জামায়াত-নামা

মোনেম অপু
Published : 14 Nov 2012, 06:39 PM
Updated : 14 Nov 2012, 06:39 PM

জামায়াত একাত্তরে জনগণের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার সাথে একাত্ম হতে ব্যর্থ হয়েছিল। তারা পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে অস্ত্র হাতে হানাদার বাহিনীর সহায়তায় নেমেছিল। এই সিদ্ধান্ত গুরুতরভাবে ও স্পষ্টতই ভ্রান্ত ছিল। তারা সর্বোচ্চ যা করতে পারতো তা হলো নিষ্ক্রিয় থাকা ও পাকিস্তানিদের কঠোর সমালোচনা করা। তারপরও যদি বলা হয় যে, অমন সংকটকালে সিদ্ধান্ত নিতে ভুল হওয়া অস্বাভাবিক নয় তবে বলা যায়, ৪০ বছর অনেক সময়, এই ভুল বুঝতে পারার জন্য। আজও জামায়াত সেই ভুল বুঝতে পারেনি। বুঝতে পারলে অনেক আগেই জাতির নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতো এবং এই দাবী সে নিজেই করত যে, যদি তাদের কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ থাকে তবে তার বিচার করে যে শাস্তিই তাদেরকে দেয়া হোক তারা তা মেনে নেবে। যদি সুবিচার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে তারা মনে করে থাকে, তবুও এই পথ ছাড়া তাদের অন্য পথ ছিল না। তারা যদি যথার্থই আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী হয় তবে "অবিচার"-এর শিকার হয়ে বিচার মেনে নিতে তাদের সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না। বিচারের নামে তারা অবিচারের শিকার কিনা তা জনগণের বিবেচনার উপর ছেড়ে দেয়া কর্তব্য ছিল।

উপরে যা বলা হল তা একান্তই যুক্তি ও আদর্শের বিচারে বলা কথা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে নিজের অতীত কর্ম বুঝবার, যুক্তি ও নিজের দাবীকৃত আদর্শটিকে বুঝবার ক্ষমতা যদি তাদের থাকতো তবে একাত্তরে তারা ভুল সিদ্ধান্তটিই নিত না—এমন অনুমান করা যায়। তাদের ভ্রান্তি ও ভ্রান্তির উপর অটল থাকাটাই তাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে নির্দেশ করে। কোরানের শিক্ষা ও নবীদের চলার পথ সম্বন্ধে তাদের নিজেদের ভাষ্য ও বোধের মধ্যেই যদি ভ্রান্তি থেকে যায় তবে সিদ্ধান্ত ভুল হবে। ফ্রেম অব রেফারেন্স ভুল হলে তা থেকে নেয়া সিদ্ধান্ত ভুল হয়। এর লক্ষণ আমরা আবার দেখছি। নিজেদের নেতাদের মুক্ত করার জন্য তারা গত কয়দিন ধরে যে আন্দোলন করে যাচ্ছে তার মধ্যে বৈধতা নেই; কোরান ও সংবিধান—কোন বিচারেই নেই। গাড়ী ভাংচুর করা, তাতে আগুন দেয়া, পুলিশকে প্রহার করা ইত্যাদি স্পষ্টতই গুরুতর অপরাধ। যারা জামায়াত-শিবিরের সমর্থক তারা বলবেন, বিচার ন্যায্য হচ্ছে না, এই বিচার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত, এই বিচার প্রহসন মাত্র। দাবীগুলোকে সত্য বলে ধরে নিলেও জামায়াতের এসব কার্যকলাপ বৈধ হয় না। এই জ্বালাও-পোড়াও করে আন্দোলন করা নবীদের সুন্নাহ নয়, খারেজীদের সুন্নাহ। জামায়াতের কাজের বিচার হবে নবীর পথের আলোকেই, যেহেতু তারা নিজেদেরকে সেপথের অনুসারী বলে দাবী করে। এখানে অন্যদের নজীর টেনে লাভ হওয়ার নয়।

কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও জামায়াত এবং তার ছাত্রসংগঠন শিবির অনেক শক্তিশালী হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর মাত্র চার বছরের মাথায় আওয়ামী লীগের বিশাল পতন তাদেরকে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেয়। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের আগে জামাতের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ লক্ষণীয় ছিল না। জামায়াত তখন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি'র সাথে যুগপৎ আন্দোলনে নামে। এই আন্দোলনের কালও ছিল দীর্ঘ। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ দুপক্ষের সাথে একসঙ্গে লড়তে পারেনি। কৌশলগত কারণেই হোক বা সহায়ক শক্তি হিসেবে তাদেরকে গ্রহণ করার কারণেই হোক জামায়াত তখন এগিয়েছে। বিএনপি'র বিরুদ্ধে আন্দোলনের কালে জামায়াতকে সাথে পেয়ে লীগের অখুশি হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যায়নি। একবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় জামায়াতের সমর্থনও তারা চেয়েছিল।

