চিঠি এসেছে চিঠি!

মোসাদ্দিক উজ্জ্বল
Published : 3 August 2011, 09:03 AM
Updated : 3 August 2011, 09:03 AM

শেষ কবে চিঠি লিখেছেন মনে পড়ে? মনে কি পড়ে সেই হলুদ রং আর তার ডান পাশে জাতীয় সৃতি সৌধ মনোগ্রাম সম্বলিত রাষ্ট্রীয় সেই খামটির কথা? ঐ খামটি শেষ কবে স্পর্শ করেছেন তাও ও কি মনে পড়ে? আসলে মনে পড়ার কোন কথা নয়। আজ কে-ই বা চিঠি লিখে বলুন। অত সময় ই বা কই। কালের আবর্তে আর সময়ের স্রোতে কত কিছুই না হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের জীবন থেকে। কে ই বা সেই সব খেয়াল রাখে। প্রযুক্তি যেই ভাবে আমাদের তার দাসত্বে বন্দি করে রেখেছে সেই জিঞ্জীর ছিন্ন ভিন্ন করবার মতন শক্তি বা সামর্থ্য কিছু যে আমাদের নেই।

হৃদয়ের কথা, নিজের অভিব্যাক্তি বা মনভাব প্রকাশ করার কোন এক সময় একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। কাজেই সেই চিঠি ছিল এক সময় স্বর্গীয় এক দূতের মতন।ব্যক্তি সমস্যা কিংবা পারিবারিক সুখ আনন্দ বেদনা ব্যাক্ত করার এক মাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। জীবনে কত না চিঠি লিখেছি। স্কুল জীবনে পিতার নিকট টাকা চাহিয়া পত্র, বোনের বিবাহে নেমন্ত্রন দেওয়ার জন্য বন্ধুর নিকট পত্র, নিজের দেখা কোন ভয়ানক বা আনন্দ দায়ক ঘটনা দেখে সেইটি বন্ধুর নিকট জানিয়ে এক খানা পত্র, কত না পত্র লিখেছি সেই স্কুল জীবনে। তার পর নিজেদের প্রয়োজনে ও লিখেছি। কিন্তু আজ আর চিঠি লিখিনা। কিভাবে চিঠি লিখতে হয় তাও হয়তো ভুলতে বসেছি।

জীবনে অন্তত একটি বারের জন্য কারো প্রেমে পড়েননি এই কথা বুকে হাত দিয়ে বলুন তো। প্রেমে পড়ে প্রিয়তম বা প্রিয়তমার নিকট প্রেম পত্র লিখেন নি এমন প্রেমিক হৃদয়ের মানব- মানবী খুঁজে পাওয়া কি খুব বিরল? নিজের সেই ভাল লাগা আর ভালবাসার কথা প্রকাশ করা হোত এক সময় চিঠির মাধ্যমে। প্রেম করেছেন কিংবা প্রেম করবেন কিন্তু একটি প্রেম পত্র ও লিখেন নি এই কথা কি বিশ্বাস করতে হবে? না বিশ্বাস যোগ্য কথা এটি নয়। বরং সত্য হচ্ছে এই যে প্রেম করেছেন আপনি। তবে প্রেম পত্র ও লিখেছেন। তবে হ্যা এটি কিন্তু আমাদের বর্তমান টিনেজ দের জন্য প্রযোজ্য নয়। অন্তত এই মুহূর্তে যাদের বয়স ১৮ থেকে ২২। এই নব প্রজন্মদের প্রেম করা আর সেই সাথে প্রেম পত্র লেখা কোনটির ই দরকার নেই। আসছি সেই প্রসঙ্গে একটু পরে।

