কিন্তু 'এলিট ও গণ' সমস্যা নিয়ে এখন কী করা যায়? একটি কাজ হতে পারে 'এলিট-ইজম'কে সার্বজনীন করে তোলা—এতে উন্নত অবস্থাটি বজায় থাকবে, আবার তা গণ বিস্তারও পাবে। এ-প্রস্তাবে অনেকেই হতাশ হতে পারেন এই ভেবে যে, গণ মানুষের পক্ষে সে-স্তরে উঠা সম্ভব নয়, তোমার আশা একটি স্বপ্নবিলাস। এই হতাশা বা শঙ্কা আমরা পেয়েছি অতীতের অভিজাতদের দ্বারা গৃহীত ও পরিচালিত সম্মোহন প্রক্রিয়ার শিকার হয়ে। অভিজাতরা বরাবরই বিপুল শ্রমজীবী সমাজ সহ আমজনতাকে 'গেঁয়ো', 'স্থূল', 'সুকুমার অনুভূতি রহিত', 'উচ্চ বৌদ্ধিক সামর্থ্য বিবর্জিত' অসংস্কৃত অসভ্য ভাবতেই পছন্দ করতেন—এতে নিজেদেরকে নিয়ে একটি অহংকার করার স্বসাব্যস্ত ছুতা খুঁজে পাওয়া যায়, নিজেদের জন্য একটি স্বকল্পিত 'উচ্চ' স্তর নিশ্চিত হয়। এর বিপরীতে বর্তমানে ব্লগারদের প্রয়োজন একটি আত্মবিশ্বাস—আমরা আমজনতাও উন্নত চিন্তা ও তা প্রকাশ করার ক্ষমতার সম্ভাবনা সম্পন্ন।
লেখক হওয়া প্রতিষ্ঠিত কাঠামোর অনুমোদন, ইচ্ছা ও সমর্থনের উপর নির্ভরশীল; অর্থাৎ কাঠামোর অধিকারীদের বিচারে উত্তীর্ণ না হলে লেখক হিসেবে আবির্ভূত হওয়া যায় না। ফলে সাধারণ ব্যক্তিরা ব্লগকে মুক্তভূমি হিসেবে দেখেন ও সহজেই তাদের লেখা পাবলিশ করতে পারেন। মুদ্রিত অক্ষরের লেখকরা কবে ব্লগ জগতে পদার্পণ করবেন সে আশায় আমাদের বসে থাকারও কোন উপযোগিতা নেই। উচ্চ আঙ্গিকের ব্লগিং ও ব্লগে সাধারণের আগ্রহ—এদুয়ে মিলে আমাদের সেই কথিত 'গণ এলিট' ব্লগিংয়ের সূচনা করতে পারে। আমাদেরকেই উচ্চ আঙ্গিকে ব্লগ লিখতে সক্ষম হতে হবে—এর কোন বিকল্প নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে 'উচ্চ আঙ্গিক' বলতে কী বুঝায়? দীর্ঘ কলেবর অর্থাৎ শব্দসংখ্যায় বড় হওয়া, ভাষাগত শৈলী ও ধারণার বিন্যাসগত সৌষ্ঠব ও সংহতি ইত্যাদি? এসব বিচারে আমাদের পক্ষে উত্তীর্ণ হওয়া কঠিন; যদিও অসম্ভবও নয়। এসব ক্ষেত্রে ক্রমে ক্রমে উন্নতি সাধন করা সম্ভব যদি আমরা চিন্তা করতে ও নিজের চিন্তাজাত ধারণার যথাযথতাকে নিজের বিচারের আওতাধীন রাখতে অভ্যস্ত হই এবং সেই সাথে বড় বড় লেখকদের বই পড়তে অভ্যস্ত হই। এতে লেখকদের বই বিক্রি হবে ও ব্লগাররা পড়া থেকে উপকৃত হবেন। লেখকদের মনেও এই আক্ষেপ থাকতে পারে যে, ব্লগাররা বই পড়েন না, পড়েন শুধু কিছু ওয়েব পেইজ; আর যখন যা মনে আসে তা নিয়ে হুটহাট ৪/৫ প্যারাগ্রাফ লিখেই উঠিয়ে দেন সাইটে।
তবে অঙ্গ-গত উচ্চতা বা কলা-গত সৌষ্ঠবের চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে ধরা যেতে পারে চিন্তা ও ভাবনার জীবন-ঘনিষ্ঠতাকে। জীবন-ঘনিষ্ঠতা বলতে সংখ্যালঘু অভিজাত জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠতা না বুঝে যদি সংখ্যাগুরু বঞ্চিত মানুষের জীবনের সাথে বাস্তবসম্মত ঘনিষ্ঠতাকে বুঝা হয় তাহলে কলা-গত সৌষ্ঠবে দারিদ্র্যকে আমরা তা দিয়ে পুষিয়ে নিতে পারবো। শুদ্ধশিল্পসামর্থ্য ব্লগারদের মধ্যে দ্রুত বিকশিত হবে না, কিন্তু ব্লগার সত্তার গণ-প্রকৃতি তাকে ভাবনায় সহজে জীবন-ঘনিষ্ঠ করে তুলতে পারে এবং ক্রমে ক্রমে উচ্চাঙ্গের লেখা তৈরিতে সক্ষম করে তুলতেও পারে। শিল্পবোদ্ধারা সাধারণত একজন শিল্পীর কর্মকে তার অসাধারণ আবেগ বা অভিজ্ঞতার প্রকাশ হিসেবে দেখে থাকেন। এর বিপরীতে একজন ব্লগারের কর্ম যদি হয়ে উঠে বঞ্চিত-জীবন-ঘনিষ্ঠতার সাদা-মাটা প্রকাশ তবে তাওবা কম কিসে?
