বুশ ও ব্লেয়ারের যুদ্ধাপরাধ, আগ্রাসন ও নিরীহ লোকের প্রাণ

গোলাম কিবরিয়া পিনুগোলাম কিবরিয়া পিনু
Published : 17 Oct 2011, 09:20 AM
Updated : 3 Dec 2016, 04:04 AM

এখনও প্রায় প্রতিদিন ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান বা আরও অন্য কোথাও না কোথাও আত্মঘাতী বোমা বা হামলায় নিরীহ লোকের প্রাণ যাচ্ছে। যেন গা-সওয়া হয়ে তা, স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে আমরা ধরে নিচ্ছি। জেনে বা দেখে সাধারণ মানুষের করার যেন কিছু নেই। যারা এসবের নির্মম শিকার হচ্ছে বা যে পরিবার ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে, তারা শুধু বেদনাবিহ্বল হয়ে কাতরায় না, তাদের জীবন যে কী দুর্বিষহ হয়ে পড়ে তা তারাই উপলব্ধি করতে পারছেন। এই পরিস্থিতিতে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর কর্ণধাররা তাদের ক্ষমতা ও অন্যান্য স্বার্থের সমীকরণে এইসব হামলা-সংঘাত ও মানুষ নিধনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাঙ্ক্ষিতভাবে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে না। বরং পুতুল খেলার মতো নিছক খেলা হিসেবেই দেখছে বলে মনে হয়।

আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্সসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলো গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেও চললেও, তাদের সরকারপ্রধানরা বৈদেশিক নীতিতে শুধু অগতান্ত্রিক নয়, অস্বচ্ছ ও উন্নাসিকভাবে ইচ্ছেমতো ভূমিকা পালন করেছে। যার ফলে আজ আইএসসহ জঙ্গিদের উত্থান হয়েছে। আফগানিস্তান-ইরাক-লিবিয়া ও সিরিয়ায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে গোটা বিশ্বে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি শুধু সৃষ্টি করা হয়নি, দীর্ঘস্থায়ী এক যুদ্ধের মধ্যে সবাইকে ঠেলে দিয়েছে। উল্লিখিত দেশগুলোর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজ দেশে ও দেশের বাইরে জনমত ও বিক্ষোভ থাকলেও, তার তোয়াক্কা না করে লুণ্ঠন আর আগ্রাসনের উদ্দেশ্যে অমানবিক ভূমিকা পালন করেছে তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর রাষ্টপ্রধানরা।

কিছু দিন আগে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ২০০৩ সালে মার্কিন বাহিনীর নেতৃত্বে ইরাকে সামরিক অভিযান চালানোর সময় যেসব 'ভুল' হয়েছিল, তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। ওই যুদ্ধের পরিণামেই জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) উত্থান হয় বলে তিনি স্বীকার করেন। তিনি আরও বলেন, "যে গোয়েন্দা তথ্য আমরা পেয়েছিলাম, তা ভুল ছিল। এ জন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। কারণ, তিনি (সাদ্দাম) নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে এবং অন্যদের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করলেও সেটার মাত্রা আমরা যে রকম ভেবেছিলাম, ঠিক সে রকম ছিল না।"

তাহলে মিথ্যে অজুহাতে ভিন্ন দেশ আক্রমণ করা গণতান্ত্রিক লেবাসে কতটুকু জায়েজ ছিল? এ প্রশ্ন আমাদের। এরই পরিণতিতে আজও হত্যা চলছে, মানবিক বিপর্যয় নেমে আসছে। এর কি কোনো বিচার হবে না? কারা বিচার করবে? এদের হাতে শক্তি ও জাতিসংঘের মত প্রতিষ্ঠানও। এরা যা করবে, তা-ই যেন জায়েজ।

ক্ষমতাশালী দেশগুলোর মিথ্যে অজুহাতে ও তাদের আগ্রাসী বাহিনী আক্রমণ করার পরপরই ইরাকি সামরিক বাহিনী পরাজিত হয়। রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হোসেন পালিয়ে বেড়ান। অবশেষে ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে তাকে আটক করা হয়। ২০০৬এর ডিসেম্বরে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। মার্কিন কোয়ালিশন বাহিনী ইরাক দখল করার পর ইরাকের বিভিন্নপন্থী দলগুলোর মধ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সুন্নি এবং শিয়া দলগুলোর মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং আল-কায়েদা ইরাকে তাদের কার্যক্রম ত্বরান্বিত করে। এই যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা আনুমানিক দেড় লাখ থেকে ১০ লাখের মতো।

যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় হয়েছে ৮৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চেয়েও বেশি। আর যুক্তরাজ্যের প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন ইউরো। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের জনগণের করের টাকায় আগ্রাসন চালিয়ে ইরাককে ধ্বংস করা হল; পরবর্তী সময়ে লিবিয়াকেও। বুশ ও টনি ব্লেয়ারকে 'যুদ্ধাপরাধী' হিসেবে চিহিৃত করছেন তাদের দেশে ও দেশের বাইরের শুভবাদী মানুষজন। কিন্তু বিচার কি হবে? এরা গোটা বিশ্বকে অনিরাপদ কেবল করেননি, নিজ দেশের জনগণকেও বিপদের মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন– ক্ষমতার অপব্যবহার করে ও দায়িত্বহীনভাবে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ে রিপাবলিকান পাটির ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, "সাদ্দাম হোসেন, মুয়াম্মার গাদ্দাফির মতো শাসকরা ক্ষমতায় থাকলে বিশ্ব এখনকার চেয়ে ভালো থাকত।"

ইরাকে সাদ্দাম ও লিবিয়ায় গাদ্দাফি ক্ষমতায় থাকলে বিশ্ব কি এখনকার চেয়ে ভালো থাকত এমন প্রশ্নে ট্রাম্প দৃঢ়ভাবে আরও বলেন, "একশ ভাগ।"

তাহলে বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী কারা, সেটা সহজ-সরলভাবে আমাদের চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে যায়।

আইএসএর উত্থানের পেছনে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে বলে মন্তব্য করেছিলেন কিউবার সদ্যপ্রয়াত নেতা ফিদেল কাস্ত্রো, মৃত্যুর কিছুদিন আগে। কিউবার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থায় প্রকাশিত তাঁর লেখা এক প্রবন্ধের বরাত দিয়ে রাশিয়া টুডেসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম একথা জানিয়েছিল। কাস্ত্রো তাঁর প্রবন্ধে বলেছেন:

"ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ও মার্কিন সিনেটর জন ম্যাককেইন ষড়যন্ত্র করে আইএস গঠন করেছে। যে দলটি এখন ইরাক এবং সিরিয়ার অনেক এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে।"

আইএস গঠনের এই পুরো প্রক্রিয়াকে জার্মানির এসএস ট্রুপের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন:

"ন্যাটোর নেতৃত্ব হিটলারের মতোই আধিপত্যবাদী। তাদের অবস্থানও অ্যাডলফ হিটলারের সাম্রাজ্যের লোভের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।"

আজ ধর্মান্ধ কালজ্ঞশক্তির উত্থানের পিছনে তথাকথিত 'গণতান্ত্রিক' নামে পরিচিত নেতৃত্বের অপরিণামদর্শী ভূমিকা ও জটিলতার কারণে সারাবিশ্বের সাধারণ ও নিরীহ মানুষ বলি হচ্ছে। আর এদের হাতে গুপ্ত থাকা সুতোর টানে না-বুঝে না-জেনে ধর্মের নামে কিছু বিভ্রান্ত কিশোর-তরুণও নিজেদের ধ্বংস করছে, পাশাপাশি ধ্বংস করছে অন্যদেরও।

এ-সবের মূলে দায়ী তথাকথিত 'গণতান্ত্রিক' দেশের নেতা ও নেতৃত্ব। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সারা বিশ্ব আজ জটিল অবস্থানে চলে গিয়েছে। যে যুদ্ধে শুধু সমারাস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে না, মনস্তাত্ত্বিক অস্ত্র গভীরভাবে ব্যবহার হচ্ছে। এই অস্ত্রের শক্তি আরও ভয়াবহভাবে ক্ষতিকর ও গভীর। এর পরিণাম থেকে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও দূরবর্তী থাকছে না, বাংলাদেশের মানুষও নয়।

আমাদের দেশে ঘটে যাওয়া ঘটনার দিকে চোখ রাখলে উপলব্ধি কি করা যায় না?