নারীর কোরান – ২ (পরিবার)

মোনেম অপু
Published : 4 Jan 2013, 07:08 AM
Updated : 4 Jan 2013, 07:08 AM

২.১। এই পর্বে আমরা পরিবারের সম্ভাব্য বিকল্প সব কাঠামো নিয়ে আলোচনা করবো। পরিবারকে যদি একটি সংগঠন হতে হয় তবে তা হয় মাতা শাসিত হবে, নয়তো হবে পিতা শাসিত। কারণ কোন সংগঠনে একজনকে বিরোধ নিষ্পত্তিকারীর ভূমিকায় থাকতে হয়। আমরা উভয় ক্ষেত্রে পরিবারের প্রাকৃতিক রূপ কী হতে পারে তা নির্ধারণের চেষ্টা করবো। প্রাকৃতিক সংগঠন বলতে আমরা বুঝবো এমন সংগঠন যা নিয়ন্ত্রণের জন্য চিন্তাপ্রসূত বা নৈতিক নিয়ম একান্তভাবে আবশ্যক না হলে গ্রহণ করা হবে না। পরিবারের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক আবশ্যকতা বলতে বুঝবো সন্তান উৎপাদন, তাদের প্রতিপালন ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য যা আবশ্যক তা।

২.২। প্রাকৃতিক মাতা-শাসিত পরিবার

এরূপ পরিবার গড়ে উঠবে মায়ের নেতৃত্বে ও মাকে কেন্দ্র করে। এখানে মা পরিবারের প্রধান ও তার সন্তানরা সেই পরিবারের অন্যান্য সদস্য। মা এই পরিবারে নিষ্পত্তিকারী। মায়ের কন্যার সন্তানেরা এই পরিবারেরই অন্তর্ভুক্ত হবে। মায়ের/নানীর মৃত্যুর পর কন্যাদেরকে কেন্দ্র করে পরিবার বিভক্ত হবে। মা, মায়ের সন্তানরা ও মায়ের কন্যাদের সন্তানরা পরিবার রক্ষার কাজ করবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মা বা তার কন্যারা সন্তান নেবে কিভাবে? ব্রিডিংয়ে পুরুষরা কিভাবে অংশ নেবে? এখানে দুটি বিকল্প হতে পারে।

২.২.১। বিবাহবর্জিত মাতা-শাসিত পরিবার

যখন কোন নারী সঙ্গ চাইবে তখন সে অন্য পরিবারের পুরুষকে আহ্বান করবে, যেহেতু পুরুষকে দীর্ঘ সময় অবস্থানের প্রয়োজন পড়ে না। পুরুষ এরূপ আহ্বানে সাড়া দিতে পারে, যেহেতু তার সন্তান মাতার আশ্রয়ে নিরাপদ, যেহেতু এতে পুরুষের জন্য বহুগামিতার সুযোগ থেকে যায়, যেহেতু পুরুষের অংশ গ্রহণ সম্পন্ন হলেও সন্তান সাথে সাথেই অস্তিত্বে আসে না বিধায় সন্তানের সাথে তার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় না। একারণেই যে পুরুষেরা যায় তারা এত সহজেই পতিতালয়ে যেতে পারে, তারপর খুশিমনে দূরে সরে যেতে পারে, সম্ভাব্য সন্তানের জন্য তার না থাকে কোন চিন্তা, না থাকে দুঃখ। ক্রুড ন্যাচারাল মাতৃতান্ত্রিক পরিবারে বিবাহ বা চুক্তির কোন প্রয়োজন নেই এবং যৌনাচারে কোন নিয়ন্ত্রণ বা শর্ত আরোপের প্রয়োজন নেই।

পুরুষ তার মায়ের পরিবারে বসবাস করবে ও বৃদ্ধকালে বোন, বোনের কন্যা বা ভাইয়ের কন্যার আশ্রয়ে থাকবে। এখানে পুরুষরা অন্য পরিবারের জন্য ব্রিডার, ও নিজ পরিবারের জন্য শ্রমদাতা। ভাই-বোনেরা নীতিগতভাবে পরস্পরের অর্ধ-ভাই ও অর্ধ-বোন। কারণ তারা কেউ নিশ্চিত নয় কে কার বাবা। এই ধরনের সমাজে নারীর গর্ভ সংরক্ষণ অর্থহীন; ফলে পুরুষ কোন শঙ্কা নিয়ে বাস করবে না।

২.২.২। বিবাহযুক্ত মাতা-শাসিত পরিবার

নারীরা তাদের কাছে অন্য পরিবারের পুরুষকে এনে রাখবে সার্বক্ষণিক সান্নিধ্য ও সহায়তার জন্য ও পুরুষ সম্মত হবে তার সন্তানের সান্নিধ্যে থাকার ও তাদের জন্য কাজ করার সুযোগ লাভের উদ্দেশ্যে এবং এক্ষেত্রে নারীকে গর্ভ সংরক্ষণ করতে হবে (অন্য পুরুষের কাছে সে যাবে না)। যদি স্বামী অন্য নারীর নিকট যায় তবে স্ত্রী তার বিরুদ্ধে তার পরিবারে অন্যের সন্তান নিয়ে আসছে—এমন অভিযোগ তুলতে পারছে না, পারবে চুক্তিভঙ্গ ও তার প্রাপ্য সান্নিধ্য থেকে তাকে বঞ্চিত করার অভিযোগ করতে। স্বামীকে সে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করতে পারে, না ফিরলে চুক্তি বাতিল করতে অর্থাৎ বিয়ে ভেঙ্গে দিতে পারে।

যদি স্বামী গর্ভ সংরক্ষণের অঙ্গিকার থেকে স্ত্রীর সরে যাওয়ার আশঙ্কা করে তবে সে স্ত্রীর বিরুদ্ধে তার কোলে অন্যের সন্তান তুলে দেয়ার চেষ্টা করার অভিযোগ করতে পারে, যা অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ এবং সেই সাথে চুক্তিভঙ্গ ও সান্নিধ্যে বঞ্চনার অভিযোগ তো থাকছেই। এ ক্ষেত্রে তাকে স্ত্রীর অধীনে থেকে তার বিরুদ্ধে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী শক্ত অভিযোগ আনতে হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে অত্যাচারটি বড়, অথচ তা উত্থাপন করতে হচ্ছে সে যার অধীন তার বিরুদ্ধে। সন্তুষ্ট না হলে স্বামী চুক্তি ভেঙ্গে দিয়ে চলে যেতে পারে, এবং তার সান্নিধ্য কালে প্রসূত সন্তানদেরকে সে তার সন্তান হিসেবে গণনায় বা স্বীকৃতির মধ্যে রাখতে পারে। কিন্তু এ ব্যবস্থা পুরুষরা বদলে ফেলতে চাইবে। অতীত ও বর্তমানের মানবসমাজে মাতা শাসিত পারিবারিক ব্যবস্থা আমরা তেমন একটা দেখিনা।

২.৩। প্রাকৃতিক পিতা-শাসিত পরিবার

এরূপ সমাজ গড়ে উঠে পিতার নেতৃত্বে ও পিতাকে কেন্দ্র করে। সন্তান উৎপাদনের জন্য পুরুষ অন্যান্য পরিবার থেকে এক বা একাধিক নারীকে নিজের পরিবারে এনে রাখে। মাতা শাসিত পরিবার অবাধ যৌনতার ভিত্তিতে সম্ভব হলেও পিতা শাসিত পরিবারে তা সম্ভব নয়। স্বামী তার স্ত্রীকে অন্য পুরুষের কাছে যেতে দেবে না। কাজেই একটি অস্থায়ী বা স্থায়ী সমঝোতা বা চুক্তি বা বিবাহ এখানে আবশ্যক হয়।

২.৩.১। অস্থায়ী বিবাহ ভিত্তিক পিতা-শাসিত পরিবার

গর্ভধারণ ও সন্তানকে স্তন্যদানের কালকে গুনলে মোটামুটি তিন বছর অন্ততপক্ষে স্ত্রীকে পরিবারভুক্ত রাখতে হয়। কালের দৈর্ঘ্যে কিছু হের ফের করা গেলেও সময়কালটি বেশ দীর্ঘই থেকে যায়। ফলে শর্ত ছাড়া কোন নারী একাজে এগুনোর কথা নয়। এটিকে আমরা তাই অস্থায়ী বিবাহ ভিত্তিক পরিবার বলতে পারি। কিন্তু নারীর জন্য এটি মোটেই গ্রহণীয় নয়। নারী গর্ভ সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি থেকে বিচ্যুতির মধ্যে পড়তে পারে, কিন্তু নিজের সন্তান থেকে সরে যেতে সে চাইবে না। কারণ নারীর গর্ভধারণ ও স্তন্যদান নারীকে তার মূর্ত অস্তিত্বশীল সন্তানের সাথে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় সম্পর্কে আবদ্ধ করে ফেলে। চুক্তিভঙ্গের দায়ে দোষী হলেও সে সন্তান ছেড়ে যেতে চাইবে না, আর বিনা দোষে তাকে সন্তান থেকে দূরে সরিয়ে দিলে তাকে সে খুবই অত্যাচারমূলক কাজ বলে মনে করবে। কাজেই স্থায়ী বিবাহ ভিত্তিক পরিবার ছাড়া নারী চুক্তি করতে চাইবে না। সন্তানরাও নিজেদের মায়ের সান্নিধ্য ও স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়—যা তাদের জন্য একটি বড় বঞ্চনা।

২.৩.২। স্থায়ী বিবাহ ভিত্তিক পিতা-শাসিত পরিবার

স্থায়ী বিবাহ ভিত্তিক পিতা-শাসিত পরিবারে মাতা সন্তানের সান্নিধ্যে থাকতে পারে। কিন্তু এখানে স্ত্রী বিপন্ন হয়ে উঠে। তার স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সংকটের মধ্যে পড়ে। এক নারীর কোলে অন্য নারীর সন্তান তুলে দেয়া যায় না, কারণ গর্ভ ধারণ, লালন ও সন্তান প্রসব দশ মাস দীর্ঘ একটি প্রসেস ও বিরাট ঘটনা। এখানে গোপন করার বা লুকানোর কিছু নেই। নারী সেজন্য নিরাপদ অন্যের সন্তানের ভারবহন ও উত্তরাধিকারের সমস্যা থেকে। কিন্তু এক পুরুষের ঘরে অন্য পুরুষের সন্তান নিয়ে আসা সহজ, কারণ গর্ভধারণের সূচনাটি সংক্ষিপ্ত সময়ের ও তা গোপন রাখা সম্ভব। এটি গোপন রাখারই বিষয়। পুরুষ তাই শঙ্কিত, অন্যের সন্তানের ভার ও উত্তরাধিকার নিয়ে। পিতা-শাসিত পারিবারিক সংস্থায় নারীর উপর নজরদারী ও তাকে কর্তৃত্বাধীনে রাখার জন্য পুরুষের ইচ্ছার ও মরিয়া হয়ে উঠার এটিই মূল কারণ। এজন্য সে নারীর জন্য এমন মূল্যমান ও আদর্শ তৈরি করে যা পুরুষের শঙ্কা হ্রাসে সহায়ক হয় এবং যেন নারী নিজেই বা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পুরুষের অনুগত হয়ে চলে। পিতা-শাসিত পরিবারে নারী এজন্য বিপন্ন হয়ে উঠে।

চলবে ….

পরের পর্ব: নারীর কোরান – ৩ (নাফসিন ওয়াহিদাতিন)
প্রথম পর্ব: নারীর কোরান – ১ (ভূমিকা)