দক্ষিন এশিয়ায় নয়া মেরুকরণ

জাফর পাঠান
Published : 24 March 2012, 01:37 PM
Updated : 24 March 2012, 01:37 PM

বর্তমান আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিমন্ডলে দক্ষিণ এশিয়া কেন্দ্রিক রাজনৈতিক ও সামরিক তৎপরতা বেশী পরিলক্ষিত হচ্ছে বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত ও উদীয়মান শক্তিগুলোর মধ্যে। এই তৎপরতার পিছনে মূলত বেশ কয়েকটি কারণ ও উদ্দেশ্য কাজ করছে। এর মধ্যে প্রধান কারণগুলি হচ্ছে-

1.বিশ্ব ক্ষমতার বলয়ে চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠতায় দ্রুত উত্থান
2.ভারতের স্বার্থ সংরক্ষণে এবং অভিন্ন দৃষ্টিকোণের আলোকে ভারত কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক।
3.সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো ও ভারতের আফগানিস্তানে অবস্থান গ্রহন।
4.মুসলিম বিশ্বে ইসলামিক শক্তি হিসাবে পাকিস্তান ইরানের পারমানবিক শক্তি অর্জন ও প্রযুক্তিগতভাবে খুব দ্রুত এগিয়ে যাওয়া।
5.দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার বিপুল প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদের উপর লোলুপ দৃষ্টি।
6.চীন ও ভারতের কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব।
7.আরব সাগর, ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগরে কৌশলগত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা।

উল্লেখিত কারণগুলির কারণে দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলি রাজনৈতিক ও সামরিক গাঁটছড়ার মাধ্যমে নয়া অবস্থান গ্রহনের দিকে ধাবিত হচ্ছে ও কিছু কিছু ক্ষেতে বাধ্য হচ্ছে। চীন অর্থনৈতিক সহায়তা, প্রযুক্তিগত সহায়তা ও সুসম্পর্কের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলিকে কাছে টেনে নিচ্ছে। অপরদিকে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের সহযোগিতায় ছলে-বলে-কৌশলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিকে কাছে টানার চেষ্টা করছে। এই চেষ্টার প্রক্রিয়ায় অতীতে ভারত সিকিম নামক স্বাধীন একটি দেশকে গিলে খেয়েছে এবং ভূটানকে গৃহপালিত রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। মেরুকরণের পরিক্রমায় প্রথমে আসা যাক মূল মেরুকরণের পরিক্রমার কারণগুলিতে। (১) বিশ্ব ক্ষমতার বলয়ে চীনের আবির্ভাব এশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর ঘুম হারাম করে দিয়েছে। জাপানকে টপকে বিশ্ব অর্থনীতিতে দ্বিতীয় শক্তি হিসাবে আবির্ভাবের পর অধুনা প্রথম স্থানটিও চীনের দখলে চলে আসবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। যদিও প্রথম স্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত দেশ হিসাবেও প্রথম স্থানের অধিকারী। সামরিক অনেক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে যাওয়া চীন- যুক্তরাষ্ট্রের ঘরের দেশ কিউবা, বলিভিয়া, ভেনিজুয়েলা ও অন্যান্য প্রতিবেশীদের সম্পর্কের বাহুডোরে যেভাবে বেঁধে ফেলছে ঠিক তেমনি ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকাতেও চলছে। রাজনৈতিক কারণে পাশ্চাত্য তৃতীয় বিশ্বের যেইসব দেশগুলিতে সাহায্য বন্ধ করে দিচ্ছে সেখানে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে চীন। বিচ্ছিন্নতাবাদ উস্কে দিয়ে যেইসব দেশ থেকে ফায়দা লুটছে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি সেইসব দেশকে চীন সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তার মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনে সচেষ্ট হচ্ছে। যার কারণে বিশ্বে প্রভাব প্রতিপত্তিতে মার্কিন ও পাশ্চাত্যের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়িয়েছে চীন। পাশাপাশি চীনের প্রতিবেশী ভারত তার প্রতিপক্ষের তালিকায় পাকিস্তানকে দ্বিতীয় নাম্বারে সরিয়ে দিয়ে প্রথম স্থানে বসিয়েছে চীনকে। তাই চীনকে কাবু করার মানসে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ দেশ ভারত সহযোগীদের সাথে নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম দেশ চীনকে কেন্দ্র করে বলয় সৃষ্টির চেষ্টায় রত হয়েছে। (২) ভারত ভালো করেই জানে একার পক্ষে চীনকে মোকাবেলা করা তার পক্ষে অসম্ভব এবং ভারতের দীর্ঘদিনের বন্ধু রাশিয়াকে চীনের বিরুদ্ধে কাজে লাগানো সম্ভব নয়। কারণ, চীন ও রাশিয়া দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দূরদৃষ্টি নিয়ে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে। যেখানে নিজস্ব স্বার্থ সংরক্ষণে ভারতের স্বার্থ দেখা রাশিয়ার কাছে গৌণ হয়ে দাঁড়ায় সময়ে সময়ে। তাই উপায়ান্তর না দেখে চীন, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও অন্যান্য উদ্দেশ্যকে ঘিরে একই মনোভাবাপন্নের দেশ যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল ও পাশ্চাত্যকে বেছে নিয়েছে ভারত। যা দক্ষিণ এশিয়ায় খাল কেটে কুমির আনার পর্যায়ে পড়ে।

যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল ও অন্যান্য পাশ্চাত্য শক্তিকে নিয়ে ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় যেই খেলায় অবতীর্ণ হয়েছে রাজনৈতিক বিশে­ষকদের মতে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ের ন্যায় আফগানিস্তানের মত ভারতকেই একটি অস্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করবে। কারণ পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিকার করায়ই স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। বিপদ দেখলে রূপের পরিবর্তন ঘটিয়ে শটকে পড়ে। কারণ, ভারতের এই দোস্তি আফগানিস্তান, পাকিস্তানের উগ্রবাদ সহিংসতা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াকে ছেয়ে ফেলবে। এই দোস্তীর অংশিদার দক্ষিণ এশিয়ার যেই রাষ্ট্র হবে তাকেই বিপর্যস্ত পাকিস্তানের মত দোস্তীর প্রতিদান পেতে হতে পারে।

(৩,৪,৫)ভারতের সাথে বর্তমান দোস্তীর বহু পূর্বে সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য নিয়ে আফগানিস্তানে পদার্পন করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো। ২০১৪ সালে চলে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও এখন বলছে থাকবে। দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার খনিজ সম্পদের উপর লোলুপ দৃষ্টি রয়েছে ইউরোপ, আমেরিকা, চীন ও ভারতের। ভারত ও ইউরোপ বর্তমানে বিপুল জ্বালানী ঘাটতিতে নিপতিত। বিশেষ করে ভারতের জ্বালাণী ঘাটতির কারণে শিল্পোৎপাদন মারাত্বকভাবে মার খাচ্ছে। তাই উদভ্রান্ত ভারত দিকভ্রান্ত হয়ে পাশ্চাত্যের সাথে আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছে। খনিজ সম্পদ ব্যতীত চীনকে এবং ইরান ও পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে আফগানিস্তানে পশ্চিমাদের অবস্থান। কারণ দক্ষিণ এশিয়ায় পাকাপোক্ত অবস্থান নিতে পারলে ভারতের সহযোগিতায় ইসলামিক পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র পাকিস্তানকে কব্জা করা যাবে। আফগানিস্তানে অবস্থানের মাধ্যমে পশ্চিমাদের আরেক মাথা ব্যথা মুসলিম পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র ইরানকে ইরাক ও সৌদি আরবের মার্কিন সামরিক ঘাঁটির মাধ্যমে ঘিরে রেখে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। পাশাপাশি ভারতের সহায়তায় চীনকে নির্ঘুম রজনী কাটাতে চেষ্টা করা যাবে। এতসব উদ্দেশ্য নিয়ে পশ্চিমা শক্তি আমাদের দক্ষিণ এশিয়ায় ঢুকে পড়াতে ছোট দেশগুলি বিপাকে পড়ে গিয়েছে। কারণ কৌশলগত কারণে ছোট দেশগুলি এখন তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।

