দর্শনমনস্কতার প্রয়োজনীয়তা

মোনেম অপু
Published : 22 Nov 2012, 06:53 AM
Updated : 22 Nov 2012, 06:53 AM

ঔপনিবেশিক শাসনামলে ও সমাজতন্ত্রের উত্থানকালে বিজ্ঞান-মনস্কতার কথা নানা ঢংয়ে আমরা শুনেছি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে আমাদের পশ্চাদপদতাকে সাধারণত দায়ী করা হয় আমাদের দারিদ্র্যের জন্য। কিন্তু সমৃদ্ধ মানবিক পরিবেশ ও সামাজিক সম্পর্কের জন্য দর্শনের প্রয়োজন বেশী। বিজ্ঞানের প্রতি আমাদের মনোভাব ইতিবাচক হলেও দর্শনের প্রতি অনীহা লক্ষণীয়। সাহিত্যিক ও শিল্পীদের মধ্যেও দর্শনানুরাগ তীব্র নয়। আমাদের হয়তো ধারণা, দর্শন কিছু মতিচ্ছন্ন ও অকেজো মানুষ তৈরি করে মাত্র। অথচ প্রকৃত কথা হচ্ছে, মানব-পরিবেশের উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক বিকাশ ও একটি সুন্দর সামাজিক ভবিষ্যতের জন্য যে চিন্তাগত ভিত্তি দরকার তা দর্শন তৈরি করতে পারে। দুর্নীতি, অবিচার, বা মূল্যবোধের অবক্ষয়ের জন্য আমাদের উদ্বেগ দিনে দিনে বাড়ছে। দর্শন সুনীতি, ন্যায়পরতা ও মূল্যবোধের মাতৃকা বা শিকড়। আমরা মাকে অবহেলা করে তার শিশুর জন্য কাঁদছি, শিকড় কেটে গাছের ফুলে পানি ঢালছি।

অতীতে দর্শন মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির পথ আবিষ্কার করেছে এবং সে পথে আলোক সম্পাত করেছে। যেখানে দর্শন চর্চার বিস্তার ঘটেছে ও দার্শনিক চিন্তায় উন্নতি সাধিত হয়েছে সেখানে একটি স্থবির সংস্কৃতিতেও সম্মুখ গতি এসেছে। দর্শনের জগতে যখন শূন্যতা ও অন্ধকার নেমে এসেছে তখন অগ্রসর সভ্যতাও ক্ষয়িত ও পতিত হয়েছে। একথা শুধু রোমান বা আরব সভ্যতাই নয় প্রতিটি সভ্যতার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। গ্রীসে যখন থেলিস, হিরাক্লিটাস, পারমেনাইডিস, সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটলদের জন্ম হলো তখন মানুষের চেতনায় নতুন মাত্র যুক্ত হল, সংস্কৃতি একটি বৈপ্লবিক উল্লফন লাভ করল। সম্রাট জাস্টিনিয়ান যখন দর্শনের স্কুলগুলো বন্ধ করে দিলেন তখন একধরণের অন্ধকারে পশ্চিম আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। সেই অন্ধকার কাটিয়ে রেনেসাঁ সম্ভব হয়েছিল আরবদের বলিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি ও তাদের দ্বারা সাধিত লুপ্ত জ্ঞান পুনরুদ্ধার ও সংগ্রহ এবং দর্শনচর্চার বিস্তার থেকে। আজকের বিজ্ঞানেরও বিকাশ ঘটেছে আধুনিক দর্শন থেকে।

ব্যক্তির চেতনা ও মানসিকতা, ব্যক্তিদের মধ্যকার সম্পর্ক, মূল্যবোধ, নৈতিক আচরণ, মানুষের পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কায়কারবার নিয়ে মানব-পরিবেশ গড়ে উঠে। আমাদের পরিবেশ মোটেই সুন্দর ও আশানুরূপ নয়—দিগভ্রান্তি ও কলুষের মাত্রা হতাশাকে গাঢ় করে তুলছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ক্রমোন্নতি বজায় থাকলেও মমতা, ন্যায়বোধ ও কর্তব্যবোধ যেন দিনে দিনে উবে যাচ্ছে। মিথ্যাচার, অবিচার, দ্বেষ, অনাহার, নিরাপত্তাহীনতা, একঘেয়েমি, উদ্বেগ, সন্ত্রাস সমকালীন মানুষকে এমনভাবে গ্রাস করছে যার তুলনা প্রাচীন বা মধ্যযুগে খুঁজে পাওয়া ভার। আবার এজন্য শিক্ষাবঞ্চিত দরিদ্র ও ক্ষমতাশূন্য মানুষদের বদলে শিক্ষিতদেরকেই দায়ী করা যায়। মানব-পরিবেশের উন্নয়ন এখন গতানুগতিক বৈজ্ঞানিক সভ্যতার সম্প্রসারণের চেয়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

