নারীর কোরান – ৮ (কাওয়াম)

মোনেম অপু
Published : 3 Feb 2013, 05:11 PM
Updated : 3 Feb 2013, 05:11 PM
৮.১। কোরানের চতুর্থ সুরা নিসা'র ৩৪ নং আয়াতটির প্রথম বাক্যটি নিয়ে এই পর্বে আলোচনা করব। বাঙালী মুসলিম সমাজে যারা ইসলামপন্থী বলে পরিচিত তারা যেসব বাংলা অনুবাদক ও তফসিরকারককে নির্ভরযোগ্য ও মান্য বলে মনে করেন তাদের অনুবাদ ও তফসিরে এমন কিছু কথা লিখিত আছে তা অত্যন্ত বিস্ময়কর ও দুঃখজনক। কিন্তু মূল আরবিতে কোরানের এই আয়াত কি সত্যই এরূপ কথায় উপনীত হওয়ার মতো কিছু বলে? এই বাক্যটিকে আমরা 'রিজাল বাক্য' বলে অভিহিত করবো এবং এই বাক্যের 'কাওয়াম' শব্দটির অর্থ নির্ধারণ করার চেষ্টা করবো।

৮.২। রিজাল বাক্য (৪:৩৪ আয়াতের ১ম বাক্য)

বাংলা ট্রান্সলিটারেশন:—আর্‌রিজালু কাওয়ামুনা আলা ন্‌নিসায়ি বিমা ফাদ্দালা ল্লাহু বায়্‌দাহুম আলা বায়্‌দিন ওয়া বিমা আনফাকু মিন আমওয়ালিহিম।
পুরুষতন্ত্র সহায়ক অনুবাদ:—Men are the managers of women, because God hath made the one of them to excel the other, and because they spend of their property.
মধ্যপন্থী অনুবাদ:—Men are the protectors and maintainers of women, because God has given the one more than the other, and because they support them from their means.

এই বাক্যের চারটি গুরুত্বপূর্ণ পদ:—কাওয়ামুনা, বিমা ও ফাদ্দালা। এই পর্বে 'কাওয়াম' পদের যুক্তিসঙ্গত অর্থ নির্ধারণের চেষ্টা করা হলো। পরের পর্বে 'বি-মা' ও 'ফাদ্দালা' পদের অর্থ নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করব এবং শেষে এই বাক্যের একটি বাংলা অনুবাদ প্রস্তাব করা সম্ভব হবে। কাওয়াম শব্দের অর্থ 'কর্তা' বা 'রক্ষক' করে এবং 'বিমা' পদের অর্থ 'তা সহ' না করে 'যেহেতু' করে কিভাবে অবিচার ও অসঙ্গতি তৈরি করা হয়েছে তা আমরা দেখার চেষ্টা করব।

৮.৩। কাওয়াম

৮.৩.১। ত্রি-অক্ষর শব্দমূল:— ক্কাফ ওয়াও মীম।

এই মূল থেকে জাত তিনটি প্রধান ক্রিয়া পদের অর্থ:
কামা — to stand up, to rise, to establish.
আকামা — to establish.
ইসতাকামু — to be upright, to be straight, to stand firm

'কাওয়াম' এর জন্য ইংরেজি অনুবাদকদের ব্যবহৃত শব্দ:
উগ্র অর্থ:— in charge, manager.
মৃদু অর্থ:— protector & maintainer, securer.

৮.৩.২। এই আয়াতের 'কাওয়াম' শব্দের অর্থ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ইউসুফ আলী লিখেছেন:

Qawwam: one who stands firm in another's business, protects his interests, and looks after his affairs; or it may be, standing firm in his own business, managing affairs, with a steady purpose.

কোরানের ৪:১৩৫ ও ৫:৮ আয়াতে কাওয়াম শব্দের অর্থ বিশ্লেষণে তিনি লিখেছেন:

Justice is Allah's attribute, and to stand firm for justice is to be a witness to Allah, even if it is detrimental to our own interests (as we conceive them) or the interests of those who are near and dear to us.

৮.৩.৩। বর্তমান ৪:৩৪ আয়াতের 'কাওয়াম' শব্দের অর্থ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মুহম্মদ আসাদ লিখেছেন:

The expression qawwam is an intensive form of qa'im ("one who is responsible for" or "takes care of" a thing or a person). Thus, qama 'ala l-mar'ah signifies "he undertook the maintenance of the woman" or "he maintained her" (see Lane VIII, 2995). The grammatical form qawwam is more comprehensive than qa'im, and combines the concepts of physical maintenance and protection as well as of moral responsibility: and it is because of the last-named factor that I have rendered this phrase as "men shall take full care of women".

৮.৪। বিভিন্ন অনুবাদে কাওয়াম

এবার দেখা যাক ৪:৩৪ আয়াতের অনুবাদে কাওয়াম শব্দের অর্থ করতে গিয়ে কোন অনুবাদক কি লিখেছেন:

Sahih International — Men are in charge of women
Pickthall — Men are in charge of women
Sher Ali — Men are guardians over women
Daryabandi — Men are overseers over women
Muhammad Sarwar — Men are the protectors of women
Shakir — Men are the maintainers of women
Yusuf Ali — Men are the protectors and maintainers of women
Mohsin Khan — Men are the protectors and maintainers of women
Shehzaz — Men are protectors and maintainers of women
Arberry — Men are the managers of the affairs of women
Muhammad Asad — MEN SHALL take full care of women
ইবন কাসিরের বাংলা অনুবাদ — পুরুষেরা নারীদের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত
মউদূদীর বাংলা অনুবাদ — পুরুষ নারীর কর্তা
মুহম্মদ শফির বাংলা অনুবাদ — পুরুষরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বাংলা অনুবাদ — পুরুষ নারীর কর্তা

৮.৫। কাওয়ামুন বনাম কাওয়ামিন

৮.৫.১। 'কাওয়ামিন' পদটি আছে কোরানের ৪:১৩৫ ও ৫:৮ আয়াতে। একই সুরা নিসা'র সম্পূর্ণ ১৩৫ আয়াতটির অনুবাদ সহি ইন্টারন্যাশনাল অনুযায়ী নিম্নরূপ:

O you who believe! Be persistently standing firm in justice, as witnesses for God, even if it is against yourselves or your parents or relatives whether rich or poor, for God is nearer to both of them. So do not follow the desires, lest you deviate. And if you distort or fall away, then indeed, God is All-Aware of what you do. [4:135]

এবার দেখা যাক এই আয়াতে কাওয়াম শব্দের কে কিভাবে অনুবাদ করেছেন:

Sahih International — O you who have believed, be persistently standing firm in justice
Yusuf Ali — O ye who believe! stand out firmly for justice
Mohsin Khan — O you who believe! Stand out firmly for justice
Muhammad Sarwar — Believers, be the supporters of justice
Muhammad Asad — O YOU who have attained to faith! Be ever steadfast in upholding equity
Pickthall — O ye who believe! Be ye staunch in justice
Shakir — O you who believe! be maintainers of justice
Daryabandi — O Ye who believe! be ye maintainers of justice
Arberry — O believers, be you securers of justice
Sher Ali — O ye who believe! be strict in observing justice
Shehnaz — O you who believe! Be custodians of justice
ইবন কাসিরের বাংলা অনুবাদ — হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহরে উদ্দেশ্যে সাক্ষ্য দানকারী, সুবিচার প্রতিষ্ঠাতা হও
মউদূদীর বাংলা অনুবাদ — হে ঈমানদারগণ! ইনসাফের পতাকাবাহী ও আল্লাহর সাক্ষী হয়ে যাও
মুহম্মদ শফির বাংলা অনুবাদ — হে ঈমানদারগণ, তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বাংলা অনুবাদ — হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা ন্যায় বিচারে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাকিবে।

৮.৫.২। কোরানের ৫:৮ পূর্ণ আয়াতটির অনুবাদ সহি ইন্টারন্যাশনাল অনুযায়ী নিম্নরূপ:

O you who believe! Be persistently standing firm for God, witnesses in justice, and do not let the hatred of a people prevent you from being just. Be just; that is nearer to righteousness. And fear God; indeed, God is Acquainted with what you do. [5:8]

এবার দেখা যাক এই আয়াতে কাওয়াম শব্দের কে কিভাবে অনুবাদ করেছেন:

Sahih International — O you who have believed, be persistently standing firm for Allah
Yusuf Ali — O ye who believe! stand out firmly for Allah
Mohsin Khan — O you who believe! Stand out firmly for Allah
Pickthall — O ye who believe! Be steadfast witnesses for Allah
Muhammad Sarwar — Believers, be steadfast for the cause of God
Sher Ali — O ye who believe! be steadfast in the cause of God
Muhammad Asad — O YOU who have attained to faith! Be ever steadfast in your devotion to God
Shakir — O you who believe! Be upright for Allah
Arberry — O believers, be you securers of justice
Shehnaz — O you who believe! Be steadfast for Allah
Daryabandi — O ye who believe! be maintainers of your pact with Allah
ইবন কাসিরের বাংলা অনুবাদ — হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিধানসমূহ পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠাকারী ও ন্যায়ের সাথে সাক্ষ্য দানকারী হয়ে যাও
মউদূদীর বাংলা অনুবাদ — হে ঈমানদারগণ! সত্যের উপর স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত ও ইনসাফের সাক্ষ্যদাতা হয়ে যাও
মুহম্মদ শফির বাংলা অনুবাদ — হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাকবে
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বাংলা অনুবাদ — হে বিশ্বাসিগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্য দানে তোমরা অবিচল থাকিবে

৮.৬। তিন আয়াতে শব্দের ব্যবহার

৮.৬.১। নীচে নানা অনুবাদের একটি তুলনামূলক চিত্র দেয়া হলো।


৮.৬.২। দেখা যাচ্ছে, ঈশ্বর ও ন্যায়বিচারে ক্ষেত্রে কাওয়াম শব্দের অর্থে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়ানোর অভিধাই প্রাধান্য পেয়েছে। রক্ষণশীলরাও নির্দ্বিধায় "persistently standing firm", "upright", "stand out firmly" ইত্যাদি এক্সপ্রেশন ব্যবহার করেছেন। কিন্তু নারীদের প্রসঙ্গে তারা "in charge", "overseer" "protector", "maintainer" ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেছেন। কাওয়ামিন ও কাওয়ামুন এর মধ্যে মূল অর্থগত কোন পার্থক্য নেই: দুটোই Noun: কাওয়ামিন accusative noun রূপ এবং কাওয়ামুন nominative noun রূপ। উল্লেখ্য যে, আরবি ভাষার মতো বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় accusative noun বলে বিশেষ্যর কোন রূপ নেই। ৪:১৩৫ ও ৫:৮ আয়াতে বলা হয়েছে, কুনু কাওয়ামিনা—অর্থাৎ কাওয়ামিন হও। যে 'কাওয়ামিন হয়েছে' সে 'কাওয়ামুন'। কাজেই কাওয়ামুন হচ্ছে সে যে সমর্থনে দৃঢ়তার সাথে দণ্ডায়মান হয়েছে।

৮.৬.৩। আগের ৮.৩.৩ অনুচ্ছেদে মুহম্মদ আসাদের ব্যাখ্যায় আমরা দেখেছি যে, কাওয়াম শব্দটি কায়িম শব্দ থেকেও অধিক তাৎপর্য বহন করে। কোন কিছুর সমর্থনে, রক্ষার্থে যে দাঁড়ায় তাকে কায়িম বলা যায়। কিন্তু এই দাঁড়াতে গিয়ে যখন নিজের স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়, বাধা অতিক্রম করতে হয়, কষ্ট বা ক্ষতি স্বীকার করতে হয়, উদ্যোগী হয়ে কর্মতৎপর হতে হয় তখন এ ধরণের দাঁড়ানেওয়ালার জন্য কাওয়াম শব্দটি ব্যবহার করা যায়।

৮.৬.৪। নারীর পক্ষে মজবুতভাবে দাঁড়ানোর অর্থ এটা হতেই পারে না যে, তা নারীর স্বার্থের বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে হবে; বা এটি নারীকে দুর্বল করে রেখে বা তার কাছ থেকে তার নিজের কর্তৃত্বকে কেড়ে নিয়ে জোর করে প্রয়োগযোগ্য কিছু হবে। এটি হলে তো আর কাওয়াম হওয়া হচ্ছে না; হচ্ছে অত্যাচারী জমিদারের মতো স্বেচ্ছাচারী হওয়া মাত্র—এতে অন্যে সমর্থন লাভ করে না, বরং পরাভূত হয়। ন্যায়ের জন্য মজবুতভাবে দাঁড়ানোর অর্থ তো ন্যায়ের উপর কর্তাগিরি বা মাতব্বরি ফলানো নয়। একই কথা নারীর বেলাতেও প্রযোজ্য। মানুষের উপর থেকে মানুষের কর্তৃত্বের অবসানই আল্লাহর ধর্মের প্রধানতম উদ্দেশ্য এবং সকলের কর্তব্য-পরিচয় যথাযথভাবে প্রকাশ করাই নবীদের কাজ। পুরুষদের সমভাবে মানুষ হিসেবে নারীদের বিকাশ, তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মনির্ধারণ, সম্মান, ক্ষমতায়ন, প্রতিষ্ঠা, বৈষম্য দূরীকরণ, প্রতিরক্ষা ইত্যাদির জন্য নারীদের উদ্দেশ্যে দাঁড়ানোর কথাই যুক্তিসঙ্গত ও কোরানের সামগ্রিক শিক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কথা হতে পারে।

৮.৭। কাওয়ামুন বনাম কুনু কাওয়ামিন

আল্লাহ ন্যায়ের ক্ষেত্রে আবেদন করেছেন 'কুনু কাওয়ামিনা' (ন্যায়ের পক্ষে দণ্ডায়মান হও) বলে। কিন্তু নারীর বেলায় আহ্বান বা আবেদনের সিনটেক্স অনুসৃত হয়নি। এর ব্যাখ্যা কী? মনে করুন জামাল কর্তৃক সেলিম ক্রমাগত বঞ্চিত হচ্ছে। জামালের বাহাদুরির ভিত্তি তার ক্ষমতা ও বিত্ত। এখন জামালের কাছে আবেদন করা যায়: হে বাহাদুর! সেলিমের সমর্থনে ক্ষমতা ও বিত্ত নিয়ে দাঁড়াও। আবার এভাবেও বলা যায়: বাহাদুর সে, যে অন্যের সমর্থনে ক্ষমতা ও বিত্ত নিয়ে দাঁড়ায়। এই পরের বাক্যটি এরূপ পরিস্থিতিতে বেশী জোরালো স্টেটমেন্ট। এতে জামালের প্রতি আবেদন যেমন করা হচ্ছে, তেমনই নিজ অবস্থানের পক্ষে অহংকারপ্রসূত তার নিজের যুক্তিকেই তার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হচ্ছে—যাকে বলা যায় 'টার্ন দি টেবিল ওভার'। নবীপূর্বের অজ্ঞতার যুগে পুরুষের যে অবস্থান ছিল, যে যুক্তি ছিল, পরবর্তী কালে কোরানের শব্দের ভ্রান্ত ও অবৈধ অর্থ নির্ধারণ করে টেবিলটি আরও একবার ঘুরিয়ে দেয়া হলো (২x১৮০) এবং মুসলিম সমাজকে অজ্ঞতার যুগে ফিরিয়ে নেয়া হলো।

৮.৮। Protector বনাম Stand Out Firmly

৮.৮.১। কাওয়ামুনা শব্দের মূল অর্থ এমন ব্যক্তি যিনি দৃঢ়তার সাথে দণ্ডায়মান। এরূপ ব্যক্তিকে রক্ষক, প্রটেক্টর, মেইনটেইনারও বলা যায়। এ অর্থ ভাবগত বা ফলিত দিক থেকে সঠিক। যৌক্তিকভাবে ডিরাইভড এই অর্থ কোন কোন বচনে সমস্যা তৈরি না-ও করতে পারে। নারীর বেলায় এইরূপ শব্দ ব্যবহারের সবচে বিপদজনক ও ধ্বংসাত্মক দিক হচ্ছে পূর্বসংস্কার ও ধারণার অনুষঙ্গ জাত ভ্রষ্টতা।

৮.৮.২। ন্যায়ের ধারণাটি নিয়ে কথা বলা যাক। ন্যায় বা জাস্টিস এর একটি স্বতঃ বা নিজস্ব কাঠামো (ইনট্রিনসিক স্ট্রাকচার) রয়েছে। আমরা বাইরে থেকে ন্যায়ের কাঠামো তৈরি করি না। ন্যায়ের প্রটেক্টর, মেইনটেইনার বা কাস্টোডিয়ান হও বললে আমরা এটা বুঝি না যে, আমরা বাইরে থেকে ন্যায়ের কাঠামো তৈরি করবো অথবা আমরা আমাদের বিবেচনামতো ন্যায়কে চালনা করব। আমরা ন্যায়ের উপর কর্তৃত্ব করি না। বরং আমরা বুঝি যে, যা ন্যায় তা-ই ন্যায় এবং সেই ন্যায়কে আমরা সংরক্ষণ করবো। কিন্তু পুরুষতন্ত্রের প্রভাবেই হোক, বা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে লালিত-পালিত হওয়া থেকে জাত পূর্বসংস্কার বা প্রেজুডিসের বশেই হোক, নারীর বেলায় এই একই শব্দাবলী ব্যবহার করলে তাদের উপর আমরা অন্যায় অর্থ আরোপ করতে থাকি, বাক্যে যা বলা হয়নি সেসব ধারণাবলীর দিকে দ্রুত ধাবিত হতে থাকি—পরবর্তী ধারণামালা গঠনে, অনুষঙ্গে এবং অনুসিদ্ধান্তে যাওয়ার ক্ষেত্রে বা যাওয়ার মাধ্যমে। পুরুষ নারীর প্রটেক্টর, গার্ডিয়ান বা মেইনটেইনার বললে চট করে এই ধারণা বলবান হয়ে উঠে যে, নারীর ভবিষ্যৎ বা নারীর কাঠামো নারী নিজে ঠিক করবে না—পুরুষ তাকে গড়বে, চালাবে। এখানে নারী নিষ্ক্রিয়, ব্যক্তিত্বহীন, স্বাধীনতাহীন এবং পুরুষের আনুগত্য করাই যেন তার দায়িত্ব।

৮.৮.৩। কাঠামোর নিজস্বতার দিক থেকে বিবেচনা করলে, ন্যায়ের ধারণা থেকে নারীর সত্তাগত পার্থক্যটি বিরাট। নারী চিন্তাশীল মানুষ, প্রতিজন নারী স্বতন্ত্র ব্যক্তি। ব্যক্তিনারী ও নারীসমাজের অবস্থা ও পুরুষের সাথে সম্পর্ক একটি ক্রমোন্নতিশীল, ক্রমবিকাশমান প্রসেস যেখানে নারী নিজে অংশ গ্রহণ করে এবং চিন্তায় ও কর্মে সক্রিয় হতে পারে।

৮.৯। কর্তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার

৮.৯.১। কে কার উপর কর্তৃত্ব করবে, মানবসমাজের কোন অংশ অন্য কোন অংশের উপর কর্তৃত্ব করবে তা ঠিক করে দেয়ার জন্য আল্লাহ রসুল পাঠান না; পাঠান দায়িত্ব/কর্তব্য সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন করার জন্য। আল্লাহ নবীদেরকে মানুষের উপর, পিতামাতাদেরকে সন্তানদের উপর, শিক্ষকদেরকে ছাত্রদের উপর, সরকারকে জনগণের উপর কর্তা নিযুক্ত করেননি। আল্লাহ বলেছেন উল্টোভাবে—আল্লাহর আনুগত্য কর; আল্লাহ, নবী ও জনগণ কর্তৃক বা আইনানুগভাবে নিয়োজিত উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে অনুসরণ কর; পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ থাক; কর্তব্যপরায়ণ হও; ইত্যাদি। পুরুষ বা স্বামী এমন কী বিশিষ্ট হয়ে উঠলো যে—নিয়ম ভেঙ্গে—তাদেরকে নারীদের উপর কর্তা পদে নিয়োগ দিতে হবে আল্লাহকে? "হে নারীরা/স্ত্রীরা, তোমরা পুরুষদের/স্বামীদের অনুসরণ কর" অথবা "হে নারীরা/স্ত্রীরা, তোমরা পুরুষদের/স্বামীদের প্রতি কৃতজ্ঞ হও"—এমন শর্তহীন আহ্বান বা আদেশ কোরানে পাওয়া যায় না। পুরুষ হওয়া কী কোন সৌভাগ্য, আর নারী হওয়া কী কোন দুর্ভাগ্য যে নারীর স্রষ্টাকে নারীকে বলতে হবে, "শোন নারী! পুরুষ তোমার কর্তা?!!!"

৮.৯.২। 'কর্তা' অভিধাযুক্ত শব্দ সহযোগে 'কাওয়াম'য়ের অর্থ করা কালে কালে পরিত্যক্ত হচ্ছে। নতুন নতুন অনুবাদে প্রটেক্টর/মেইনটেইনার অর্থটি গৃহীত হচ্ছে, এমনকি রক্ষণশীলরাও এই দিকে আসছেন। কেন? কারণ কাওয়াম শব্দের অর্থ কর্তা বা অথরিটি নয়। তাছাড়া, কোন জ্ঞানী মুসলিমের পক্ষে এটি বলা সম্ভব নয় যে, পুত্র মায়ের উপর কর্তৃত্ব করার অধিকারী। মাতা-পুত্রের সাবসেটে যেহেতু কর্তৃত্ব অকার্যকর বা অবৈধ হয়, সেহেতু নারী-পুরুষের পূর্ণ সেটে তা আর বৈধ থাকে না। আর রক্ষক, নিরাপত্তাবিধায়ক জাতীয় শব্দগুলো পরিহার করা ভাল এদের সাথে যুক্ত পুরুষতান্ত্রিক অনুষঙ্গমূলক ধারণাগুলোর কারণে। কাজেই 'পুরুষ তারা, যারা নারীর সমর্থনে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায়' জাতীয় অনুবাদ অনেকটাই নিরাপদ এবং মূল আরবির নিকটবর্তী। এই সমর্থনে দাঁড়ানোর অর্থ কন্যা-পিতা, মাতা-পুত্র, স্ত্রী-স্বামী, বোন-ভাই সহ যেকোনো নারী ও যেকোনো পুরুষের বেলাতেই প্রয়োগযোগ্য থাকে।

৮.১০। আগের পর্বে যেমন বলা হয়েছে, রিজাল শব্দটি সক্ষম ব্যক্তিমানুষকেও—যা লিঙ্গ-নিরপেক্ষ— বুঝায় (এটি নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করতে চেষ্টা করব)। অগ্রসর, সক্ষম, প্রতিষ্ঠিত নারীরাও রিজালের অন্তর্ভুক্ত। এক্ষেত্রে 'আররিজালু কাওয়ামুনা আলান্নিসা' অর্থ প্রসারিত হয়ে দাঁড়ায়: সক্ষম ব্যক্তিরা—পুরুষ হোক, নারী হোক—নারীর সমর্থনে দাঁড়ায়। নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই নারীবাদ কোরানে বিধৃত আদর্শের একটি অন্যতম উপাদান। আল্লাহ নারীবাদী, কোরান নারীবাদী, নবীও নারীবাদী। নবীর স্ত্রীরাও ছিলেন নারীবাদী। নবীর নারী সাহাবিদের মধ্যেও ছিলেন নারীবাদীরা।

চলবে ….

আগের পর্ব: নারীর কোরান – ৭ (লাহুন্না ও সুবর্ণবিধি)

প্রথম পর্ব: নারীর কোরান – ১ (ভূমিকা)