প্রতিবন্ধী এবং প্রশান্তি ও সজীবতা

মোনেম অপু
Published : 13 Nov 2012, 06:20 PM
Updated : 13 Nov 2012, 06:20 PM

ধর্ম বা জীবনাদর্শের প্রধান বিষয় হচ্ছে সম্পর্ক। ঈশ্বরের সাথে, নিজের সাথে, অন্য মানুষের সাথে এবং জগতের সাথে সম্পর্ককে শুদ্ধ ও সঠিক করাই প্রকৃত প্রস্তাবে জীবনকে সফল করার উদ্দেশ্যে সাধনা।(*১) এই সাধনার সূত্রপাত হয় চিন্তা ও মনোভাবে এবং অভিযানটি সাধিত হয় বাস্তব কাজের ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে। অন্যের সাথে সম্পর্কের ও মিথস্ক্রিয়ার সামাজিক রূপের বর্ণনা আমরা কোরানের কয়েক স্থানে পাই।
(২৪:৬১) অন্ধের উপর প্রতিবন্ধকতা নেই, ও পঙ্গুর উপর প্রতিবন্ধকতা নেই, ও অসুস্থদের উপর প্রতিবন্ধকতা নেই, ও তোমাদের উপর প্রতিবন্ধকতা নেই। প্রতিবন্ধকতাহীনভাবে তোমরা খাদ্য গ্রহণ কর তোমাদের ঘরে, বা তোমাদের পিতাদের ঘরে, বা তোমাদের মায়েদের ঘরে, বা তোমাদের ভাইদের ঘরে, বা তোমাদের বোনদের ঘরে, বা তোমাদের চাচাদের ঘরে, বা তোমাদের ফুফুদের ঘরে, বা তোমাদের মামাদের ঘরে, বা তোমাদের খালাদের ঘরে, বা সে ঘরে যার চাবি তোমাদের হতে, বা যা তোমাদের বন্ধুদের। এটি দূষণীয় নয় যে, তোমরা একত্রেই আহার কর অথবা আলাদাভাবে। তবে ঘরে উপস্থিতকালে নিজেদের মধ্যে তোমরা প্রশান্তিময় ও প্রাণবন্ত হও যা বয়ে আনবে সমৃদ্ধি ও মঙ্গল, আল্লাহর নিকট থেকে। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য বিবৃত করছেন বাণী যেন তোমরা উপলব্ধি করতে পার।

এখানে আল্লাহ সকলের সাথে প্রতিবন্ধীদেরকে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার রূপ ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনার অঙ্গনে। প্রতিবন্ধী ও অপ্রতিবন্ধীদের মধ্যে একটি মানসিক অন্তরাল, বাধা বা দূরত্ব বিদ্যমান থাকতে পারে। উভয় পক্ষের চিন্তার মধ্যেই এর উৎস নিহিত থাকতে পারে। প্রতিবন্ধীরা নিজেদেরকে সরিয়ে রাখতে চাইতে পারে, আবার অপ্রতিবন্ধীরা উৎকট করুণা বা প্রকাশ্য তাচ্ছিল্য দুপথেই যেতে পারে। বাস্তব সত্য হচ্ছে একদল সংকুচিত হয়ে থাকে ও অন্যদল অপর পক্ষকে অক্ষম মনে করে। আল্লাহ আমাদেরকে—উভয় পক্ষকে—মানসিক সকল বাধা ও দূরত্ব অতিক্রম করতে বলছেন এবং সামাজিক পরিমণ্ডলকে প্রশান্তিময় ও প্রাণবন্ত করে তুলতে বলেছেন। আমরা 'বাইত' বা ঘরের অর্থকে প্রসারিত করতে পারি সকল সম্মেলন-সাক্ষাৎ ক্ষেত্রে এবং 'কুলু' বা খাদ্যগ্রহণকে সকল সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায়; এবং কোরানের এই শিক্ষাকে সার্বজনীন করে তুলতে পারি।

