হুমায়ূনের ‘ইন্টারেস্টিং লাইফ’ তত্ত্ব

মোনেম অপু
Published : 23 August 2012, 06:09 AM
Updated : 23 August 2012, 06:09 AM

মাসুদ রানা পড়তে পড়তে যখন কৈশোর পার করছিলাম তখন বাংলা শিক্ষকের পাল্লায় পড়ে শুরু করেছিলাম পথের পাঁচালী দিয়ে। তারপর রচনাবলী কিনে কিনে পড়া। ফলে হুমায়ূন আর পড়া হয়ে উঠেনি। আমার বয়েসি আমার মতো অনেকেরই এই অবস্থা হয়ে থাকতে পারে। এটিকে বলা যায় গ্যাপের মধ্যে পড়ে যাওয়া। আমার জেনারেশন এই গ্যাপের মধ্যে পড়েছে—এটা যেমন বলা যায়, তেমনই বলা যায় হুমায়ূন, মিলনরাও গ্যাপের মধ্যে পড়েছেন। তা এরূপ গ্যাপের মধ্যে পাঠকের পতন হোক বা লেখকের পতন হোক—কথা হচ্ছে—এরূপ গ্যাপ অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই ব্লগে কারও লেখায় আমি এরকম একটি মন্তব্য করেছিলাম। আমার এই কথা নিয়ে তেমন সমস্যা ছিল না, কিন্তু সমস্যা বেঁধেছে যখন তা আমাদের অহিফেন সেবক আব্দুল্লাহর নজরে পড়ল। আব্দুল্লাহর সাফ কথা, দাদা, আপনি নিজের নাকটি একটু অসংগতভাবে উঁচু করে ফেলেছেন। হুমায়ূনকে অত সহজে ফেলে দেয়া যাবে না। আজ আমি আপনাকে হুমায়ূনের ইন্টারেস্টিং জীবনের তত্ত্ব শোনাবো। হয়তো বুঝতে পারবেন।

আমার বুঝতে বাকী রইল না—হুমায়ূনের বই পড়ে আমাদের আব্দুল্লাহর তেজ বেড়েছে। টিভি, সিনেমা ছেড়ে আব্দুল্লাহ বই নিয়ে বসেছে জেনে আমার কৌতূহলেরও সীমা থাকল না। জিজ্ঞেস করতেই বলল, দাদা, ঈদের লম্বা ছুটি। টানা সাতদিনের ডুব, তারপর দুদিনের জন্য ভেসে আবার ডুব—সাতদিন গিয়ে ঠেকল এগার দিনে। এর মধ্যে ভাগ্নিদের কাছে থাকা গোটা পাঁচেক কিতাব সাবাড় করে দিলাম। হিমুর দর্শনটার নির্যাস তার ভাষায় আপনাকে বলি: তুমি যদি আমার মতো সবকিছু ঠাট্টা হিসেবে নাও তা হলে দেখবে জীবন ইন্টারেস্টিং। এ কথা হিমু বলেছিল মিতুকে। শুনে মিতু তো রেগে কাঁই—আমি যখন একটা খুন করব তখন ভাবব এটা ঠাট্টা? আবার যখন খুনের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলব সেটাকেও ভাবব ঠাট্টা?… আপনি হাসবেন না। এবং আপনি চলে যাবেন।… ধরে নিন আমি আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করেছি।… আপনার প্রতি আমার এই অনুরোধ আপনি টেলিফোন ধরবেন না। আর যদি ধরেনও ফিরে আসবেন না।… প্রমিজ?

আপনি যদি, দাদা, আপনার স্বভাব মতো হিমুর কথাটিকে একটু উল্টেপাল্টে ইংরেজি করেন তো এমন দাঁড়াতে পারে—লাইফ ইজ ইন্টারেস্টিং, ইফ ইউ ক্যান মেক ফান অফ ইট। সংক্ষেপ করে একে জীবনের ইন্টারেস্ট এন্ড ফান বা I&F তত্ত্ব বলতে পারেন। আমার কান একটু বেশী খাড়া হয়ে উঠলো। বললাম, মিতুর রাগের তো ভার আছে। জীবন তো আর হেলাফেলা জিনিস না। শুনে আব্দুল্লাহ বলে, তা তো ঠিকই। জীবন বলে কথা। একটি প্রাণ হত্যা করা আর একটি প্রজাতি ধ্বংস করা তো একই কথা। তাছাড়া, জীবন বিপন্ন হয়ে উঠলে মরা শুকরের মাংসও জায়েজ, চুরি করাও জায়েজ। কিন্তু দাদা, একটু ভেবে দেখলে হিমুর উপর আপনার অত রাগ না-ও হতে পারে। যখন সেই দিনটা আসবে যেদিন গালাগাল করনেওয়ালারা গালাগালকারীদেরকে গাল দিবে, গিবত করনেওয়ালারা গিবতকারীদের গিবত করবে, চোরেরা সব চোরদের হাত কাটবে, ব্যভিচারীরা সব ব্যভিচারীদের দোররা মারবে, খুনিরা সব খুনিদের ফাঁসিতে ঝুলাবে সেদিন আপনি হিমুর ঠাট্টার মানে বুঝবেন।

