সত্যপাঠ

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া
Published : 16 April 2011, 04:48 PM
Updated : 10 Nov 2013, 04:02 PM

সত্য কী? বাল্মিকির ব্যাখ্যায় যে সত্যের সন্ধান আমরা যুগযুগান্তরে করে এসেছি– কালের বিবর্তনে তা আজ অসাড় হয়ে গিয়েছে। আমাদের সামনে সত্য নিত্যই তার পরিবর্তিত রূপ নিয়ে হাজির হয়। আমরা আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যা দেখি, শুনি বা অনুধাবন করি তাও অনেক সময় কুহেলিকা মনে হয়। আমরা বিভ্রান্ত হই।

অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, আমাদের বিভ্রান্ত করে। গত সপ্তাহের হরতালে, মনির নামের কিশোরটিকে সারা শরীরে আগুন নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে যখন হেঁটে যেতে দেখি– তখন আমাদের চোখে দ্বিধা কাজ করে। মনে হয় ডিজিটাল কারসাজি। পরদিন সংবাদপত্রে একই ছবি দেখে মনে হয় 'ফটোশপের' কাজ।

আমাদের হৃদয় নিংড়ে আর্তচিৎকার বের হয়ে আসে না। আমরা ছুটে যাই না। আমরা আরও বীভৎস মৃত্যু দেখেছি। একজন দুজন নয়, শত শত। ইটের নিচে চাপা পড়ে গলিত দেহের গন্ধ বাতাস ভারি করেছে মাসের পর মাস। আমরা বিকারহীন। আমরা অনেক কেঁদেছি একাত্তরে। ধীরে ধীরে আমদের কান্নার সঞ্চয়ও যেন কমে আসছে, এখন আর কান্না আসে না। আমাদের ভাবনাগুলো এখন ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত হয়।

৭ নভেম্বর দৈনিক 'ডেইলি স্টার' ছবিসহ সাঁথিয়া নিয়ে একটি ফলোআপ খবর ছেপেছে যাতে দেখা যাচ্ছে, মাননীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের পেছনে পাবনার সাঁথিয়ার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়ি-দোকান লুটপাট ও পোড়ানোর সঙ্গে জড়িত হিসেবে এলাকাবাসী যাদেরকে চিহ্নিত করেছেন তাদেরই একজন উপস্থিত রয়েছেন, যিনি সরকার দলীয় সংগঠনের কর্মী।

পাঠকের নজর কাড়ার জন্য অতিরিক্ত আয়োজন হিসেবে লাল কালিতে বৃত্ত এঁকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এতসব আয়োজন যে কারণে, তা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এখনও কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। তাবড় তাবড় নেতা-মন্ত্রীরা গেলেন, কেউ দায়িত্ব নিলেন না আগাছা পরিষ্কার করার। কীভাবেই বা করবেন, আগাছা যে মূল গাছকেই খেয়ে ফেলতে বসেছে।

এই প্রসঙ্গে, গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বরে রামুতে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা আবার একটু মনে করিয়ে দিতে চাই। ২৯ সেপ্টেম্বর রাত ১২ টার সময় 'লাল চিং' নামক মন্দিরে আগুন দেওয়ার মাধ্যমে সহিংসতার শুরু– যে শুরুটা হয়েছিল স্থানীয় যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের হাত ধরে। একথা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের প্রতিবেদনেই প্রকাশ।

শুরুতে যুবলীগ-ছাত্রলীগের মাধ্যমে হলেও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের উপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। চতুর্থ শ্রেণির নেতারা জড়িত ছিল বিধায় তাদের কাছ থেকে 'নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা' প্রত্যাশিতও ছিল না।

ফলে রাজনৈতিক ভিন্নতা সত্ত্বেও এক ধরনের একাত্মতা, একস্বর গড়ে ওঠে। যার ফলে ঘটনাস্থলে নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি এলিট বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতেই জ্বলতে থাকে মন্দির, লুট হয় দোকান-বাড়ি। ঘটনা-পরবর্তী পত্রিকার রিপোর্ট আর স্থানীয়দের মোবাইলে ধারণকৃত ভিডিও থেকে এটি এখন স্পষ্ট। একটি টিয়ার শেলও ছোঁড়া হয়নি! আক্রমণকারীরা বিভিন্ন বাহিনীর উপস্থিতিতে নিরাপদে কাজ করতে পেরেছে!

