কিন্তু এটি আমাদের দেশে বোধ করি খুব বিস্ময়ের কিছু নয়। আজ যদি শিবিরের কতিপয় ছেলে বিশ্বজিৎকে এভাবে হত্যা করতো তাহলে প্রতিবাদের সারিতে আমরা আরও অনেককে পেতাম। আমরা অনেকেই তখন অস্থির হয়ে উঠতাম। 'শিবিরের হায়েনারা' ইত্যাদি কত কথাই না আমাদের মুখে উঠে আসতো। হাতে হাত ধরে রাস্তায় মানব বন্ধন করতাম। ব্যানারে পোস্টারে আঁকা থাকত কত রকম দৈত্যের মুখ। আবার যদি বিশ্বজিৎ নিজেই শিবিরের কর্মী হতো, তাহলেও প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে আমরা অনেকেই অন্যরকম হতাম। হয়তো মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকতাম। বিশ্বজিৎ নিজের জীবন দিয়ে আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেল আমরা একাংশ নিষ্ঠুরতায় কিভাবে সিলেক্টিভ ভাবে প্রতিক্রিয়া করি।
তবে ছাত্রদল বা ছাত্রশিবিরের কেউ অনুরূপ কাজ করলে যেমন আমরা পুরো দল বা শিবিরের গায়ে 'হায়েনা'র ব্র্যাণ্ড লাগিয়ে দিতে পারি না, তেমনই ছাত্রলীগের কেউ কেউ এরূপ কাজ করলে ছাত্রলীগের বেলায়ও তা করতে পারি না। সকল ক্ষেত্রেই আমাদের সমরূপ প্রতিক্রিয়াই করা দরকার; বরং নিজের সমর্থিত দলের কর্মীদের এরূপ কর্মকাণ্ডের বিপরীতে বেশী অস্থির ও দুঃখিত হওয়া আমাদের কর্তব্য। সব দলের বিরুদ্ধেই যে কোনো রকম উৎকট ভাষার জেনারালাইজেশন বা স্টেরিওটাইপিং পরিহার করে চলাই উচিত।
এধরণের নিষ্ঠুরতার, নিষ্ঠুর অপরাধের বিপরীতে সুবিচার প্রত্যাশী হওয়া ও সুবিচারের জন্য কাতর হয়ে উঠার মধ্য দিয়েই আমাদের মানবিক অনুভূতির প্রকাশ ঘটে। যে মানুষ অন্তরে সত্যই ব্যথা অনুভব করে, সে মানুষই কাতর হতে পারে। যে অন্তরে বেদনা অনুভব করে না, তাকেই আমরা সিমার বলে থাকি। কিন্তু আমারা যে একটি ক্ষুদ্র অংশ এরূপ ঘটনাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বা রাজনৈতিক যুদ্ধের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করি বা করার পলিসি নিয়ে চলি তারা কিন্তু আসলে এই বেদনাটি অনুভব করি না। তখন শিবিরের ছেলেকে মার খেতে খেতে মরে যেতে দেখলেও একদলের যেমন মায়া লাগে না, তেমনই ছাত্রলীগের ছেলেকে একইভাবে মরে যেতে দেখলেও অন্য দলের মনে ব্যথা লাগে না। আর এই মায়াহীনতা, ব্যথাহীনতা আমাদেরকে মানুষের অবস্থান, প্রাণীর অবস্থান থেকে নীচে নামিয়ে দেয়—প্রাণীরাও মায়া বা ব্যথা অনুভব করে।