুখ অট্টালিকার নিয়ন আলো সে অন্ধকার গ্রাস করে উঠতে পারে না। আর মাঝে মাঝে কেউ মারধর করলে খুব উল্টো মারতে ইচ্ছে করে। আমার গলা পর্যন্ত কথাটা চলে আসলেও মনটা বলতে দিলো না যে, মা হল তাই ক্ষুধা লাগলে আন্ধার দুনিয়ায় যেমনেই হোক চারডা খাওনের ব্যবস্থা করে, মা হল সেই যে অমাবস্যার রাতে বুকের মাঝে ভালোবাসার আলোয় সব অন্ধকার দুর করে দেয়, আর বাবা হল সেই যে সন্তানের এক ফোটা হাহাকারের বিপরীতে নিজের জীবন বাজি রাখে। বলা হলো না আমার এই ভেবে যে, এতটুকুন বাচ্চার মনে আর অপ্রাপ্তির সুর বাজিয়ে লাভ কি? এ বয়সে প্রকৃতি তার সাথে এত বেশী করুণ লয় আর বাদ্য বাজিয়েছে যে সেখানে আমার বলা কথাগুলো শুধু নতুন করে কষ্টের ছুরিটাকে আরো শানিত করা ছাড়া আর কিছুই করবে না। যে অনুভুতি পাওয়াই হয় নাই সেই অনুভূতি না পাবার বেদনা বুঝিয়ে কি লাভ?

সেদিন আর তেমন কথা হয় নাই, বেশ বেলা গড়িয়ে গিয়োছিলো, হঠাৎ ছেলেটা লাফ দিয়ে উঠে বললো, ভাই কয়ডা বাজে?
আমি বললাম, বারোটা।
হায়, হায় কন কি? আইজ উপাস করোন লাগবো ? এহনো সব প্যাপার পইড়া আছে। ভাই যাই, বলেই কলা ভবনের সামনের গেট দিয়ে ভোঁ দৌড়।
এরপর প্রায়ই শাহবাগ সিগন্যালে অঞ্জনের সাথে দেখা হতো, আমার দূর্বলতার সুযোগে কিনা জানিনা অতটুকুন বাচ্চাকে প্রকৃতি এটা শিখিয়েছিলো যে, এই মানুষটা তার প্রতি সদয়। তাই সে আমাকে দেখা মাত্র কারো অনুমতির তোয়াক্কা না করে বাসে উঠে পেপার বিক্রি করা শুরু করে দিত। বিনিময়ে আমি অবশ্য বেশ বড় মাপের একটা কমিশন পেতাম। তার সেই ভূবন ভোলানো হাসি। অমন হাসির সামনে আমার কঠিন মনটা সবসময় মাথা নীচু করে থাকতো।

আমার স্পষ্ট মনে পড়েনা , সম্ভবত কোন এক বর্ষায় ভার্সিটি যাচ্ছিলাম। ছেলেটার সাথে পুরানো সেই জায়গায় দেখা। বেশ মন খারাপ মনে হল। ডাক দিলাম, অ্যাই অঞ্জন, এদিক আয়, দৌড় দে, গাড়ি ছেড়ে দেবে। একটু ধীরলয়ে এসে গাড়িতে উঠলো। জিজ্ঞেস করলাম, কিরে? আজ পেপার বিক্রি করবি না?

