কিভাবে নানা সম্প্রদায় একসাথে সকলের স্বাধীনতা বজায় রেখে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে? কিভাবে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সমবায়ে গঠিত সমাজটিকে তারা উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে পারে? স্বাধীনতায় সর্বনিম্নসম্ভব মাত্রায় হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়ে পরে যখন কেউ অন্যের প্রতি হিংসাত্মক হয়ে উঠে বা অত্যাচার করতে অগ্রসর হয়। তাই রাষ্ট্র ছাড়া কোন সমাজ নিরাপত্তা বিধান ও উন্নতি সাধনে অগ্রসর হতে পারছে না। এখন নানা সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যক্তির সংখ্যার উপর ভিত্তি করে গরিষ্ঠের ধর্মকে রাষ্ট্র তার ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করলে সংখ্যার বিচারে যারা লঘু হয়ে পড়ছে তাদের ইচ্ছা বা সম্মতি পরিত্যক্ত হতে পারে।
হিংসা ও অত্যাচারের অবসান করা এবং জীবনমানে উন্নয়ন আনাই রাষ্ট্রের কাজ হতে পারে। এখানে আইন প্রণয়ন, শাসন ও বিচার অত্যাবশ্যক হয় এবং আবশ্যক হয় প্রতিরক্ষা। কারা আইন প্রণয়ন করবে? আইনের উদ্দেশ্য কী হবে? কারা শাসন করবে? কারা বিচার করবে? বিরোধের নিষ্পত্তি কে করবে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তরে যদি বলা হয়, সবকিছুই নির্ধারণ করবে সংখ্যাগুরুরা, তবে সংখ্যালঘুদের কোন কর্তৃত্ব বা অংশগ্রহণ থাকছে না। যদি সকলে একমত হন যে, হ্যাঁ, আমরা সকলে সংখ্যাগুরুর জন্য এই অধিকার সাব্যস্ত করে দিলাম, তবে তারা নিজেদের স্বাধীনতাকে পরিত্যাগ করল বলা যায়। কিন্তু আমরা বলতে পারব যে, একটি প্রাথমিক চুক্তি সকল পক্ষের মধ্যে সম্পাদিত হলো।
কিন্তু যেখানে মুসলিমরা সংখ্যালঘু সেখানে কি তারা এইরূপ প্রাথমিক বা মৌলিক চুক্তিতে আবদ্ধ হবে? নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে অপরের হাতে তুলে দেবে? এর উত্তর, না। তাহলে কি সংখ্যাগুরু মুসলিমরা সংখ্যালঘুদেরকে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে মুসলিমদের হাতে ছেড়ে দিতে বলতে পারবে? অর্থাৎ মুসলিমরা সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও কারও নিরঙ্কুশ নেতৃত্ব মানবে না, কিন্তু নিরঙ্কুশ নেতৃত্বের অধিকারী হতে পারবে সংখ্যালঘুর ইচ্ছা ও সম্মতি ছাড়াই—এটি স্বাধীনতা ও সাম্যের পরিপন্থী ধারণা। এটি অধিকারের রেসিপ্রোসিটি বা সমরূপতা বিধির পরিপন্থী।
কাজেই সংখ্যাগরিষ্ঠের আইন, শাসন ও বিচার কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারে সংখ্যাগরিষ্ঠ দাবী করতে পারছে না। তাহলে রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন বা শুরুটি কিরূপে হতে পারে? এই শুরুটি হতে পারে একটি দলিলের মাধ্যমে যা সকল পক্ষ অনুসরণ করবে বলে সম্মত হবে। এটি রাষ্ট্রের কাঠামো ও কর্তব্যকর্ম নির্ধারণের মূল ভিত্তি। অর্থাৎ এটি সেই দলিল যার ধারাবলীতে সকলের সম্মতি থাকবে বা যা সকলের আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা, মূল্যমানের প্রকাশ ঘটাবে। অর্থাৎ সকলের কমন টার্মের ভিত্তিতেই এই দলিল আত্মপ্রকাশ করবে।