(৬,৭) দক্ষিণ এশিয়ায় চীন ও ভারতের কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব অত্র অঞ্চলকে নতুন করে নাড়িয়ে দিচ্ছে। ভারত পরাশক্তি চীনকে নিয়ে প্রতিনিয়তই বিনিদ্র রজনী কাটাচ্ছে। কারণ চীন ভারতের চতুর্দিকের রাষ্ট্রগুলিকে প্রায় নিজস্ব বলয়ে নিয়ে ফেলেছে। পাশাপাশি ভারত মহাসাগর ও আরব মহাসাগরে অবস্থিত দেশগুলির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে চীন নৌশক্তির মাধ্যমে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ভারতকে প্রায় নিঃসঙ্গ করে দিয়েছে। পশ্চিমাদের সহায়তায় আফগানিস্তানে ভারত অবস্থান নিয়েছে মূলত পাকিস্তানকে চাপে রাখার জন্য এবং পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশগুলিতে বিচ্ছিন্নতাবাদ উস্কে দিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্নতাবাদে পাকিস্তানের হাতকে গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য করার জন্য। পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে দূর্বল করে সামরিক ক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতাকে সংকুচিত করে দিয়ে কৌশলগত স্বার্থ হাসিলের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে আফগানিস্তানকে কাজে লাগানোর চিন্তাও ভারতের সামরিক চিন্তায় আছে। কিন্তু আফগানিস্তান বিষয়ক গবেষকদের মতে যেখানে কোন পরাশক্তি টিকে থাকতে পারে নি সেখানে পশ্চিমাদের অবর্তমানে ভারতের অবস্থান তাদেরকে শোচনীয় পরিণতির গুহায় ঠেলে দিবে। ভারত আশাবাদী তাদের প্রচেষ্টা সফল হবে। সেই কামনায় সম্প্রতি ভারত সফর করতে আসা আফগান প্রেসিডেন্টের সাথে ভারত কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি সম্পন্ন করেছে। চুক্তি করার পরও পাকিস্তান আতংক আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই বলতে বাধ্য হচ্ছে- পাকিস্তান আমাদের যমজ ভাই। তবে কারজাই ভারতের সাথে ইতিমধ্যে পাকিস্তানের রোষাণলে পড়ে গিয়েছে যার নমুনা বিভিন্ন বিবৃতিতে পাওয়া যাচ্ছে। পাকিস্তান এতে আরও প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলতে পারে বলে আশংকা আছে। পশ্চিমাদের সাথে নিয়ে ভারতের এই তৎপরতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ডাবল স্ট্যান্ড পাকিস্তানকে চীনের সাথে আরো ঘণিষ্ঠ করে দিয়েছে। এবং মেরুকরণে সক্রীয়ভাবে অংশগ্রহণে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাঁড় করালেও অভিজ্ঞ মহলের বিশ্বাস- সাবেক আফগান প্রেসিডেন্ট বুরহানুদ্দিন রববানি হত্যাকান্ড এবং ১১ ও ১৩ সেপ্টেম্বর ভার্দাক প্রদেশ ও কাবুলে সন্ত্রাসী হামলা ঘটানো হয়েছে আফগানিস্তানে পশ্চিমা ও ভারতের অবস্থান স্থায়ী করার জন্য। আরও বিশ্বাস আফগানদের মনে পাকিস্তানের প্রতি বিদ্বেষ জন্মানোও অভিযোগের পিছনে উদ্দেশ্য ছিলো। ছিদ্রান্বেষণকারীদের দৃষ্টিতে এই বিদ্বেষ জন্মানোর উপর ভর করেই নির্দ্বিধায় ভারতের সাথে অংশিদারী চুক্তিটি করাটা সহজ হয়েছে। ভারত নয়া মেরুকরণে আফগানিস্তান ব্যতিত দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশকে বর্তমানে বাগে আনতে পেরেছে শুধুমাত্র ভারত বান্ধব আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্য। সামরিক কোন চুক্তি ভারত করতে না পারলেও ভৌগলিক কৌশগত বেশ কিছু চুক্তি ভারত বাগিয়ে নিয়েছে বর্তমান সরকারের হাত ধরে। যার প্রতিফল স্বরূপ- বাংলাদেশ ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে, অবকাঠামো ক্ষেত্রে। অভিজ্ঞ মহলের আশংকা রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিপর্যয় শুরু হওয়ার আশংকা আছে- যদি চীনের স্বার্থ বিরোধী কোন পদক্ষেপ এই সরকার গ্রহন করে। চীন বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু। বাংলাদেশকে অবকাঠামোগত, প্রযুক্তিগত, সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তার সামগ্রিক বিচারে সবচেয়ে বড় সহায়তাকারী দেশ হচ্ছে চীন। চীনের সাথে বাংলাদেশের সামরিক সহযোগিতা চুক্তি (Defence co-operation agreement) আছে। যার মাধ্যমে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী উত্তরোত্তর আধুনিক ও সমৃদ্ধ হচ্ছে। আগামী ১৫ মাসের মধ্যে ১৬৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তির আওতায় ৪৪ টি আধুনিক এমবিটি-২০০০ নামের সামরিক যুদ্ধযান পাচ্ছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মুবিন এবং চলতি মাসে বাংলাদেশের সংসদ স্পীকার আব্দুল হামিদ চীন সফর করে এসে সফরকে অত্যন্ত ফলপ্রসূ বলে আখ্যায়িত করেছেন। স্পীকার তার সফরে চীনের গণ কংগ্রেসের স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যানকে বলেন- বাংলাদেশ চীনকে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও আস্থাবান বন্ধু হিসাবে দেখে। সুতরাং বন্ধুত্বের ও সহযোগিতার ঘনিষ্ঠতার আলোকে বলা যায় ভারত বাংলাদেশকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারবে না। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপে একটি গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরী করে দেওয়ার জন্য চীনকে অনুরোধ করেছে। চীন বাংলাদেশের সাথে সড়ক পথ সংযোগের জন্য মায়ানমারের সাথে কাজ করে যাচ্ছে বলে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত জানান।
দক্ষিণ এশিয়ার নয়া মেরুকরণে বর্তমান সরকারের বদৌলতে বাংলাদেশকে ভারতের গায়ে ঠেস দিয়ে দ৭াড়ানোর জন্য ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। শ্রীলংকার ক্ষেত্রে পরীক্ষায় ভারত অকৃতকার্য হয়েছে। ভারতের নিকট প্রতিবেশী ও একসময়ের ভারত বলয়ের দেশ শ্রীলংকা ভারত সৃষ্ট তামিল টাইগারদের মাধ্যমে বন্ধুত্বের মধুর কষাঘাতে প­xত হয়ে এখন চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে নিজেকে রক্ষা করছে। শ্রীলংকা চীনের সহায়তায় টাইগারদের পরাজিত করে রাষ্ট্র গঠনে মনোযোগী হয়েছে। শ্রীলংকা চীনের সহায়তায় টাইগারদের পরাজিত করে রাষ্ট্র গঠনে মনোযোগী হয়েছে। শ্রীলংকার চরম দূর্দিনে পশ্চিমা শক্তি ও ভারত যখন হাত গুটিয়ে নিয়েছিলো তখন চীন এগিয়ে না আসলে শ্রীলংকা এতদিনে হয়তো টুকরো টুকরো হয়ে যেতো। কারণ বিশ্বের গেরিলা যুদ্ধের ইতিহাসে তামিল টাইগাররা ছিলো ব্যতিক্রম। টাইগাররা বিমান বাহিনী এবং নৌবাহিনী শক্তির অধিকারী হয়ে গিয়েছিলো। বর্তমানে চীনকে শ্রীলং নৌবন্দর ও বিমানবন্দর উন্নয়ন ও ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। নয়া মেরুকরণে চীনের কৌশলগত বন্ধু হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে।