আমাদের দেশে দুধরণের ব্লগ সাইট নজরে পড়ে। একটি ধরণ যেখানে সব কিছুই উন্মুক্ত এবং অন্যটি একটি নির্দিষ্ট আদর্শ বা চিন্তার একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্নে আবদ্ধ। প্রথমটি 'যা-ইচ্ছা-তাই' রোগে আক্রান্ত এবং অপরটি একটি নির্দিষ্ট বৃত্তে আবদ্ধদের মধ্যকার আপোষে কথোপকথন মাত্রের রূপ পেয়েছে। আবার বিডিনিউজ২৪.কম ব্লগের মতো কিছু ব্লগও রয়েছে যারা নিয়ন্ত্রণহীনতা ও আত্যন্তিক নিয়ন্ত্রণ—এই দুয়ের মধ্যবর্তী একটি অবস্থান বজায় রাখতে ইচ্ছুক বলে মনে হয়। তবে মুক্তই হোক আর নিয়ন্ত্রিত, ব্লগের জগতেও কাঠামো বিদ্যমান, যদিও সেটি বইয়ের জগতের মতো তত কঠিন নয়। সার্ভার, নেটওয়ার্ক ও ক্লায়েন্ট, পরিচালনা কর্তৃপক্ষ, পরিচালনা আদর্শ নিয়ে এই কাঠামোটি গড়ে উঠে। ফলে মধ্যপন্থী ব্লগ সাইটগুলো 'যাচ্ছেতাই' রোগ থেকে মুক্ত কিন্তু প্লুরালিস্টিক প্ল্যাটফর্ম হতে পারে খুব সহজেই, যদি ব্লগাররা নিজেই নিজেকে সচেতনভাবে পরিচালিত করেন।
আত্মসচেতনতা বলতে বুঝা যেতে পারে নিজের নীতি সম্বন্ধীয় সচেতনতা। মনে করুন, আমি সুফিবাদ নিয়ে ইতিবাচকভাবে কিছু লিখছি, কিন্তু সুফিবাদের সমালোচকদেরকে কষে গালাগাল করছি। এতে বড় বড় সুফিরাই হয়তো বলে বসবেন, ওহহো, আমরা কী চাইছি আর আমাদের সমর্থক কী করছেন! অথবা মনে করুন, একজন মসজিদে যাচ্ছেন নামাজ পড়তে, কিন্তু পথে ভিখারিদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ায় তাদেরকে শাসিয়ে চিৎকার করতে করতে মসজিদের দিকে দৌড়চ্ছেন। তিনি খেয়ালই করছেন না যে এতে তিনি মসজিদে যাওয়ার উদ্দেশ্যটিই নস্যাৎ করে দিচ্ছেন। আমাদের পক্ষে খুবই স্বৈরধর্মী ভাষায় গণতন্ত্রের পক্ষে এবং খুবই রেইসিস্ট ভাষায় সাম্যবাদের পক্ষে অথবা খুবই অসহিষ্ণু ভাষায় অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে কথা বলা সম্ভব। একটু খেয়াল রাখলেই লেখাগুলোকে এসব থেকে সম্ভবত অনেকখানি মুক্ত রাখা যায়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে প্লুরালিজমের দরকার কী? প্লুরালিস্টিক প্ল্যাটফর্মের উপকারিতা বলে কিছু আছে কি? আমরা ব্যক্তিরা এমনিতেই বহু, বহু আমাদের আদর্শ, ধর্ম, জাতিগত সত্তা, সম্প্রদায় ইত্যাদি। ফলে বহুমতের এক প্ল্যাটফর্ম আমাদের সকলকে পরস্পরকে বুঝতে সহায়তা করে, আমাদের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থা বাড়াতে পারে, নিজেদেরকে অন্যের কাছ থেকে পাওয়া উচ্চ ধারণা দ্বারা উপকৃত করতে সাহায্য করে। সেই সাথে যদি আমাদের প্রতিষ্ঠিত লেখকগণও আমাদের কাছে আসেন, তবে লেখক-ব্লগার সম্মেলনও হয়ে উঠতে পারে ব্লগ জগত।
আগের লেখা – পোস্টমডার্নিটি