ভোররাতেই মারা যায় ধর্ষিতা ইয়াসমিন

মোসাদ্দিক উজ্জ্বল
Published : 24 August 2011, 05:55 AM
Updated : 24 August 2011, 05:55 AM

আপনাদের কি মনে পড়ে আজকের দিনটির কথা? মনে পড়ার কথাও নয়। বিশাল এই পৃথিবীতে প্রতিদিন কত ঘটনাই ঘটে। সব কিছু কেই বা মনে রাখে বলুন। তবে সময় যতই স্রোতের মতন আমাদের সামনের দিকে নিয়ে যাক না কেন কিছু ঘটনা খুব আবছা আবছা হলেও মনের মধ্যে মাঝে মাঝে কিছু প্রশ্ন নিয়ে উকি মারে। আর চাইলেও সেই সব ঘটনা গুলি আমরা ভুলতে পারিনা। ভোলা সম্ভব ও নয়।

আজ ২৪ অগাস্ট। ১৯৯৫ সালে তৎকালীন বি এন পি সরকারের ললাটে এক কলংকের কালিমা লেপন করে আমাদের পুলিশ ভাইয়েরা। আমাদের এক বোন ইয়াসমিন কে রাতভর ধর্ষণ করে জাতির কতিপয় সূর্য সন্তান নামের কিছু জারজ সন্তানেরা। এই ঘটনার প্রতিবাদে গোটা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। সাধারন মানুষের বিক্ষোভে সরকারের ভীত নড়ে যায়। তৎকালীন বি এন পি সরকারের নির্দেশেই পুলিশ সেই বিক্ষোভ মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায়। আরে তাতে প্রান হারায় ৭ জন নিরীহ মানব।

ফ্ল্যাশ ব্যাক
১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট ভোরে ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁওগামী হাছনা এন্টারপ্রাইজ নৈশ কোচের সুপারভাইজার ইয়াসমিন নামে এক তরুণীকে দিনাজপুরের দশমাইল মোড়ে নামিয়ে দেন। এক চায়ের দোকানদারকে বলেন, সকাল হলে তরুণীটিকে যেন দিনাজপুর শহরগামী বাসে উঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই সেখানে পৌঁছে পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যান। পুলিশ সদস্যরা চায়ের দোকানে বেঞ্চে বসে থাকা ইয়াসমিনকে নানা প্রশ্ন করে এক পর্যায়ে দিনাজপুর শহরে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে জোরপূর্বক পুলিশ ভ্যানে তুলে নেয়। এরপর তারা দশমাইল সংলগ্ন সাধনা আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইয়াসমিনকে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ রাস্তার পাশে ফেলে রেখে চলে যায়।

ওইদিনের সেই ঘটনায় গোটা দিনাজপুরের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদ আর বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ২৬ অগাস্ট হাজার হাজার জনতা দিনাজপুরের সদর থানা ঘেরাও করে। এবং ২৭ অগাস্ট হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ মিছিল বের করে দোষীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য স্মারকলিপি দিতে জেলা প্রশাসকের নিকট যায়। কিন্তু মধ্যপথেই পুলিশ নামের সেসব জারজ সন্তানরা বিনা উস্কানিতে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে সাতজনকে হত্যা করে। সেই সাথে আহত হয় প্রায় তিন শতাধিক।গোটা দিনাজপুর শহরের আইন শৃঙ্খলা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে শহরে ১৪৪ ধারা জারী করা হয়। শহরে দানবের মতন হুংকার করতে থাকে বি ডি আর আর সেনা সদস্যরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে ঐ রাতেই জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার কে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

ধর্ষকদের বিচার
ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা ঘটনায় দায়ের করা মামলাটি তিনটি আদালতে ১২৩ দিন বিচার কাজ শেষে ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট রংপুরের জেলা ও দায়রা জজ আবদুল মতিন মামলার রায় ঘোষণা করেন। মামলার রায়ে আসামি পুলিশের এএসআই মঈনুল, কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার ও পুলিশের পিকআপ ভ্যান চালক অমৃত লাল বর্মণের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ বিধান '৯৫-এর ৬ (৪) ধারায় ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুর আদেশ দেন। আলামত নষ্ট, সত্য গোপন ও অসহযোগিতার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এএসআই মঈনুলকে আরও ৫ বছরের সশ্রম কারাদ- দেওয়া হয়। অপরদিকে, দণ্ডবিধির ২০১/৩৪ ধারায় আলামত নষ্ট, সত্য গোপন, অসহযোগিতার অভিযোগে অভিযুক্ত আসামি দিনাজপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার আবদুল মোতালেব, ডা. মহসীন, এসআই মাহতাব, এসআই স্বপন চক্রবর্তী, এএসআই মতিয়ার, এসআই জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত তাদের খালাস দেন।

চাঞ্চল্যকর ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয় আট বছর পর, ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। মামলার অন্যতম আসামী এএসআই মইনুল হক, পিতা-জসিমউদ্দীন, গ্রাম-বিশ্রামপাড়া, উপজেলা-পলাশবাড়ী, জেলা-গাইবান্ধা ও কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার, পিতা-এসএম খতিবুর রহমান, গ্রাম-চন্দনখানা, উপজেলা-ডোমার, জেলা-নীলফামারীকে রংপুর জেলা কারাগারের অভ্যন্তরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ২০০৪-এর ১ সেপ্টেম্বর মধ্যরাত ১২টা ১ মিনিটে মৃত্যু দণ্ড- কার্যকর করা হয় । অপর আসামি পিকআপ ভ্যানচালক অমৃত লাল বর্মণ, পিতা-লক্ষীকান্ত বর্মণ, গ্রাম-রাজপুর, উপজেলা-সদর, জেলা-নীলফামারীকে রংপুর জেলা কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয় একই বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর মধ্যরাত ১২টা ১ মিনিটে।

আজ ১৬ বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও হাজার হাজার ইয়াসমিনরা এখনো প্রতিনিয়ত নির্মমতার শিকার হচ্ছেন। আমাদের চোখের সামনে দিয়েই ঘটে যাচ্ছে এই সব। কিছু আমাদের চোখে পড়ে, কিছু লোক চক্ষুর আড়ালেই রয়ে যায়। যেই দেশের প্রধানমন্ত্রী আর বিরোধী দলীয় নেত্রী নারী সেই দেশে নারীদের প্রতি এহেন আচরন সত্যি লজ্জাদায়ক। হাস্যকরও বটে। আর যেন কোন ইয়াসমিন এমন পরিস্থিতির শিকার না হয়। এই প্রত্যাশা ই জাতির।

***
সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিভিন্ন খবর:
১. দিনাজপুরে ইয়াসমিন হত্যা দিবস পালন, দৈনিক ইত্তেফাক, আগস্ট ২৬, ২০১০,
২. ইয়াসমিন ট্রাজেডি দিবস, ইউকে বিডি নিউজ, আগস্ট ২৪ ২০১১
৩. দিনাজপুরে ইয়াসমিন ট্র্যাজেডি দিবস পালিত, অনলাইন মিডিয়া সার্ভিস, আগস্ট ২৪ ২০১০
৪. আজ ইয়াসমিন ট্র্যাজেডি দিবস, দৈনিক করতোয়া, আগস্ট ২৪ ২০১১
৫. আজ ইয়াসমিন ট্রাজেডি'র ১৬তম বার্ষিকী ॥ দেশব্যাপী পালিত হচ্ছে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস,দিনাজপুর নিউজ ডট কম, আগস্ট ২৩ ২০১১

***
ফিচার ছবি: আন্তর্জাল থেকে গৃহিত