বাল্য বিবাহ থেকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা ও আইনি বিশ্লেষণ

মোঃ জাহিদ হোসেন
Published : 7 Oct 2012, 09:34 AM
Updated : 7 Oct 2012, 09:34 AM

নিতু(১৪) ১০ শ্রেণীতে বাণিজ্য বিভাগে পড়ছে। পড়াশুনায় বেশ ভাল। চোখে রঙিন সপ্ন, বড় হয়ে পাস করে নাম করা কোন ব্যাংকের ম্যানেজার হবে। তখন সে তার বা-মায়ের সকল দুঃখ কষ্ট দূর করে দিবে। নিজের মত করে পৃথিবীটা সাজাবে সুন্দর করে। তাই আসছে পরিক্ষার জন্য তার সেই কি বিশাল প্রস্তুতি। সময় এগিয়ে যাচ্ছে। সে সাথে নিতু তার পড়াশুনাও গুছিয়ে নিচ্ছে। সুন্দর করেই তার দিনগুল কাটছিল। কিন্তু হঠাৎ এক দিন বাবা-মার কথা বার্তাই সে ভিন্ন কিছু আঁচ করতে পারে যেটা তার রঙিন সপ্ন বুনার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। নিতুর মাধ্যমিক পরীক্ষার এখনো প্রায় ২০/২৫ দিনের মত বাকী এমন সময় তার মা তাকে এসে বলে "আজ তোকে দেখতে আসবে, তৈরী হয়ে নে,ভাল পাত্র হাত ছাড়া করতে নেই।" যখন সে জানতে পারে তখন তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো যেন। নিতুর আর বুঝতে বাকী রইলো না যে কি হতে চলেছে তার ভাগ্যে। সে কোন মতই এটা মেনে নিতে পারছে না। তার কাছে তার সপ্নের পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যেতে লাগল, এক অজানা শঙ্কা তাকে ঘিরে ধরল যেন। সে সাহস করে তার বাবা মাকেও কিছু বলতে পারছে না। রাত্রি বেলা ছেলে পক্ষ দেখতে এলো। মেয়ে পছন্দ হয়ে গেল তাঁদের। বিয়ের দিন তারিখও ঠিক। আসছে শুক্র বার। নিতুর মনের ভেতর দিয়ে এক অগ্নি ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেল। নিতু নিরবে সব সহ্য করে যেতে লাগল, কিন্তু এ সময় তার কিছুই করার ছিল না। আর নিতুর পড়াশুনা……? অত টুকুইতেই সমাপ্তি ঘটল।

বিয়ের পর নিতু এখন স্বামীর ঘরে। ভেবেছিল বিয়ের পর হয়তো সে সুখী হবে। আবার তার সপ্নের পৃথিবীটা সাজাবে সুন্দর করে। কিন্তু এবারও তার সপ্ন সপ্নই রয়ে গেল। স্বামী বিয়ের কিছু দিন পর থেকেই নিতুকে বাবার বাড়ীতে যাওয়ার জন্য চাপ দিতে লাগল। নিতু এবারও কাউকে কিছু বলতে পারল না। রাতের অন্ধকারে নীরবে তার চোখের পানি মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। এক সময় বাধ্য হয়ে সে বাবার বাড়ীতে চলে যায়। নিতু তার স্বামীর বাড়ীতে ফিরে যায় এক লক্ষ টাকা নিয়ে। কিন্তু তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। তাই পুনরায় স্বামী তাকে টাকার জন্য চাপ দিতে লাগল ।

স্বামীর বাড়ীতে এখন কেউ আর তার সাথে ভাল ব্যাবহার করে না। এক সময় মৌখিক নির্যাতন থেকে তার উপর শারীরিক নির্যাতন শুরু হল। এবারও নিতু নীরবে সব সহ্য করে যেতে লাগল। কিন্তু এই ভাবে করে আর কত দিন সহ্য করে যাবে সে, আর কত দিন নিজের ভেতর যন্ত্রণা পুষে যাবে……? এক এক করে তার স্বপ্নগুলোর মৃত্যু হতে লাগল। এবার তার আত্মসম্মানে বাঁধে। এক দিন সে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল, তার উপর অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে লাগল। যতোই সে প্রতিবাদ করতে লাগল ততই তার উপর স্বামীর নির্যাতনের মাত্রা বেঁড়ে যেতে লাগল। তবে এবার সে বাবর বাড়ীতে টাকার জন্য না যেতে মনঃস্থির করে। ভাবল জীবন যুদ্ধে টিকে থাকতে হবে। একদিন স্বামীর সাথে তার প্রচণ্ড ঝগড়া হয়। স্বামী তাকে বেশ মারধরও করে। শরীরের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। তার কোন রকম চিকিৎসা করারও ব্যবস্থা করা হল না। আর এই ভাবে বেশ কিছু দিন চলতে থাকে……।
এরি মধ্যে নিতুর স্বামী নিতুকে না জানিয়ে ২য় বিয়ে করে। ঘরে এখন তার নতুন সতীন। এক দিকে সতীনের উৎপাত অপর দিকে স্বামীর নির্যাতন নিতুর জীবনকে আস্তে আস্তে বিষিয়ে তুলতে লাগল। এবার সে আর সহ্য করতে পারল না, হাল ছেড়ে দিল এই জীবন যুদ্ধের। অবশেষে কোন এক রাতের আঁধারে নিতুর লাশ পাওয়া গেল গাছে জুলন্ত অবস্থায়।

পাঠক এই গল্পে নিতুর যে করুণ পরিণতি ঘটেছে তা তার বাল্য বিবাহের মাধ্যমে শুরু হয়ে যৌতুক, নারী নির্যাতন, অনুমতি ছাড়া স্বামীর ২য় বিবাহ এবং আত্মহত্যায় প্ররোচনা মাধ্যমে শেষ হয়েছে। আর বাল্য বিবাহ, যৌতুক, নারী নির্যাতন, স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া স্বামীর ২য় বিবাহ ও আত্মহত্যায় প্ররোচনা – এসবই প্রচলিত আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। গল্পে নিতুর বাবা-মা নিতুকে ১৪ বছর বয়সে বিয়ে করতে বাধ্য করেছে। ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন অনুযায়ী কোন ব্যাক্তি কোন শিশুকে বাল্যবিবাহ করতে বা করাতে বাধ্য করতে পারবে না। এখানে শিশু বলতে যার বয়স পুরুষ হলে একুশ বছরের নিচে এবং নারী হলে আঠার বছরের নিচে হবে। এই অপরাধের শাস্তি এক মাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয়ই হতে পারে। নিতুর স্বামী নিতুকে বাবার বাড়ী থেকে যৌতুক হিসেবে অর্থ দাবী করেছিল এবং টাকা আনতে বাধ্য করেছিল। যৌতুক নিরোধ আইন ১৯৮০ অনুযায়ী যদি কোন ব্যক্তি যৌতুক প্রদান বা গ্রহণ করে অথবা প্রদান বা গ্রহণে প্ররোচনা, উৎসাহ বা বাধ্য করে তা হলে তিনি সর্বাধিক পাঁচ বৎসরের এবং সর্বনিম্ম এক বৎসরের কারাদন্ডে বা জরিমানায় কিংবা উভয়বিধ দন্ডে দন্ডিত হবেন। নিতুর স্বামী নিতুকে বাবার বাড়ী থেকে পুনরায় টাকা আনতে অর্থাৎ যৌতুকের জন্য মারাত্মক জখম করেছিল যাতে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ অনুযায়ী যদি কোন নারীর স্বামী অথবা স্বামীর পিতা, মাতা, অভিভাবক, আত্মীয় বা স্বামীর পক্ষে অন্য কোন ব্যক্তি যৌতুকের জন্য কোন নারীর মৃত্যু ঘটান বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করেন কিংবা উক্ত নারীকে মারাত্মক জখম করেন বা সাধারণ জখম করেন তা হলে ঐ স্বামী, স্বামীর পিতা, মাতা, অভিভাবক, আত্মীয় বা ব্যক্তি – মৃত্যু ঘটানোর জন্য মৃত্যুদণ্ডে বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং উভয় ক্ষেত্রে ঐ দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন। মারাত্মক জখম করার জন্য যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অনধিক বার বছর কিন্তু কম পক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং ঐ দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন। সাধারণ জখম করার জন্য অনধিক তিন বছর কিন্তু কম পক্ষে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং ঐ দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন। নিতুর স্বামী তার ১ম স্ত্রী নিতুর অনুমতি না নিয়ে ২য় বিয়ে করে। মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ অনুযায়ী কোন পুরুষ একটি বিবাহ বলবৎ থাকা অবস্থায় ১ম স্ত্রী বা সালিসি পরিষদের অনুমতি না নিয়ে ২য় বিয়ে করতে পারবেন না। যদি অনুমতি ছাড়া বিয়ে করেন তাহলে ঐ ব্যক্তি এক বছর পর্যন্ত বিনা শ্রম কারাদণ্ড অথবা দশ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় প্রকারে দণ্ডনীয় হবেন এবং ঐ বিবাহ মুসলিম বিবাহ ও তালাক আইন ১৯৭৪ অনুসারে নিবন্ধিত হতে পারবে না। নিতুর স্বামী এবং সতীন(২য় স্ত্রী) নিতুর উপর নানা প্রকার মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করে তার জীবনকে আস্তে আস্তে বিষিয়ে তুলেছিল যার কারনে নিতু আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিল। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ অনুযায়ী কোন নারীকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করা একটি অপরাধ এবং এই অপরাধের জন্য প্ররোচনাকারী অনধিক দশ বছর কিন্তু কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন। পাঠক নিতুর মত এই ভাবে হাজার হাজার মেয়ে আমাদের দেশে এই সব সমস্যার অন্তরালে আঁটকে আছে, কিন্তু আমরা কয় জনেরই বা এসব খবর জানি। আমরা অন্তত এই সব সমস্যা যাতে না হয় বা কমিয়ে আনা যায় তার জন্য সচেতনেতা সৃষ্টির করতে পারি এবং প্রতিবাদ করতে পারি।

লেখকঃ ছাত্র ও মানবাধিকার কর্মী
আইন বিভাগ, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়