বললো বৃষ্টিতে অর্ধেক পেপার ভিজে গেছে। বলার ধরনটার মাঝে কি এক দরদ ছিলো জানি না আমি তো আমি আমার আশেপাশের ছেলেগুলো পর্যন্ত চুপ করে গেলো। আমি কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কিছু একটা তো বলতে হয়, মুখ খুলতেই আবার অঞ্জন বলে উঠলো, " ভাই আইজ সারাদিন না খাইয়া থাকতে হইবো, আল্লাহয় আমাগো লেইগ্যা কেন বৃষ্টি দেয়, খাইবার তো দেয় না এক বেলা।"
আসলেই তো, কি বলবো?
অযাচিত মনেই বলে বসলাম, আচ্ছা যা আজ আমি তোরে খাওয়াবো, খুশী ?
হঠাৎ বিদ্যুৎ চমক, আমি শুধু বলতে পারি যে অঞ্জনের মুখে যে চমক ফুটে উঠেছিলো তার কাছে বিদ্যুৎ চমকটা হার মেনেছিলো সেদিন, আমার অন্ত:ত তাই মনে হয়েছে।
সেদিন সারাদিন অঞ্জনের সাথে ছিলাম। সকালের নাস্তা হাকিমে আর দুপুরের খাবার টা টি.এস.সি এর ক্যান্টিনে। এক প্লেট ভাত, এক টুকরো মাংস আর আলুভর্তা সাথে এক বাটি ডাল যে মানুষকে এতখানি তৃপ্তি দিতে পারে তা আমার জানা ছিলো না। আমি তো কোন দিন এর মাহাত্মই বুঝি নাই। সেদিন অনেক কথা হয়েছিলো অঞ্জনের সাথে। ওর থেকে শুনলাম কিভাবে ও পেপার বিক্রি করে, কিভাবে আনে। অঞ্জন সেগুনবাগীচা বস্তিতে যে পানির পাম্প আছে তার কর্ণারে একটু জায়গা আছে সেখানেই থাকে। ও একা না ওর মত অরো কয়েকজন আছে যাদের কোন ঠিকানা নাই তারা সবাই মিলে এই ঠিকানাটা বানিয়ে নিয়েছে। আমাদের অঞ্জনের রুটিন হলো রোজ সকালে ৬:০০ টা বাজতেই ঘুম থেকে চোখ কচলাতে কচলাতে ভো দৌড় কারওয়ান বাজারের দিকে। প্রথম আলো অফিসের সামনে সকালে হকারদের মাঝে কাগজ বিলি করা হয়।কাগজ নিয়ে ওরা বিক্রি করে পরে মহাজনকে টাকা দেয়। প্রতি কাগজে ৫০পয়সা লাভ। পারলে কিছু বেশী। কিন্তু এই কাগজ পেতেও মহা ঝক্কি কারন এই স¦প্নের শহরে হাজার হাজার অঞ্জন ঘুরে বেড়ায়। কোনদিন যদি ভুলেও ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরী হয় সেদিন আর কাগজ পাওয়া হয় না। সারাদিন উপোস। বহুদিন অঞ্জনের উপোসে কেটেছে ঘুম ভাঙ্গতে দেরী হওযায়। কারন সে স্বপ্ন দেখছিলো হয়তো প্লেটভরা গরম ভাত না হয় অন্ধকারে তাকে জাবরে ধরে আছে কালা ভূত। ১০০ কাগজ বিক্রি করলে ৫০টাকা থাকে। সকালের নাস্তা ১০ টাকা, দুপুরে চারুকলার সামনের ফুটপাতে ১৫টাকায় ডাল-ভাত আর রাতে সবাই এক হয়ে কিছু টাকা একত্র করে আলু, ডাল, চাল কিনে সবার জন্য গণ রান্না।