স্কুল জীবনে মুলত আমাদের অন্তরে ভাল লাগা আর ভালবাসা নামের এক আবেগ জন্ম নেয়। ভালবাসা আসলে কি এর কোন সু ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। এমন কি কোন দার্শনিক যে সর্বজন স্বীকৃত কোন ভালবাসার সংজ্ঞা প্রদান করেছেন এমন কোন গ্রহন যোগ্য সংজ্ঞা ও আজ পর্যন্ত এই পৃথিবীতে এসেছে তা ও কারো জানা নেই। সেই যাই হোক সংজ্ঞা জানি আর নাই জানি আমরা প্রেমে পড়ি। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি মানব জাতির যেই আকর্ষণ সেটি প্রকৃতির সহজাত এক প্রবৃত্তি। একে রোধ করার কোন উপায় নেই। তাইতো যুগে যুগে কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক সকলেই কম বেশি প্রেমে পড়েছেন। রবি ঠাকুর অসংখ্য বার প্রেমে পড়েছেন। নজরুল তো প্রেম ই লালন করতেন হৃদয়ে। আইনস্টাইন শেষ জীবনে ও প্রেম করেছেন। এবং প্রেয়সী কে চিঠি ও লিখেছেন। সেই চিঠি নিলামে ও বিক্রি হয়েছে। মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন তো প্রেম নিয়ে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। আবার হিলারির বিয়ে কিন্তু প্রেমের সফল এক পরিনতি। ব্রিটেনের রাজপরিবারের বিয়ে গুলি সব ই প্রেম কেন্দ্রিক। ভারতের রাজীব সোনিয়ার বিয়ে তাও প্রেম ঘটিত। আসলে এই প্রেম নিয়ে লিখতে গেলে পুরা ১০০ পর্বর এক কাহিনি লিখেও শেষ করা যাবেনা। কাজেই আবার না হয় আলোচনায় ফিরে আসি বরং।

কথা হচ্ছিল চিঠি নিয়ে। আসলে চিঠির সাথে প্রেমের এক অদৃশ্য যোগসূত্র রয়েছে। আগেই বলেছি প্রযুক্তির আশীর্বাদে আমরা আজ অনেক কিছুই ভুলতে বসেছি। এই চিঠিও কিন্তু আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে প্রযুক্তি। আজ মনের ভাব আদান প্রদানের মাধ্যম হিসাবে চিঠির তো কোন দরকার ই নেই। বরং এই চিঠির মাধ্যমে সেটি করতে গেলে সকলের হাসির খোরাকে পরিনত হতে হবে। কি জন্য চিঠি লিখবো, কি বা দরকার এই চিঠির মাধ্যমে নিজের মনের ভাব প্রকাশের?

বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে নিত্য নূতন সব প্রযুক্তি। সেই গুলি আমাদের আশীর্বাদ স্বরূপ অনেক কিছুই দিয়েছে। আর কেড়ে ও নিয়েছে। বলছিলাম চিঠি কেন লিখবো? আসলে কেন লিখবো? মুঠো ফোনের এস এম এস বার্তা আজ চিঠির বিকল্প! চাইলেই ১ সেকেন্ডে ই মনের ভাব প্রকাশ করা যায়। চিঠি লিখবো আর সেটি কবে কাংখিত ঠিকানায় পৌঁছাবে এই সময় যে আমাদের হাঁতে আজ আর নেই। পকেটে পকেটে ছেল ফোন। নিমিষেই পৌঁছে যায় হৃদয়ের কথা। সেই সাথে চিঠি লিখে আবার তার জবাবের জন্য পথ চেয়ে বসে থাকা সেই সময় টুকু ও আজ হারিয়ে গেছে। এই ছেল ফোন ই দিয়েছে ফিডব্যাক পাবার সকল ব্যবস্থা। আর লাইভ কথা বলার বিস্ময়কর সুযোগ! ভাবুন তো ২০ বছর আগে কি আপনি এটি ভাবতে পারতেন?

