নফসানিয়াত বনাম রব্বানিয়াত

মোনেম অপু
Published : 3 August 2012, 05:24 PM
Updated : 3 August 2012, 05:24 PM

১। একটি শিশুকে যদি আমরা মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করি তবে দেখতে পাব যে, সে তার চোখ-কান ইত্যাদি ইন্দ্রিয়গুলোকে, হাত-পা ইত্যাদি অঙ্গগুলোকে ব্যবহার করছে তার চারপাশকে বুঝবার জন্য; তাদের নানা অংশের ধর্ম, আচরণ ও প্রতিক্রিয়াকে আবিষ্কার করার জন্য। কিন্তু বুঝবার ঘটনাটি ঘটছে কোথায়? তার বুদ্ধিতে। তার বুদ্ধির কিছু পূর্বত-প্রাপ্ত পারঙ্গমতা রয়েছে যার মাধ্যমে সে প্রত্যক্ষণগুলোকে জ্ঞানে রূপান্তরিত করে; তার স্মৃতি আছে যেখানে তার অভিজ্ঞতা সঞ্জাত জ্ঞান সঞ্চিত থেকে যায়।

২। আমরা এও দেখি যে, শিশুটি কিছু জিনিস পছন্দ করছে, আর এগুলো তার মধ্যে সুখের অনুভূতি তৈরি করছে; অন্যের চেয়ে বেশী আমার আছে – এরকম জ্ঞানে সে অহমিকা অনুভব করছে। এ থেকে সে তার সঙ্গীদেরকে তার প্রাচুর্যের কথাটি জানাতে আগ্রহী হচ্ছে। এখানে আমরা পাচ্ছি সঞ্চয় ও অহমিকা। এই প্রবণতা অনুচ্ছেদ ১ এ বলা জ্ঞান প্রক্রিয়া থেকে বেশ খানিকটা আলাদা। একে আমরা বলে থাকি স্বার্থপরতা, সেলফিশনেস বা নফসানিয়াত।

৩। আবার এও আমরা দেখতে পাই যে, একটি অসহায়, ছিন্নবস্ত্র, মলিন শিশুকে পথের উপর পরে থাকতে দেখলে অন্য শিশুটি অন্তরে একটি বেদনা অনুভব করে। 'সদা সত্য কথা বলিও' – এ ধরণের নীতির সাথে শিক্ষার সম্পর্ক যতটা আছে, মমতার অনুভবের সাথে সেটি নেই। মমতা মানুষের একটি সহজাত অনুভূতি। জগতে দুঃখের আধিক্য মমতাকে প্রকাশ করতে চায়। এখানে একজন নিজের সঞ্চয়ে অন্যকে অংশীদার করতে অভিলাষী হয়, অহমিকা বর্জন করে নিজেকে বিনয়ী অবস্থানে স্থাপন করতে আগ্রহী হয়। একে আমরা বলে থাকি পরার্থপরতা, আলট্রুইজম বা রহমানিয়াত ও রহিমিয়াত।

৪। আল্লাহ রহমান এবং রহিম। এ দুটিই তাঁর প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। কোন কিছুর সৃষ্টি বা উন্মেষ থেকে তার পূর্ণ বিকাশের দিকে প্রতিপালনের কর্তা হিসেবে আল্লাহ হচ্ছেন রব। আল্লাহর রবুবিয়াতের নীতিমালার প্রথম নীতি হচ্ছে এই রহমানিয়াত ও রহিমিয়াত। রহমান তিনি যিনি অযাচিতভাবেই দান করে চলেন, শ্রম এখানে পূর্বশর্ত নয়। আর রহিম তিনি যিনি শ্রমের বিপরীতে প্রাপ্যের চেয়েও অনেক বেশী প্রদান করেন।

৫। আল্লাহ কোরানে জগত সৃষ্টি নিয়ে কথা বলার সময় সাধারণত রহমান গুণটি ব্যবহার করেছেন এবং মানুষ সৃষ্টির বেলায় রব গুণটি ব্যবহার করেছেন। জগতের নানা অংশের সৃজন নিয়ে বলা কাব্যিক সুষমামণ্ডিত সুরাটির নামও আর-রহমান। এ থেকে পারভেজ, আজাদ সুবহানী বা আবুল হাশিমের মত চিন্তকরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, মানুষ আল্লাহর রবুবিয়াত তথা প্রতিপালন নীতির প্রতিনিধি বা অবতার এবং জগত তার কর্মক্ষেত্র যেখানে রহমানিয়াত ও রহিমিয়াত হচ্ছে এই রবুবিয়াতের প্রথম নীতি। তাই নফসানিয়াতের বিপরীত ধারণা হিসেবে আমরা এককথায় রব্বানিয়াতকে ব্যবহার করতে পারি। তাহলে রব্বানিয়াত হচ্ছে সেই আদর্শ যার মাধ্যমে ব্যক্তি নিজেকে পূর্ণত্বের দিকে বিকশিত করে মমতাকে বিস্তৃত করার মাধ্যমে।

৬। আল্লাহ কোরানে তাদের নিন্দা করেছেন যারা সম্পদ সঞ্চয় করে ও তা গুণে গুণে দেখে। তাদের নিন্দা করেছেন যারা দেয়ার সময় কম দেয় ও নেবার সময় বেশী নেয়। দানশীলতার বিষয়ে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কতটুকু দিতে হবে, তখন উত্তরে বলা হয়েছে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সব। আরও বলা হয়েছে নিজের অর্জন থেকে উত্তম অংশ অন্যকে দিতে। বলা হয়েছে, নিজে যেটি ভালবাস সেটি অপরকে দিতে ব্যর্থতার মধ্যেই জীবনের ব্যর্থতা নিহিত। তিনি কোরানে মানুষকে রব্বানি হওয়ার জন্য আবেদন করেছেন।

৭। রহমান ও রহিম শব্দ দুটি যে মূল থেকে এসেছে, রেহেম (গর্ভ) শব্দটিও সেই একই মূল থেকে এসেছে। মানুষ মমতাকে সবচেয়ে গভীরভাবে ও প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করে সন্তানের কষ্ট দেখে। প্রতিটি মাতা ও পিতা জানে মমতা কী যখন তার সন্তান অসুখে বা কষ্টে বিপন্ন হয়ে উঠে। এই মমতাকে সকলের প্রতি প্রসারিত করাই আমাদের চিন্তা ও কর্মের চালিকা শক্তি হলে আমাদের পক্ষে রব্বানি হওয়া সম্ভব।

৮। আমাদের নৈতিক জীবন গঠনের মূলে বিদ্যমান দ্বন্দ্বটি এই স্বার্থপরতা বনাম পরার্থপরতা বা নফসানিয়াত বনাম রব্বানিয়াতের দ্বন্দ্ব। আমাদের নৈতিক জীবনের মূল হচ্ছে মমতা বা রহমানিয়াত ও রহিমিয়াত। মমতা অন্য সকল পুণ্যের, সদগুণের উৎস বা মাতৃকাস্বরূপ। অন্য সকল ভাল বৈশিষ্ট্যের উদগমন ও বিকাশ এই মমতা থেকে। হিংসা থেকে আসে দুঃখ, দুঃখ থেকে আসে মমতা, মমতা থেকে উদগত হয় দুঃখীকে রক্ষা করার প্রত্যাশা ও সামাজিক ন্যায়ের আকাঙ্ক্ষা। আর এখানেই সকল ধর্মের ঐতিহাসিক যোগসূত্রটি নিহিত।

৯। শিশুরা নিজ প্রতিভায় প্রতিবেশকে যেমন বুঝতে পারে, তেমনই বুঝতে পারে মা-বাবার মনকে। শিশুদের মধ্যে স্বার্থপরতার প্রাধান্য থাকে, যদিও মমতাকে তারা অনুভব করে আন্তরিক ভাবেই। মমতার প্রাধান্য তৈরি হতে এবং তা চর্চা করার ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটতে পারে ক্রমে ক্রমে। স্বার্থপরতা ও পরার্থপরতার ক্ষেত্রে মা-বাবার জীবনবোধ ও জীবনচর্চার আকার শিশুর মনে প্রভাব ফেলে অপরিসীমভাবে। একইভাবে সমাজের শিক্ষা ও সংস্কৃতির মূলনীতি যদি হয় ভোগবাদ-সুখবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত তবে শিশুরা মমতার পথে এগোতে ব্যর্থ হবে। পিতামাতার আদর্শ বা শিক্ষা-সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে তৈরি হতে পারে প্রজন্মের পর প্রজন্মের জন্য অন্ধকার বদ্ধচক্র অথবা পূর্ণতার দিকে যাত্রার আলোকিত সরল পথ।

১০। নফসানিয়াত মনে যে বিষবৃক্ষের জন্ম দেয় তা দ্রুত ও বহুল পরিমাণে ফলপ্রসূ হয়ে উঠে এবং ফলের ভার বইতে না পেরে স্বার্থপর মনের মালিক নিজেই ভেঙ্গে পড়ে এবং নিজের বীজ থেকে আবার জন্ম নেয়। একই ভাবে রব্বানিয়াত মনে যে মধুবৃক্ষের জন্ম দেয় তা-ও দ্রুত ও বহুল পরিমাণে ফলপ্রসূ হয়ে উঠে, কিন্তু পরার্থপর মনের মালিক তা বিতরণ করে পরের বছরের জন্য প্রস্তুত হয়। নফসানিয়াত একটি বৃত্তাবদ্ধ জগতে পুনর্জন্মের পর পুনর্জন্মের আকর; রব্বানিয়াত সুন্দরের দিকে, পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হবার সরল পথের আলোর ঝালর।

১১। সর্বোচ্চ সাধ্যমত কাজ করা, সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য তৎপর হওয়া এবং অর্জিত সম্পদ থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অংশ দিয়ে অন্যের সহায়তায় এগিয়ে আসার উপায় অন্বেষণ করাই রব্বানি হওয়ার পথ। এই পথে যে যতদূর অগ্রসর হয় সে তত বড় হয়। এখানে আমরা পাই ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যক্তিত্বের বিকাশের আদি সূত্র: মানুষের প্রয়োজন ও ভোগের পরিমাণ মনুষ্যত্বের মাত্রাকে নির্ধারণ করে না; মানুষ কিভাবে সম্পদ উৎপাদনে অংশ নেয় এবং অর্জিত সম্পদের কতটুকু অন্যের জন্য ত্যাগ করতে পারে তা-ই মনুষ্যত্বের মাত্রাকে নির্ধারণ করে।

১২। বাস্তবতা ও আদর্শের মধ্যে ব্যবধান বিরাট। একদিনেই এক লাফেই লক্ষ্য অর্জিত হয় না। ক্রমান্বয়ে ব্যবধান কমানোর যত্নই আমাদের নৈতিক জীবনের সাধনা। প্রতিদিন একটু একটু করে এগুনোর চেষ্টাই এই সাধনা। যদি গতকালের আমি থেকে আজকের আমির কোন ফারাক না থাকে তবে আমি নফসানিয়াতের আবদ্ধ জীবনের আবর্তেই থেকে যাই। মৃত্যুর আগেই মৃত হয়ে বেঁচে থাকি।