দেশে খুনের ঘটনা কালে ভদ্রে ঘটার মত ব্যাপার। আমাদের দেশের জন্য একথা প্রযোজ্য নয়। শুধু এই আমলেই না, সকল আমলের জন্যই একথা কমবেশি সত্য হয়ে আছে। খুন হচ্ছে মানুষ নানা কারণে। ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বন্দ্বে, রাজনৈতিক বিরোধে, সংঘবদ্ধ মাফিয়ারূপী যুদ্ধে। বিচারের বাণী প্রকাশ্যে কেঁদে মরছে অনেক ক্ষেত্রেই। এর মধ্যে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড মানুষের মনে দাগ কেটেছে একটি ভিন্ন মাত্রায়। যখন হত্যাকাণ্ডের প্রাদুর্ভাব সহনীয় হয়ে উঠে অসহায়ত্বের বোধ থেকে, বিচারের অভাবে, তখন এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে মানুষ বিচারের আশায় আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে মরিয়া হয়ে। এটি হতে পেরেছে সাগর-রুনির বৈশিষ্ট্যের কারণে আর মেঘের মুখের জন্যে। প্রতিটি অতিষ্ঠ মানুষ অন্তরে এবার একটি অবলম্বন খুঁজে পেয়েছিল কঠোর বিচার পাওয়ার আশায়।
এই অবলম্বনের প্রধান কারণ এই সত্য যে সাগর-রুনি সাংবাদিক। আমার পড়শি সলিম মিঞা বা ভজন কুমার খুন হলে বা আমিই যদি কোনদিন খুন হয়ে যাই তাতে মানুষদের করার কিছু থাকে না, থাকবে না। থাকে না এজন্য যে আমরা নিরীহ, বিত্ত ও ক্ষমতার সাথে আমরা সম্পর্ক-শূন্য। কিন্তু আঁচর লেগেছে সাংবাদিকদের গায়ে। আগেও আমরা দেখেছি এরকম কাজের কর্তার পরিণাম। দুরাচারী মুনিরের বিচার হয়েছে। সেখানে সমস্যা হয়নি। সাংবাদিকদের কলম আগুন ঝরিয়েছে বিচারের দাবিতে। কিন্তু এবার সবখানেই দেখছি প্রহসন।
শুরুতে বাঘের তর্জন গর্জন, তারপর ক্রমে ক্রমে মেষের কান্না। একের পর এক নিত্য নতুন প্রকল্প, জল্পনা কল্পনা; এখন হয়তো চলছে কেবল নীরব ভাবনা-চিন্তা। সাংবাদিকরা গেলেন চায়ের নিমন্ত্রণে। সরকারের আহ্বানে সাড়া দেয়া, তাকে সহায়তা করা সকলেরই কর্তব্য। সরকার সময় চাইলে সময় দেয়াও আমাদের কর্তব্য। কিন্তু সময়টি দিয়ে চা-টুকু না খেয়েও চলে আসা যেত। এটি হতো প্রদত্ত সময়ের ব্যাপারে তাদের সিরিয়াসনেস এর স্পষ্ট ইঙ্গিত। দেয়া সময়ের পরও সময় কেটে গেছে। কিন্তু ফলোআপ কিছুই হলো না।
এটিএন-এর মাহফুজ সাহেবের হাতে মালের যত আধিক্য, তার মাথায় মালের তত অভাব। এরূপ মানুষটি এবার হয়ে উঠেছেন আলোচনার মধ্যমণি। কাজেই সুযোগ পাওয়া গেল বা সুযোগ তৈরি করা হল। চল তার দপ্তরে চল। কি লাভ? তিনি কি পুলিশ? তিনি কি মন্ত্রী? দোষীকে খুঁজে বের করার ক্ষমতা, বিচারের ব্যবস্থা করার এখতিয়ার তার কোথায়? অর্থাৎ একটি ভাঙ্গন, একটি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য এরচে মোক্ষম পদক্ষেপের প্রস্তাব আর কি হতে পারে? ফলটিও ফলেছে ভালভাবেই। হাতাহাতি। ধাওয়া ধাওয়ি। যারা শক্তির অধিকারী হয়েও নিজেদের সহকর্মীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবীকে বানচাল করতে বদ্ধপরিকর, সেখানে আমাদের মত দুর্বল জনদের সব আশা যে শেষ হতে চলেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। খেলা দ্বিপাক্ষিক নয়, সেমসাইড গোল দেয়ার পক্ষও এ খেলার তৃতীয় পক্ষ।
বুদ্ধিমানেরা অনেক আগেই বুঝেছিলেন, তাই আশায় বসে না থেকে নিজের কাজে মন দিয়েছিলে তখনই। আমার মত বোকা এতদিনে বুঝলো বুদ্ধিমানেরা আগেই যা করেছেন তারা কেন তা করেছিলেন। শিশু মেঘ বোধহীন দৃষ্টিতে মা-বাবাকে খুঁজে বেড়াবে, বড়রা বোধপ্রসূত প্রহসন একের পর এক মঞ্চস্থ করে চলবে। আমার তোমার দর্শক হয়ে থাকার ইচ্ছা নিঃশেষিত হবে। জীবনের চাকা ঘুরতে থাকবে নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে, যেমন ঘুরে চলেছে দশকের পর দশক।