এমন একটি সময় ছিল একটি চিঠি লিখে তার জবাব পাবার জন্য তীর্থের কাকের মতন অপেক্ষা করতে হয়েছে। চাতক পাখির মতন পথের পানে চেয়ে থাকতে হয়েছে। কখন আসবে সেই চিঠি! আহারে আমার খোকা-খুকু কেমন আছে এটি যানতে বাবা মারা চিঠি লিখে তার সন্তানদের কাছ থেকে উত্তর পাবার আশায় ডাকপিয়নের হাকের অপেক্ষায় বসে থাকে। কখন ডাক পিয়ন জোরে দরাজ কণ্ঠে হাক পাড়বেন চিঠি এসেছে চিঠি, বাড়িতে কে আছেন? জীর্ণ শীর্ণ নোংরা কাপড়ের খাকি পরিহিত উস্ক খুস্ক চেহারার ডাক পিয়নের হাকে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসবে পরিবারে কর্তা ব্যাক্তি। আর পিয়ন কে বকশিশ স্বরূপ ধরিয়ে দেবে ২-৫ টি টাকা।চিঠি টি হাঁতে পেয়ে সেই কি খুশি। আহারে খুশিতে একেবারে আটখানা। সবাই কে বাবা মা রা ডাক দেবে। এই কোথায় কে আছিস, আমার খোকা- খুকি চিঠি পাঠিয়েছে। এই বার চিঠি খুলে সকলের সামনে চিঠি পড়া! সেই আবেগ গুলি কি ভাষায় বর্ণনা করা যায়? আর আজ ছেল ফোনে ই সেই কথা গুলি আদান প্রদান হয়। বাস্তবতা হচ্ছে এই যে এই ছেল ফোন সেই আবেগ গুলি নষ্ট করে দিয়েছে। আজ সন্তান রা দেশে গিয়ে খুব আবেগ আর দরদ নিয়ে বাবা- মা কে জড়িয়ে ধরেনা। এই তো বাড়ি পৌঁছানোর ৫ মিনিট আগেই তো কথা হোল। পরিবারের সবার খোজ খবর তো প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তেই জানা যাচ্ছে। সেই আবেগ আর অনুভূতি আজ সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেছে। ছেল ফোনে প্রতি মুহূর্তেই বাবা মা সহ পরিবার পরিজন দের এমন কথোপকথন চিঠির সেই ভাষা গুলিকে অতিক্রম করতে পারলেও চিঠি লিখে সেটির জবাব পাবার যেই আবেগ আর ভালবাসা জড়িত সেই টিকে কিন্তু ছেল ফোন কখনো অতিক্রম করতে পারেনি, পারবেনা কোন দিন।

নূতন বিয়ে হয়ে গেলো। মেয়েটি দেশে। আর ছেলেটি বিদেশে। ( শহরের বাইরেই এক সময় বিদেশ বলা হোতো। এমনকি যারা ঢাকা শহরে এক সময় থাকতো তাদের কে ও বিদেশ বলা হোতো)। চির চরিত সেই নিয়ম। বিয়ের পর কিছু ছুটি কাটিয়ে ছেলেটির কাজের জন্য আবার ও বিদেশে ফিরে যাওয়া। আর অবলা নারীটি একা একা কেদে কেদে আচলে মুখ মুছে। আর সেই চির চেনা গান "

বিদেশ গিয়ে বন্ধু, তুমি আমায় ভুইলনা। চিঠি দিয় পত্র দিয়, জানাইয়ো ঠিকানা

কবে আবার দেখা হবে? কবে আসবে তার প্রান প্রিয় স্বামী! মন যে মানেনা। কিছুদিন পর স্বামী চিঠি লিখে পাঠায়। আবারো ডাক পিয়নের সেই হাক। চিঠি এসেছে চিঠি। এই হাক শুনে সেই বাংলার বঁধুটির বুকের মধ্যে কেমন কেমন যেন করে। আমার চিঠি নয় তো? জানালার পর্দা ফাক করে উকি মারে বাইরের দিকে। ছোট ভাই কিংবা বোনটির হাঁতে ডাক পিয়ন চিঠি ধরিয়ে দেয়। চিঠি পেয়ে ছোট ভাই বোন গুলি একটু স্বৈরাচার হয়ে যায়। আপু মনির সামনে এসে বলে দিবনা দিবনা। এই বলে দৌড়া দৌড়ী শুরু করে দেয়। তার পর আবার ও সেই ঘুষ। ২ টাকা দিয়ে সেই চিঠি উদ্ধার। তার পর দৌড়ে গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে খাটের উপর শুয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চিঠি পড়া। আহারে সেই সুখ! কি করে বুঝাই? চিঠি পড়তে পড়তে এক সময় দু চোখের কোনে চিক চিক করে জ্বল। পড়া যেন শেষ ই হয়না। এক বার, দুই বার, দশ বার, শত বার শেষ ই হয়না। এ যেন এক অমৃত সুধা। মনে মনে মেয়েটি গেয়ে ওঠে

