চাঁদের হাটে আমরা ক’জন আর…হযরত খান জাহান আলী (আঃ) মাজার শরীফের পাশে!

মোসাদ্দিক উজ্জ্বল
Published : 12 Sept 2011, 09:45 AM
Updated : 12 Sept 2011, 09:45 AM

গতকাল ছিল বাংলা ভাদ্র মাসের পূর্ণিমা। চাঁদের আলো কার না ভাল লাগে। নির্মল আর পবিত্র এক স্নিগ্ধ অনুভূতি ভোগ করতে কে না চায়? সেই নির্মলতার এক অনন্য চাঁদের হাট বসেছিল বাংলাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত বাগেরহাট জেলার হযরত খান জাহান আলী ( আঃ) এর মাজার শরীফের পাশেই। ঈদের পর ঢাকায় ফেরা হয়নি এখনও। ব্যক্তি এবং ব্যবসার কিছু কাজেই আমাকে অবস্থান করতে হয়েছে খুলনাতে। গতকাল বিকাল ৫ টার একটু আগে সেল ফোন টা বেজে উঠলো। অপর প্রান্ত থেকে পরিচিত বন্ধু তমাল এর কণ্ঠ ভেসে এলো। আমি হ্যালো বলতেই সে বলে উঠলো, গাধা! তুই তো সেই কবি সুলভ জীবন ভুলতে বসেছিস। আমি বললাম কেন? তমাল বলে উঠলো আজ যে ভাদ্র মাসের পূর্ণিমা মনে আছে? গত বছর এই দিনে আমরা প্রায় ৩০ জন বন্ধু রাতে মেঘনায় নৌ ভ্রমণে গিয়েছিলাম। এবং ওই দিনের কথা গুলো বোধ হয় তমাল বলতে চাচ্ছে এমনটি ভাবতে লাগলাম। তমাল বলল, আজ সব কাজ প্যাকাপ। ৬টায় আমরা বের হচ্ছি। বললাম, কোথায়? তমাল বলল, বাগেরহাট। বাগেরহাট শুনেই মনের মধ্যেই এক সুখানুভূতি অনুভব করা শুরু করে দিলাম। গত বার চৈত্র মাসের পূর্ণিমায় খান জাহান আলীর মাজারে গিয়েছিলাম। সেই বার ক্লোজআপ শিল্পী আবিদ ও সাথে ছিল। প্রতি বছর চৈত্র মাসের পূর্ণিমায় ওই মাজারে লাখ লাখ মানুষের সমাগম ঘটে। এবং তা ছাড়া প্রতি পূর্ণিমায়ও হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয় ওই খান জাহান আলীর মাজারে। যাই হোক তমালের কথায় এক বাক্যে রাজি হয়ে গেলাম। বললাম, আর কে যাবে? তমাল আমার আরও ৬ জন বন্ধুর কথা বলল। আমি রাজি হয়ে গেলাম।

বিকাল ৬ টার দিকে সবাই হাজির। আমি বললাম পূর্ণিমার আলো যদি এনজয় করতে হয় তবে সন্ধ্যার আগে আমরা কেউ যাচ্ছি না। সন্ধ্যার পরেই যাত্রা শুরু করবো। খুলনা থেকে বাগেরহাট এর দূরত্ব ৩০ কিঃ মিঃ। কাজেই যেতে খুব বেশি সময় লাগেনা। সন্ধ্যার আগেই শুরু হল এক ক্যাচাল। ওরা প্রাইভেট কারে যেতে চায়। আমি বললাম না। চাঁদের আলোই যদি দেখতে হয় তবে গাড়ীতে কেন? বাইকে যাব। আস্তে আস্তে বাইক চলবে। আর রাতের জোস্না উপভোগ করবো। ওরা প্রথমে রাজি নাহলেও আমার যুক্তির কাছে অসহায় হয়ে শেষ পর্যন্ত আমার দাবী মেনে নীল। সন্ধ্যার পর আমরা যাত্রা শুরু করে দিলাম। আমি ইয়ামাহা ফেযারে চড়ে বসেছি। পেছনে তমাল। অন্যদিকে রুপম, সুমন, প্রিন্স ও রাহাত আর দুইটা বাইকে। পুরা রাস্তার রাজা মনে হয় আমরা। ওরা গান শুরু করে দিল

নীল আকাশের নিচে আমি রাস্তা চলেছি একা!

আমি বললাম গাধার দল পূর্ণিমার রাতের আকাশের নিচে পথ চলেছি ৬ জন। আর তোরা কিনা বলছিস একা! হাসিতে সবাই ফেটে পড়লো। কিন্তু পথে বিপত্তি হল সার্জেন্ট। আমাদের কারো মাথায় হেলমেট নেই। সার্জেন্ট মামার এবার পোয়া বার। কেস ফাইল অথবা ৩ বাইকে ৬০০ টাকা!! কিন্তু তমাল তো বহুত কাঁচড়া। ৬০০ টাকা তো দেবেই না। আরও সার্জেন্ট এর কাছ থেকে ২০০ খাবে! সার্জেন্ট কিছুতেই আমাদের ছাড়বে না। তমাল বলল, কথা বলেন; এই বলে সেল ফোনটা সার্জেন্ট এর হাতে দিলেন। সার্জেন্ট বললেন, কে? তমাল বলল, কথা বলে দেখেন? সার্জেন্ট ফোন রিসিভ করেই স্যার স্যার বলে পা দাপানো শুরু করে দিল। আমি একা একা হাসি। হায় রে দুনিয়া! সঙ্গত কারনেই বলতে চাইলাম না ফোনটি কার ছিল। তারপর সার্জেন্ট আমাদের কাঁটা খালি মোড়ে বসেই জামাই আদর শুরু করে দিল। কি খাবেন ভাই আগে বলবেন না আপনারা স্যার এর ভাই। আমি আবারো হাসি। হাসি আর থামে না। আমি বললাম না আসলে ভুলটা আমাদের। তাড়াতাড়ি আসার কারণে আমরা কেউ হেলমেট আনতে পারেনি। আমরা রং। আপনি সঠিক আছেন। শেষ পর্যন্ত আমি বাধা দিলাম ওনার কাছে থেকে কিছু না খাওয়ার জন্য। কিন্তু তমাল এর মাথা গরম। ও খাবেই। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে ওকে আমি আমার বাইকের পেছনে বসালাম।

আবারো পথ শুরু। ১০ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম সেই চাঁদের হাটে। কিন্তু চাঁদের হাটে ঢুকতেই নির্মল চাঁদের আলো আর পবিত্র বাতাসে এক ধরনের গন্ধ অনুভব করলাম। বিশ্রী এক গন্ধে গোটা চাঁদের হাট যেন অপবিত্র মনে হতে লাগলো। দেশ বিদেশ থেকে বিভিন্ন সাধু আর সন্ন্যাসীর মিলন মেলার মধ্যেই জমে উঠেছে ভক্তদের ভালবাসা আর মারফতি শরিয়তি গানের আসর।

একবার দিদার দে বাবা একবার দিদার দে, দে বাবা দে বাবা দে বাবা দে। বাবা খান জাহান জানেরই জান চরণ কর দান দান দান।

এই সব গান ভেসে আসতে লাগলো কানে। কিন্তু গাঁজার গন্ধে পরিস্থিতি কেমন বীভৎস মনে হতে লাগলো। কেউ কেউ জিকির করছে। কেউ কেই জিকির করতে করতে একেবারে উলঙ্গ হয়ে গেছে। কেউ কেউ জিকির করতে করতে বিশাল এক গাছের মগ ডালে উঠে গেছে। শেষ পর্যন্ত পুলিশ এসে ওই ভক্তকে নামিয়ে এনেছে গাছের মগ ডাল থেকে। আমাদের ইসলামী শরীয়তে যেগুলো পুরো শিরক আর বেদাত সেই সব কাজ গুলো দেখতে লাগলাম চোখের সামনে। এক দিকে মুখে দাড়ি অন্য দিকে হাতে গাঞ্জা সেই সাথে আল্লার জিকির আল্লাহু!!! নাউজুবিল্লা।

এক জনকে দেখলাম বলছে মাজারের দিকে চেয়ে বাবা তুমি আমার ছেলেকে সুস্থ করে দাও। একজন বলছে বাবা আমার স্ত্রীর সন্তান হয় না ওর কোলে সন্তান দাও। একজন বলছে বাবা আমারে একটা চাকরি দাও।

নাউজুবিল্লা! এইরকম হাজারো নাজায়েজ কাজ দেখে ভাল লাগলো না। বাবা দেবে কি ভাবে? বাবার বাবার ও ক্ষমতা নেই কিছু দেওয়ার। সকল ক্ষমতা কেবল মহান আল্লার।

আমরা ঘুরছি। হঠাৎ আমার বিডি ব্লগের কথা মনে পড়ে গেল। ভাবলাম বিষয়গুলো শেয়ার করার দরকার। আমি আইরিন আপু কে এসএমএস দিলাম। আইরিন আপুকে বেশ অতি উৎসাহী মনে হল। তিনি বললেন ছবি ধারণ করতে। কিন্তু আমরা কেউ ক্যামেরা নিয়ে আসেনি। বাধ্য হয়ে মোবাইলে কিছু ছবি ধারণ করলাম। আইরিন আপুর সাথে এসএমএস বিনিময়ে মনে হল উনিও আছেন আমাদের ৬ জনের সাথেই। কিন্তু ছবি তুলতে গেলে ওই সব গাঞ্জা বাবারা ক্ষেপে যায়। আর একটা বিপত্তি দেখা গেল সেটি হল স্পটে কোন আলো জ্বালানো যাবে না। মোমবাতি ছাড়া। তাই অন্ধকারে কোন ছবিই শেষ পর্যন্ত ভালভাবে নিতে পারলাম না। তবুও আইরিন আপুর কথা রাখতেই হবে। নিলাম গোপনে কিছু ছবি। যেইগুলো শেয়ার করলাম।

রাত ১১ টার দিকে আমরা আবারো আমাদের ঘরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। আর রাস্তায় বসেই চোখের সামনে দিয়ে ভাসছে সেই সব দৃশ্য গুলো।কোন জগতে আছি আমরা? জেনে শুনে আল্লার সাথে শিরক করা! আইরিন আপু বললেন একটি পডকাস্ট ভিডিও পোস্ট করতে। অনেক রাতে সেটি পোস্টও করলাম। যেটি ব্লগ পেজে এখনও দেখা যাচ্ছে [লিংক]।

আসলে আজকের এই লেখাটি শেয়ার করার একটি মহৎ উদ্দেশ্য আছে। আর সেটি হল ২০১১ সালেও পরিপূর্ণ ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পন্ন একজন মানুষ হতে পারিনিসকল ধর্মীয় অনুশাসন গুলো নাই বা পালন করা গেল তাই বলে আল্লার সাথে শিরক করা কিংবা বেদাতে জড়িয়ে পড়া এটা বোধ হয় মুসলমানদের কোন বৈশিষ্ট্য হতে পারেনা। এই সব মানুষ গুলোকে মহান সৃষ্টি কর্তা হেদায়েত করুন। আর আমরা যেন শিরক- বেদাত হতে মুক্ত থাকি।