বইটি আব্দুল্লাহ সাথে করে এনেছে আমাকে দেয়ার জন্য। সে 'আঙুল কাটা জগলু' নামের বইটি আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, দাদা শেষের গোটা আষ্টেক পাতা পড়ে দেখুন; ততক্ষণ আমি একটু ঝিমোই। পড়া শেষে বললাম, কিন্তু আব্দুল্লাহ, তুমি কি খেয়াল করনি যে, শেষে প্রেমেরই জয় হয়েছে। হিমুকে কোমলমতি ভালমানুষ মিতু যেমন ভালবাসে তেমনই নিষ্ঠুর জগলু মাস্তানও ভালবাসে। অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে, হিমুও তাদেরকে ভালবাসে। তাহলে কি বলা যায় না যে, লাইফ ইজ ইন্টারেস্টিং, ইফ ইউ হ্যাভ পাওয়ার টু লাভ আদার্স? তোমার মতো করে সংক্ষেপ করে দিলে—এটা হল জীবনের ইন্টারেস্ট এন্ড লাভ বা I&L তত্ত্ব। আমার তো মনে হয় হিমুর এটা বুঝার কথা।

এবার আব্দুল্লাহও একটু নড়েচড়ে বসল। বলল, ইঙ্গিত যা-ই হোক, দাদা, খেয়াল তো করেছেন যে, বেচারা মিতু ভালবেসেও ফেঁসে গিয়েছে। হিমুর ঠাট্টার এবং ঠাট্টা করার ক্ষমতার বিকর্ষণ ও আকর্ষণের লব্ধিতে পড়ে কেবল যে মিতুই ফেঁসেছে তা নয়। হিমুও ফেঁসেছে নিজের বলের লব্ধিতে। তা না হলে মিতুর ফোনে পার্ক যখন স্বর্গসম পারিদায়েজা হয়ে উঠে তখন প্রমিজ-মতো হিমুকে ফোন কেটে দিতে হতো না। পারিদায়েজা থেকে পার্কে নেমে আসতে হতো না, জিতু মিয়ার মাথা মালিশের আরাম আর সিনেমার গানের ফ্যান্টাসি জগত নিয়ে থাকতে হতো না।

একটি বিষয় আমার একটু বিদঘুটে লাগল—আব্দুল্লাহ কেবলই হিমু হিমু করে চলেছে। তাহলে শুরুতে হিমুর ইন্টারেস্টিং জীবন না বলে সে হুমায়ূনের ইন্টারেস্টিং জীবন বলতে গেল কেন? হিমুর বদলে হুমায়ূন—ভুলটা হয়তো স্লিপ অব দি টাং। বিষয়টি তার নজরে আনলে সে বলল, দাদা, আমি বুঝে শুনেই বলেছি এবং এর পেছনে আমার দুটো যুক্তিও আছে। ইফ দেয়ার ইজ নো গড, এভরিথিং ইজ পারমিটেড—এই কথাটি দস্তয়েভস্কির বাণী চিরন্তনীর রূপ লাভ করেছে। কিন্তু আসল কথা হল, প্রায় এরকম একটি কথা তার লেখা উপন্যাস দি ব্রাদার্স কারামাজোভ-এর কোন এক চরিত্র প্রমুখাৎ বলা ডায়ালগ মাত্র। সে হিসেবে হিমুর মধ্যে হুমায়ূনকে দেখলে দোষের কিছু হয় না। আপনি তো জানেনই, টলস্টয়ের লেভিন বা পিয়ের আর টলস্টয় তো একাকার হয়ে আছে; অথবা দস্তয়েভস্কি ও তার রাস্কলনিকভ যেমন।

দ্বিতীয়টা একটু লম্বা করে না বললে হচ্ছে না। আপনি তো ফরিদুদ্দীন আত্তারের মান্তেুক আত্‌তায়ের-এর সিমোর্গের কথা জানেন। দুরতিক্রম্য সাত উপত্যকা পাড়ি দিয়ে সমস্ত পক্ষীকুলের মধ্যে মাত্র ত্রিশটি পাখি তাদের রাজা সিমোর্গের দেখা পেয়েছিল। কিন্তু হলে কী হবে! সেই স্তরে তাদের যে ফানা দশা। ত্রিশ (সি) পাখি (মোর্গ) নিজেদের দিকে তাকালেও দেখে সিমোর্গকে। এদিক ওদিক দশ দিকের যেদিকেই তারা তাকায় সব দিকেই কেবল সিমোর্গ আর সিমোর্গ—সন্ধানী অভিযাত্রী প্রজা পাখিরা সব উধাও। সমস্ত জগত যেন সিমোর্গময়। তা আত্তারের পাখিদের এই ভূমা-দর্শনের মতোই হবে আমাদের হিমু-দর্শন। যেদিন ঠাট্টার ষোলকলা পূর্ণ হবে সেদিনই হবে এই চরম হিমু-দর্শন; ফানা ফি হিমু।