এত সুখ পাইনি কখনো আমি, মাটিতে আজ স্বর্গ এসেছে নামি

এই অনুভূতি কেবল চিঠির মাধ্যমেই প্রকাশ সম্ভব। অন্য কিছুতে কখনো নয়।

আজ নিজের স্ট্যাটাস বাড়ানোর জন্য, যোগাযোগ এর জন্য কিংবা বন্ধু খোজার জন্য কত না প্রযুক্তি। এক টি সময় বন্ধু তৈরি করতে আমরা কি না করেছি। বুক স্টল দিয়ে পত্র মিতালি গাইড কিনেছি। তাতে নাম ছবি ও ঠিকানা সহ শত শত ছেলে মেয়েদের পোর্ট ফলিয়ো দেওয়া থাকতো। পছন্দ মতন বন্ধু খুঁজে নিতাম চিঠির মাধ্যমে। বন্ধুর সাথে হতো পত্র মিতালি। চিঠি পোস্ট করে অপেক্ষায় থাকতাম কখন উত্তর আসবে? পিয়ন কে সাবধান করে দিতাম খবরদার আমার ব্যাক্তি চিঠি বাবার হাঁতে দিয়না। আর পিয়ন মশাই এটি বুঝে মাঝে মাঝে দোকান দিয়ে এক খিলি পান কখনো সিজার সিগারেট আমার পকেট দিয়ে খসাত। তবে মেয়েদের সঙ্গে মিতালিতে আগ্রহী ছিলাম একটু বেশি। যদি চেহারা একটু ভাল হয়, তাহলে তো আর কথাই নেই। মধুবালা, জয়া প্রদা, শ্রী দেবী, ভাগ্যশ্রী, সুচিত্রা কিংবা শতাব্দি রায় বানিয়ে পটিয়ে পটিয়ে চিঠি লিখতাম। আর ওরা তো আহ্লাদে খুশিতে গদ গদ। কত না মিতালি বন্ধু ছিল আমার! আজ তারা কোথায় কে আছে জানিনা। উল্লেখ্য ছোট বেলায় দেখতে খুব একটা খারাপ মনে হয় ছিলাম না। তাই বরা বর মেয়ে বন্ধু নাকি আমার ভাগ্যে একটু বেশি জুটতো। আর জন্ম সূত্রে সিংহ রাশির জাতক হবার কারনে ও বন্ধুরা আমাকে কন্যা রাশি বলে ডাকতো। আমার নাকি নারী ভাগ্য!

আজ পত্র মিতালি গাইড এর মাধ্যমে বন্ধু খোজার দরকার নেই। দাদা বাবু মার্ক জুকার বারগ উনি বিষয়টি বুঝতে পেরে ফেছ বুক বানিয়েছেন। আমরা তার দাসত্ব গ্রহন করছি। কি দরকার চিঠি লেখার? লাইভ চ্যাটিং তো আছেই। কিন্তু চিঠি লেখার যে আনন্দ সেই আনন্দ কি জুকারের ফেছ বুক দিতে পারে? উত্তর না, পারবেনা কোন দিন। টুইটারে লিখছি। কিন্তু আমরা তো আবেগ বিবর্জিত এক মানব মানবীতে পরিনত হয়ে যাচ্ছি। এটি কি আমরা বুঝতে পারছি?

নিজের একটি লেখা একটি দৈনিক কিংবা সাপ্তাহিক কিংবা পাক্ষিক অথবা মাসিক পত্রিকায় প্রকাশ করার জন্য কত না চেষ্টা। আমাদের সময় চলচ্চিত্র বিষয়ক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা চিত্রালি বের হোতো। ৯০ এর শেষ পর্যন্ত এটি ছিল বহু জন প্রিয়। ঐ পত্রিকায় লিখেছি। আহারে সুখ! মার্জিন টানা কাগজে ইকনো বল পেন দিয়ে লিখতাম কত কথা। আর ২ টাকার খামে পুরে পাঠিয়ে দিতাম চিত্রালি অফিসে। আমার প্রতি লেখা প্রকাশিত হোতো। লিখতাম ছায়া ছন্দ, কিশোর তারকালোক, তারকালোক, উম্মাদ সহ অনেক পত্রিকায়। সব কিছুই হোতো চিঠির মাধ্যমে। আর আজ নিজের লেখা প্রকাশ করতে কত ব্লগ! চিঠি লিখার আজ দরকার নেই। অন লাইনে ক্লিক করলেই নিজের লেখা ভেসে আসে। আর পাঠক ফিড ব্যাক তো রয়েছেই। কিন্তু চিঠির মাধ্যমে নিজের লেখাটি পত্রিকায় প্রকাশের যে আনন্দ সেটি কি ইন্টারনেট এর ইন্দ্রজালে সম্ভব? না সম্ভব নয়।