নেপালকে ভারত প্রায় গিলেই ফেলেছিলো। ভারতের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিলো নেপাল। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে বহির্বিশ্ব থেকে ভারতের অনুমতি ব্যতিত সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করতে পারত না নেপাল। ভারত কর্তৃক শোষণের তলানিতে পৌঁছেছিলো। ভারতের পদলেহী নেপালী কংগ্রেস পার্টি ভারতের স্বার্থ সংরক্ষণ করে চলতো। রাজপরিবার এক সময় এই কংগ্রেস পার্টি দ্বারা কোনঠাসা হয়ে পড়াতে চীনমুখী অবস্থান নিতে শুরু করেছিলো। কিন্তু চক্রান্তের মাধ্যমে তাদেরকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেওয়া হলো। ভারতের ক্রীড়নক রাজপরিবার প্রতিষ্ঠিত হলো। কিন্তু নির্যাতিত মানুষদের সংগঠন মাওবাদী গেরিলা গোষ্ঠী সশস্ত্র সংগ্রাম ত্যাগ করে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে নেপালের রাজনৈতিক চেহারা প­vস্টিক সার্জারীর ন্যায় আমূল পরিবর্তন করে ফেললো। রাজতন্ত্র ও হিন্দু রাষ্ট্রের লেবাস খুলে পরিধান করলো প্রজাতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার পোশাক। ভারতের প্রভাবকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বর্তমানে মার্কসবাদী কম্যুনিষ্ট ও মাওবাদী কম্যুনিষ্টদের যুগ শুরু হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ মাসে চীনের সামরিক বাহিনীর প্রধান ১৫ জন সামরিক প্রতিনিধিসহ নেপাল সফরে এসে সরাসরি নেপালের সামরিক বাহিনীর সাথে সামরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। যার আওতায় নেপালের সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিবে চীন। এই চুক্তির আওতায় নেপালের সামরিক বাহিনী ২০ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তাও পাবে। দুই দেশের সহযোগিতার আওতায় অতি শীঘ্রই চীনের তিববত হইতে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু পর্যন্ত রেলওয়ে লাইন নির্মাণ শুরু হচ্ছে। নয়া মেরুকরণে নেপাল বর্তমানে চীনের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে।

মালদ্বীপ পৌণে দুই হাজার ক্ষুদ্র দ্বীপের সমন্বয়ে একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হলেও এর কৌশলগত অবস্থান পরাশক্তিগুলিকে এর প্রতি আকৃষ্ট করে তুলছে। মালদ্বীপকে অংশীদারি হিসাবে পাওয়ার জন্য চীন, ভারত ও পাশ্চাত্য মরিয়া। ভারতের প্রযুক্তিগত সহায়তায় কৃপণতা এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতার সুযোগে চীন খুব দ্রুত মালদ্বীপের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। ২০০১ সালের মে মাসের ১৭ তারিখে চীনের প্রধানমন্ত্রী জু রঞ্জী (Zhu Rongji) মালদ্বীপ সফর করার সময় মালদ্বীপের মারাও নামক দ্বীপটি ২৫ বছরের জন্য লীজ নিয়েছে একটি চুক্তির মাধ্যমে। এই দ্বীপে চীন সাবমেরিন বেজ নির্মাণ করবে। বর্তমানে পাকিস্তানকে সাথে নিয়ে চীন মালদ্বীপের সাথে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠতার চেষ্টায় সচেষ্ট আছে। মালদ্বীপ ও ভারতের মধ্যবর্তী সাগর দিয়ে বর্তমানে প্রতিবছর ২৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের তেল ও গ্যাস পরিবহন হয়। মালদ্বীপ এই সুযোগে সহযোগিতার বিনিময়ে অর্থনৈতিক ও কাঠামোগত সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছে। তবে নয়া মেরুকরণে সরাসরি অবসথান না নিলেও যে কোন সময় মোড় ঘুরে যেতে পারে।

পাকিস্তানের সাথে চীনের সম্পর্ক সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। পাকিস্তানের বর্তমান উন্নয়নে পাকিস্তানের অবদান সবচেয়ে বেশী। বর্তমানের এই সংকটময় সময়েও চীন পাকিস্তানে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। পাকিস্তান ভারতকে শায়েস্তা করার সংকল্পে আরব মহাসাগরে ভারতের দোরগোড়ায় চীনকে দুইটি গভীর নৌবন্দর করার এবং সামরিক উপস্থিতির অনুমতি দিয়েছে। যা ভারতকে মহা ফাঁপড়ে ফেলে দিয়েছে এবং সামরিক ক্ষেত্রে কৌশলগত সুবিধায় চীন ভারতের পেটের ভিতর ঢুকে পড়লো। নয়া মেরুকরণে চীন পাকিস্তান দোস্তী আরো বলিষ্ঠ হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার কর্তৃত্বের প্রতিযোগিতায় যে নয়া মেরুকরণেরসূত্রপাত হয়েছে তাতে কোন রাষ্ট্র যদি সঠিক অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয় তাহলে সেই দেশকে দূর্দশার ঘূর্ণিপাকে পড়ে যেতে বেশী সময়ের প্রয়োজন পড়বে না।

সাংবাদিক ও কলামিষ্ট
zabpathan@gmail.com