অহিংসা, মমতা ও ন্যায় – ৭/৮ (মমতা বনাম প্রতিরক্ষা)

মোনেম অপু
Published : 29 Sept 2012, 11:51 AM
Updated : 29 Sept 2012, 11:51 AM
কোরানে আমরা মমতার অভিধাযুক্ত যে শব্দগুলো পাই তাদের মধ্যে প্রধানতম হলো রাহমা (মমতা), হুব্বা (ভালবাসা), ওয়াদ্দা (স্নেহ) ও রাফাতা (অনুকম্পা)।

ক. মমতা:— রাহমা হচ্ছে মমতা, করুণা। আল্লাহ আমাদের প্রতি মমতাবান—তিনি রহমান ও রহিম। মানুষও মানুষের প্রতি মমতাবান হতে পারে। কিন্তু আমরা আল্লাহর প্রতি মমতাবান হতে পারি না। যে মমতাবান সে নিজ থেকে উদ্যোগী হয়ে একতরফাভাবে দেয়, ভালর জন্য চিন্তা করে ও কাজ করে, ক্ষমা করে ইত্যাদি। মমতার অধিকারী যার সাথে মমতাপূর্ণ কিছু করে তার কাছ থেকে প্রতিদানের আশা করে না। মমতাপূর্ণ আচরণ পেলে গ্রহীতা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের চেয়ে বেশী কিছু করতে সক্ষম হয় না।

খ. ভালবাসা:— হুব্বা বা ভালবাসা হচ্ছে উভয়মুখী আদান-প্রদান ভিত্তিক সুসম্পর্ক। আমরা আল্লাহকে ভালবাসতে পারি, আল্লাহও আমাদেরকে ভালবাসতে পারেন। যেহেতু সকলেই মমতাবান আল্লাহর সৃষ্টি এবং আল্লাহ সকলের প্রতিপালক সেহেতু আমরা আল্লাহর প্রতি ভালবাসা পোষণ করলে অন্যের প্রতি মমতা পোষণ করব, অন্যের মঙ্গলের জন্য কাজ করব, নিজের সম্পদ ব্যয় করব, অন্যকে ক্ষমা করব। এবং আল্লাহ ভালবেসে আমাদেরকে এর বিপরীতে ভাল প্রতিদান দেবেন। ভালবাসা সাধারণত দ্বিপাক্ষিক, ভালবাসা সার্থক হয় এরূপ দ্বিপাক্ষিক দেয়া-নেয়ার মধ্যে।

গ. স্নেহ:— ওয়াদ্দা ভালবাসার চেয়ে বেশী কিছু; এটিকে ইংরেজিতে 'এফেকশন' ও বাংলায় 'স্নেহ' বলা যায়। স্নেহকারী মমতাশীল ও সহনশীল হয়। যে স্নেহ করে সে স্নেহের পাত্রকে প্রশ্রয় দেয়, তার আবদার রক্ষা করতে চায়, তার কাছ থেকে পাওয়া কষ্টের জন্য সে সহজে বিরক্ত বা ক্ষুণ্ণ হয় না—বরং সহ্য করে।

ঘ. অনুকম্পা:— রাফাতা হচ্ছে সেই অনুকম্পা যা অত্যাচারী বা অপরাধীর প্রতি পোষণ করা হয়, তাদের জন্য অনুভব করা হয়—ইংরেজিতে যাকে আমরা 'পিটি' বলে থাকি। কোরানের ৫৭:২৭ আয়াতে আল্লাহ বলেছেন যে, তিনি যীশুর অনুসারীদের (আল্লাহ তাঁদের সকলের উপর শান্তি বর্ষণ করুন) অন্তরে অনুকম্পা ও মমতা স্থাপন করেছিলেন। এ আয়াতে আল্লাহ 'রাফাতান' (অনুকম্পা) ও 'রহমাতান' (মমতা) শব্দ দুটো ব্যবহার করেছেন। কেউ এক গালে চড় দিলে অন্য গাল পেতে দেয়া হচ্ছে এরূপ রাফাতা বা অনুকম্পার চূড়ান্ত প্রকাশ।