একটি সময় কর্পোরেট জগত তাদের চিঠি পত্র গুলি আদান প্রদান এর জন্য ডাক বিভাগের জি পি ও বক্স কিনে নিত। অর্থাৎ কোন ঠিকানা দরকার নেই। শুধু ঐ জি পি ও কোড আর স্থান টি লিখলেই চিঠি টি পৌঁছে যেত কাংখিত ঠিকানায়। কিন্তু আজ আর পোস্ট বক্স দরকার নেই। জি মেইল, হট মেইল, ইয়াহু মেইল সহ কত না মেইল বক্স! সেকেন্ডেই চলে যায় ডাটা। চাকরি আবেদন করবেন? অন লাইনে করুন। ডিয়ার স্যার এই গুলি দিয়ে আর লাভ নেই। তবে নিজের স্ব হস্তে লিখিত চাকুরীর আবেদনের এক অন্যরকম মজা ছিল। বিশেষ করে বানান গুলি শুদ্ধ করবার জন্য অব্যাহত এক চেষ্টা ছিল। তবে প্রযুক্তি আমাদের সেই থেকে মুক্তি দিয়েছে। এখন পূর্ব থেকে ই সিস্টেম করা। জাস্ট এডিট অ্যান্ড ক্লিক ব্যাস পৌঁছে যাবে জব দাতার হাতে চাকরীর আবেদন।

আসলে আজ আর চিঠি লেখার কোন দরকার ই দেখছিনা। তবে কি চিঠি লিখবার যেই একটি ঐতিহ্য ছিল সেটি হারিয়ে যাবে? লেখার শুরুর দিকে বলেছিলাম ১৮ – ২২ বছর যাদের বয়স তাদের একটি বিষয় নিয়ে। আসলে ওরা তো বর্তমানে সুপার ফাস্ট। ওদের প্রেমের জন্য কি আর চিঠি লেখার দরকার পড়ে? আজ যখন বনানীর স্টার কাবাবে যাই তখন দেখি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছেলে মেয়ারা একে অপরকে হাই দোস্ত বলে জড়িয়ে ধরছে। এটি হোল যুগের হাওয়া। ওরা তো ওদের হৃদয়ের কথা সরা সরি বলতে পারে। ওরা বেশ সাহসী এবং সময়ের সন্তান। কিন্তু ৯৫ এর দিকে আমাকে কিন্তু প্রেমের জন্য সত্যি চিঠির আশ্রয় নিতে হয়েছিল। ঐ সময় আমি ক্লাস টেনে। একটি মেয়ে আমার এক বছরের জুনিয়র ওকে কেমন যেন ভাল লাগতো। মেয়েটি ও যেন আমার দিকে মাঝে মাঝে কেমন করে তাকাত।উল্লেখ্য ঐ তমা ছিল অনিন্দ্য সুন্দরি। ওর পেছনে সিরিয়াল লাগানো থাকতো।কত বন্ধুরা যে দিওয়ানা হয়েছিল তার হিসাব নাই। তবে বরশি দিয়ে মাছ শিকার কিন্তু করেছিলাম আমিই। সেই কথায় পরে আসি। তখন বাংলা চলচ্চিত্রে সালমান শাহ্‌ এর স্বর্ণ যুগ। সেই সাল মান এর একটি জ্বল ছাপ আবৃত একটি লাল সাদা প্যাডে লিখলাম

তোমাকে কিছু কথা আমি বলতে চাই। কিন্তু সাহস পাইনা। কি করে যে বলি? না না পরে বলবো

ঐ সময় আমি ছিলাম ঐ রুপ সাহসী! একেবারে বীর কা পুরুষ। আমি চিঠিটি লিখে আমার আর এক বন্ধুর মাধ্যমে ওর কাছেই দিয়েছিলাম। পরের দিন ছোট্ট একটি নোট বুক প্যাডে উত্তর

পুঁটি মাছের প্রান নিয়ে আর যাই হোক প্রেম হয়না! আমি একটি কথা আপনার মুখ দিয়ে শোনবার জন্য অনেক দিন ধরে প্রতীক্ষায় আছি। কিন্তু আপনি কিনা…………?

