কাজীর গরু গোয়ালে থাকবে কি

ধীরাজ কুমার নাথ
Published : 26 April 2011, 03:11 PM
Updated : 30 Dec 2013, 06:18 AM

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র ৭ দিন পূর্বে, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৩ তারিখে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করা হয়েছে। ভিশন-২০২১ এর অনুরূপ 'রূপকল্প-২০৪১' ঘোষণা করা হয়েছে এবং ২০৫০ সালকে লক্ষ্য নির্ধারণ করে তরুণদের উদ্দেশ্যে রূপকল্প উপহার দেওয়া হয়েছে।

তবু বলা যায় গণতন্ত্রের সন্মান রক্ষার্থে, নির্বাচনী প্রচার বন্ধ হওয়ার পাঁচ দিন পূর্বে একটি নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করা হল। অন্য কোনো দল এ জাতীয় আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে ভাবে না। অবশ্য মাঠে-ময়দানে এমন কোনো দল নেই, যাদের ইশতেহার প্রকাশ করার মতো অভিজ্ঞান বা প্রয়োজনীয়তা আছে।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এবারের প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনে ইশতেহারে আছে না নেই তা নিয়ে জনগণের ভাবনা নেই। কারণ এতে আছে শান্তি, প্রগতি, সমৃদ্ধি, গণতন্ত্র, মুক্তচিন্তা বা ভাবনার স্বাধীনতা এবং আরও কত কথা যা বঙ্কিমচন্দ্র বা মীর মোশারফের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে অতীতে। তদুপরি, এবার ভোটারদেরকে ইশতেহার নিয়ে ভাবনার বা পড়ার প্রয়োজনও হবে না। কারণ বিকল্প বা প্রতিদ্বন্দ্বী এমন প্রার্থী নেই যেখানে তুলনামূলক বিশ্লেষণের প্রয়োজন হতে পারে।

নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে যে জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশে উন্নীত করা হবে এবং দারিদ্র্যের হার ২৬ থেকে ১৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। বিদ্যুতের উৎপাদন ১০ হাজার মেগাওয়াট থেকে ২৪ হাজার করা যাবে, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নির্ধারিত সময়ে সমাপ্ত হবে। তদুপরি, মাথাপিছু আয় ২০২১ সাল নাগাদ ১ হাজার ৫০০ ডলারে উন্নীত করা হবে। বড় প্রত্যাশা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ দেশকে বিশ্বের প্রথম সারির দেশে পরিণত করা যাবে। পদ্মা সেতু একটি নয়, দুটি হবে।

অত্যন্ত আশাপ্রদ প্রতিশ্রুতি হচ্ছে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বলছে, দুর্নীতি প্রতিরোধে আইনি, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ জোরদার করা হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করে প্রতিষ্ঠানটির কার্যকারিতা আরও বাড়ানো হবে। ঘুষ, অনোপার্জিত আয়, কালো টাকা, চাঁদাবাজি, ঋণখেলাপি, টেন্ডারবাজি ও পেশীশক্তি প্রতিরোধ এবং দুর্নীতি-দুর্বত্তায়ন নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দুর্নীতি প্রতিরোধ সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতিটি হচ্ছে এদেশের মানুষের কাছে সবচেয়ে অর্থবহ ও স্পর্শকাতর অঙ্গীকার। শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, সম্প্রতি ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে নিতান্তই অপরিচিত আম আদমি পার্টির প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৩ দিল্লির সপ্তম মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে রামলীলা ময়দানে শপথ গ্রহণ করলেন। কারণ এই প্রাক্তন সরকারি কর্মকর্তা আন্না হাজারের অনুসারী হয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন।

বাংলাদেশেও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এরশাদ সাহেব দুর্নীতির অভিযোগেই গণপ্রতিরোধের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। অনেকে মনে করেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি পরাজিত হওয়ার অন্যতম কারণ দুর্নীতির অভিযোগ। ২০০১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অনেক ভালো কাজ করার পরও নির্বাচনে হেরে যাওয়ার একটি প্রধান কারণ ছিল ফেনীর জয়নাল হাজারী, লক্ষীপুরের তাহের, নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমানের মতো অনভিপ্রেত ব্যক্তিদের কর্মকাণ্ডকে দলীয়ভাবে প্রকাশ্যে সমর্থন প্রদান করা। এছাড়া সেবার টেন্ডারবাজি, ঘুষগ্রহণের মাধ্যমে সরকারি চাকুরিতে নিয়োগ, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বারবার দেওয়া হয়েছে।

গত পাঁচ বছরে কোনো প্রকার সততার কথা আমলে না নিয়েই, মন্ত্রী-এমপিগণের অর্থের সীমা বেড়েছে শত গুণ, হাজার গুণ। অর্থমন্ত্রী বলছেন– ক্ষমতায় থাকলে আয়-উন্নতি বাড়ে। তারপর আবার বলা হচ্ছে, দুর্নীতি এবং দুর্বত্তায়নকে কঠোর হাতে দমন করা হবে? জনগণ কী বিশ্বাস করতে চাইবে?

আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান সময়কালে দুর্নীতি দমন কমিশনকে নখ ও দন্তবিহীন করার এবং তাদের প্রায় সকল কর্মকাণ্ডে সরকারের অনুমতি গ্রহণ করার বিধান করা হয়েছে। পক্ষান্তরে, পুনরায় প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে। জনগণ একথা বিশ্বাস করবে কি? বাংলাদেশের অনেক মানুষই বিশ্বাস করে বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি, জাইকা ও আইডিএ কর্তৃক প্রায় ২৪০০০ কোটি টাকার অর্থায়নে পদ্মাসেতু হতে পারেনি, কারণ সরকারের দুর্নীতির অভিপ্রায় বা কারসাজি প্রমাণিত হয়েছে অথবা কোনো মন্ত্রীকে রক্ষার চেষ্টা করার কারণে বাংলাদেশ এক ঐতিহাসিক প্রগতির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

এখন যদি বলা হয় দুটি অনুরুপ সেতু হবে, জনগণ কি তাতে পঁচা ইঁদুরের গন্ধ খুঁজবে না? শেয়ার বাজারের কেলেঙ্কারিকে 'রাবিশ' বলে অথবা ৪৫০০ কোটি টাকার হলমার্ক দুনীতিকে 'সামান্য টাকা' বলে উপেক্ষা করাকে জনগণ কি স্বাভাবিক মনে করছে? গ্রামীণ ব্যাংক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, ডেসটিনি-২০০০, ইউনিপে-২, সাগর-রুনি হত্যা, রানা প্লাজা ভেঙে পড়ার মাঝে অনেক ভুলবুঝাবুঝি ছড়িয়ে পড়েছে বলে মনে হয়। এসব কথা ভেবে দেখার সময় এসেছে।

সদ্যঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহারের মানবাধিকারের প্রতিশ্রুতির প্রতি জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ হয়েছে ব্যাপকভাবে। বলা হয়েছে নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তার বিধান, তাদের কাজের ও চলাফেরার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হবে। সংবিধান সুরক্ষা, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করা হবে এবং সংসদকে কার্য়কর করতে প্রয়েজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সবই উত্তম ও ভালো সরকারের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু প্রয়োগ দৃশ্যমান হয়নি অতীতে এবং এখনও হচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রে। ২৯ ডিসেম্বর 'গণতন্ত্রের অভিযাত্রা' ব্যর্থ করতে গিয়ে সরকার যা করেছেন তাতে সারাদেশের সাধারণ মানুষ চরম হেনস্তা ও দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন। কিন্তু কেন?

নবম সংসদের শুরু থেকে সামনে বসার দুটো চেয়ার নিয়ে সংসদ অচল হয়ে গেল্। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এমনটি হয়েছে বলে কেউ শুনেনি। মানসিকতার এমন দৈন্যতা কেউ অবলোকন করেনি কখনও। গণতান্ত্রিক অধিকার হচ্ছে সভা-সমিতি করা, প্রতিবাদ করা। মনে হয় না বিরোধী দলের লোকেরা তা সকল সময় নির্ভয়ে করতে পেরেছে।

নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তার বিধান যে কোনো সরকারের প্রাথমিক এবং মৌলিক দায়িত্ব। ২০১৩ সালের ২৮ ফ্রেব্রুয়ারি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির হুকুমের পর, সমগ্র বাংলাদেশে হিন্দুদের বাড়িঘর ও উপাসনালয় নির্বিচারে আক্রমণ করা শুরু হল, সরকার দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। দলের কর্মীদের প্রতিরোধ করতে নির্দেশ দিয়েছেন বলে মনে হয় না। অথচ ২৯ ডিসেম্বর দলের কর্মীরাই রাস্তার মোড়ে মোড়ে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল বিরোধীদের গণতন্ত্রের অভিযাত্রা প্রতিহত করতে!

সেই যে চলল মন্দির ভাঙার মহোৎসব, এখনও চলছে; অথচ অসম্প্রদায়িকতার ভাবনায় বিভোর অনেকেই। পাবনার সাথিঁয়ায় প্রকাশ্যে ৩৩ টি হিন্দু বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হল কেবলমাত্র একটি মিথ্যার উপর ভিত্তি করে। কারা এ কাজ করেছে তাদের চিহ্নিত করতে কষ্ট হল না। ডেইলি স্টার পত্রিকায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ছবি উঠল ওই সকল লোকের সঙ্গে যারা আগুন দিয়েছে। এর নাম কি সুশাসন?

স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা এবং লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা অর্থবহ করতে হবে। একথা সত্য, বাংলাদেশ একটি অপার সম্ভাবনার দেশ যেখানে জনগণ সকল প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতার মাঝেও অগ্রগতির পথে পা বাড়াতে জানে। জনগণ সাম্প্রদায়িক নয়, রাজনীতি তাদেরকে অনুপ্রাণিত করে সাম্প্রদায়িক হতে– যেমন করেছে রামুতে, তেমনি করেছে সাঁথিয়ায়। যেন গভর্নর মোনায়েম খানের প্রেতাত্মা বিচরণ করছে বাংলার জনপদে, নির্ভয়ে।

গণমাধ্যমের প্রতিনিধিগণ, বেসরকারি উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠানসমূহ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, বিশিষ্ট সমাজসেবীরা, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিভাবান কর্মচারিবৃন্দ তাদের প্রচেষ্টায় দেশকে অগ্রগতির পথে ধাবিত করে একটি সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। দুর্ভাগ্য দেশের মানুষের– নষ্ট রাজনীতি বারবার এ অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিয়েছে। গীতা সেনের ভাষায় বলতে হয়– "আমরা অসুস্থ সরকার চাই না, আমরা ভালো সরকার চাই। আপনারা আমাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন।"

এখন আমাদের অনুরোধ থাকবে দেশটাকে সংঘাতময় এবং ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করবেন না। আলোচনা করুন এবং সমাধান করুন। বাংলাদেশ বেনিন, টঙ্গো, দক্ষিণ সুদান নয় অথবা ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী রাষ্ট্র নয়।

পরিশেষে একথা বলে শেষ করব, নির্বাচনী ইশতেহারে যে সকল প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তা পালন করতে হবে। যদি না হয় তবে কোনো ভোটার এ ইশতেহার দেখে এবং বিশ্বাস করে যদি প্রবঞ্চিত হয় অথবা সুশাসনের ব্যত্যয় দেখে ব্যথিত হয়, তবে সেই ব্যক্তি বা ভোটার দলের বিরুদ্ধে মামলা করে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারবে– এমন একটি প্রতিশ্রুতিও দিতে হবে। কথায় এবং কাজে মিল থাকতে হবে।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশের স্বাধীনতা এনেছে; দেশের সন্মানও অক্ষুণ্ন রাখবে বলে অনেকেই মনে করে। দেশ যেন অস্থিতিশীল না হয় তার জন্য তারা সচেষ্ট হবে এবং বড় ধরনের আত্মত্যাগেও পিছপা হবে না আশা করি।

ধীরাজ কুমার নাথ: প্রাক্তন সচিব ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।