আগুনের পরশ-শনি

প্লাবন গাঙ্গুলী
Published : 22 Jan 2012, 08:13 AM
Updated : 24 June 2020, 06:25 PM

মফস্বলে জন্ম আমার, এখন মেগাসিটিতে বাস। গ্যাদাকাল ও শৈশবের কয়েক বছরের পর থেকে মূলত গ্যাসের চুলার রান্নাতেই মিটেছে আমার রসনা-বিলাস। কিন্তু, নিজ বাড়িতে পাত পেড়ে খাওয়া থেকে শুরু করে, বন্ধুদের আড্ডা বা সকল বয়সী সহকর্মীদের আয়োজন- সবখানেই একটি আফসোস করতে দেখেছি- স্বাদের আহ্লাদ নাকি খুব জমে মাটির চুলার রান্নায়। শহুরে হবার দ্রুত গতির সাথে পাল্লা দিয়ে আরও বেড়েছে খাদ্য রসিক এ জাতির এই আহা-উঁহু। স্যোসাল মিডিয়ায় একটু সতর্ক চোখ রাখলে নেটিজেনদের এই আফসোস মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে। বাপ-চাচাদের কথা আর নাইবা বললাম।

'আমি লাকড়ির রান্না খাইতে ব্যাকুল, রাঁধিলো না কেহ'- এই আকুলতাকে পুঁজি করে খোদ রাজধানীর বুকেও গড়ে উঠেছে রেস্তোরাঁ। ঢাকার আশেপাশের অনেক প্রমোদকেন্দ্র ক্রেতা আকর্ষণের অনন্য উপায় হিসেবেও এটা বেছে নিয়েছে। এই প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে ছাড়া কমছে না। করোনাকালের গৃহবন্দি দশায় যখন রান্না করার চল তুঙ্গে, তখন ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে বাঁচা অনেককে এ নিয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত-আবেগী হতে দেখেছি, স্মৃতিকাতর হতে দেখেছি। এটি কতটা শিকড়ের টান, কতটা অতিরঞ্জন আর কতটা বিজ্ঞান- তা আমি বিচার করতে বসিনি এ লেখায়। তাছাড়া, স্বাদের অত সূক্ষ্ম তফাত আমার ভোঁতা জিহ্বা ধরতেও পারে না।

 অন্তুত চুলার ক্ষেত্রে "চল ফিরে চল মাটির টানে" নীতিতে আমি মোটেও বিশ্বাসী নই। স্বাদের সাথে আপস করতে রাজি, মায়েদের স্বাস্থ্যের ও স্বস্তির সাথে না। রাতের বেলা কাশতে থাকা মলিন মুখের সাথে আপস করতে বা চুলার পারেই আটকে থাকা দীর্ঘ সময় থেকে মুক্তির সাথে আপস করতে রাজি না মোটেই। তাতে আমার স্বাদ-বিলাসী মন চুলোয় যায় যাক।

আগুনের পরশমণি সভ্যতার সূতিকাগার হলেও, প্রথাগত চুলার আগুন আসলে রাঁধুনির কপালের শনি ছাড়া আর কিছুই না। ছোটবেলায় মা যখন মাটির চুলায় রান্না করতে করতে রান্নাঘরে বসিয়ে আমাকে পড়াতেন তখন ধোঁয়া সহ্য করতে না পেরে ১০-১৫ মিনিট পরপর বাইরে গিয়ে ঘুরে আসতাম। এখন বড়বেলায় বুঝি, বছরের পর বছর মা কত ধোঁয়া নিয়েছেন নিঃশ্বাসের সাথে, আর কপালে শনি ডেকেছেন বৃদ্ধ বয়সের জন্য।

আবহমানকাল ধরে, আমার-আপনার পরিবারে সবার আগে ঘুম থেকে উঠেন কে? জরিপ চালালে কমবেশি সবাই মায়ের বা স্ত্রী-র কথাই বলবেন। মোটাদাগে পরিবারের নারীরা। "আমি হব সকালবেলার পাখি, সবার আগে কুসুম বাগে উঠব আমি জাগি। স‍ূয্যি মামা জাগার আগে উঠব আমি জেগে, 'হয়নি সকাল, ঘুমোও এখন'- মা বলবেন রেগে" এ মন্ত্র ছোটবেলায় জপ করেননি এমন বাঙালি পাওয়া বড্ড দুষ্কর। একটা রূঢ় বাস্তবতা এই শিশুপাঠ্যের মধ্যেই লুকানো আছে। স‍ূয্যি মামা ও তার ভাগিনা-ভাগিনীরা জাগার আগেই জেগে যান তার বোনেরা, মানে আমাদের মায়েরা, দৈনন্দিন কাজগুলো শুরু করার জন্য।

