অপমান বা অবমাননার সংজ্ঞা কী? মর্যাদার পিরামিডে (হায়ারার্কি) যার যেখানে স্থান তাকে সেখান থেকে নামিয়ে আনলে তাকে অপমান বা অবমাননা করা হয় বলে ধরছি। আবার নিজেকে নিজের উপযুক্ত স্থান থেকে উপরে উঠিয়ে অন্যকে অপমান করা যায়।
আত্মাবমাননা কিভাবে করা যায় তা জানতে হলে জগতে আমার অবস্থানটি কী—তা মীমাংসা করা দরকার হয়ে পড়ে। এটি একটি কঠিন কাজ এবং, বলাই বাহুল্য, আমার সাধ্যাতীত। মীমাংসাটা আমি আমার বিশ্বাসের মাধ্যমেই সেরে নিচ্ছি ও নিচের বচনটির মাধ্যমে প্রকাশ করছি:
"ঈশ্বর মানুষকে তাঁর প্রতিনিধি করে জগতে স্থাপন করেছেন এবং প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে সকল ব্যক্তি মানুষকে সমান মর্যাদা দিয়েছেন।"
ঈশ্বরত্বে বিভাজন এনে আমি নিজেকে অপমান করি।
কারণ, বিভাজিত অংশ তখন অবশ্যই কোনো মানুষের উপর বা প্রকৃতির কোনো অংশ বা সার্বিকভাবে পুরো প্রকৃতির উপর আরোপ করতে হয়। এতে আমাদের প্রতিবেশে সবার উপর মানুষের অবস্থান এ নীতিটি অথবা মানুষে মানুষে সমমর্যাদার নীতিটি লঙ্ঘিত হয়। প্রকৃতির বা তার কোনো অংশের সামনে অথবা অন্য কোনো ব্যক্তির সামনে অতিবিনয়ভাব বা ভক্তিভাব প্রকাশের মাধ্যমে আমি এ কাজটি করি।
অহংকার, অত্যাচার ও অন্যের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করার মাধ্যমে আমি নিজেকে অন্য ব্যক্তিদের উপরে স্থাপন করি। অহংকার লালন করা ও সুচিন্তিতভাবে মানুষের উপর অত্যাচার-নির্যাতন করার ইচ্ছা পোষণ করা আর নিজের জন্য দেবত্বের অংশ দাবী করা একই কথা, যদিও ঈশ্বর অত্যাচারী নন। এটি এ কারণে যে, আমি তখন এটা ভাবি যে, আমার ইচ্ছাই সার্বভৌম।
সংস্কার দ্বারা চালিত হওয়ার মাধ্যমেও আমি নিজেকে অপমান করি।
সংস্কার বলতে আমি বিজ্ঞান মনস্কতার বিপরীত অবস্থাকে বুঝচ্ছি আর বিজ্ঞান বলতে বুঝচ্ছি প্রকৃতির অংশসমূহের বৈশিষ্ট্য, তাদের আচরণের নিয়ম ও আমাদের জীবনে তাদের ঘাত (ইমপ্যাক্ট) সম্বন্ধে আমাদের পরীক্ষিত অভিজ্ঞতাজাত জ্ঞান। বিজ্ঞান থেকে সংস্কারের পার্থক্য এখানে যে, সংস্কারের উৎসের কোনো নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক বিবরণ থাকে না এবং সংস্কারের বিষয়টি মানবসমাজের কেউই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রদর্শন বা ডেমন্সট্রেট করতে পারে না।
ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্বের কাজ করা সম্ভব কেবল প্রকৃতির নিয়মগুলো জানার ও প্রয়োগের মাধ্যমেই। প্রকৃতির নিয়মগুলো ঈশ্বরের তৈরি, আর একারণে তাদের প্রয়োগ ঈশ্বরের ইচ্ছার অনুবর্তন। অন্যদিকে নিয়মগুলো বাস্তব যেহেতু তা ঈশ্বরের সৃষ্টি।
সংস্কার একধরণের ভয় জনিত ফ্যান্টাসি বা অবাস্তব মানসিক অবস্থার নির্দেশক যা যুক্তি বা অভিজ্ঞতা কোনো বিচারে টেকে না, আর একারণে তা প্রকৃতির উপর একধরণের দেবত্ব আরোপ ছাড়া কিছু নয়। আজকের সংস্কার কাল বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক বলে প্রমাণিত হতেও পারে। তবে যতদিন তা না হচ্ছে তত দিন তা পরিহার করে চলা ছাড়া আমাদের মান বাঁচানোর উপায় নেই। ফসলের মাঠে কাকতাড়ুয়া বসানো কোনো সংস্কার নয় কিন্তু নজর পড়বে ভয়ে গাছ ঢেকে রাখা সংস্কার বটে।
জ্ঞাতসারে প্রকৃতির স্বভাব বা বৈশিষ্ট্যের সাথে সংগতিহীন কাজ করার মাধ্যমে আমি নিজেকে অপমান করতে পারি। যেমন, আমি জানি জড় বস্তু বা প্রকৃতি শুনতে পায় না, আবাহনে সাড়া দিতে পারে না। তারপরও যদি আমি তাকে আবাহন করি তবে নিজেকেই অপমান করি।
অনুমানের উপর কাজ করেও আমি নিজেকে অপমান করতে পারি। আমি আপনার সাথে যোগাযোগ করার জন্য অভিজ্ঞতা থেকে জানা মাধ্যম গুলোই ব্যবহার করতে পারি। আমি আপনার সাথে টেলিফোনে বা ইন্টারনেটে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে পারি, আপনাকে দেখে চিৎকার করে ডাকতে পারি। আবার বিপদে পড়ে কাওকে না দেখেও চিৎকার করতে পারি এ আশায় যে রাস্তায় যদি কেউ থাকেন তবে শুনতে পাবেন। এরূপ 'ব্লাইন্ড ট্রান্সমিশনের'ও বাস্তব ভিত্তি আছে। কিন্তু আমি যদি আপনাকে মনে মনে ডাকতে থাকি অথবা কবরে শায়িত কোনো ব্যক্তিকে মনে মনে বা চিৎকার করে ডাকতে থাকি তবে আমি এ নিয়মটি ভঙ্গ করি।
আবেগের অবাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমেও আমি নিজেকে অবমাননা করতে পারি।
আমি আমার মাকে দৈনন্দিন জীবনে কথায় ও আচরণে শ্রদ্ধা করতে পারি, অন্তরপ্লাবী মমতায় তাঁর সেবা করতে পারি। এতে আমার মা বাস্তবিক উপকৃত হন। কিন্তু আমি তাঁর উদ্দেশ্যে আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা নিবেদন করলে বা তাঁর ছবিতে ফুলের মালা দিলে তাঁর কোনো বাস্তব উপকার তো হয় না। এতে মানুষ হিসেবে আমার মা ও আমার মধ্যে সমমর্যাদার যে নীতিটি ছিল তা ক্ষুণ্ণ হয়।
আমি আমার সন্তান বা ছাত্রকে তার ভালোর জন্য প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। কিন্তু যদি সন্তানের ব্যক্তিসত্তাকে সম্মান না করে ও তাকে সবক্ষেত্রেই সবসময় একজন অবুঝ শিশু মাত্র গণ্য করে তার ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্য বা সম্মান না দিয়ে নিছক বিরক্ত হয়ে নিজের ইচ্ছা তার উপর আরোপ করতে থাকি তাহলেও ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমার ও আমার শিশু সন্তানের মধ্যে সমমর্যাদার যে নীতিটি ছিল তা আমি ভঙ্গ করি।