আসলে মেয়েরা যে ছেলেদের চেয়ে একটু বেশি ম্যাচুর সেটি ঐ দিন ই বুঝলাম। কারন আমি ভিতু হলেও তমা ছিল বেশ সাহসী। প্রথম চিঠিতেই সরা সরি প্রেম উল্লেখ করে ফেলেছে। কিন্তু সেই প্রেম প্রনয় এর দিকে যাবার প্রশ্নই ছিলনা। দুজনেই বয়সে অপরিপক্ক। আমি ক্লাস টেন আর সে নাইন। তাই শেষ পর্যন্ত বিদায় নিতে হোল জীবনের প্রথম প্রেম থেকে। আজ তমাকে দেখলে হাসি। তমা ও হাসে। ওর মেয়ে ক্লাস ফোরে পড়ে। তবে তমা কিন্তু আমার সবচাইতে ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু। তার আর এক টি পরিচয় অবশ্যই আছে সে কিন্তু বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান সঙ্গীত শিল্পী। অনেকেই তাকে চেনেন। সঙ্গত কারনে তমা নামটি আমি ছদ্দ নাম হিসাবে ব্যবহার করেছি।

যাই হোক কথা হচ্ছিল চিঠি নিয়ে। চিঠি আমাদের আবেগ কে ধরে রাখে। চিঠি আমাদের অনুভূতি গুলিকে প্রকাশ করে ভিন্ন মাত্রায়। তবে আজ আর চিঠি লেখা হয়না। কি মার কাছে, কি বন্ধুদের কাছে। কোথাও যেন চিঠির প্রয়োজন নেই আর। ২ পকেটে ২ টি ছেল ফোন থাকা মানেই গোটা দুনিয়া, মহাবিশ্ব ভ্রমান্ড হাতের নাগালে। লাইফ আজ সত্যি ফাস্ট। সব কিছু ইনস্ট্যান্ট। অত সময় কই ভাবার? চিঠি লিখবার সময় কোথায়? ছেল ফোনের বাটন চাপলেই ৩০ সেকেন্ডে সব শেষ করা যায়।

আজ আর বাবা মা সন্তানদের কিংবা সন্তানরা বাবা মাদের কাছে চিঠি লিখেনা। প্রেমিক প্রেমিকারা প্রেম নিবেদনের জন্য ও চিঠি লেখেনা। গ্রামের সেই সহজ সরল বাংলা বধুরা ভাঙ্গা ভাঙ্গা হাতে তার স্বামীদের কাছে লেখেনা। সব ই যুগের হাওয়া। সক্ষম কল আর অক্ষম কল এই দুটি শব্দ একেবারে রুট শ্রেণীর লোকেরা না বুঝলেও মিসড কল আর রিছিভড কল তারা বেশ বুঝে। ডাক পিয়ন আর খুব একটা আসেনা। কালে ভাদ্রে হয়তো বছরে একবার তাও না। মেইল বক্স গুলি সেই ডাকের চাহিদা মেটায়। পত্র মিতালির মাধ্যমে বন্ধু ফাইন্ড আউট করার দরকার পড়েনা। ফেছ বুক সেই চাহিদা মেটায়। কিছু লিখবেন? চিঠির মাধ্যমে পত্রিকা অফিসে কেন? সরাসরি ব্লগে!

সত্যি আজ লাইফ বড়ই ফাস্ট। তবে এই যান্ত্রিক জীবনের মাঝেও চিঠির প্রচলন বেচে থাক যুগ যুগ ধরে। অন্তত বছরে ২ টি না হোক ১ টি চিঠি লিখুন। বাবা মাকে অথবা বন্ধু বা প্রিয়তম কে।