মানুষ গড়ার কারিগরেরা আজ ধর্ষক!

মোসাদ্দিক উজ্জ্বল
Published : 7 July 2011, 06:05 AM
Updated : 7 July 2011, 06:05 AM

জ্বি! ইনি একজন মানুষ গড়ার কারিগর! বর্তমানে ক্ষয়ে যাওয়া আমাদের এই নষ্ট সমাজের মাঝেও যারা সত্য আর আলোর পথ দেখায়, যাদেরকে আমরা আলোর পথের যাত্রী ভাবি, যারা স্নেহ ভালবাসা আর আদর্শের বীজ বপন করেন আমাদের বুকের মাঝে, যাদের জ্যান এর আলোয় আলোকিত হয়ে আমারা সামনের দিকে ধাবিত হই, যারা আমাদের ভবিষ্যৎ দিনের আধারের মাঝেও আলোর পথ দেখায়, যাদের আদর্শ বুকে ধারন করে আমরা আগামীর পথ চলি ,যারা আমাদের এই সমাজের সব চাইতে সন্মানিত ব্যাক্তি, সেই মানুষ গড়ার কারিগরেরা আজ ধর্ষক! এটি যেন নিজ পিতার হাঁতে নিজ সন্তানের ধর্ষণ হবার চাইতেও জঘন্য তম এক পাপ! অথচ এই শিক্ষক সমাজ যারা কিনা আমদের আগামী দিন গুলির কাণ্ডারি।

একটি মানুষ জন্মের পর তার পরিবার থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহন করেন। কিন্তু তার একটি প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার যেই গল্প সেই গল্পের সঞ্চালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। তারা আমাদের বধির আর অন্ধ দেহ কোষের ভেতরে আলোর তীক্ষ্ণ রশ্মি ঢুকিয়ে দেয়। সেই আলোর রশ্মি এক সময় বিন্দু থেকে মহা সাগর, তার পর বিশাল আকাশের মতন একটি হৃদয় তৈরি করতে শেখায়।সেই বিশাল আকাশের মতন এত বড় জ্ঞানের সাগরে আমরা আমৃত্যু পর্যন্ত জ্ঞান আহরণ করি। জ্যান পিপাসায় কেউ তৃপ্ত হতে পেরেছে এমন নজির নেই। ছোট্ট বেলার সেই কথা যতই পড়িবে ততই শিখিবে। সেই জ্যানের রাজ্যে আমাদের পদার্পণ হয় আমাদের বাবা, মা তুল্য শ্রদ্ধেয় শিক্ষক দের হাত ধরে।

আজ আমার সেই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ধর্ষক! চোখের কোণায় চিক চিক করছে কিছু জ্বল। কাঁদতে ও পারছিনা। ভাবছি আর কি লিখবো? রাজনীতি আর সমাজ নিয়ে ব্লগে কতই লিখলাম। ঐ সব বিষয় গুলী নিয়ে লিখতে বসলে কি বোর্ড এর কি গুলী খুব ব্যাস্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু আজ কোন ভাষাও খুঁজে পাচ্ছিনা। সব ভাষা, সব শব্দ, সব উপমা গুলী কেমন করে যেন হারিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে আমি বধির হয়ে গেছি! আমি অন্ধ হয়ে গেছি। হিসাব বিজ্ঞান এর ছাত্র হয়েও আমি কোন হিসাব ই আজ মেলাতে পারছিনা! ভীষণ এক যন্ত্রণায় কাতর আমি। প্রান ভোরে নিঃশ্বাস নিতে ও কষ্ট হচ্ছে। আমাদের সমাজের মূল্যবোধ আর ধর্মীয় অনুভূতি গুলী কোথায় গিয়ে হারাল?

দেশের মাধ্যমিক লেবেলের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বসুন্ধরা শাখার শিক্ষক পরিমল জয়ধর। নিজের হাঁতে ধর্ষণ করেছেন তার সন্তানকে। তার এক ছোট বোনকে। আমাদেরই এক ছোট বোনকে।