২৯ সেপ্টেম্বর রাতেই ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে সহিংসতার খবর ছড়িয়ে পড়ে দেশে-বিদেশে। চাপ বাড়তে থাকে। পরদিনই হেলিকপ্টারযোগে র‌্যাব, পুলিশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে রামু যান মাননীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। তাঁর উপস্থিতিতেই জ্বলতে থাকে উখিয়া, টেকনাফ ও পটিয়ার বৌদ্ধ মন্দির, বাড়ি। পটিয়ায় একটি হিন্দু মন্দিরেও আগুন দেওয়া হয়।

মাননীয় মন্ত্রী ঢাকায় ফিরেই বিমান বন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, এটি জামাত-বিএনপির কাজ। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্যে এ সহিংসতা ঘটিয়েছে। রামুর ক্ষতিগ্রস্তরা সেদিনই বুঝেছিলেন, নদীর জল কোন দিকে গড়াবে।

মাননীয় মন্ত্রীর এই বক্তব্য বিশ্বাস করার যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকত, যদি তিনি বলতেন, "স্থানীয় বিপথগামী কতিপয় যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরাও এতে জড়িত ছিলেন বলে আমরা অভিযোগ পেয়েছি, যা অনভিপ্রেত। আমি পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছি, অপরাধী যে দলেরই হোক না কেন, তাদেরকে যেন ছাড় দেওয়া না হয়। ঘটনার সঙ্গে যদি তাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ মেলে তাহলে সাংগঠনিকভাবেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।''

গোস্তাকি মাফ করবেন। আমাদের মন বড়ই কল্পনাপ্রবণ। আমাদের সাধ আর সাধ্যের সীমা আমরা অনেক সময়ই ছাড়িয়ে যাই।

আমাদের দেশীয় রাজনীতির সংকটকালে আমাদের সঠিক পাঠটি কখনও পড়ানো হয় না। রামুর ক্ষেত্রে তাই আমরা যাকে দায়িত্বশীল আচরণ বলি, তা কারও কাছ থেকেই পাওয়া গেল না। সবাই বায়বীয় কথা বলতে লাগলেন।

যে দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল গোটা দেশের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে তারা তাদের তৃণমূল পর্যায়ের অপকর্মে জড়িত পাতি নেতাকর্মীদের disown করা তো দূরে থাক, যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকারও করতে পারল না। এটি তৃণমূলের নেতাকর্মীদের জন্য নিঃসন্দেহে ভালো দিক।

কিন্তু আখেরে এই পাতি নেতাকর্মীরা ভোটের রাজনীতিতে কোনো কার্যকর ভুমিকা রাখতে পারেন না। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও তৎপরবর্তী সামরিক শাসনামলে দেশের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ কারাগারে আর অন্যরা দৌড়ের উপর থাকলেও, রামুতে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। জনসমর্থন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিল।

তাই বলে স্থানীয় নেতারা কেউ ধোয়া তুলসী পাতা ছিলেন তা বলা যাবে না। রামুর সাম্প্রতিক সহিংসতার পর ভোটের রাজনীতির হিসেবেও ব্যাপক গরমিল হবে। এখন আর চিরাচরিত 'ভোট ব্যাংক' তত্ব চলবে না। নতুন করে ভাবতে হবে।

এই যে হিসেবের গরমিল তাতে যে কেবল সহিংসতায় স্থানীয় নেতাদের জড়িত থাকা বা ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিরোধে ব্যর্থতা অন্যতম কারণ তা নয়, বরং এর মূল কারণ হবে বিচারহীনতা, এলাকাবাসীর মনে অবিশ্বাস আর চাপা ভীতি জিইয়ে রাখা। কেন্দ্রীয় নেতারা এটুকু বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন যে, কোটি টাকা খরচ করে একটি বিল্ডিং বানিয়ে দেওয়া যায়– তাই বলে সেটি রাতারাতি মন্দির হয়ে ওঠে না।

শত বছরের চর্চার ফলে আমরা এক একটি কাঠের স্থাপনাকে মন্দিরে পরিণত করেছি। একরাতের আগুনে সেই মন্দিরের সঙ্গে সবার সম্মিলিত সহাবস্থানও পুড়ে ছাই হয়ে গেল! আর যারা সত্যিকার অর্থে এর জন্যে দায়ী তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেল, কেবল ক্ষমতার রাজনীতির বলয়ে থাকার কারণে। এই impunity মানুষের বিশ্বাসকেও পুড়িয়ে ছাই করল।

রামুর ঘটনার পরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত একটি তদন্ত কমিটি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। এছাড়া পুলিশের আইজি কর্তৃক গঠিত পুলিশের দায়মুক্তির নিমিত্তে একটি তদন্ত দলও তাদের প্রতিবেদন দিয়েছে।

সবশেষে মহামান্য হাইকোর্ট কর্তৃক নির্দেশিত একটি 'বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি' তাদের প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়েছেন। প্রথম ও তৃতীয় প্রতিবেদনে রামুর ঘটনায় জড়িতদের নামের একটি করে তালিকা সংযুক্ত করেছেন। সে তালিকায় স্থানীয়দের মধ্যে যেমন আছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের নাম, তেমনি রয়েছে অপরাপর রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের নামও।

উভয় রিপোর্টে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকার সমালোচনা করা হয়। কিন্তু তাদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে কোনো শাস্তি কিংবা ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়নি। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি কিংবা জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বে অবহেলা কেবল 'মৃদু ভৎর্সনা' প্রদানে সীমাবদ্ধ থেকেছে বলে আজ দাবি উঠছে তাদের অবহেলা ফৌজদারি অপরাধ গণ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার।

রামুর ক্ষেত্রে ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত ছিলেন, কীভাবে তাদের নাম-পরিচয় পাওয়া গেল তা নিয়ে যদি প্রশ্ন করা হয়, তাহলে আরও একটু পেছন ফিরে তাকাতে হবে। ঘটনার পরদিন অর্থাৎ ৩০ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকরা স্থানীয় জনসাধারণের কাছে জানতে চেয়েছেন তারা কাউকে চিনতে পেরেছেন কিনা। সবাই বলেছেন, রাতে তারা কাউকে চিনতে পারেননি।

এর দুদিন পর ঢাকা থেকে মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক স্থানীয় বৌদ্ধ নেতাদের সঙ্গে একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। সেখানে স্থানীয়রা তাকে সংশ্লিষ্টদের নামের একটি তালিকা দেন।

দুদিন পর স্থানীয়রা চিনতে পারলেন কী করে? এ প্রশ্নের উত্তর আজ আর কাউকে বলে দেওয়া লাগে না যে, তারা পরিচিতদের সহিংসতায় জড়িত থাকার কারণে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না কাউকেই। তবে স্থানীয়রা কী ভেবে মাননীয় মন্ত্রীকে এই নামের তালিকা দিয়েছিলেন? তারা কি ভেবেছিলেন তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন?

নিতান্তই শিশুতোষ ভাবনা। আমাদের দেশে ব্যক্তির চেয়েও দল, সর্বোপরি রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি অনেক বড়। তাছাড়া প্রচলিত পন্থায় বিরোধী দলগুলোও সুযোগ নেবে। তারা নিজেদের সম্পৃক্ততা ছিল না বলে প্রচার করবে। রাজনীতির চালে এই ভাবনাগুলো হয়তো সঠিক ছিল। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তরা এতে শাঁখের করাতের মধ্যে পড়লেন।

মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক সাঁথিয়াতেও গেছেন। পার্থক্য শুধু এই যে তার মিছিলে আগে থেকেই জড়িতদের দেখা গেছে। জানি না তিনি সেখানেও রুদ্ধদ্বার কোনো বৈঠক করে জড়িতদের নামধাম নিয়েছেন কিনা। যদি নিয়েও থাকেন তাহলে রাজনৈতিক এই অস্থিরতার সময়ে তিনি কিংবা তার দল আদৌ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবেন কিনা তাতে বিপুল সন্দেহ রয়েছে।

সাঁথিয়ায় সহিংসতা ঘটে ২ নভেম্বর দিনের বেলায়। আর পরদিন সকল দৈনিক এ নিয়ে খবর ছেপেছে। সেখানে কারও নাম ছিল না। ক্রমে অনেকের নাম উঠে আসছে। বাবলু সাহা ২০ জনকে চিহ্নিত করেন এবং আরও দু-তিনশ অজ্ঞাত ব্যক্তির নামে মামলা করেন। সাঁথিয়ার আগাম পাওনা আপাতত এটুকুই।

রামুতে কোনো ব্যক্তি মামলা করতে সাহস পাননি। রামু থানার ৭ টি মামলাই পুলিশের করা। সংশ্লিষ্ট থানার ওসি নজিবুলের পরে যিনি ওসি হয়ে আসেন তিনি নিরপরাধ ব্যক্তিদের গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে সারাজীবনের আয় করে গেছেন বলে এলাকায় জনশ্রুতি আছে। সাঁথিয়াতে এখনই একই অভিযোগ উঠছে। এখানেও হয়তো 'গ্রেফতার-বাণিজ্য' হবে।

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ায়ম্যান জনাব মিজানুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেছেন, "পাবনার সাঁথিয়ার বনগ্রামের ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদেরকে গ্রেপ্তার না করে পুলিশ নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছে। এটা মানবাধিকার পরিপন্থী। কিন্তু ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত পুলিশ তা জানে, কোনো একটা অদৃশ্য কারণে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করছে না।" [তথ্যসূত্র: বিডিনিউজ২৪ ডটকম, ৭-১১-২০১৩]

এভাবেই যদি চলতে থাকে তাহলে, সাধারণ মানুষ যারা প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলেন তারা গ্রেফতার কিংবা অন্য কোনোভাবে হয়রানির শিকার হয়ে নিজেদের বর্তমান অবস্থানকে ভুল ভাবতে শুরু করবেন। ভবিষ্যতে আর হয়তো কেউ এগিয়ে আসতে চাইবেন না। ভবিষ্যতের ভাবনা যে কারণে প্রয়োজন তা হল ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা বাড়বে বৈ কমবে না।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রায় প্রতিটি জনসভায় খোলাখুলি বলছেন আগামীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে কী কী হতে পারে। যেসব বর্ণনা তিনি দিচ্ছেন তা ভুল বলার দুঃসাহস কেউ করবে না। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়, এতে ধর্মচর্চার ভিত্তিতে চিহ্নিত কম সংখ্যার মানুষগুলো তাঁর কথায় বেঁচে বা টিকে থাকার শেষ ভরসাটাও হারাচ্ছেন।

আমাদের দ্বিদলীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পাঁচ বছর অন্তর দেশ শাসনের যে চর্চা তাতে বর্তমান দল ক্ষমতায় আবারও আসবেন এমনটি ভাবার মতো আপাতত কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না। তাহলে উপায় কী? পাশের দেশে যাবার প্রস্তুতি, নাকি ২০০১ সালের চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবার মানসিক জোর তৈরির চেষ্টা করা? কোনটি?

কেননা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিংবা সরকারের ভেতরে-বাইরে কেউই বলছেন না তেমনটি করা হবে না বা হলেও তারা ঘটনা প্রতিরোধে পাশে থাকবেন। অবশ্য এই পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি পেলেও আমরা বিশ্বাস করব কিনা সেটা ভেবে দেখার বিষয়। কারণ হাটহাজারি, রামু, তাইন্দং, সাতক্ষীরা, চিরির বন্দর, বগুড়া আরও কতশত স্থান যেখানে আমাদের বিশ্বাস পুড়েছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এবং অন্যান্য রাজনীতিবিদদের কথা থেকে একটি বিষয় বেশ স্পষ্ট, এবার 'সংখ্যাতত্ব' ভোটের রাজনীতিতে কতটা কার্যকর ভূমিকা পালন করবে তা নিয়ে তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন। এই দ্বিধায় তারা পড়তেন না যদি তারা সমস্যাটির মূলোৎপাটনে সক্রিয় ভুমিকা রাখতেন।

সাঁথিয়ায় সহিংসতার পর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি সুশীল সমাজের ব্যক্তিরাও ঘটনাস্থল দেখতে যাচ্ছেন। তেমনি বিগত ৮ নভেম্বর সিনিয়র সাংবাদিক আবেদ খানসহ সুশীল সমাজের একটি দল সেখানে যান। তারা স্থানীয় প্রেসক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে জনাব আবেদ খান বলেন, সাঁথিয়ার সহিংসতার সঙ্গে জামাত-শিবির জড়িত। এছাড়াও একটি গোপন রাজনৈতিক দলও এর সঙ্গে জড়িত।