কোরানে 'তাহিয়াতান' ও 'সালামান' শব্দদুটি যুগলভাবে অনেক স্থানে এসেছে। সাধারণত এদের অর্থ আনুষ্ঠানিক 'সম্ভাষণ' ও 'শুভেচ্ছা' এর মাঝেই সীমিত রাখা হয়, যেখানে আরবি শব্দদুটির মধ্যে আরও ব্যাপক অর্থ নিহিত রয়েছে। শব্দমূলের বিচারে 'তাহিয়াত' শব্দটির মধ্যে জীবন, প্রাণবন্ততা, উচ্ছলতা, সঞ্জীবতা ইত্যাদি নিহিত; 'সালামা'র মধ্যে আছে শান্তি, প্রশান্তি, স্বাচ্ছন্দ্য ইত্যাদি। 'সালামত' এমন একটি অবস্থা ও প্রতিবেশ যা একটি সত্তার ইতিবাচক স্ফুরণ বা বিকাশে সহায়ক; কৃত্রিম সকল বাধা থেকে মুক্ত। 'সালামা' কেবল সালাম দেয়া-নেয়ার মধ্যেই সীমিত নয়। একজনের সাথে অপরজনের সাক্ষাতের সূচনাতে নিজের পক্ষ থেকে অপরজনের জন্য শান্তি কামনা ও শান্তির অঙ্গিকার সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকার কালকে প্রাণবন্ত ও প্রশান্তিময় করতে প্রথম প্রয়োজন; কিন্তু কোরানের শিক্ষাটিকে এটুকুর মধ্যে সীমিত করা চলে না—তা সাক্ষাৎকার কালের সমগ্র ব্যাপ্তির উপর প্রযোজ্য। অন্যদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে ও একত্রে অবস্থানকালে পরস্পরের সাথে কথা ও আচরণ হতে হবে এমন যেন তা উভয়ের জন্য প্রাণবন্ত ও সঞ্জীবনী হয়, যেন হয় প্রশান্তিময় ও ইতিবাচক।

ক্ষুদ্র-বৃহৎ সকল সামাজিক পরিমণ্ডলে পারস্পরিক বাচন, আচরণ ও মিথস্ক্রিয়াকে ইতিবাচক করা যেতে পারে; আবার তা নেতিবাচকও হতে পারে। ইতিবাচক চিন্তা ও আবেগ থেকে ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরি হয়। স্বাধীনতা, সাম্য, বিনয়, অহিংসা, মমতা ও ন্যায়বিচারের নীতির পরিবর্তে স্বৈরধর্ম, অহংকার, হিংসা, ঈর্ষা, শত্রুতা, অত্যাচারকে স্থায়ীরূপ দিলে নেতিবাচক সম্পর্কের উৎপত্তি হয়। প্রথম ক্ষেত্রে কথা ও আচরণ এমন হয় যে সকলের মনের উপর তা গঠনমূলক প্রভাব ফেলে, অন্যরা আরও সতেজ, উৎসাহী ও কর্মোদ্যম হয়ে উঠে। নেতিবাচক কথা ও আচরণ অপরকে মানসিকভাবে দুর্বল, হতোদ্যম ও বিশৃঙ্খল করে তোলে। এতে ব্যক্তির জীবনই কেবল আক্রান্ত হয় না—জাতীয় উৎপাদন, কর্মায়তন, উন্নয়ন কমে আসে। এতে ব্যক্তির জীবনীশক্তির সাথে সাথে এমনকি তার আয়ুষ্কাল পর্যন্ত কমে আসে।

আমরা প্রত্যেকেই এক একটি পাত্র স্বরূপ। একের কথা ও আচরণের উপর নির্ভর করে হয় তার পাত্র পূর্ণ হচ্ছে, নয়তো সে অন্যের পাত্র শূন্য করছে। ইতিবাচক আচরণ অন্যের পাত্র এবং সেইসাথে নিজের পাত্র পূর্ণ করে। নেতিবাচক আচরণ অন্যের পাত্রকে শূন্য করে এবং ফিরতি বিচারে তা নিজের পাত্রকেও শূন্য করে। এতে ঘরের পরিবেশ বিনষ্ট হয়, বিনষ্ট হয় জাতীয় রাজনৈতিক পরিবেশও। ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে জীবন, প্রতিবেশ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি। ইতিবাচক বা প্রাণবন্ত আচরণ জীবনকে আনন্দময় ও দুর্ভাবনামুক্ত করে। ঘর, অফিস-আদালত, কল-কারখানায় বাড়তে থাকে সঞ্জীবনী পরিবেশ। এতে ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে আসে সমৃদ্ধি। কোরানের এই আয়াতে ইতিবাচক আচরণের সুফল বুঝানোর জন্য 'বারাকা' ও 'তাইয়েবা' শব্দদুটি ব্যবহৃত হয়েছে। 'বারাকা' হচ্ছে সমৃদ্ধি যা আরও সমৃদ্ধির কারণ হয় এবং 'তাইয়েবা' অর্থ পরিচ্ছন্ন, সুন্দর। ইতিবাচক সম্পর্ক, আচরণ ও কথা আমাদেরকে দেয় পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও সমৃদ্ধ জীবনক্ষেত্র—এটাই আল্লাহর সৃষ্ট প্রাকৃতিক নিয়ম, যে কারণে বলা হয়েছে এ দান আসে আল্লাহর কাছ থেকে।

(৪:৮৬) যখন কেউ তোমাকে সম্ভাষণ করে প্রাণবন্তভাবে, তুমি তার প্রতি তার চেয়েও অধিকতর সুন্দরভাবে প্রাণবন্ত হও; অথবা অন্ততপক্ষে তার সমরূপভাবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল কিছুর হিসাব সংরক্ষণ করেন।

এই আয়াতেও আল্লাহ আমাদেরকে পারস্পরিক কথাবার্তা ও মিথস্ক্রিয়ায় প্রতিযোগীতামূলক ভাবে সজীব হতে বলেছেন—অর্থাৎ তিনি আমাদেরকে পরস্পরের জীবনপাত্র পূর্ণ করে তোলার প্রতিযোগীতায় নামতে বলছেন। আল্লাহ জান্নাতের যে রূপকল্প তুলে ধরেছেন কোরানে নানাভাবে, সেখানেও একটি চিত্রে এই একই 'তাহিয়াতন' ও 'সালামান' শব্দ দুটি ব্যবহৃত হয়েছে নিম্নরূপভাবে।

(২৫:৭৫) দৃঢ়তা ও ধৈর্য ধারণের প্রতিদানে তাদেরকে দেয়া হবে সমুন্নত গৃহ যেখানে তাদের জন্য মঞ্জুর করা হবে প্রফুল্লতা ও প্রশান্তি।

হররোজ আমাদের দেখা হয়, কথা হয় ঘরে স্বামী/স্ত্রী-সন্তানের সাথে, মা-বাবা ভাইবোনদের সাথে, অফিসে সহকর্মীদের সাথে, স্কুলে সহপাঠীর সাথে, পথে সহযাত্রী, বাসের কন্ডাকটর, রিকশাচালক, ড্রাইভারের সাথে, বাজারে দোকানীর সাথে, পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে, স্টেশনে-বন্দরে চেনা-অচেনা নানা মানুষের সাথে। আমরা আত্মীয়-বন্ধুদের বাড়ী যাই বেড়াতে। কিন্তু আমি কি অন্যের সাথে এমন কথা বলি ও আচরণ করি যার ফলশ্রুতিতে সে প্রফুল্ল হয়ে উঠে, উৎসাহিত বোধ করে? নাকি সে আরও পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে, মনভারী হয়ে পড়ে, বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে? আমাদের আচরণ কি অন্যের জীবনী শক্তিকে উজ্জীবিত করে? নাকি তার জীবনী শক্তিকে ক্ষয়িষ্ণু করে তোলে? তার কাছে জীবন কি ইতিবাচক হয়ে উঠে? নাকি জীবন আরও ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে? মর্মপীড়া ও জ্বালা বাড়ে? সে কি সম্মানিত বোধ করে? নাকি অপমানিত বোধ করে? প্রতিটি ইন্টারেকশনের পর এসব প্রশ্নের উত্তর বিচার করে আমরা আমাদের আচরণের প্যাটার্নটিকে বুঝতে পারি।

অন্যকে আঘাত করে কথা বলা, তাকে হেয় করা, তার কাজের কেবল দোষ ধরা, তার ভুলগুলো আগে নজরে পড়া, দক্ষতার প্রশংসা করায় কার্পণ্য করা, পরনিন্দা করে বেড়ানো ইত্যাদি সব নেতিবাচক কাজ ও আচরণ(*২) আমাদের সংস্কৃতির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের ঘর ও কর্মক্ষেত্রের পরিবেশের চিত্র অনেকটা এরকমই। এই নেতিবাচক সংস্কৃতি থেকে ইতিবাচক চিন্তা ও আবেগের দিকে আমরা ফিরতে পারলে আমাদের জীবন সুন্দর হবে, উৎপাদনশীলতা বাড়বে এবং আমাদের সামর্থ্য অপচয় হওয়া থেকে রক্ষা পাবে—আমরা সমৃদ্ধ হব, সাংস্কৃতিকভাবে ও অর্থনৈতিকভাবে—দুনিয়া জান্নাত হয়ে উঠবে। নবীর একটি কথাকে সাধারণত এভাবে বলা হয়, তোমরা বেশী বেশী সালাম দেবে, এতে বরকত। এর প্রকৃত অর্থ: তোমরা প্রতিযোগীতামূলকভাবে পরস্পরের জন্য প্রশান্তিময় হয়ে উঠ—এতেই সমৃদ্ধি।

+++++++

*১ দেখুন কোরানের আয়াত ২:২৭, ১৩:২১, ১৩:২৫।
*২ দেখুন কোরানের আয়াত ৪৯:১১-১৩।