লিখিত এক বক্তব্যে আমাদের এই বোন টি জানায়,

গত মে মাস থেকে সে পরিমলের কোচিং সেন্টারে যাওয়া শুরু করে। স্কুলের কাছেই পরিমল জয়ধর, বাবুল কুমার কর্মকার, বিষ্ণুপদ বারুই, বরুণচন্দ্র বর্মণ ও বিশ্বজিৎ চন্দ্র মজুমদার বাসা ভাড়া নিয়ে কোচিং করাতেন। ঘটনার দিন ছাত্রীটি কিছু সময় পরে কোচিংয়ে গিয়েছিল। এই অজুহাতে শিক্ষক সবার পড়া শেষে ছাত্রীটিকে অপেক্ষা করতে বলেন। বিলম্বে আসায় ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন। এরপর অন্যদের চলে যেতে বলেন। পরিমল একপর্যায়ে দরজা বন্ধ করে দেন। কিছু বোঝার আগেই মুখ বেঁধে ফেলেন। হাত ছোড়াছুড়ি করলে ওড়না দিয়ে দুই হাত বেঁধে ফেলেন। পরে গায়ের জামাকাপড় খুলে ছবি তোলেন। এরপর তার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। এসব ঘটনা কাউকে জানানো হলে নগ্ন ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেন ওই শিক্ষক। গত ১৭ জুন ওই শিক্ষক একই কাজ করেন। উপায় না দেখে ছাত্রীটি ১৯ জুন বিষয়টি তার সহপাঠীদের জানায়। ২১ জুন শাখাপ্রধান লুৎফর রহমানকে ঘটনাটি জানায় ওই ছাত্রী। তিনি বিষয়টি দেখার আশ্বাস দেন। এর পরও পরিমল জয়ধর স্কুলে পড়াতে এলে ২৮ জুন দশম শ্রেণীর সব ছাত্রী লিখিতভাবে বিষয়টি অধ্যক্ষকে জানায়।

লিখিত এই কতিপয় শব্দগুলো আমাদেরকে কি মনে করিয়ে দেয়? আমরা বেচে আছি কোন সমাজে?সেই সমাজের ব্যাবস্থাই বা কিরূপ? এটি কি সমাজের অধঃপতন! নাকি শিক্ষকদের নৈতিক অধঃপতন? এই রকম অসংখ্য ছাত্রী নির্যাতিতা হচ্ছে। খোদ উচ্চ শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় গুলির যৌন নির্যাতনের খবর শুনেছি অনেক আগেই। জাহাঙ্গির নগর বিশ্ববিদ্যালয় এর সেই সব কাহিনি গুলী সময় এর আবর্তে হারিয়ে গেছে। কিন্তু এই পরিমল আবার ও মনে করিয়ে দিল যে আমাদের শিক্ষকরা আজ অনেক দূরে সরে এসেছে। তাদের সেই মূল্যবোধ আর সমাজ বদলানোর প্রত্যয় নিয়ে মানুষ গড়ার যেই মহৎ উদ্দেশ্য বুকে ধারন করে তারা মানব কল্যাণের জন্য ব্রত ছিল, সেই আদর্শ আর মনুষ্যত্ব বোধ গুলী আজ হারিয়ে গেছে।

আজ আর শিক্ষকরা হয়তো শিক্ষক নেই। তারা হয়েগেছে এক একটি ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা ব্যবস্থাকে তারা বানিয়েছেন পণ্য। কোচিং আর ব্যাক্তি টিউশনির জন্য না হয় তাদের ক্ষুধাই দায়ী। কারন এই সমাজের শিক্ষকদের রাষ্ট্র যেই সুবিধা দেয় তাতে তাদের হয়তো পেট চলেনা। তাই জ্যান অর্জন করে সেই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে ধনার্জন করা বোধ হয় পাপ নয়।

কিন্তু মানবিক যেই মূল্যবোধ, তাদের যেই আদর্শ, তাদের যেই নীতি, তাদের আলোয় আলোকিত করে আমরা, আমাদের ভাই বোন, আমাদের সন্তানরা আগামীর অনিশ্চিত পথ পাড়ি দেবার যেই স্বপ্ন বুকে লালন করে সামনের দিকে অগ্রসর হবার জন্য অবিরাম ছুটে চলেছে, সেই চলার পথ গুলী কি বাধাগ্রস্থ হচ্ছেনা আমাদের এই শিক্ষক দের জন্য? এক জন ধর্ষক কি করে মানুষ গড়ার কারিগর হবেন? ধর্ষক কি তার সন্তান তুল্য ছাত্র ছাত্রী দের ধর্ষক বানানোর কলা কৌশল শেখাবেন? নাকি মানুষ থেকে অমানুষ বানাবেন? আমারা তো একজন আলোকিত মানুষ হবার জন্য আমাদের শিক্ষক সমাজের কাছে নিজেদের সমর্পণ করি। সেই আলোকিত মানুষ না হয়ে যদি আধারের বাসিন্দা হয়ে যাই, তবে তো মূর্খ থাকা টাই শ্রেয়। কারন আমরা মানুষ না হতে পারি ক্ষতি নেই, কিন্তু অমানুষ যেন না হয়ে যাই।

****
ছবিঃ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন।