কানকাটা রমজান ও একজন ভূমিদস্যু…

ওয়াচডগ
Published : 12 March 2012, 05:52 AM
Updated : 12 March 2012, 05:52 AM

গৌরনদী ডট কমে (http://gournadi.com/) খবরটা পড়ে নিজের কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করার ইচ্ছাটা চাপতে পারলাম না। সময়টা তখন বিএনপির। ছাত্রদল, যুবদল, শ্রমিক দল, ওলামা দল, তাতী দল সহ হরেক রকম আন্ডা বাচ্চা নিয়ে মসনদে বসে আছেন বেগম জিয়া। পাশাপাশি ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, তাতী লীগের উজির নাজির সহ পানি পথের যুদ্ধের জন্যে তৈরী হচ্ছেন অন্য এক মহিয়সী। ১২ বছরে বর্ণাঢ্য ইউরোপীয় জীবন শেষে কেবল দেশে ফিরেছি। ভাল করে ক্যারিয়ার শুরুর আগেই বাবার মৃত্যু বদলে দেয় জীবন নক্সাা। রাজধানীর লোভনীয় চাকরিতে ইস্তাফা দিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হই মেঘনা পাড়ের নিজ বাড়িতে। ৭৪ সালের পর ছোট্ট জেলা শহরটায় স্থায়ীভাবে আর থাকা হয়নি, তাই সবকিছুর সাথে নতুন করে পরিচয় করতে হল। এ পরিচয় পর্বের শুরুতেই দেখা হয় আমিরুলের (আসল নাম নয়) সাথে। স্থানীয় ছাত্রদলের সভাপতি। হালকা পাতলা টাইপের শরীর আর চোখে মুখে ফেন্সির প্রেতাত্মা থাকলেও এই সেনাপতির চলাফেরায় থাকত নেপোলিয়ানের দৃঢ়তা আর কাজকর্মে কানকাটা রমজানের হিংস্রতা। স্থানীয় ডিসি, এসপি, ওসি সবাইকে এক অর্থে দৌড়ের উপর থাকতে হত হরিহরের চাহিদা পূরণ ও মন জয়ের জন্যে। ক্ষমতা নামক পানিপথে যুদ্ধরত এসব সৈনিকদের ভাগ্য কোন ঘাটে বাঁক নেয় আর কোন ঘাটেই বা নোঙর করে এ নিয়ে কোন কালেই আগ্রহ ছিলনা। কিন্তু এ সেনাপতির ভাগ্য নিয়ে আগ্রহের পেছনে অন্য একটা কারণ ছিল। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের ৫০ বছরের পুরানো পারিবারিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের পাশেই ছিল আমিরুলদের বাসা। কোন এক সুন্দর সকালে আবিস্কার করলাম ওদের পয়োপ্রণালি নিষ্কাশনের ড্রেন আমাদের সীমানার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পরিকল্পনা ক্ষমতার সর্বোচ্চ পর্যায় হতে পাশ হয়ে এসেছে। তাই নির্মান করতে বেশ কিছু শ্রমিক জড়ো হয়েছে আমাদের সীমানায়। পিস্তল হাতে এই নির্মান কাজের নেত্রীত্ব দিচ্ছেন খোদ নেপোলিয়ান। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে প্রতিবাদ করতে গেলাম। আমার ছোট ভাই এসে বাধা দিল। জানাল এদের সাথে তর্কে জড়ানো মানে মৃত্যুর সাথে জুয়া খেলা। সাড়াটা দুপুর ভারাক্রান্ত মনে দেখতে হল এ অন্যায়। আইনের আশ্রয় নিতে গিয়ে আবিস্কার করলাম বাংলাদেশি থানা, পুলিশ, হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট আসলে মহারানীদের উজির নাজির কোতয়ালদেরই অংশ। এভাবেই কেটে গেল কটা বছর। ঋতু বদলের পালার মত সময়ের চাকায় চড়ে দিগন্ত রেখায় হাজির হল তত্ত্ববধায়ক নামের আউলা ঝাউল বাউলা সরকার। সরকার আসে সরকার যায় এবং এক কাপ চা ও একটা আকিজ বিড়ির গণতান্ত্রিক ঘোড়ায় চেপে বন্দরে হাজির হয় নতুন নতুন নেপোলিয়ান, এভাবেই নাকি অভ্যস্ত স্থানীয় ব্যবসা বানিজ্য। কিন্তু এ যাত্রায় ব্যাপারটা একটু অন্যদিকে মোড় নিল। নেপোলিয়নের ঘোড়া আসলো ঠিকই কিন্তু তাতে কোন সওয়ারী দেখা গেলনা। শোনা গেল যুদ্ধক্ষেত্র অরক্ষিত রেখে ওরা পালিয়েছে।

বিদ্যুৎ গতিতে খবরটা ছড়িয়ে পরল। আমিরুলকে গ্রেফতার করেছে সেনাবাহিনী। বাজার হতে মুরগি ক্রয়ের পর যেভাবে ঘরে নিয়ে যায় একই কায়দায় আমিরুলকেও নিয়ে যাচ্ছে। নীচের দিকে মাথা আর শূন্যে দু'পা ঝুলিয়ে জামাই আদরে খাতির করছে উর্দিওয়ালারা। শহরে চৌরাস্তার মোড়ে অনেকক্ষণ ধরে চলল এ প্রদর্শনী। দর্শকরাও প্রাণ ভরে উপভোগ করল 'বীরের' করুণ পরিণতি। সুযোগ পেয়ে শরীরে থুথু পর্যন্ত ঝরতে কার্পণ্য করল না অনেকে। শহরের আবহাওয়া বেশ কটা মাস গরম থাকল আমিরুলকে কারণে। গ্রেফতারের সাথে সাথে আমাদের আঙ্গিনায় বহমান মেইড ইন নেপোলিয়ন ড্রেনও ঠাই নিল ক্ষমতা হারানোর ইতিহাসে।

বরিশালের গৌরনদী হতে প্রকাশিত গৌরনদী ডট কমেও দেখলাম একই ধরণের একটা খবর। খবরের টাইটেলটা এরকম, আবুল হাসনাত আবদুল্লার বিরুদ্ধে সওজ ও শহীদ পাঠাগারের চার কোটি টাকার সম্পত্তি দখল করে দেয়াল নির্মানের অভিযোগ। খবরে প্রকাশ গৌরনদী উপজেলার উত্তর বিজয়পুর মৌজার এস এ খতিয়ান নং ১৬৭, ১৬৮ ও ৩৪৩, ৩৪৪ ও ৩৪৫ নং দাগের ৮৩ শতাংশ জমি যার বর্তমান বাজার মূল্য চার কোটি টাকা তা জনাব হাসনাত আবদুল্লাহ নিজের দাবি করে দখলে নিয়েছেন এবং রাতারাতি দেয়াল উঠিয়ে দখল পোক্ত করেছেন। উল্লেখ্য, জমির আসল মালিক কৃষ্ণ কান্ত ধুপী, শ্যামল লাল ধুপী, ভাষারাম ধুপী ও শংকর লাল ধুপী যৌথভাবে জমিটি শহীদ স্মৃতি পাঠাগারের জন্যে ১৯৭৫ সালে সাফ কেবলা দলিল করে দিয়েছিলেন। চার কোটি টাকার সম্পত্তি চোখের সামনে এতিম হয়ে থাকবে এমন একটা বাস্তবতা বাংলাদেশের জন্যে এখন গবেষণার বিষয়। তবে পাবলিক ধিক্কারকে ধামাচাপা দেয়ার খুব ভাল একটা সহজ ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতেও তিনি ভুল করেননি। দখলের পর মহানুভবতা দেখাতে জমির কিছু অংশ স্থানীয় প্রেস ক্লাবের নামে বরাদ্দ দিয়ে সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করার পুরাণ কৌশল প্রয়োগ করেছেন। তবে এ ক্ষেত্রে সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহ মোহম্মদ মোকাদ্দেসের উক্তিটা উল্লেখ না করলে লেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তিনি বলেছেন, দখলদাররা জমি দখল করেছে তাতে কি, সময় এলেই তা উচ্ছেদ করা হবে। সময় বলতে তিনি কোন সময় বুঝিয়েছেন তা আমার মত মূর্খদের কাছেও খুব একটা অপরিস্কার নয়। নিশ্চয় তা তত্ত্বাবধায়ক নামক আতংকের সরকার।