দাদা, হুমায়ূন যে কেবল পাঠক তৈরি করেছেন তা তো মাত্র নয়—নতুন লেখকের আবির্ভাবের পথও করে দিয়ে গিয়েছেন। হুমায়ূন ঠাট্টা বা রঙ্গের ছয় কলা পূর্ণ করেছেন। আর পাতিলের তলার মতো কালো ব্যাচেলার এবং তিন বেটে-মোটা ছয় কলাকে নয় কলায় নিয়ে ঠেকিয়েছে। বাকী রইলো সাত কলা। গোটা দশেক বছরে সেই সাত কলাও পূর্ণ হবে। রঙ্গের উৎপাদক ও ভোক্তা এখানে সক্রিয় ডাইপোল, যেখানে রঙ্গ উভয় দিকে রস-প্রবাহী এক্সিসের মতো কাজ করে। যেদিন ষোল কলা পূর্ণ হবে সেদিন উৎপাদক ও ভোক্তা সকলেই দেখবে দশ দিকে কেবল হিমু আর হিমু—সমাজ হিমুময়। উৎপাদক হিমু, ভোক্তাও হিমু—জীবন ইন্টারেস্টিং এবং কেবলই ইন্টারেস্টিং। তারপর কী হবে জানি না। হয়তো ভালবাসার জয় হবে অথবা হয়তো নতুন তত্ত্ব আসবে। ইন্টারেস্টের উপর তো আর ভালবাসাকে বসানো যায় না—বসালেও তা টিকে থাকে না।

কে জানে হয়তো কেউ সোচ্চারে উচ্চারণ করবে, লাইফ হ্যাজ মিনিং এন্ড ইউ হ্যাভ রেসপন্সিবিলিটি। I&F বা I&L তত্ত্বের মতো এটিরও একটি সংক্ষেপ করা যায়; জীবনের মিনিং এন্ড রেসপন্সিবিলিটি বা M&R তত্ত্ব। যাদের সামর্থ্য আছে তারা রঙ্গের ষোল কলা পূর্ণ হবার ক্ষণটির জন্য অপেক্ষা না করুক। আব্দুল্লাহর মুখে আর কোন কথা যেন জুটছে না; তার চোখে কেমন একটি উদাস উদাস ভাব। আমি বললাম, তা তোমার তত্ত্ব যে বেশ নিরস তত্ত্ব, আব্দুল্লাহ, তা কি তুমি খেয়াল করেছ? জীবন যদি ইন্টারেস্টিং না হয়, তবে কি দায়িত্বের বোঝা জীবনকে ডাল করে ফেলবে না? বকুনির ছুতা পেয়ে আব্দুল্লাহর চোখ যেন চকচক করে উঠল। বলল, দাদা, আমি কিছু গ্রাফ এঁকে দেই—বুঝে দেখেন। সে আমার নোট খাতা ও পেন্সিল হাতে নিয়ে দুই অক্ষের দ্বিমাত্রিক কার্টেসিয়ান তলে কি একটি গ্রাফ আঁকার যোগার ধরল।

আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বুদ্ধিমান আব্দুল্লাহর এক্ষণে বোধোদয় হল যে, আজকের মতো তার পাগলামির দ্রুত যবনিকাপাতের সময় হয়েছে। কাগজটি আমার হাতে দিয়ে তাড়াহুড়ার সাথে বলল, দাদা, এ হলো লাভ এন্ড রেসপন্সিবিলিটির ডিসকন্টিনিউড ফাংশন। আশা করি জীবন নন-ইন্টারেস্টিং হবে না। আপনি যদি শূন্য থেকে বড়র দিকে যান তবে ভালবাসায় উপনীত হবেন, আর যদি অনন্ত থেকে কমের দিকে আসেন তবে কর্তব্যে এসে পৌঁছবেন। এই ভালবাসা ও কর্তব্য কিন্তু একই বিন্দু—কোন দিক থেকে আসছেন তার উপর ভিত্তি করে ভিন্ন ভিন্ন নামের লিমিট। মানুষ শূন্য হয়ে জন্মায় কিন্তু কেবলই অনন্তের দিকে ধায়। এক নিঃশ্বাসে শেষ করল আব্দুল্লাহ। মনে হল তার ট্রেন বুঝি এই স্টেশন ছেড়ে যায় যায়।

শেষতক উঠে দাঁড়িয়ে সে আমাকে হতবাক করে দিয়ে আমার কাছে হাজার টাকার আব্দার করে বসল। বলল, দাদা, এটা অনেক কিস্তির প্রথম কিস্তি। বস্তু আফিম দশ টাকা বিশ টাকার নোটেই হয় কিন্তু ভাবের আফিম হাজার টাকার। হুমায়ূনের কিছু বই কিনব, পড়া শেষে আপনাকে সেগুলো উপহার দেব। বুঝতেই পারছেন আখেরে আমার এই মাগনা পড়ার সুযোগটুকু মাত্র আপনার খয়রাতের একাউন্টে আটকা পড়ে থাকবে। বাকী সব আপনারই হবে। পড়ে দেখবেন। হুমায়ূন সহসাই মরে যাচ্ছেন না।