আমরা এবার বাংলাদেশের জন্য চিন্তা করতে পারি। মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ বা আস্তিক, নাস্তিক, বাঙালী, চাকমা, নির্বিশেষে সকলে যে বিষয়ে মতৈক্য পোষণ করতে পারে তা-ই দলিলে আসবে—এটাই স্বাভাবিক। এটিই সেই রাষ্ট্রের সংবিধান হবে। সকলেই শান্তিতে থাকতে চায়, জীবনের মান উন্নত করতে চায়, শোষণ, বৈষম্য, অত্যাচারের অবসান চায়। কাজেই এই প্রাথমিক দলিলকে ধর্মনিরপেক্ষ ও ইহলোকবাদী হতে হচ্ছে।
তাহলে এর আওতায় ভিন্ন ভিন্ন আদর্শের সম্প্রদায়গুলো কিভাবে কাজ করবে? তারা সবাই সংবিধান অনুসরণ করবে, এবং নিজেদের আদর্শের ভিত্তিতে নিজেদেরকে স্বাধীনভাবে গড়ে তুলবে এবং রাষ্ট্রকে তার উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়তা করার জন্য পরস্পরের সাথে ইতিবাচকভাবে প্রতিযোগিতা করবে। রাষ্ট্র কোন সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাতিত্ব বা আনুকূল্য করতে পারবে না, কোন পক্ষের ধর্মকে তার ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করবে না। প্রত্যেক সম্প্রদায় ধর্মীয় ক্ষেত্রে স্ব স্ব আইন অনুসরণ করবে। কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করলে, বা কেউ অন্য কারও উপর অত্যাচার না করলে, কারও সাথে কারও বিরোধ না বাধলে রাষ্ট্র কোনরূপ হস্তক্ষেপ করবে না।
এই প্রাথমিক চুক্তি পরে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবলে পরিবর্তন করা যায় না। এরূপ সুযোগ দিয়ে সংখ্যালঘুরা চুক্তিতে আসবে না। আবার সংবিধানটি নিজেই একটি বৃহৎ আইনমালা হতে পারে। এরূপ বড় সংবিধান ও তার কোনো ধারা কি পরে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবলে পরিবর্তন করা যায়? তাকে কি এমন রূপে ফিরিয়ে নেয়া যায় যা প্রাথমিকভাবে সম্মত সম্প্রদায়গুলোর কেউ কেউ মেনে নেবে না? কাজেই এই সংবিধানে একটি অপরিবর্তনযোগ্য অংশ থাকবে, যা প্রতিফলিত করবে প্রাথমিক চুক্তিকে। এই অংশটি কেউ পরিবর্তন করার অধিকার রাখবে না, যদি না সকলে একমত হয়ে পরিবর্তন না করে, যেভাবে প্রথমে তারা সকলে একমত হয়েছিল।
সংখ্যাগুরুরা এরূপ দাবী করতে পারে যে, আমরা সংখ্যালঘুদের সাথে কোন চুক্তিতেই যাব না এবং তাদেরকে আমাদের রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্তই করবো না। এটি সম্ভব হতো যদি প্রতিবেশীদের প্রতি মুসলিম হিসেবে আমাদের কোন দায় দায়িত্ব না থাকতো, যদি তাদের পক্ষে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব হতো, যদি তারা অগ্রসর হয়ে এই প্রস্তাব দিত যে, তারা সংখ্যাগুরুর সাথে থাকবে না। কিন্তু নীতিগতভাবে বা বাস্তবিকভাবে সেটি খুব সম্ভাব্য নয়। কারণ আমরা একে অপরের উপর নির্ভরশীল ও আমরা সকলেই নিরাপত্তা চাই। একই সমাজে নানা ধর্মের মানুষ থাকবে তারা সকলে সহাবস্থান করতে চাইবে এবং সকলে মিলে সমাজকে এগিয়ে নিতে চাইবে—এটাই স্বাভাবিক।
পশ্চিমাদের গণতন্ত্রকে অনেক সময় সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন বলা হয়। কথাটি প্রশাসনিক দিক থেকে ঠিক আছে। কিন্তু শাসনের নিয়ম হিসেবে সে আইন অনুসরণ করে। আইন প্রণীত হয় কিছু পূর্বতগৃহীত ও অপরিবর্তনীয় মূলনীতির সাথে সঙ্গতি রেখে। এই মূলনীতিগুলো জনগণের সকল অংশের ঐকমত্যের ভিত্তিতে রচিত হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নয়। এই নীতিগুলোই প্রাথমিক চুক্তি। শাসক বা আইনপ্রণেতারা সেই মূলনীতিগুলোর উপর গরিষ্ঠতার জোরে আক্রমণ করতে পারে না। আর এজন্যই একে গণতন্ত্র বলা হয়, গরিষ্ঠতন্ত্র নয়।
এরূপ রাষ্ট্র কি ইউটোপিয়া? সর্ববাদিসম্মত মূলনীতি কিভাবে নির্ধারিত হবে? সর্ববাদীসম্মত চুক্তি কিভাবে সম্পাদিত হতে পারে? এত এত ব্যক্তিমানুষের মধ্যে এরূপ চুক্তি কিভাবে স্বাক্ষরিত হবে? সম্প্রদায়গুলোর নেতৃত্বের দ্বারা এটি সম্ভব—একথা কি বলা যায়? কাদেরকে একটি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বকারী বলে সাব্যস্ত করা যায়? তাছাড়া প্রশাসনে, বিস্তারিত আইন প্রণয়নে সংখ্যাগরিষ্ঠতার নীতি ছাড়া তো উপায় নেই। এই সংখ্যাগরিষ্ঠরা ক্ষমতা লাভের পর সকলের প্রতিনিধিত্বের আসন গ্রহণ করবেন ও প্রাথমিক চুক্তির প্রতি বিশ্বস্ত থাকবেন তার নিশ্চয়তা কোথায়? এখানে এসে এর চেয়ে ভাল কি বিকল্প হতে পারে তা জিজ্ঞেস করা যায় এবং গণতন্ত্রের ব্যর্থ হয়ে উঠার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা গ্রহণীয় বলে মেনে নিতে হয়। আদর্শ হিসেবে গণতন্ত্র সর্বশ্রেষ্ঠ আর এর বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সমবেতভাবে ও আন্তরিকভাবে কাজ করে যাওয়া ছাড়া আমাদের গতি নেই।
এখন বাংলাদেশে মুসলিমদের একাংশের কেইস নিয়ে আলোচনা করা যায়। যারা আল্লাহর সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে তারা আল্লাহর ইচ্ছার কাছে নিজেদেরকে সমর্পণ করবে। অন্যের এই অধিকার নেই যে তাদেরকে তারা বাধা দেয়। কিন্তু সার্বভৌমত্ব যদি আল্লাহরই হয়ে থাকে, তবে তাদেরকে এই কথাও মেনে নিতে হবে যে, তাদেরও কোন অধিকার নেই অন্যদের বাধা দেয়ার, যদি অন্যেরা আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে এসব মুসলিমদের জ্ঞান, বিবেচনা বা ব্যাখ্যা অনুগভাবে মেনে নিতে না চায় বা আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে একেবারেই অস্বীকার করে।
নবীর মৃত্যুর পর সর্বপ্রথম আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে রাষ্ট্রের বুনিয়াদ হিসেবে যারা গ্রহণ করেছিল তারা হলো খারেজিরা। নবী বা রাশেদ খলিফারা এই নীতি অনুসরণ করেননি। নবীর শাসনের মূল ভিত্তি ছিল মদিনার সনদ, যা ছিল সকল পক্ষ কর্তৃক সর্বসম্মতভাবে গৃহীত চুক্তি। খারেজীরাই প্রথম চুক্তির বদলে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের কথা তুলেছিল রাজনীতিতে। আলীর বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ ছিল, মানুষের মীমাংসা, সন্ধির কোন বৈধতা বা ভিত্তি নেই, যার দিকে অগ্রসর হয়ে আলী নিজেকে ধর্মচ্যুত করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় আল্লাহ তাঁর সার্বভৌমত্ব প্রয়োগ করবেন কিভাবে? তাই খারেজিরা আবার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, যারা আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে মানে তারাই আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে প্রয়োগ করবে অন্যদের উপর। অর্থাৎ মানুষের সন্ধি বা চুক্তিকে অস্বীকার করে তারা নিজেরা মানুষ হওয়া সত্ত্বেও নিজেদেরকে একতরফাভাবে সকলের উপর আল্লাহর তথাকথিত "সার্বভৌমত্ব"কে প্রয়োগ করার অধিকারী বলে সাব্যস্ত করেছিল। এটিকে তথাকথিত বলা হলো এ কারণে যে, খারেজিরা ধারণা করতো তারা যেটিকে আল্লাহর ইচ্ছা বা মীমাংসা বলে জানবেন বা নির্ধারণ করবেন সেটিই আল্লাহর ইচ্ছা বা মীমাংসা।