এত কলঙ্কিত অতীত নিয়েও জামায়াত যেটুকু বিস্তৃত হয়েছে, যেভাবে বিস্তৃত হচ্ছে তা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গৌরব করা রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্নীতির, অর্থাৎ দেশ শাসনে ব্যর্থতার ফল। স্বাধীনতার পরে মুজিবকে যদি দুর্নীতির জন্য অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে না হতো, জাতীয় পার্টির সরকারের বিরুদ্ধে যদি আন্দোলন করতে না হতো, বিএনপির বিরুদ্ধে যদি আন্দোলন করতে না হতো তবে জামায়াত কারও মাথা ব্যথার কারণ হওয়ার মতো পর্যায়ে আসতো না। সকল প্রগতিশীলরা মিলেই জামায়াতকে এতদূর নিয়ে এসেছে। আজকের জামায়াত যে শক্তি অর্জন করেছে তা জামায়াতের নিজের গুণে যতটা তার চেয়েও বেশী আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির দোষের গুণে। জামায়াত প্যারাসাইটের মত বড় হয়েছে, তাকে রসদ জুগিয়েছে যাদেরকে জামায়াত শত্রু মনে করে তারাই।

আমাদের কোন দোষ নেই, সব দোষ বিএনপি-জামায়াতের—এমন কথা জোরগলায় কে বলতে পারবে? আজ মুখের ফুঁৎকারে বা কয়েকজন নেতাকে শাস্তি দিয়ে বা নিষিদ্ধ করেও তাদের বিরুদ্ধে খুব যে সাফল্য অর্জিত হবে তা আশা করা দুরাশায় পরিণত হয়েছে। জামায়াতের বিরুদ্ধে লড়তে হলে তার শক্তি পরিমাপ করতে হবে আগে এবং তার শক্তির উৎস, শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণগুলো চিহ্নিত করতে হবে। জামায়াতের দাবী, জামায়াত ইসলামের কথা বলে। তার এই দাবীর বিপরীতে 'জামায়াতের ইসলাম বিকৃত ইসলাম' কেবল একথা বললেই কোন মীমাংসা হয়ে যাবে না, যদি প্রতিপক্ষ কথায়, আচরণে, রাজনীতিতে উন্নত জীবনাদর্শের অভিব্যক্তি ঘটাতে না পারে।

জামায়াতের ভবিষ্যৎ নির্মিত হচ্ছে শিবিরের মাধ্যমে। যদি শিবিরকে অকার্যকর করা সম্ভব না হয় তবে জামায়াতকে স্তব্ধ করা যাবে না। শিবিরে যোগ দিচ্ছে নতুন প্রজন্মের ছেলেরা—তারা নিবেদিতপ্রাণ এবং তাদের অনেকেই মেধাবীও বটে। তারা কেন এরকম একটি উগ্রপন্থী দলে যোগ দিচ্ছে? এদেরকে ফিরিয়ে রাখার বা আনার উপায় কি? ইসলাম এখন বিশ্ব পরিসরে স্পট লাইটের নীচে। নানা টিভি চ্যানেল, ইন্টারনেট, নতুন নতুন বইপত্র ইসলামের উগ্র রাজনৈতিক রূপকে তরুণদের সামনে নিয়ে আসছে। সমাজতন্ত্রের পতনের পর তার স্থানে এই উগ্র রাজনৈতিক আদর্শ শক্তিশালী আবেদন নিয়ে যুবসমাজের কাছে আবির্ভূত হতে পারে। প্রগতিশীল চিন্তকদের কাছ থেকে যদি উন্নত জীবনাদর্শ পাওয়া না যায়, তাদের অনুবর্তীরা যদি অনুপ্রেরণামূলক হয়ে উঠতে না পারে তবে কেবল শাসিয়ে, শক্তি প্রয়োগ করে বা কেবল প্রচারণার মাধ্যমে জামাত-শিবিরকে কার্যকরভাবে নির্মূল করা সম্ভব হবে না।

জামায়াত একদিন আমাদের উপর আপতিত হতে পারে আরও বিশাল শক্তি নিয়ে। নিজেদেরকে না বদলালে জামায়াতের পতন সুদূর পরাহত। আর এটিই এখন আমাদের সামনে সবচে বড় চ্যালেঞ্জ—আমরাই শেষ বিচারে আমাদের সর্বনাশ ডেকে আনছি, জামায়াত তার সুবিধাভোগী মাত্র। নতুন প্রজন্মকে তাই অগ্রসর হতে হবে বুদ্ধি চর্চায়, নৈতিকভাবে নিজেদের উন্নতি বিধানে এবং আওয়ামী লীগ সহ সকল প্রগতিশীল আদর্শের দলগুলিকে পূনর্গঠনে, যেন তারা সততা ও ন্যায়বিচারের সাথে দেশ পরিচালনা করতে পারে। নয়তো আমাদের জন্য হয়তো অপেক্ষা করছে 'ইসলাম'য়ের বেনিয়া ও 'প্রগতি'র বেনিয়াদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, যেখানে অস্ত্র বিক্রেতারা উভয় পক্ষকেই মদদ দিয়ে যাবে সমানে।