পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বিশ্বব্যাংক ঋণ দিচ্ছে না বলে জানিয়ে দিল, অর্থাৎ তারা রীতিমত চুক্তি বাতিল করে দিল। এর আগে তারা ২০১১ এর সেপ্টেম্বরে দুর্নীতির অভিযোগে অর্থায়ন স্থগিত করে এবং বাংলাদেশকে তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের অনুরোধে কানাডীয় ইঞ্জিনিয়ারিং ও কনসরটিয়াম গ্রুপ এসএনসি-লাভালিনের দপ্তরে হানা দেয় কানাডীয় পুলিশ। পুলিশ তাদের দুই কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে ও তাদের (পুলিশের) ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য কাগজপত্র পায়। এই বিচারকাজ এখনও শেষ হয়নি। এই প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়োগ করার কথা ছিল তদারককারী বা কনসালটেন্ট হিসেবে। প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দেয়ার বিপরীতে তাদের কাছে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা ঘুষ চেয়েছেন বলে অভিযোগ এবং এটিই সেই দুর্নীতির অভিযোগ।
অভিযোগ সত্য হোক বা নির্জলা মিথ্যা হোক, অভিযোগটির গুরুত্ব ছিল। বিশ্বব্যাংক 'চামার' হোক আর 'জোচ্চোর'ই হোক তারা হেলা ফেলা প্রতিষ্ঠান নয় এটিও মানতে হয়। আমরাই তাদের কাছ থেকে টাকা আশা করেছিলাম ও সেজন্য চুক্তিও করেছিলাম। অর্থমন্ত্রীর ভাষায়, অভিযোগের পর থেকে সরকার বিশ্বব্যাংকের সাথে আন্তরিক যোগাযোগ বজায় রেখেছিল এবং 'অসাধারণ' সব কাজ তারা করেছিলেন। চুক্তি বাতিলের খবর পেয়ে তিনি কতগুলো 'হয়তো' 'হয়তো' শব্দসহ যে তাৎক্ষণিক ভাষ্য, মত, ব্যাখ্যা দিলেন তাতেও তার পূর্ববর্তী 'অসাধারণ' কর্মকাণ্ডের নমুনা পাওয়া যায়।
আমরা যারা কম বুঝি, কম দেখি তারা সরকারের কাজের নমুনা কিছু ভাসাভাসাভাবে দেখেছি। তার মধ্যে প্রথমে বিএনপির তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রীর উপর অভিযোগ আরোপ এবং পড়ে নিজের মন্ত্রীকে দফতান্তরে সরানোটাই প্রধান। আর প্রধান হয়ে আছে হম্বিতম্বি করে বলা কিছু আজাইরা কথা। আমরাই 'দুর্নীতিবাজ' বিশ্বব্যাংকের সাথে চুক্তি করেছিলাম – আমাদেরকে ধরে বেঁধে কেউ বাধ্য করেনি। টাকা পেলে কাজ শুরু করে দিতাম। যেই বাগড়া বাধল আর অমনি বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে ঝাল মেটালাম। আশা কমে যাওয়ায় সদর্পে মালয়েশিয়ার সাথে মাঝপথেই দহরম-মহরম শুরু করে দিলাম যা সমঝোতা চুক্তি পর্যন্ত গড়াল। ভাবটা এমন যে, দিলে দে, না দিলে গেলাম কিন্তু। তা যাও এখন মালয়েশিয়ার কাছে, দেখ কি পাও – সে-ও এখন তোমাকে আরও পেয়ে বসবে।
এদিকে তদন্ত করে দুদক দুর্নীতির কোন সন্ধান পায়নি, এবং কানাডীয়দের বিচারও এখনও নিষ্পন্ন হয়নি। এর মধ্যে কিছুদিন আগে কানাডীয় পুলিশ এসে বাংলাদেশে হাজির। তারাই বা কী করল কী পেল আমরা ভালভাবে জানি না। অবস্থা যখন এমন তখন অকস্মাৎ বজ্রপাতের মত বিশ্বব্যাংক চুক্তি বাতিল করে দিল, চুক্তির অপর পক্ষ কেবল দূরে বসে জানল যে তা বাতিল হয়েছে।
এভাবে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে অপমান করেছে; একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের, চুক্তির অপর পক্ষের প্রাপ্য মর্যাদা সে তাকে দেয় নি, তার উপর অগ্রহণযোগ্যভাবে একতরফা মাতব্বরি করেছে। তা না হলে এখনই এভাবে চুক্তি বাতিল করার মত চূড়ান্ত কিছু সম্পন্ন হয়নি। 'বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ' পাওয়াই শেষ কথা হতে পারে না। চুক্তি স্বাক্ষরটি যে রকম অবস্থায় দুপক্ষের একত্র উপস্থিতিতে হয়েছে তেমনই বাতিলটিও সেভাবেই হতে পারতো। কিন্তু এটিও কি সত্য নয় যে, আমাদের রাজনীতির ভাষা, কৌশলও বিশ্বব্যাংকের জন্য অপমানিত বোধ করার মতো ছিল?
এসব আর নতুন কথা নয়। কি নাগরিক হিসেবে, কি জাতি হিসেবে কোথায় আমরা সম্মান পাই? আমরাইবা অন্যদের সম্মান করতে শিখলাম কবে? বিশ্বব্যাংককে এখন আর দুষে কী হবে? আঙ্গুর ফল তো আমরাই খেতে গিয়েছিলাম। এখন গাছ খারাপ, ফল টক ইত্যাদি বলে জাত ফিরে পাওয়া যাবে না। অথবা জাত যদি না গিয়ে থাকে তবে হায়হুতাশের কী আছে? এদিকে আবার এর জন্য বিএনপি ও ইউনুস দায়ী – এই থিওরিও শোনা যাচ্ছে। তাদের যদি এতই ক্ষমতা তবে তাদের চটানোর দরকার ছিল কি? আর যদি চটানোটাই উচিৎ কাজ হয়ে থাকে তো বাঘের বাচ্চার মতই থাক, ব্যর্থ মনোরথ শেয়ালের মত কথা কেন?
আমাদের রাজনীতি, কূটনীতি ও আমলাতন্ত্রের অসামান্য দুরবস্থার ও দেউলিয়াপনার আরেকটি উদাহরণ হয়ে উঠলো স্বপ্নের সেতু নিয়ে স্বপ্নভঙ্গটি।