গবেষণা বলছে, প্রতি দশ জনে চার জন নারীর দিন শুরু হয় চুলার পাড়ে (প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন, ২০১০)। দিনের আলো ফোটার আগেই তারা কাঠ, কয়লা বা কেরোসিন দিয়ে আগুন জ্বালান পরিবারের সবার চা আর প্রাতঃরাশ তৈরি করতে। উপরন্তু, সকাল ও বিকাল দু বেলাতেই একটা উল্লেখযোগ্য সময় তাদের ব্যয় হয় জ্বালানি সংগ্রহ করতে এবং সন্ধ্যেবেলা আবার চুলোর আগুন জ্বালিয়ে পেটের আগুন নেভাতে।

'কাঠকুড়োনি', 'পাতাকুড়োনি'- ইত্যাকার কাব্যি করে কষ্টটাকে যতই প্রশমন করি আর আহারে-আহারে করিনা কেনো, বাস্তবতা হলো বাংলাদেশের গ্রামীণ ও প্রান্তিক পরিবারগুলো প্রতিদিন গড়ে ৪ ঘণ্টা ৪৪ মিনিট করে ব্যয় করেন শুধু রান্নার জ্বালানি সংগ্রহ ও প্রস্তুত করার কাজে (প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন, পুওর পিপলস্ এনার্জি আউটলুক, ২০১৯)।

দেশজুড়ে চুলার ও জ্বালানির পছন্দ, প্রাপ্যতা, সহজলভ্যতা, রান্নার ধরন-ধারণ, এসব পণ্যের বাজারের আকার, বিস্তৃতি ও সক্ষমতা ভিন্ন হলেও একটি ব্যাপার সর্বজনীন। শহর কিংবা গ্রাম, ধনী কিংবা গরীব, প্রায় সকল ক্ষেত্রেই এ দায়িত্ব মূলত নারীদের ঘাড়েই বর্তায়। আমরা নানা পদের খাবার খাই, আর প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা করে ধোঁয়া খান তারা। ঘরের ভেতরের, মূলত রান্নাঘরের এই বায়ুদূষণজনিত বিভিন্ন রোগে প্রতিবছর বিশ্বে তেতাল্লিশ লাখেরও মানুষ মারা যান, যার সিংহভাগই নারী ও শিশু (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ২০১৮)। একই কারণে শুধু বাংলাদেশেই প্রতিবছর মারা যায় এক লাখ সাত হাজারের বেশি মানুষ; সারাদিনের রান্নার সময় প্রচলিত মাটির চুলার ধোঁয়া, দিনে ২ প্যাকেট সিগারেট খাওয়ার সমপরিমাণ ক্ষতি করে (প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন, ২০১৯)। পরিবেশ বিপর্যয় বা কার্বন নিঃসরণ তো আছেই। অথচ, এই মৌলিক ব্যাপারটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক অগ্রাধিকার তালিকায় ঠাঁই পায়নি এত বছরেরও।

কর্মসূত্রে বিভিন্ন বিষয় জানা ও জানানোটাই আমার রুটি-রুজি। দেশ ঘুরে ঘুরে 'আমার তো গল্প বলা কাজ'। সেই সূত্রেই 'ক্লিন কুকিং' ব্যাপারটার সাথে পরিচয়, আর গত প্রায় চার বছর ধরে ওঠাবসা। কিন্তু 'ক্লিন কুকিং'-এর যুতসই বাংলা পরিভাষা এখন পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি। সবচেয়ে কাছাকাছি যেটা করে নিয়েছি, সেটা হলো- 'উন্নত চুলা ও উন্নত জ্বালানি'। কেননা 'পরিষ্কার/পবিত্র/সাফ/শুচি/শুদ্ধ রান্না' ব্যাপারটা আমাদের সংস্কৃতিতে অন্যকিছু নির্দেশ করে। অনেককে অবশ্য 'পরিচ্ছন্ন রান্নাঘর ও সবুজ জ্বালানি' বলতে শুনেছি। কিন্তু সেটাও বাকিদের কাছে খুব একটা বোধগম্য হয়না। গ্রামীণ জনগোষ্ঠির কাছে তো আরও না, উল্টো খাবারের শুচিতা ও রান্নাঘর ধোঁয়া-মোছার সাথে গুলিয়ে ফেলে। যেহেতু তারা উন্নত/মডার্ন/বন্ধু চুলার সাথে পরিচিত তাই সেটা ব্যবহারই শ্রেয় মনে হয়েছে আমার কাছে। ফোকটে বলে রাখি, চুলার মত এরকম নানান ইস্যুতে আমাদের দেশে যেসব প্রচারাভিযান চালানো হয় তার অধিকাংশের ভাষা ও প্রকাশের কার্যকরিতা নিয়ে আমার কিছুটা সন্দেহ আছে। মানুষের মুখের বা আগ্রহের ভাষা ব্যাবহার না করে উদ্ভট ও জোর করে অন্তর্মিল মিলিয়ে স্লোগান বানালে জনসচেতনতা তো হয়ই না, উল্টো তা বছর ঘুরে দিবস উদযাপনেই আটকে থাকে। না হয় সেগুলো কৌতূহল বা উত্সাহ উদ্দীপক, না সেগুলো লোকমুখে ফেরে। সরকারি সংস্থা ও এনজিওগুলোর উচিৎ ব্যাপারটা অনতিবিলম্বে পুনর্বিবেচনা করা।

উন্নত চুলা ও তার উন্নত জ্বালানি- আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত অবহেলিত বিষয়ই রয়ে গেছে। নীতি নির্ধারণী ও মাঠ পর্যায়ে যে একবারে কাজ হচ্ছে না তা না। কিন্তু সেটা এখনও 'স্যাকরার ঠুকঠাক' পর্যায়েই আছে। 'কামারের ঘা' তো সব পড়ছে বিদ্যুৎ খাতে। ২০১০ সালে যেখানে অর্ধেকের কিছু বেশি (৫৫.২৬ শতাংশ) পরিবার বিদ্যুতের আওতায় ছিল, সেখানে মাত্র ৯ বছরেই সেটা শতকরা নব্বই ভাগেরও (৯২.২) বেশিতে গিয়ে ঠেকেছে। নবায়নযোগ্য, পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী এনার্জির বিভিন্ন উদ্যোগও মূলত বিদ্যুৎ কেন্দ্রিক। ১৯৯৬ সালে সোলার হোম সিস্টেম (এসএইচএস) কর্মসূচি চালু হওয়ার পর থেকে এটি বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নবায়নযোগ্য জ্বালানি কর্মসূচি। টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা)-এর তথ্য মতে, এ পর্যন্ত প্রায় ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে এবং সরকার কর্তৃক গৃহীত সমন্বিত কর্মসূচির কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইডকল এর মাধ্যমে এর সংখ্যা বাড়ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী এবং বিনিয়োগকারীদেরকে সরকার বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা প্রদান করছে। সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন- বাংলাদেশ ব্যাংক, ইডকল এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থায়ন সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হয়েছে। তাছাড়া কিছু নবায়নযোগ্য জ্বালানি পণ্য যেমন- সোলার প্যানেল, সোলার প্যানেল বানানোর উপাদান, চার্জ কন্ট্রোলার, ইনভার্টার, এলইডি লাইট, সৌরচালিত বাতি এবং বায়ু-বিদ্যুৎকেন্দ্র এর উপর শুল্ক অব্যাহতিমূলক প্রণোদনা দিয়েছে সরকার। নিঃসন্দেহে এসবই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু প্রদীপের নিচের অন্ধকারের মত, এত শুভ কাজের ভিড়ে রান্নার উন্নত চুলা ও জ্বালানি তুলনামূলক খুবই কম মনোযোগ পাচ্ছে। এ খাতে নিবিড় মনোযোগের ঘাটতির এই ব্যাপারটি যে শুধু নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে আছে তা না। ব্যবহারকারী জনসাধারণও এটাকে অতটা গুরুত্ব দেয় না যতটা দেয় এনার্জির অন্যান্য দিকগুলোকে (প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন, পুওর পিপলস্ এনার্জি আউটলুক, ২০১৯)।

খুব বেশি প্রত্যন্ত গ্রামে যাবার দরকার নেই। বড় বা মাঝারি শহরের গণ্ডি ছেড়ে বেরোলেই দেখা যায় মাটির চুলায় রান্না-বান্নার কাজে প্রচুর উদ্ভিজ্জ জ্বালানি ব্যবহৃত হচ্ছে। এর প্রায় সবটাই কাঠ, খড়কুটো, নাড়া, শুকনো গোবর ইত্যাদি। উপশহর বা উপজেলা সদর পর্যায়ে এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার বা কেরোসিন ভিত্তিক চুলার প্রচলন থাকলেও তার ব্যাবহার মূলত একটু অবস্থাসম্পন্ন গেরস্থবাড়িতেই সীমিত। যদিও ২০১৫ থেকে ২০১৮- এই তিন বছরে এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডারের চাহিদা বেড়েছে প্রায় চারগুণ (রহমান, ২০১৮), গ্রামাঞ্চলে গ্যাস বা কেরোসিন এখনও একটা 'বাড়তি খরচ'। উপরন্তু এই ব্যবস্থাকেন্দ্রিক বাজারের বিকাশ (উদ্যোক্তা, সরবরাহ, ক্রেতা বা বিক্রয়োত্তর সেবা) এখনও খুব দুর্বল ও অনেক ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। তবে, এ আলোচনায় 'বন্ধু চুলা'র উদাহরণটি প্রণিধানযোগ্য। উন্নততর, সুলভ ও স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য সমাধান দিলে মানুষ যে সেটা সাদরে গ্রহণ করে তার একটি বড় উদাহরণ এই 'বন্ধু চুলা'। ২০১৩ এর মে থেকে ২০১৮ এর জুন- এই পাঁচ বছরে সরকারি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) দেশজুড়ে মোট প্রায় ১৬ লাখ আধুনিক চুলা বিতরণ করেছে (বিশ্বব্যাংক, ২০১৮এ), যা মোট চাহিদার মাত্র ৩-৫ শতাংশ। ইডকলের দাবী অনুযায়ী এই চুলাগুলো মানভেদে সর্বোচ্চ প্রায় ৫০ শতাংশ জ্বালানি সাশ্রয় করলেও, স্বাস্থ্যগত দিক দিয়ে বিশেষ কোনো সুবিধা এর নেই; রান্নাঘরের পরিবেশকে আরও নির্মল করতে খুব একটা কার্যকরীও সেগুলো না (গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড, ২০১৮; পুওর পিপলস্ এনার্জি আউটলুক, ২০১৯)।

আশার কথা হলো, মোটাদাগে হলেও সরকার এলপিজি গ্যাসের প্রসারে ব্যাপক উদ্যোগী। বিগত প্রায় পাঁচ বছরে এ পালে হাওয়াও লেগেছে বেশ। যদিও এটা নিয়ে দাতা ও ঋণদানকারী সংস্থাদের মধ্যে মত-দ্বিমত দুটোই আছে। বৈশ্বিকভাবেই একটি বিতর্ক বেশ হয় যে, আমাদের কি সম্প‍ূর্ণ নির্মল ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবস্থায় যাওয়া উচিৎ? নাকি, জীবাশ্ম জ্বালানি ভিত্তিক প্রচলিত ব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান উন্নতি করা উচিৎ? কৌতূহল থেকে আমার জানার আগ্রহ জাগল, এ নিয়ে জনপরিসরে, বিশেষত প্রান্তিক নারীদের ভাবনাটাই বা কি? পুওর পিপলস্ এনার্জি আউটলুক ২০১৯ ঘেঁটে পেলাম যে এ বিতর্ক নিয়ে তাদের মাথাব্যথাই নেই। বরং তাদের আগ্রহের পাল্লা, দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সুবিধার চেয়ে সময়, খরচ ও শ্রম বাঁচানোর দিকেই ভারি। আপাত কষ্ট থেকে রেহাই পাবার আনন্দটাই মূখ্য তাদের কাছে এবং সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। অনেকটা 'ভিক্ষা চাই না মা কুত্তা ঠেকাও' অবস্থা।

নিম্নমানের জ্বালানি হলেও, উদ্ভিজ্জ ও প্রাণিজ আবর্জনা আমাদের দেশে প্রচুর সহজলভ্য হওয়ায়, আবহমানকাল ধরেই গেরস্থের কাছে এটি রান্নার জ্বালানির অন্যতম প্রধান উৎস। যেমনঃ একটি অঢেল উৎস হলো ধানের খড়। আমাদের দেশে বার্ষিক প্রায় ১০ মিলিয়ন টন পরিমাণ খড় উৎপাদনে এবং ব্যবহার হয় জ্বালানির যোগানে (দাস ও হক, ২০১৪)। দেশে প্রায় ৯০ শতাংশ বা ২ কোটি ৭০ লাখ পরিবার এখনও মূলত উদ্ভিজ্জের উপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে ৪৫.৬ শতাংশের প্রধান ভরসা ফসলের অবশিষ্টাংশ, আর ৪৪.৩ শতাংশের ভরসা হলো কাঠ (প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন, পুওর পিপলস্ এনার্জি আউটলুক, ২০১৯)। কিছুটা ঠেকা চলে প্রাণিজ আবর্জনা, যেমন- গোবর, ঘুটে, নারা ইত্যাদি দিয়ে।

একথা অনস্বীকার্য যে, সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায় গত কয়েক বছরে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। ধানের খড় আরও পরিকল্পিত ও সুদক্ষ ব্যবহারের জন্য, কাপাসিয়া ও ঠাকুরগাঁও উপজেলায় যথাক্রমে ২৫০ কিলোওয়াট এবং ৪০০ কিলোওয়াট ক্ষমতার দুটি প্ল্যান্ট নির্মাণের প্রস্তাব রয়েছে (ইডকল, ২০১৬)। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে, ইডকল চুয়াল্লিশ হাজারেরও বেশি ঘরোয়া বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট নির্মাণ করেছে এবং ২০১৮ সালের মধ্যে আরও ষাট হাজার প্লান্ট স্থাপনের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল তাও প্রায় পুরোপুরি অর্জন করেছে। বাংলাদেশের মত জনবহুল দেশ, যেখানে প্রতিদিন প্রচুর পরিমান জৈব ও পয়ঃবর্জ্য তৈরি হয়, সেখানে এই বর্জ্যকেও যথাযথ ব্যাপস্থাপনা করে নবায়নযোগ্য, পরিবেশবান্ধব জ্বালানিতে রূপান্তর করা সম্ভব। গত কয়েক বছর ধরে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে এ নিয়ে কাজ শুরুও হয়েছে বেশ তোড়জোড়ের সাথেই। ফরিদপুর, বাগেরহাট ও গাইবান্ধা জেলায় এরকম কিছু দৃষ্টান্ত দেখার সৌভাগ্যও আমার হয়েছে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদের অগ্রগতি নিয়ে জাতীয় একটি দৈনিকে প্রকাশিত এক লেখায় পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম উল্লেখ করেছেন ২০১৯ সাল নাগাদ বাংলাদেশে উন্নত চুলা ও উন্নত জ্বালানী ব্যাবহারকারী হলো ১৯ শতাংশ। তার মানে দাঁড়ায়, আরও ৮১ শতাংশকে এখনও এর আওতায় আনা বাকি। তাও মাত্র ১০ বছরে। উপরন্তু, এ দায়িত্ব সরকারের একক কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগের না; যার অনিবার্য ফল হলো পরিকল্পনা ও বিনিয়োগের মধ্যেকার সমণ্বয়ের গতি মাঝে মাঝেই স্থবির হয়ে যাওয়া। অবশ্য রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছা থাকলে সবাইকে অন্তর্ভূ্ক্ত করার এ কাজটি অসম্ভব না। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৭ অর্জনের পথে এটা এক সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ।

 এ চ্যালেঞ্জ পেরোতে এবং ব্যবস্থাটি সর্বস্তরে টেকসইভাবে ছড়িয়ে দিতে, চাহিদা, সরবরাহ, নীতি এবং বিনিয়োগের কার্যকর সমণ্বয়ে তৈরি বাজার অবশ্যই সামগ্রিকভাবে হতে হবে, যাতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী স্বল্পতম সময়ে এর সুফল ভোগ করতে পারে। এবং, সেটা করতে গিয়ে তাড়াহুড়ো করাটা মোটেও সমীচীন কিছু হবে না। খাপছাড়া ভাবে না, বরং ধীরে সুস্থে হলেও গৃহস্থালির জ্বালানি খরচ, ভর্তুকি এবং সুবিধা- সব বিবেচনায় জাতীয় পর্যায়ে সত্যিকারের কিছু দৃষ্টান্ত তৈরি করা খুবই প্রয়োজন, যাতে নীতি নির্ধারকেরাও উপযুক্ত পরিকল্পনা করতে পারেন এবং জনগণও উদ্বুদ্ধ হন।