রাফাতা ও সবর:— রাফাতা'য় বিচারের বা প্রতিরোধের আকাঙ্ক্ষা তেমন উপস্থিত থাকে না। যীশু অত্যাচারীদেরকে কিছু না বলার জন্য তাঁর শিষ্যদেরকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। মক্কায় মুসলিমদেরকেও অনুরূপ নির্দেশই দেয়া হয়েছিল। তারা কোন নির্যাতনকারীকে কিছু বলতেন না—নির্যাতন সহ্য করতেন। 'রাফাতা' এর সাথে 'আদল' (ন্যায়) ও আত্মরক্ষার নীতিকে যুক্ত করলে 'সবর' বা ধৈর্য গুণের উৎপত্তি হয়। কোরানে মমতা, ভালবাসা, স্নেহ ও ধৈর্য চারটি প্রধান গুণ বা পুণ্য হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। যে মমতাবান ও স্নেহশীল, শত্রুর বা অত্যাচারীর বিরুদ্ধে তার মনে কোন বিদ্বেষ থাকে না। যে ধৈর্যশীল সে বিদ্বেষতাড়িত হয়ে সাথেই সাথেই প্রতিশোধ গ্রহণে অগ্রসর হয় না। ধৈর্যশীল মানুষ অনুকম্পাসহ সুপরিমিতভাবে অপরাধ অপসারণে, ন্যায়বিচারের জন্য বা নিজেকে রক্ষা করতে উদ্যোগী হয়। এখানে সে আবেগমুক্ত, বাসনামুক্ত থেকে চিন্তা ও বিবেচনাকে অনুসরণ করে।

ধৈর্য হচ্ছে মানসিক দৃঢ়তা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ—বাসনা, ভয় ও বিদ্বেষের তাড়না থেকে মুক্ত জনই ধৈর্যশীল হতে পারেন। কোরানে ধৈর্যের কথা এসেছে অনেক স্থানে। যার আবেগ চিন্তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে সে ধৈর্য ধরতে অক্ষম হয়। যে শত্রুর প্রতি মমতাশূন্য, শত্রুকে পর মনে করে ও শত্রুর সাথে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ককে ছিন্ন করে সে সহজেই ধৈর্যচ্যুত হয়। এমন মানুষের কাছে প্রতিশোধটাই বড় হয়ে উঠে, প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষেত্রেও সে সীমা ছাড়িয়ে যায়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে: প্রতিরক্ষার নীতি কি অহিংসা ও মমতার নীতির সাথে সাংঘর্ষিক? আমার এক গালে কেউ চড় দিলে আমার কি কর্তব্য নয় অন্য গালটি পেতে দেয়া? নিজের বেলা এই নীতি যতদূর সম্ভব পালন করা যায় ততই ভাল। তবে আমারও অধিকার আছে আমার মমতা পাওয়ার—যদি আমার জীবন বিপন্ন হয়ে উঠে বা জীবনের বিকাশটি এতে বাধাগ্রস্ত হয় তবে প্রতিরক্ষা করাই আমার কর্তব্য, যদি সেই প্রাধিকার আমার থাকে।

অন্যের বেলায় বিষয়টি আরও নাজুক হয়ে উঠে। আপনি দেখছেন, সেলিম জামালকে প্রহার করছে এবং জামাল আপনার নিকট প্রতিরক্ষার আবেদন করছে এবং আপনি প্রতিরক্ষার জন্য প্রাধিকারসম্পন্ন। আপনি দেখছেন জামাল হিংসার শিকার হয়ে কষ্ট পাচ্ছে। জামালকে রক্ষা করতে যতটুকু বল সেলিমের উপর আরোপ করতে হয় তাতে সেলিম কষ্ট পাবে। জামালের কষ্ট কালের দিক থেকে নিকটবর্তী, সেলিমের কষ্ট সম্ভাবনা হিসেবে থাকছে—কাজেই দূরবর্তী; জামালের কষ্ট ও সেলিমের কষ্ট—এ দুটির একটি আপনাকে বেছে নিতেই হচ্ছে; কিন্তু জামাল কষ্ট পাচ্ছে বিনা দোষে, সেলিম পাবে তার নিজের দোষে। কাজেই অহিংসা, মমতা ও যুক্তি আপনাকে ঠেলে দিবে জামালকে রক্ষা করার দিকে—এতে অহিংসা, মমতা ও ন্যায়বিচার তিন নীতি একই সাথে রক্ষিত হচ্ছে।

সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও প্রতিরক্ষা না করা একটি নির্মমতা, একটি অন্যায্যতা—অপরিমিত পথের দিকে যাত্রা। আবার প্রতিরক্ষা নীতি এও নয় যে, সেলিমকে প্রতিরোধ করার জন্য আমার মন থেকে সেলিমের প্রতি মমতা বা স্নেহকে মুছে ফেলতে হবে। যদি মুছে ফেলা হয় তবে সেলিম সীমালঙ্ঘনের শিকার হবে—যা হবে নতুন অত্যাচার। যে অত্যাচারীতের প্রতি মমতা বোধ করে না, তার মনে অত্যাচারীতকে রক্ষা করার আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয় না। যে অত্যাচারীর প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ ও মমতাশূন্য সে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে শক্তিপ্রয়োগে বিচার বা পরিমিতি বোধ বজায় রাখতে পারে না।

আমি আগামী অংশে কোরানে বর্ণীত প্রতিরক্ষার মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব।

(অসমাপ্ত)