সেদিন পকেটে টাকা ছিলো তাই অঞ্জনের স্বপ্নগুলো একদিনের জন্য পূরণ করতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। আর আমাদের অঞ্জনের স্বপ্নগুলো ছিলো এত ছোট যে ওগুলো পূরণ করার জন্য আগের দিন আমার টিউশনির বেতন না পেলেও চলতো। যেমন- দুজনে হাঁটছি, হঠাৎ অঞ্জন বলে বসলো, আইচ্ছা ভাই, আইসক্রীম জিনিসটা খুব ঠান্ডা, তাই না?
আমি বললাম, কেন তুই খাবি?
সে বললো, 'নাহহহ্'
বাংলা সাহিত্যে বহুবার পড়েছি মাঝে মাঝে না শব্দটা নাকি হ্যা অর্থ প্রকাশ করে আজ তার বাস্তব প্রমাণ পেলাম। আমি একটা কাপ আইসক্রীম কিনে ওর হাতে দিতেই আমাকে বললো , ভাই আপনে আগে খান।
আমি বললাম, কেন ?
অঞ্জন বললো, শুভ কাজ ভাল মাইনষেরে দিয়ে শুরু করান উচিত
আমি হা হা করে হেসে ওঠায় খানিকটা ভড়কে গিয়ে বললো, ভাই কি হইছে?
আমি বললাম, কিছু না তুই খা, আমি শুভ কাজ শুরু করে দিলে সেটা তোর জন্য অশুভ হয়ে যাবে।
সেদিন রাতে আমি অঞ্জনদের সাথে খেয়েছিলাম, গণ রান্নার মেহমান ছিলাম আমি। সেদিন রাতে আমি যখন অঞ্জনকে খেতে বললাম, তখন বললো, ভাই একটা কথা কই? আমি বললাম, বল।
ও বললো, আপনে আমারে যে ট্যাকা দিয়া খাওয়াইবেন ওই ট্যাকাডা আমারে দেন।
আমার একটু খটকা লাগলো, ভাবলাম, হায়রে টাকার কাছে সবকিছুই অসহায় । পরক্ষনেই আমার ভুল অবশ্য ভেঙ্গেছিলো। অঞ্জন বললো, ভাই হয় ট্যাকাডা দেন নইলে আপনে আামার লগে চলেন।
আমি বললাম, কই যাবো?
সে বললো, আমাগো পানির ট্যাঙ্কে, আমি যদি আইজ না যাই তাইলে আমার দোস্তগো ট্যাকা শর্ট পড়বো, ওগো খাওনডা ঠিকমতন হইবো না । আমি আইজকা সারাদিন জব্বর খাইছি। দুইদিন না খাইলেও হইবো। ওগো লেইগ্যা পরাণডা পুরতাছে।

মানুষে মানুষে এই অপত্য ভালোবাসার সামনে আমি অধম, আমার বলার কিছুই ছিলনা। আমি চিরকাল সুখ অট্টালিকায় যে ভালবাসার রং দেখতে চেয়েছিলাম সেটা সেদিন রংধনু হয়ে আমার চোখে ধরা দিয়েছিলো। আমি সেদিন ওদের সবার খাওয়া কেনার টাকাটা দিয়েছিলাম। ওরা আমাকে পানির ট্যাঙ্কে বসিয়ে রেখে গিয়ে বাজার করে আনলো। নিপুন হাতে চুলা ধরিয়ে ভাত বসিয়ে দিলো ওদের একজন। এদের একজন আবার গান জানে। খোলা গলায় গান ধরলো, " ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো .. … .."

সেদিন পানির ট্যাঙ্কে বসে বসে তপ্ত আলুভর্তা, ধোঁয়া ওঠা ভাত আর হলদে ডাল দিয়ে খেতে খেতে মনে হচ্ছিলো আমি বোধহয় প্রকৃত জীবনের স্বাদ আহরণ করছি। মনে হচ্ছিলো এদের সাথে থেকে যাই, এটাই প্রকৃত জীবন। কিন্তু ফিরতে আমাকে হবে, কারন এদের সাথে থাকতে চাওয়াটা আমার আবেগী মনের বিলাসীতা ছাড়া কিছু না। আমি জীবনের যে রুপ সেদিন দেখেছি সেটা আমার কাছে কাব্যিক, সাহিত্যের খোরাক, ইংরেজীকে বলতে হয় অ্যাডভেঞ্চার। কিন্তু ওর মাঝে যে নির্মমতা লুকিয়ে আছে, যে বাস্তবতার কষাঘাত আছে সেটা সইবার মত সাহস বা শক্তি কোনটাই আমার নাই।

সেদিন রাতে আর বাড়ী ফেরা হয় নাই হলে থেকে গিয়েছিলাম সেদিন। এরপর বেশ কিছুদির ওর সাথে দেখা হয় নাই । মাঝে মাঝে শাহবাগ মোড়ে ওকে আমি খুঁজতাম প্রময় দেবার আশায়। মাঝে মাঝে বাসের গেটে দাঁড়িয়ে ভোর বেলা প্রাইভেটকারগুলোতে করে মায়েরা ছোট ছোট বাচ্চা গুলোকে সুখ অট্রালিকা থেকে তুলে এনে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য চোখে পড়তো। কারন ওটাই যে নিয়ম আর সাথে সকালের নাস্তা করানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টা। আমি ভাবতাম হায়রে মুদ্রা, তুই যদি ওপিঠ টা দেখতে পেতি, কেউ দামী টোস্ট খায় না আর কেউ এক মুঠো চিড়ে জোটাতে পারে না। বিধাতার সৃষ্টিতে এ বৈষম্য কেন? আমি আজো এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজি? পরজন্মে বিধাতা হয়তো পুষিয়ে দিবেন এই বলে নিজেরে বোঝাই।

একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেলো বলা হয়নি হাজার কথার ভিড়ে, আমাদের অঞ্জন কিন্তু ছিলো বিদ্যার জাহাজ, ছোটবেলা ব্রাক এর শিশু স্কুলে পড়েছিলো কয়েক ক্লাস। এতেই তার বিশাল জ্ঞান। প্রতিদিন পত্রিকা বিক্রি করার সময় পত্রিকার কোথায় কি আছে সব মুখস্থ বলে দিতে পারতো? একবার তো আমাকে বাংরাদেশের সংবিধানের কয়টি ধারা এটা জিঝ্হেস করে রীতিমত বিব্রত করে ফেলেছিলো। আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় আমি না দিয়ে ওরে দিয়ে বি. সি.এস পরীক্ষা টা দেয়ালে একবারেই ম্যাজিস্ট্রেট। অবশ্য ওর জন্য সরকারকে নতুন পোষ্ট সৃষ্টি করতে হবে। পোষ্টের নাম ভ্যাগাবন্ড ম্যাজিস্ট্রেট। হাস্যকর এই কথাগুলো ওকে বলে আমি বিপাকে পড়েছিলাম বেশ। বেশ মনে পড়ে ওরে বলার পড় সে আমার কাছে জানতে চাইলো বি.সি.এস পরীক্ষা কি? আমি দিবো কিনা? তারে আমি যত বোঝাই সে তো বোঝেনা? শেষে আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি দেখে বললো, বাদ দ্যান ভাই, আপনে এই পরীক্ষা দিবেন কি না কন? আমি বললাম, হুম।
সে বললো, আইচ্ছা
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ডিপার্টমেন্টের কাছ এসে পড়লাম। বাস থেকে নেমে সিঁড়িতে উঠতে যাবো, হঠাৎ ভাই, ভাই বলতে বলতে ঝড়ের বেগে অঞ্জন ছুটে এলো। আমার কাছে এস হাঁপাতে লাগলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কিরে, কি ব্যপার? হাপাচ্ছিস কেন?"
সে আমাকে হাত ধরে কৃষ্ণচূড়া গাছটার নীচে নিয়ে এলো। আজ তার সব পত্রিকা বিক্রি হয়ে গেছে। সে আমার জন্য একটা জিনিস এনেছে, সেটা দিবে বলে এত হাপাহাপি। আমি বললাম, কি? কি দিবি?
সে বললো, ভাই আপনে খুব ভালো মানুষ, আপনে হেইদিন আমাগোরে খাওয়াইছেন, আমাগো লগে আছিলেন, আমাগো লগে খাইছেন, আমাগো ভাই ডাকছেন। আমরাও আপনেরে ভাই মানছি। তাই আমরা সব্বাই মিইল্যা প্রতিদিন একট্যাকা কইরা জমাইয়া আপনের লেইগ্যা একটা জিনিস কিনছি? এ কথা বলে সে তার পেছন থেকে আমাকে একটা বি.সি.এস আজকের বিশ্ব বইটা বের করে দেয়।

আমি তো পুরা অবাক। আমার অবস্থা দেখে অঞ্জন বললো, কি হইছে ভাই, অবাক হইয়েন না, আমরা এই লাইনের মানুষ। ক্যামনে বুঝলাম অ্যাই বই আপনের লাগবো কিনা। হেইদিন আপনে কইলেন না অপনে বি.সি.এস পরীক্ষা দিবেন, ওইটা দিলে বড় চাকরী পাওন যায়। আমারা যেহান থিক্যা প্যাপার আনি ওরা এই বই বেচে, হেইদিন নুরু চাচারে জিগাইলাম, কইলো যারা পরীক্ষা দ্যায় তাগো বেবাগতেরে অ্যাই বই পড়ন লাগে। তহনি মাথায় বুদ্ধিডা আইছিলো, পরে হগলতেরে কইলাম। তারপর হগলতে মিল্যা কিইন্যা ফালাইছি। ন্যান ধরেন ভাই, ভালো কইর‌্যা পইরেন কইলাম, পরীক্ষা পাস দিয়া বড় চাকরি করলে আমাগোরে কিন্তুক আরেকদিন খাওয়ান লাগবো। পোলাও , মাংস খামু। কামাইল্যা রান্ধা পারে। এটুকু বলেই উল্টো ঘুরে হাঁটা দিলো।
এতটুকুন বাচ্চার মায়া আর ভালবাসার প্রতিদান দেখে আমি এতটাই নিস্তব্ধ হয়ে গেছিলাম যে, কিছু বলার ভাষা আমার কাছে ছিলো না। এর মাঝেই আমাকে অবাক করে অঞ্জন আবার ফিরে এস আমাকে বললো, " ভাই আর একটা কথা, অ্যাই বইটার যা দাম আমি কিন্তু সবার থিইক্যা বেশী টাকা দিছি, কারন আমি আপনেরে সবার থিইক্যা বেশী মায়া করি।" এবার আর থামলো না সোজা দৌড়ে চলে গেলো। ছেলেটা একটাবার পেছন ফিরে তাকালো না । ভালোই হয়েছে তাকায়নি তাকালে আমার কৃতজ্ঞ চোখে ভালবাসায় মোড়ানো এক ফোঁটা জল হয়তো আমি আড়াল করতে পারতাম না।

কোন এক সকালের ঘটনা। ঘুমটা ভাঙ্গতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিলো সেদিন অঞ্জনের। ঘুম ভাঙ্গতেই বেলা দেখেই বুঝে গিয়েছিলো আজ কপালে খারাপি আছে। কাগজ পাবেনা। বন্ধুত্ব আর যাই থাকুক না কেন জীবনের তাগিদে বাস্তবতা সবকিছুর মাঝে এসে দাঁড়ায়। তার সঙ্গীরা সবাই চলে গেছে। তবু ক্ষীণ আশায় অঞ্জন দৌড়ায় কারওয়ান বাজারের দিকে, চোখে ঘুমের লেশমাত্র নাই। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দেখে যা হবার তাই, কাগজ নাই। এখন উপায়। আজ তো সারাদিন উপোস করা ছাড়া উপায় নাই। আমার কথা মনে উঁকি দিতেই সে সেদিন ক্যাম্পাসে চলে আসে। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও সে সেদিন আমার সাথে দেখা করতে পারে নাই । কারন ক্যাম্পাসে তখন গ্রীষ্মের ছুটি। এটা আমি কি জানলেও ও তো আর জানে না। প্রচন্ড ক্ষুধা ভর করেছে। পকেটে টাকা নাই একটাও। মাথাটা ঘুরছে। রোদের মাঝেই অঞ্জন হাঁটছিলো। প্রেসক্লাবের সামনে আসতেই বেশ কিছু মানুষের জটলা চোখে পড়ে তার। কিছু একটা জোটানো যায় কিনা এটা ভেবে জটলার দিকে হাঁটা দেয় সে। ঝটলার কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই মানুষগুলো দিগবিদ্বিগ দৌড়াতে শুরু করলো। কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে সেও উল্টো দৌড়াতে লাগলো। চারদিকে হট্টগোল, গোলাগুলির আওয়াজ, হঠাৎ সব নীরব, তপ্ত রাজপথে আছড়ে পড়লো অঞ্জন, আমাদের অঞ্জন। একটা গুলি অঞ্জনের ঠিক হৃৎপিণ্ডটা ভেদ করে বুক দিয়ে বের হয়ে চলে গিয়েছে।

ধীরলয়ে অঞ্জনের দেহটা আছড়ে পড়ে রোদেলা তপ্ত রাজপথে। চারদিকে স্বপ্নগুলো উড়ছে, পাতলা পালকের মত ভেসে যাচ্ছে. মায়ার সুতোয় বেঁধে রাখা যাচ্ছে না। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, ভালোবাসার সুতো কেটে স্বপ্নগুলো নীলিমায় মিলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এমন তো কথা ছিলনা। লুটিয়ে থাকা অঞ্জনের চোখে এক ফোঁটা জল লেগেছিলো, অশ্রুবিন্দুটা বুলেটের তীব্র জ্বালায়, নাকি প্রচন্ড ক্ষুধায়, নাকি অন্ধকারে চিরতরে হারিয়ে যাবার বেদনায় ওর চোখে আছড়ে পড়েছিলো তা আর কোনদিন জানা হবে না কারন অশ্রুবিন্দুটিও স্বপ্ন হয়ে উড়ে যাচ্ছে চোখের সামনে দিয়ে, ধরবার সাধ্য নাই.. .. .. .. .. ..

পরদিন অন্য কোন এক অঞ্জনের হাত ধরে আবার বাংলাদেশ প্রতিদিন এলো সবার হাতে, আজ পত্রিকার বাহক হয়ে গেছে পত্রিকার প্রধান শিরোনাম। পত্রিকাগুলো অঞ্জনের লুটিয়ে পড়া দেহ ছাপিয়েছে(অবশ্য সে ছবিতে অশ্রুবিন্দুটি ফুটে ওঠেনি হয়তো কারনটা জানা থাকলে ফুটে উঠতো), আর শিরোনাম হয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় দুই রাজনৈতিক দলের সংঘর্ষে পড়ে পথশিশু নিহত। আমি কেন যেন শিরোনামটিতে দেখছিলাম দেশের শীর্ষস্থানীয় দুই রাজনৈতিক দলের সংঘর্ষে পড়ে একটি অস্ফুট স্বপ্ন নিহত। যে স্বপ্ন গড়বার ক্ষমতা নেই সেই স্বপ্ন যারা ধ্বংস করে দেয় তাদের ঘৃনা করতেও লজ্জা হয় আমার। কেউ খোঁজ নেয়নি ছেলেটার, কারন সুখ অট্টালিকা যে তার ঠিকানা ছিলনা। ধিক, সেইসব রাজনীতিবিদ দের যারা এভাবে একটা স্বপ্নকে হত্যা করতে পারে, যারা এক ফোঁটা অশ্রুবিন্দু কিনতে পারে না কিন্তু ঝরাতে পারে। আমি তাদেরকে আমার হৃদয় নিংরানো ঘৃণাটুকু উপহার দিলাম।

আমি বিধাতার কাছে প্রার্থনা করি, হে বিধাতা, তুমি আমাদের অঞ্জনকে পরজন্মে একটা মা দিও, একজন স্নেহপরায়ণ বাবা দিও, একবেলা ভাতের নিশ্চয়তা দিও, পূর্ণিমার আলোয় ভরা একটা ঘর দিয়ো। ওর স্বপ্ন গুলো তো ওর সাথেই চলে গেছে, অপূর্ন স্বপ্নের বাঁধনে ছেলেটাকে আর জড়িয়ো না হে বিধাতা। অশ্রু জলটুকু না হয় আমায় দিয়ো তবু বাঁশীর অপূর্ণ সুর আর শুনিয়োনা অঞ্জনকে, আমাদের অঞ্জনকে।

আমার বি.সি.এস গাইডটা পড়ে আছে, অধিকাংশটাই পড়া হয় নাই আমার, আর হবেও না কারন অধিকাংশটাই যে অঞ্জনের মায়ায় কেনা। ও মায়ার বাঁধনের ভার আমি বইতে পারিনা শুধু অপলক তাকিয়ে থাকতে পারি.. .. .. ..

হঠাৎ শুরু হয়ে হঠাৎ করেই কলমটা থেমে গেলো, আঁকিবুকি খেলাটা শেষ, এতটা সময় ধরে খেললাম কিন্তু কি আশ্চর্য আমার লেখার খাতা এখনো ধবধবে সফেদ সাদা।
অঞ্জন, ভালো থাকিস্ .. .. .. .. ..