রান্না-বান্না শুধু নারীরই দায়িত্ব কী না, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ ও বিস্তারিত আলাপ। কিন্তু, অদ্যাবধি যেহেতু এর ভুক্তভোগী নারীরাই, তাই সবাইকে আওতায় আনার এই প্রক্রিয়ায় নারীদের অন্তর্ভূক্তি ও সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতেই হবে। পাশাপাশি, এটাও নিশ্চিত করতে হবে, শুধু ভোক্তা হিসেবে না, নারীরা যেন উদ্যোক্তা হিসেবেও গড়ে ওঠেন। কেননা, উপার্জন না বাড়লে ক্রয়ক্ষমতাও বাড়বে না। 'চলেই তো যাচ্ছে' এমন সমাজ-সংসারে রান্নার কাজে তথাকথিত 'বাড়তি খরচ' করবার সিদ্ধান্তও নারী নিতে পারবে না। পাশাপাশি, চুলা ঠেলার, বাজার করার কিংবা থালা-বাসন কেনার সব দায়িত্ব নারীর হলেও, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সীমাবদ্ধতার কারণে জ্বালানি কেনার বিষয়ে পরিবারের সিদ্ধান্তের উপর তার নিয়ন্ত্রণ নাও থাকতে পারে (প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন, পুওর পিপলস্ এনার্জি আউটলুক, ২০১৯)।

এবার আরেকটা আশংকার কথা বলি। এমনিতেই এ খাতে বিনিয়োগ কম, সেটা সরকারি হোক বা বেসরকারি।  উপরন্তু, মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে করোনাভাইরাস। এটা খুব অনুমিতই যে করোনাকালের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবছরের মত আগামী কয়েক বছরের বাজেট বরাদ্দের বেলায় চুলার মত আরও বেশ কিছু অজনপ্রিয় খাত সৎ ছেলেই হয়ে থাকবে। যা, ধারাবাহিক অগ্রগতিকে জোরদার করার বদলে কয়েকধাপ পিছিয়েও দিতে পারে। অপরদিকে, বাংলাদেশের নারীদের 'ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি)' বা সোজা বাংলায় শ্বাসের তীব্র সমস্যার উচ্চহারের পেছনে রান্নাঘরের ধোঁয়া অন্যতম কারণ। তার উপরে করোনায় তো শ্বাস ফেলাই দায়। মহামারির তীব্রতা কমলেও, আগামী দিনগুলোতে এই দু'য়ে মিলে যেনো আবার সোনায় সোহাগা না হয়। করোনায় উচ্চ মৃত্যুহার ও সিওপিডি- এই দুইয়ের মাঝের সমীকরণ খোঁজা কিন্তু বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যেই শুরু করে দিয়েছেন।

আজকাল তো "মুখের কথা একলা হয়ে, রইল পড়ে গলির কোণে, ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু, ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে"। আছেন কোন বঙ্গ সন্তান যিনি কষ্মিনকালেও ভেবেছিলেন যে লুডো খেলতে বিজ্ঞাপন দেখতে হবে? তাই বহুল প্রচারিত ও জনপ্রিয় একটা বিজ্ঞাপনের সূত্র দিয়েই শেষ করি। "ঈদে মায়ের জন্য মোবাইল নিয়ে যাচ্ছি"। সন্দেহ নেই সন্তানের সাথে কথা বলতে পারলে মায়ের মুখে হাসি ফুটবেই। কিন্তু, মায়ের মুখের সেই হাসি যাতে চুলার ধোঁয়ায় মলিন না হয়, তাই মায়ের জন্য একটা উন্নত চুলাও নিয়ে যান। ব্যবস্থা করে দিন একটু উন্নত জ্বালানির, আরেকটু ভালো রান্নাঘরের।

সামনেই কিন্তু কোরবানির ইদ আসছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সকল প্রিয়মুখ একসাথে হয়ে ঝকঝকে 'আকাশ' দেখবেন, আহ্লাদ করবেন মায়ের হাতের রান্নার জন্য। কিন্তু প্রচলিত জ্বালানি ও চুলার আগুন নামক শনির পরশে মায়ের প্রিয়মুখটি ঝকঝকে থাকবে তো?