গণতন্ত্রের পূজায় যারা সর্বক্ষণ বুদ থাকেন তাদের কাছে তত্ত্বাবধায়ক শব্দটা এক কথায় আতংকের। এ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে , সভা-সেমিনারে আলোচনা গবেষণা হচ্ছে। দেশের সুশিল সমাজ জোর গলায় বলছেন এমন একটা সরকার গণতান্ত্রিক সমাজের কলংক। আর এ কলংক হতে মুক্তি পাওয়ার হরেক রকম দাওয়াই তাবিজ নিয়ে হাজির হচ্ছেন বিভিন্ন মিডিয়ায়। কিন্তু আমরা যারা কানকাটা রমজানদের গণতন্ত্রে নিয়মিত দলিত মথিত হচ্ছি তাদের পরিণতি নিয়ে কেউ কোন শব্দ করছেন না। বাই, অব এন্ড ফর দ্যা পিপল তত্ত্বের গণতন্ত্রের জন্যে খুব কি অপমানজনক হবে যদি কোন বাউলা সরকার হাসনাত আবদুল্লাকে গৌরনদী প্রেস ক্লাবের চৌকাঠে ঝুলিয়ে গণ প্রদর্শনীর আয়োজন করে? গণতন্ত্রের ভবিষ্যত ভেবে অনেকে হয়ত হায় হায় করে উঠবেন, অনেকে আবার গণতন্ত্রের গরম মসলায় সুস্বাদু খাবার তৈরী করবেন। কিন্তু আমার মত যারা সহায় সম্বলহীন বাংলাদেশি তাদের অনেকেই সে প্রদর্শনীতে হাজির হবেন এবং সুযোগ বুঝে এক দলা থুথু মেরে নিজের অক্ষমতা গুলোকে হাল্কা করার চেষ্টা করবেন। গণতন্ত্রের মসৃণ উত্তরণের জন্যে অনেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তাকে সামনে টেনে আনছেন এবং এর পক্ষে সাফাই গাইছেন। ব্যক্তিগত ভাবে এক কাপ চা আর একটা আকিজ বিড়ির গণতন্ত্রের জন্যে আমার তেমন কোন উদ্বেগ নেই। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলেই গণতন্ত্র ডালপালা মেলে আকাশে উঠে যাবে এমনটা ভেবে সময় নষ্ট করিনা। ক্ষমতার জন্যে পানিপথের মাঠ আছে, ওখানেই লেখা হবে এর ভাগ্য। আমার জন্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন অন্য কারণে। আমিরুল আর হাসনাত আবদুল্লাহদের প্রাপ্য একদিনের জন্যে হলেও বুঝিয়ে দেয়া দরকার, এক ঘন্টার জন্যে হলেও এদের মুরগী কায়দায় ঝুলানো প্রয়োজন। এমনটা করতে ব্যর্থ হলে সভ্যতার প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাবে, সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস হারাতে শুরু করবে। আর তাতে বেচে থাকা হয়ে যাবে অর্থহীন। যেহেতু আকাশ হতে আবাবিল পাখি এসে শাস্তি দেয়ার সম্ভাবনাও নেই, তাই আমার মত আবুলদের জন্যে তত্ত্বাবধায়কই শেষ ভরসা।