তাঁর মতো সিনিয়র সাংবাদিক সেই গোপন দলটির নাম বললে বক্তব্যটি আরও গ্রহণযোগ্য হত বলে আমি মনে করি। এই ভাষ্যের সঙ্গে সরকারি ভাষ্যের অমিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যদি তাই হয়, রামুর মতো এখানেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতেই যদি এই হামলা হয়, তাহলে 'ডেইলি স্টার' পত্রিকার বিবরণে সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের নাম উঠে আসে কেন?

যদি আলোচনার খাতিরেও ধরে নিই যে, এটি একমাত্র সত্যি, তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়– পুলিশের তদন্ত শেষ না হওয়ার আগে কেন তারা একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন? এতে কি তদন্ত প্রক্রিয়া প্রভাবিত হবে না? নাকি সেটাই উদ্দেশ্য?

যুক্তিটা যদি এই হয় যে, জামাত-শিবির-বিএনপি এলে দেশে অরাজকতা হবে, তাই আগামী পনের বছর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে হবে– তবে আমরাও বুঝতে চাই সেটি তারা আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়েই করতে চান কিনা!

সংখ্যার জোরে এখন কম সংখ্যার জান ও মালের উপর যেভাবে আক্রমণ করে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হচ্ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে এদেশটি আফগান না হলেও, এখানে মার্কিনিদের মানুষবিহীন ড্রোন ব্যবহার করতে কোনো অজুহাত খোঁজার প্রয়োজন পড়বে না। কেননা তারা ইতোমধ্যেই বিশ্ববাসীর কাছে মুসলমান ধর্মের অনুসারীদেরকে সন্ত্রাসী রূপে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে।

আফগানিস্তানে কিংবা পাকিস্তানে মুসলিম ব্যতীত অন্য ধর্মাবলম্বীর সঠিক সংখ্যা আমার জানা নেই, তবে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ বলেই জানি। সেখানে ড্রোন হামলা করার ফলে যেসব নিরীহ মানুষ মারা পড়ছেন প্রতিনিয়ত, তাদের মানবাধিকার নিয়ে মার্কিনিদের মাথাব্যথা নেই, যদিও তারা সারা দুনিয়ায় মানবাধিকারের দোকান খুলে বসেছেন। সে দোকানে আমাদের জন্য ফর্মূলা বিক্রি হচ্ছে না তাই-বা কে বলতে পারেন।

আমাদের ভালো আমাদেরই বুঝতে হবে। আমেরিকা কিংবা ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কেবলই অর্থনৈতিক আর আঞ্চলিক নিরাপত্তা তথা তাদের দেশীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এতে আমাদের ভালোমন্দের কোনো ব্যাপার নেই। যদি তাই হত তাহলে সা্ঈদীকে চাঁদে দেখা যাওয়ার গুজবের পর পনেরশ' হিন্দু মন্দির আর অসংখ্য ঘরবাড়ি পুড়ত না, হাজারো হিন্দুর সম্পত্তি গ্রাস করে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রও হত না।

তারা যদি চাপ সৃষ্টি করতেন তাহলে আমরা এসব মন্দির আর বাড়িঘর পুনঃনির্মাণে সরকারের কার্যকরী ভূমিকা দেখতে পেতাম। তা কিন্তু হয়নি। আমি মনেপ্রাণে চাই, সাঁথিয়া আমার সমস্ত অনুমান ভুল প্রমাণ করুক। আমাদের অস্থিমজ্জায় ঘুণধরা ঠেকিয়ে দিক।

একটি বেশ চালু শব্দের ব্যাখ্যা চেয়ে শেষ করতে চাই– আমাদের সংবিধানের ২৮ নং অনুচ্ছেদ যেখানে বলছে– কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী, পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না– তাহলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ 'সংখ্যালঘু" শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার করেন কী করে?

এ কি কেবলই বোঝার ভুল, অভ্যাস, নাকি ইচ্ছাকৃত সংবিধান লঙ্ঘন?

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট।