মমতার কথা শুনলেই আমাদের যীশুর নাম মনে পড়ে ও যীশুর নাম শুনলেও আমাদের মমতার কথা মনে পড়ে—আমাদের বিকাশের ইতিহাসে যীশু ও মমতা দুটি অনুষঙ্গী ধারণায় পর্যবসিত হয়েছে। এর আগে আমরা মুসার কাছ থেকে "দশ অনুজ্ঞা"র শেষ পাঁচটিতে অহিংসার পাঁচ প্রধান নীতি পেয়েছিলাম। যীশু মমতার নীতিটিকে একাদশ অনুজ্ঞা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। একজন নিজেকে যেভাবে ভালবেসে থাকে সেভাবে প্রতিবেশীকে ভালবাসার এবং শত্রুকেও এই ভালবাসার অংশীদার করার উপদেশ দিয়েছেন। আমরা যীশুর শিক্ষায় স্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছি যে, তিনি মমতার সহজাত দিককে সম্পূর্ণ উল্টিয়ে দিতে চাচ্ছেন এবং নিজের প্রতি মমতাকে রেফারেন্স হিসেবে নিতে বলছেন। মমতাকে আমরা প্রত্যক্ষভাবে সরাসরি অনুভব করে থাকি নিজ সন্তানকে বিপন্নদশায় দেখলে। শুধু তা-ই নয়, নিজ সন্তানের বিপন্নদশার বা সন্তান থেকে বিচ্ছেদের কল্পনাও আমাদের মনকে মমতা-রসে আপ্লুত করে তুলতে পারে। মমতাকে সকলের প্রতি বিস্তৃত করার সাধনাকে যীশু ধর্ম হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কাজেই আমরা বলতে পারি মমতার সহজাত দিক হচ্ছে অন্তর্মুখী ও সাধনার দিকটি বহির্মুখী।
সম্পূর্ণ মানবজীবনকে অনুভূতির রিপোজিটরি হিসেবে কি ব্যাখ্যা করা সম্ভব? অনুভূতিকে আমরা চিন্তা ও কর্ম থেকে আলাদা করে দেখতে অভ্যস্ত। অনেকেই জীবনের সমগ্রকে চিন্তা, অনুভূতি ও কর্ম—মাত্র এই তিনটির সমবায় হিসেবে দেখে থাকেন। তবে অনুভূতিকে ব্যাপক করে তোলা যায়: আমাদের সব অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, চিন্তা ও যুক্তিকে শেষ বিচারে অনুভূতিতে পর্যবসিত করা সম্ভব। অভিজ্ঞতা যে আদতে অনুভূতি তা জ্ঞানতাত্ত্বিকেরা মানেন। বর্ণই বলি আর আকারই বলি, ঘ্রাণ, শব্দ, স্বাদ—সবই অনুভূতি। জ্ঞান ও চিন্তাও একধরণের ধারাবাহিক অনুধাবন বা অনুভব। যুক্তির তিন মৌলিক সূত্রও অনুভব। বিশ্বাস, ঈশ্বর ও জগতকে শেষ বিচারে অনুভবে রিডিউস করা চলে। কিন্তু কর্মের বেলায় কী বলা যায়? কর্মকে অনুভূতির প্রবাহ বা সঞ্চলন হিসেবে দেখা যেতে পারে। তাহলে আমাদের সম্পূর্ণ জীবনপ্রক্রিয়াটি মমতা ও স্বার্থপরতা এই দুই অনুভবের বা অনুভূতির মিশেলে পরিণত হয়। সত্য, শুভ এবং সৌন্দর্যও হয়ে উঠে মমতা; মিথ্যা, অশুভ এবং কদর্যতা হয়ে উঠে স্বার্থপরতা। রুমির মতো দার্শনিকেরা প্রেম তথা মমতাকে জগতের সারধর্ম এবং মানবজীবনের কেন্দ্রীয় নৈতিক আদর্শ হিসেবে দেখেছেন। এভাবে দেখলে, শুভ জীবন মমতা থেকে উৎসারিত একটি ফ্লাক্স হিসেবে রূপায়িত হয়, যা কেন্দ্রে গুচ্ছিভূত ও কেন্দ্র থেকে বাইরের সব দিকে প্রবাহিত।
মমতা দুর্বলের অক্ষমতাজাত আবেগ নয়; বীরোচিত জীবনের জন্য এটি হানিকরও নয়। মমতা বা অনুকম্পার যথার্থ প্রকাশ সাধন কাপুরুষের পক্ষে সম্ভব নয়; এটি বীরের পক্ষেই সম্ভব। মমতা-ই মানবিকতার প্রকাশ, মমতা-ই মানুষ ও মানুষের মতো আচরণ করতে সক্ষম যন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য। মমতার উদ্বোধনে সাধনার জন্য প্রয়োজন সাহস এবং এই সাধনার দ্বারাই মানবিকতার স্তর ছাড়িয়ে অতিমানবিক স্তরে উপনীত হওয়া সম্ভব। তখনই মানুষ মমতাবান ঈশ্বরের সামনে নিজের কর্মবোঝা নিয়ে দাঁড়ানোর সাহস ও উপযুক্ততা অর্জন করে। নীটশে প্রচলিত খ্রিস্টধর্ম ও তার মূল্যবোধকে আক্রমণ করলেও যীশুকে তা থেকে আলাদা করেই দেখেছেন—ব্যক্তি যীশুকে তিনি নতুন ও শক্তিশালী মূল্যবোধের স্রষ্টা বীর হিসেবেই দেখেছেন।
যীশুর বীরোচিত ব্যক্তিত্বকে পরবর্তীতে সন্ন্যাসতন্ত্রে পর্যবসিত করা হয়েছিল এবং এর বিপরীতে রেনেসাঁসের বীরেরা জগত ও জীবনকে দেখার বিপরীত ভঙ্গিটি গ্রহণ করেছিল। ফলে প্রচলিত খৃষ্টধর্ম দেখার এই নতুন প্রেক্ষিতের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে; যুক্তি ও জ্ঞানাভিযান—উভয়েরই ফসলের সাথে। আমরা শোপেনহাওয়ারের মধ্যে সেই প্রচলিত ধর্মের শেষ ডেস্পারেট সেনাপতির সাক্ষাৎ পাই। কিন্তু তিনি ইচ্ছা ও বাসনাকে পুরোপুরি বিনাশ করার পক্ষেই মত দিলেন। তিনি দেখতে চাইলেন না যীশুর বিশেষত্বকে; যীশু সন্ন্যাসী হননি, বরং রাজা না হয়েও অনন্য সাহসে বিচরণ করে ফিরছিলেন রাজার মতো; বঞ্চিত নিগৃহীত মানুষের মাঝে—দিচ্ছিলেন জীবন, সুস্থতা ও দৃষ্টিশক্তি—স্বজাতির মোল্লাদের এবং রোমানদের সৈন্যদের সামনে দিয়ে। ফলে শোপনেহাওয়ারের ঈশ্বর আর টিকে থাকতে পারেনি। তাঁরই উত্তরসূরি নীটশে মৃত্যুসংবাদটি গোপন করে রাখার প্রয়োজনীয়তাও বোধ করেননি। নীটশের "গড ইজ ডেড" এর প্রকৃত মর্ম হয়ে দাঁড়ালো "গড অব কমপ্যাশন ইজ ডেড, লং লিভ আইডলস অব প্যাশনস।" তারপর আমরা এই দেবতাদেরকে পুনঃপুনঃ আবির্ভূত হতে দেখলাম; দেখলাম দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধে, দেখলাম জাপানের দু-দুটো শহরে। আমরা জানি কিভাবে মুসা, যীশু ও মুহম্মদের ঈশ্বর কালে কালে পরিত্যক্ত হয় ও নানা নামের "আইডলস অব ক্লার্জিক্যাল ভ্যাম্পায়ার্স" এর আবির্ভাব হয়। আধুনিক কালে আমরা দেখেছি "আইডলস অব প্যাশনস" কিভাবে "লিভিং আইডলস অব মডার্ন ভ্যাম্পায়ার্স"-এর রূপ নিয়েছে এবং এখন দেখছি কিভাবে তা "লাইফলেস আইডলস অব পোস্টমডার্ন যম্বিস"-এ রূপান্তরিত হচ্ছে।
মমতা আমাদের মনে একটি প্রত্যক্ষ অনুভূতি হিসেবে বিদ্যমান, যে কারণে কোন দৃশ্য দেখে একজন বলতে পারেন যে, তিনি তখন মমতা, মায়া, করুণা ইত্যাদি অনুভব করেছেন। নিষ্ঠুরতাও কি অনুরূপ কোন প্রত্যক্ষ অনুভূতি বা বোধ? আমরা ক্রুদ্ধ হয়ে থাকি এবং সেটিকে অন্তর্দর্শনের মাধ্যমে জানতেও পারি। সে কারণে আমরা বলতে পারি আমরা ক্রোধকে অনুভব করি। ক্রুদ্ধ হয়ে আমরা নিষ্ঠুরতা করতে পারি। নিষ্ঠুরতা ক্রোধের রূপায়ন অথবা ক্রোধের প্রতিক্রিয়ামূলক কাজ বা আচরণ। তবে অজ্ঞতা, অসচেতনতা বা লোভের বশেও আমরা অত্যাচার করতে পারি আর সব অত্যাচারকেই হয়তো কোন ব্যাপক অর্থে নিষ্ঠুরতা বলা যায়—মৃদু নিষ্ঠুরতা বা অবচেতন নিষ্ঠুরতা। আবার মানুষের মধ্যে স্যাডিজম বলে একটি বৈশিষ্ট্য আছে বলে আমরা শুনেছি—এখানে নিষ্ঠুর আচরণে আনন্দ লভিত হয় এবং এর জন্য ক্রোধ বা লোভের তাড়না আবশ্যক হয় না। কিন্তু এসব কোন ক্ষেত্রেই নিষ্ঠুরতাকে মমতা, ক্রোধ বা লোভের মতো প্রত্যক্ষ অনুভব হিসেবে পাওয়া যায় না। আমাদের মনে অহিংসারও কোন প্রত্যক্ষ অনুভূতি নেই। কিন্তু একের হিংসার ফলটি প্রত্যক্ষভাবে বেদনা, কষ্ট বা যন্ত্রণা রূপে আরোপিত হয় অন্যের উপর। আমরা প্রত্যেকেই ব্যথা-বেদনা প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করে থাকি, ফলে হিংসার অবসানকামী হই; এভাবে অহিংসা নামক ধারণাটি যৌক্তিক কায়দায় নির্মিত হয়েছে। যীশুর ধর্মটি ধার্মিকের নিজের মধ্যকার মমতা নামক প্রত্যক্ষ অনুভূতির উপর প্রতিষ্ঠিত, যেকারণে এর নাম মমতার ধর্ম—অ-নিষ্ঠুরতার ধর্ম নয়। কিন্তু বুদ্ধের ধর্মটি অহিংসা নামক যৌক্তিক ধারণাটির উপর প্রতিষ্ঠিত, যে ধারণাটি আমরা পেয়েছি হিংসুকের মনোদশার ফল থেকে।
মমতা বিস্তৃত করাকে সব ধর্মই মানুষের জন্য সারধর্মগত কর্তব্য হিসেবে উপস্থাপন করেছে। মমতা ব্যক্তিজীবনে প্রথম ভার্চু বা পুণ্য এবং অন্য সকল পুণ্যের মা। এই প্রস্তাবনার যথার্থতা কোথা থেকে আসতে পারে? আমরা মানুষের মধ্যে স্বার্থপরতাকে একটি প্রধান বৃত্তি হিসেবে পাই। এই বৃত্তিকে জয় করতে হলে সাধনার ও ত্যাগের প্রয়োজন হয়। কিন্তু সেপথে মানুষ যাবে কেন? মানুষের জন্য মমতা কর্তব্য হবে কেন? মমতার সাথে কৃতজ্ঞতার সম্পর্ক এবং তার সাথে জীবনের সাফল্যের সম্পর্ক স্থাপন করা না গেলে মমতার পক্ষে কোন যুক্তি প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। মমতাবান, প্রজ্ঞাবান ও ন্যায়পরায়ণ ঈশ্বরের বিদ্যমানতা থেকেই মমতার সাথে কৃতজ্ঞতা ও সাফল্য যুক্ত হতে পারে। যেহেতু ঈশ্বর আমার প্রতি মমতাবান, সেহেতু ঈশ্বরের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার প্রকাশ সম্ভব ঈশ্বরের সৃষ্টিকুলের সাথে মমতাপূর্ণ আচরণ করার মাধ্যমেই। আর ঈশ্বর যদি প্রজ্ঞাবান ও ন্যায়পরায়ণ হন তবে মমতার চর্চা থেকেই জীবনের সফলতা আসতে পারে।
যদি অহিংসাকে বৌদ্ধধর্মের, মমতাকে খৃষ্টধর্মের সিগনেটরি প্রিন্সিপল হিসেবে দেখা হয় তবে সেরূপে ইসলামধর্মের প্রিন্সিপলটি কী? ইসলামধর্মের সিগনেটরি প্রিন্সিপল হচ্ছে ন্যায়বিচার। মধ্যযুগের মুসলিমরা এই ন্যায়বিচারের জন্য "স্বজাতি-স্বধর্মী" আর তথাকথিত "বিজাতি-বিধর্মী"র মধ্যে ফারাক না করাকেই তাদের ধর্মের প্রধানতম নীতি হিসেবে দেখতেন। ন্যায় হোক কি অন্যায়, জাতির স্বার্থ সবার উপরে—এটিই জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্র। আমাদের বর্তমান কালটি যেখানে জাতীয়তাবাদের কাল, সেখানে মধ্যযুগটি ছিল সকলের জন্য একই ন্যায়বিচারের নীতির কাল। ন্যায়বিচারের দুটি ডোমেইন রয়েছে: একটি চিন্তায় ন্যায় বা লজিক এবং অন্যটি কর্ম বা আচরণে ন্যায় বা সামাজিক সুবিচার। সামাজিক সুবিচারের আবার দুটি রূপ রয়েছে: আন্তব্যক্তি বা আন্তসম্প্রদায় আচরণ ও লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য রূপ এবং বিচারালয়ে প্রযোজ্য রূপ। কর্ম বা আচরণের দিক থেকে ন্যায়বিচারের ধারণাকে আবার মুসলিমরা আত্মগত ন্যায়বিচার ও পরগত ন্যায়বিচার হিসেবে দুভাগ করেছেন। ন্যায়বিচারকে তারা কেবল মানবসমাজের মধ্যে সীমিত করেননি; প্রাণী ও বস্তু পর্যন্ত প্রসারিত করেছেন। কোরানে ন্যায়বিচারের বিপরীত ধারণা হচ্ছে অত্যাচারের ধারণা। খাবার বা নিরাপত্তা বা স্বাচ্ছন্দ্যের প্রয়োজন ছাড়া গাছের পাতা ছেঁড়া বা পাখি শিকার করাকেও এবং এমনটি অজুর জন্য নদী থেকে অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করাকেও গাছের বা পাখির বা নদীর প্রতি অত্যাচার হিসেবে দেখা হয়; একইভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করাও অত্যাচারের অন্তর্ভুক্ত। নিজের প্রতি অত্যাচারকেই কেবল নয়, অন্যের প্রতি প্রতিটি অত্যাচারকেও আবার নিজের প্রতি অত্যাচার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে কোরানে। কোরান নির্দেশিত অর্জিতব্য ইতিবাচক বিষয় হচ্ছে "ন্যায়", কিন্তু পরিত্যাজ্য নেতিবাচক বিষয় হচ্ছে "অত্যাচার"—"ন্যায়ভঙ্গ" বা "অন্যায়" নয়।
ন্যায়ের সংজ্ঞা কী? ন্যায় কাকে বলে? কোনটি ন্যায় আর কোনটি অন্যায় নির্ধারণ করা যাবে কিভাবে? ন্যায়বিচার বা জাস্টিস শব্দটি আমরা সাধারণেরা—এবং আমাদের দার্শনিকেরা, সমাজবিজ্ঞানীরা, অর্থনীতিবিদেরা বা রাজনীতিবিদেরা—যত সহজেই উচ্চারণ করি না কেন, "ন্যায় কী" প্রশ্নটির কোন সহজ উত্তর নেই। সকল ন্যায় কাজের মধ্যে সাধারণভাবে বিদ্যমান আবশ্যিক বা পর্যাপ্ত বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা কি সম্ভব? সক্রেটিসের নিকট ন্যায় সংক্রান্ত এই প্রশ্নই ছিল জীবনের জন্য প্রধানতম প্রশ্ন। তিনি তাঁর চারপাশের মানুষকে প্রশ্ন করে করে হয়রান করে ফেলেছিলেন এবং জ্ঞানগর্বিত জনদের অজ্ঞতাকে নগ্নভাবে প্রকাশিত করে তুলেছিলেন। কিন্তু তিনি নিজেও ন্যায়ের কোন সংজ্ঞা দেননি। বিরক্ত বা ক্ষুব্ধ মানুষেরা স্বভাবতই হেরে গিয়ে তাঁর কাছেই জানতে চাইতেন ন্যায়ের পরিচয়। এখানে সক্রেটিসকে কেবল বলতে হতো যে, তিনিও তা জানেন না, তিনি কেবল এটি জানেন যে, তিনি জানেন না, যেখানে অন্যেরা না জেনেই জানার অহমিকা নিয়ে চলেন মাত্র।
আমাদের চিন্তায় সার্বিকের ধারণা রয়েছে, রয়েছে সার্বিক ধারণার ভাষাগত রূপ হিসবে রেসপেকটিভ শব্দ বা সিগনিফায়ার। সব নামকেই বা ধারণাকেই বিশেষ ও সার্বিক—মাত্র এই দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়তো যায়। তবে আমাদের অনেক ধারণাকেই সংজ্ঞায়নযোগ্য সার্বিক হিসেবে দেখা কষ্টকর। "উপন্যাস" বা "কম্পিউটার" এর সংজ্ঞা দেয়া কঠিন। নতুন নতুন "ধরণ"-এর আবির্ভাব হবার ফলে কোন সার্বিক ধারণার জন্য প্রয়োজনীয় আবশ্যিক বা পর্যাপ্ত সাধারণ গুণ চিহ্নিত করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। তাই "উপন্যাস কী" বা "কম্পিউটার কী" প্রশ্নের চেয়ে "উপন্যাস বা কম্পিউটার—এই নাম দুটিকে আমরা কিভাবে ব্যবহার করি" প্রশ্নটি অধিক সুবিধাজনক হতে পারে।
আমরা কি "ন্যায়" ধারণাটির বেলায়ও অনুরূপভাবে একই কথা বলতে পারি? "আমরা 'ন্যায়' নামটিকে কিভাবে ব্যবহার করে থাকি?"—এই প্রশ্নটির অর্থ কী? এটি কি আদৌ কোন অর্থ বহন করে? উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে: "ন্যায় হচ্ছে শক্তিশালীর স্বার্থ।" কিন্তু সক্রেটিসের পাল্লায় পড়লে এই ব্যবহারের কী দশা হয় তা আমরা দেখেছি। যুক্তি বা আইন অনুসরণ করে মীমাংসায় উপনীত হওয়াই ন্যায়; শক্তিশালীদের যুক্তিই টিকে থাকে, শক্তিশালীরাই আইন প্রণয়ন করে থাকে; কাজেই ন্যায় হচ্ছে শক্তিশালীর স্বার্থ। এখন যুক্তিই হোক আর আইন—উভয় ক্ষেত্রেই কোন কোন সময় শক্তিমানের ভ্রান্তি সংঘটিত হতে পারে; সে ক্ষেত্রে ন্যায় দুর্বলের স্বার্থ হয়ে উঠে। আমরা কি এমতাবস্থায় বলতে পারি যে, ন্যায় প্রয়োগ করতে গিয়ে শক্তিমান ভুল করেছে? অথবা আমরা কি ন্যায়কে "দুর্বলের স্বার্থ" হিসেবে দেখতে পারি না? কিন্তু শক্তিমানরা স্বার্থ না ছাড়লে অথবা দুর্বলেরা অধিকতর শক্তিশালী হতে না পারলে ন্যায় কিভাবে সম্ভব? অথবা আমরা কি বলতে পারি যে, সকলে সমরূপে শক্তিমান হলে এবং তাদের মধ্যে সমঝোতা হলেই ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? যত বৈচিত্র্যই থাকুক, "উপন্যাস" বা "কম্পিউটার"-এর মূর্ত অবয়ব রয়েছে বলে "নামটি কিভাবে ব্যবহার করা হয়" প্রশ্নটির যথার্থ উত্তর বা বিশ্লেষণ সম্ভব হয়। কিন্তু 'ন্যায়' ধারণাটি রহস্যময়ভাবে বিমূর্ত ধারণা বা নামটি যেন কোন রহস্যময় ধারণার নাম। ফলে "ন্যায় কী" ও "ন্যায় ধারণাটিকে আমরা কিভাবে ব্যবহার করি" প্রশ্ন দুটি একই প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়।
অহিংসা ধারণাটির মধ্যে একটি সুবিধা রয়েছে: এটি হিংসাকে ক্যাটাগরিক্যালি নিষিদ্ধ করে। অন্যদিকে, মমতা নিজেই হিংসা বা অত্যাচারের কারণ। নিজের বা স্বজনের বা বন্ধুর প্রতি মমতাই অপরের বা শত্রুর প্রতি হিংসাত্মক বা অত্যাচারী হয়ে উঠার দিকে আমাদেরকে ঠেলে দেয়। ফলে মমতাকে শত্রুর প্রতি প্রসারিত করার নির্দেশনা আমরা যীশুর নিকট থেকে পেয়েছি। অহিংসার ক্যটাগরিক্যাল অনুজ্ঞা পালনে সক্ষম হবার জন্য বৈরাগ্য প্রয়োজন, আসক্তি বা লোভ থেকে মুক্তি প্রয়োজন। কিন্তু সদর্থকভাবে হিংসার অবসান চাইলে মমতাকে প্রতিবেশী ও এমনকি শত্রু অবধি সম্প্রসারণ করতে সক্ষম হওয়া ছাড়া উপায়ান্তর নেই। অত্যাচারীদের প্রতি মমতাকে অনুকম্পা হিসেবে দেখা হয়। যীশুর অনুসারীদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে আমরা পেয়েছি তাদের অন্তরগত এই মমতা ও অনুকম্পাকে। আবার উদ্ধত ও অবিরাম অত্যাচারীর প্রতি অনুকম্পা অত্যাচারের অবসান ঘটাতে পারে না এবং এতে সামাজিক ন্যায়বিচার ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু মানুষের নিকট ন্যায় আবার একটি অসংজ্ঞায়নযোগ্য রহস্যময় ধারণা হয়ে আছে। দুঃখ বা মমতাকে আমরা সহজাতভাবেই সরাসরি অনুভব করি; কিন্তু ন্যায়ের বেলায় তা সম্ভব হচ্ছে না। একারণে "আমি জামালকে দুঃখ দিয়েছি" বা "রহিমের বিপদে জামালকে মমতাবান হিসেবে দেখা গিয়েছে" বলা হলে যতটুকু ধারণা সঞ্চালিত হয়, "সেলিম ন্যায্য বিচার করেছেন" বলা হলে ততটা হয় না। অর্থাৎ ন্যায় "সিগনিফায়ার"টি বহুল উচ্চারিত হলেও এর "সিগনিফাইড"টি খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু একটি অসংজ্ঞায়নযোগ্য ধারণা হয়ে থাকা সত্ত্বেও "ন্যায়" আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং সকল প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে প্রথম নীতি হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আছে—ঠিক যেমন জ্ঞানের ক্ষেত্রে "সত্য" হচ্ছে প্রথম নীতি।
গসপেলে আমরা যেমন মমতাকে বাইরের দিকে শত্রু অবধি সম্প্রসারণ করার তাগিদ পাই, কোরানে তেমনই ন্যায়কে শত্রু থেকে নিজের দিকে সম্প্রসারণের কথা পাই। কোরানের ৫:৮ আয়াতে বলা হয়েছে, "হে বিশ্বাসীরা! দৃঢ়ভাবে দাঁড়াও, আল্লাহর জন্য, সাক্ষ্য হিসেবে ন্যায়ের সাথে। এবং কোন সম্প্রদায়ের বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে প্ররোচিত না করে ন্যায়বিচার করা থেকে বিরত করতে। ন্যায়বিচার কর, এটি আত্মসংযমের নিকটতর। আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয়ই তোমরা যা কর আল্লাহ তা সম্বন্ধে অবহিত।" এখানে শত্রুতামূলক আচরণের বিপরীতেও ন্যায়ে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকার কথা এসেছে; অর্থাৎ ন্যায়বিচার যদি বিদ্বেষপরায়ণ শত্রুকেও জয়ী করে তবে তা-ই নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে, ৪:১৩৫ আয়াতে বিষয়টিকে আরও পরিষ্কার করে বলা হয়েছে, "হে বিশ্বাসীরা! দৃঢ়ভাবে দাঁড়াও, ন্যায়ের সাথে, আল্লাহর জন্য সাক্ষ্য দানে; এবং তা যদি তোমাদের নিজেদের, পিতামাতার ও নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধেও যায় তবুও; হোক সে ধনী অথবা দরিদ্র—যেহেতু আল্লাহ তাদের উভয়েরই অধিকতর নিকটবর্তী। অতএব বাসনার অনুসরণ করো না, যেন ন্যায়বিচার করা থেকে বিচ্যুত হতে না হয়। যদি বিকৃত কর বা সরে যাও তবে আল্লাহ তা অবহিত যা তোমরা কর।" এখানে আমরা ন্যায়কে নিজের, নিজ পরিবারের, নিজ সম্প্রদায়ের, নিজ জাতির পার্থিব স্বার্থহানীর বিপরীতেও বজায় রাখার তাগিদ পাই। কাজেই বলা যায়, ন্যায়ের সহজ দিক হচ্ছে বহির্মুখী, ও সাধনার দিক হচ্ছে আত্মমুখী। কোরানে প্রকাশিত এই ন্যায়বিচারকে আমরা ঈশ্বরের দ্বাদশ অনুজ্ঞা হিসেবে দেখতে পারি।
আমরা দেখেছি যে, "ন্যায়" ধারণাটি সহজবোধ্য নয় এবং একথাও গুরুত্বের সাথে বিবেচ্য যে, "ন্যায়" কর্মের সাথে জড়িয়ে আছে। "পাপ", "সৎকর্ম" ও "বিচার" সম্বন্ধীয় আমাদের ধারণা ও মূল্যবোধ নির্ধারণ করে "কর্ম" ও তার অর্জিতব্য লক্ষ্যকে। আমরা ধারণা ও মূল্যবোধ পেয়ে থাকি একটি ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার হিসেবে, যেখানে শক্তিমানেরা বা সুবিধান্বেষিরা বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তাদের হেজেমনি ও স্টেরিওটাইপিং আমাদের ধারণা ও মূল্যমানকে ভ্রান্ত বা ত্রুটিপূর্ণ করে তুলতে পারে; শক্তিমানদের ধারণা ও মূল্যমানকে আমরা আমাদের নিজস্ব ধারণা ও মূল্যমান হিসেবে সাব্যস্ত করে ফেলতে পারি। "পাপ", "সততা" ও "বিচার" সম্বন্ধে আমাদের ধারণা ও মূল্যবোধে ভ্রান্তি ও ত্রুটি থেকে আমাদের কর্ম নির্বাচনে ও কর্মের লক্ষ্য নির্বাচনে ভ্রান্তি ও ত্রুটি সাধিত হয়। আবার বিপরীতক্রমে, কর্মের লক্ষ্যকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারলে আমরা কর্ম নির্বাচনে ও ন্যায় রূপায়নে দিকনির্দেশনা পেতে পারি। কর্মের লক্ষ্যের সঠিকতার উপর কর্মের সৎ-অসৎ নির্ভরশীল এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের বিরামহীন ক্রমিক প্রচেষ্টাই ন্যায় রূপায়নের পন্থা হতে পারে—যেখানে এই রূপায়নটি একটি বিকাশমান সত্তা হয়। এই পর্যায়ে গীতার "নিষ্কাম কর্ম" ও কোরানের "আমলে সালেহ" ধারণা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে।
গীতায় বিধৃত আদর্শের মূল দর্শন হচ্ছে কর্ম, কর্মফল ও নিষ্কাম কর্মের দর্শন। প্রকৃতিতে যেভাবে কার্য ও কারণ সংবদ্ধ হয়ে আছে, সেভাবে মানুষের জীবনেও কর্ম ও কর্মফল সংবদ্ধ হয়ে আছে। জীবনকে যেমন অনুভূতিতে পর্যবসিত করা যায়, তেমনই সমগ্র জীবনকে কর্ম দ্বারাও ব্যাখ্যা করা যায়: আমাদের চিন্তা ও অনুভূতিও আমাদের কর্ম, এমনকি কর্মহীনতাও একটি কর্ম; সৎচিন্তা হচ্ছে সৎকর্ম ও অসৎচিন্তা অসৎকর্ম, এবং সৎ অনুভূতি সৎকর্ম ও অসৎ অনুভূতি অসৎ কর্ম। আমাদের জীবন কেবলই কর্ম; কর্ম থেকে মুক্তি নেই। একইভাবে কর্মের সাথে কর্মের দায় ও ফলও অবিচ্ছেদ্য—এই ফলের ভালমন্দ কর্মের ভালমন্দের উপর নির্ভরশীল। গীতার কর্মতত্ত্বের আরেকটি বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, সৎকর্ম বা কর্তব্যকর্ম নিষ্কামভাবে—অর্থাৎ পার্থিব বিচারে ফলের প্রত্যাশা ব্যতিরেকেই—সম্পাদন করা। ঈশ্বরের সাথে যুক্ত থেকে সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে নির্বিকার মন নিয়ে কৃত আত্মত্যাগমূলক কর্মই এখানে নিষ্কাম সৎকর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। মনের নিষ্কাম অবস্থা ন্যায়বিচারের প্রাথমিক প্রয়োজনীয় অবস্থা, এই অবস্থার ফলে একজনের পক্ষে পক্ষপাতমুক্ত থাকা সম্ভব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে ফেয়ারনেস রক্ষা করা সম্ভব। ফলের প্রতি আসক্তি ও দ্রুতফল প্রত্যাশার আতিশয্য ন্যায়কে বিঘ্নিত করে।
ধর্ম বলতে যদি আদেশ-নিষেধের একটি সাদা-কালো তালিকাকে বুঝায় এবং সেভাবে কাজে নিরত থাকা হয় তবে জীবন ও সমাজ স্ট্যাটিক ও ফ্ল্যাট হয়ে পড়ে। এবং অবাক করার মতো হলেও এটি চিন্তার বিষয় যে, যদি শুভ, সুন্দর, মমতা, ন্যায় ইত্যাদি ধারণাকে সচেতনভাবে অনুসরণ করেও চলা হয় তবুও অবস্থা তথৈবচ থেকে যাবে—অর্থাৎ প্রতিষ্ঠিত কাঠামো বা স্ট্যাটাস্কোটি অপরিবর্তিত থেকে যাবে। তালিকা অনুসরণই হোক আর ধারণা অনুসরণই হোক—উভয়টিই ঐতিহাসিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখে, ন্যায়ের দিকে চৈতন্য ও মানবসমাজের বিকাশকে নিশ্চিত করে না। এধরণের দৃষ্টিভঙ্গিকে বলা যায় পিউরিটান বা পারফেকশনিস্ট ভঙ্গি—যেখানে ধারণা করা হয় যে, হালাল-হারাম মেনে চললে বা ঐতিহাসিক মূল্যমানগুলোকে অনুসরণ করলে ন্যায় আমাদের ধারণাতীতভাবেই প্রতিষ্ঠা পাবে। তালিকা এককালের বিচারকে চিরকালের বিচারে পরিণত করে; আর পারফেকশন আদতে একটি কল্পিত পারফেকশন, ইমপারফেক্টকে পারফেক্ট সাব্যস্তকরণ। এধরণের জীবন হচ্ছে একটি নদীর জীবনের মতো; কিন্তু ন্যায় প্রতিষ্ঠার পথ আদতে পাহাড় বেয়ে উপরে উঠা অভিযাত্রার জীবনের মতো—এখানে প্রতিটি দ্বান্দ্বিক-জোড়ের দুর্বল করে রাখা অংশকে সমরূপে শক্তিশালী করার সংগ্রাম, সংগ্রামে ভারসাম্য, ডায়ালগ, নতুন বোধ, নতুন নতুন শর্তে সমঝোতা দরকার হয়। শুভ বা ন্যায়সম্মত কর্মপরায়ণতার লক্ষ্য সম্বন্ধে একটি স্পষ্ট ধারণা না পেলে শুভ ও ন্যায় কার্যত অনর্জিত থেকে যায়। এই লক্ষ্য সম্বন্ধে "আমলে সালেহ" একটি অধিকতর নির্দেশনাপ্রসূ ধারণা। আমল অর্থ কর্ম। সালেহ শব্দটির সাথে সম্পৃক্ত আছে দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে আদান-প্রদানে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা ও সম্পর্ককে উন্নত করার ধারণা—বা সংস্কার, সংশোধন, ক্রমাগতভাবে অধিক থেকে অধিকতর ন্যায্যকরণ, উন্নতিসাধন—ক্রমাগতভাবে উন্নতিবিধান ও বিকাশসাধন।
আগের লেখা – দর্শন কেন?