হিংসা, লিপ্সা ও ভয় আমাদেরকে পিছনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে চাইলে চৈতন্যের শক্তি ও মানুষের মহিমা সম্বন্ধে সচেতনতা, ন্যায়-অন্যায় ও শুভাশুভের জ্ঞান ও উপলব্ধির বিস্তৃতি সাধনে চেষ্টা দরকার; বিশ্বাস ও আশাবাদ সঞ্চারিত হওয়া প্রয়োজন। দর্শনানুরাগের প্রসার ও দর্শনচর্চায় ব্যাপকতা আমাদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখাতে পারে। দর্শন আমাদেরকে জীবনের চূড়ান্ত প্রশ্নগুলোর কোন মীমাংসা দিতে পারে না ঠিক, কিন্তু তা আমাদেরকে আমাদের জ্ঞানের সমস্যাগুলো ও আমাদের না জানার পরিসর সম্বন্ধে জ্ঞান দিতে পারে। চৈতন্য ও জড়ের বা জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়র মধ্যে বিদ্যমান রহস্যটিকে বুঝতে পারা, স্থান ও কালের চরিত্রের রহস্যময়তাকে বুঝতে পারা বদ্ধমত ও মতান্ধতা থেকে আমাদেরকে রক্ষা করে আমাদেরকে একটি অহংকারমুক্ত বিনয়ী অবস্থান দিতে পারে। তবে দর্শনের সব সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়েও একথা বলা যায় যে, উন্নত জীবনবীক্ষা ও নীতিতত্ত্ব রচনাও দর্শন ছাড়া সম্ভব নয়। সুন্দর ও বলিষ্ঠ জীবনের জন্য উন্নত দর্শন প্রয়োজন।

জীবনের প্রতি একটি আস্থাহীনতা ও জীবন সম্বন্ধে একটি অনিকেত মনোভাব আমাদের কালের একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুবসমাজ যেন আত্মবিস্মৃত এবং জীবনের সম্ভাবনা ও সাধ্য সম্বন্ধে বিভ্রান্ত হয়ে উঠছে। সম্পদ, আধিপত্য ও যৌনাবেগ আমাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বড় অংশের মূল ভিত্তি ও চালিকা শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে—এরা সকলে মিলে সংঘবদ্ধ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। এরূপ অবস্থায় স্বাধীনভাবে নিজের ও সন্তানদের জীবন ফলপ্রসূ করে তোলার আকাঙ্ক্ষাই দর্শনের প্রতি অনুরক্ত হবার জন্য যথেষ্ট কারণ হতে পারে। সমকালীন কঠিন সময়ে অপমান ও দুঃখ ব্যক্তিকে জর্জরিত করে তুলছে। অপমান ও দুঃখের হেতু বা সংঘটক প্রত্যেকের ব্যক্তিসত্তার বাইরে বাস করলেও তারা জয়ী হতে পারছে ব্যক্তির অন্তরকাঠামোর দুর্বলতার কারণে। দর্শন আমাদের অন্তর্দৃষ্টি ও প্রজ্ঞাকে দূরপ্রসারী ও প্রশস্ত করার মাধ্যমে এই অন্তরকাঠামোকে দৃঢ় করতে পারে; জগত ও জীবনকে দেখার একটি উন্নত ভঙ্গি দিতে পারে যা সাহস ও মহান মানবিক গুণচর্চায় প্রেরণা যোগাবে। এতে করে আমরা বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে থেকেও নিজেকে একটি শোভামণ্ডিত দ্বীপে পরিণত করতে পারি।