মালয়েশিয় ফ্লাইট MH370 রহস্য

মোনেম অপু
Published : 21 May 2014, 05:34 PM
Updated : 21 May 2014, 05:34 PM

কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (KLIA) এশিয়ার একটি অন্যতম প্রধান, বৃহৎ ও ব্যস্ত বিমানবন্দর। মালয়েশিয়া দেশ হিসেবে নিজেও একটি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ। দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান পরিবহন সংস্থা মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স-এর বেইজিংগামী একটি উড়োজাহাজ—ফ্লাইট নম্বর MH370, এয়ারক্রাফট টাইপ Boeing777-2H6ER, রেজিস্ট্রেশন 9M-MRO, ক্যাপাসিটি ২৮২ জন যাত্রী, ফ্লাইট আওয়ার ৫৩,৪৬০, টেক-অফ ল্যান্ডিং ৭,৫২৫—মোট ২৩৯ জন যাত্রী ও ক্রু নিয়ে রহস্যজনকভাবে হারিয়ে গেল। KLIA থেকে জাহাজটি উড়েছিল মালয়েশিয় সময় ৮ মার্চ ২০১৪ ০০:৪১ মিনিটে, বাংলাদেশ সময় ৭ মার্চ ২০১৪ রাত ১০টা ৪১ মিনিটে, ঘন্টাখানেকের মধ্যেই কন্ট্রোলারের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়, হারিয়ে যায় সিভিল রাডার থেকে। ৮ মার্চ মালয়েশিয় সময় সকাল ৭টা ২৪ মিনিটে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ জাহাজটির হারিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। এ শতাব্দীতে যখন সামরিক স্যাটেলাইটের মাধ্যমে মাটিতে পড়ে থাকা একটি ফুটবলকে চিহ্নিত করা যায়, সব দেশ সামরিক রাডারের সাহায্যে অচেনা-অজানা এয়ারক্রাফট ডিটেক্ট করতে বদ্ধপরিকর, তখন এতো বড় একটি এয়ারক্রাফট হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা বিস্ময়কর ও অবিশ্বাস্য হলেও এখন পর্যন্ত দুমাসেরও বেশী সময় পরেও তার কোন সন্ধান মেলেনি—না কোন ভগ্নাংশের।

২। জাহাজে কারা ছিলেন


.
জাহাজের ক্রু সদস্যদের ১২ জনের সকলেই মালয়েশিয়ার নাগরিক। পাইলট ছিলেন ৫৩ বৎসর বয়স্ক যাহারি আহমেদ শাহ ও কোপাইলট ২৭ বৎসর বয়স্ক ফারিক আব্দুল হামিদ। ফারিক জাহাজটি চালাচ্ছিলেন। মোট ১২টি দেশের ২২৭ জন যাত্রীর মধ্যে ১৫৩ জনই চীনের ও ৩৮ জন মালয়েশিয়ার নাগরিক; বাকী ৩৬ জন যাত্রী ইরান (২), যুক্তরাষ্ট্র (৩), কানাডা (২), ইন্দোনেশিয়া (৭), অস্ট্রেলিয়া (৬), ভারত (৫), ফ্রান্স (৪), নিউজিল্যান্ড (২), ইউক্রেন (২), রাশিয়া (১), তাইওয়ান (১) ও নেদারল্যান্ডের (১)। যাত্রীদের ৭ জন ছিল শিশু। চীনাদের মধ্যে ১৭ জন ছিলেন দেশে সুপরিচিত শিল্পী, যারা কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত একটি আর্ট প্রদর্শনীতে অংশ নেয়ার উদ্দেশ্যে এসে তাতে অংশ নিয়েছিলেন। যাত্রীদের বিশ জন ছিলেন টেক্সাসের ফ্রিস্কেল সেমিকন্ডাক্টরের কর্মচারী, যাদের বার জন মালয়েশিয় ও আট জন চীনা নাগরিক। মালয়েশিয়ার এয়ারলাইন সূত্রে জানা যায়, ৪ (অন্য একটি সূত্রে ৫) জন যাত্রী চেক-ইন করা সত্ত্বেও জাহাজে উঠেননি।

৩। যতটুকু জানা গিয়েছে

৩.১। ভয়েস কমিউনিকেশন

জাহাজটি মালয়েশিয় সময় ৮ এপ্রিল রাত ০০:৪১ মিনিটে বেইজিংয়ের উদ্দেশ্য কুয়ালালামপুর রানওয়ে থেকে উড়ে। ঘণ্টা খানেক পর—সময় ০১:০১—ক্রু ৩৫ হাজার ফুট অল্টিচুড নিশ্চিত করে এবং তার কয়েক মিনিট পর—সময় ০১:০৭—শেষ ACARS মেসেজ পাওয়া যায়, এবং ক্রু দ্বিতীয়বারের মতো ৩৫ হাজার ফুট অল্টিচুড কনফার্ম করে। তারপর ১২ মিনিট পর—সময় ০১:১৯—কোপাইলটের নিকট থেকে শোনা যায় "গুড নাইট, মালয়েশিয়ান থ্রি সেভেন যিরো"—এটাই ছিল মালয়েশিয়ার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের সাথে বৈমানিকের শেষ কথা। এই সাইন অফের পর পাইলটের যোগাযোগ করার কথা ছিল ভিয়েতনামের হোচিমিন সিটির কন্ট্রোলারের সাথে। তবে পরবর্তী FIR'য়ের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কয়েক মিনিটের মতো বিলম্ব ঘটতে পারে। এই সময়টিকে বলা হয়ে থাকে ব্ল্যাক স্পট। কিন্তু হোচিমিনের সাথে জাহাজের প্রত্যাশিত সময়ের চেক-ইনি বা কোন রকম যোগাযোগ শেষতক হয়নি। হোচিমিনের অনুরোধে অন্য একটি এয়ারক্রাফটের পাইলট MH370 এর সাথে ইমার্জেন্সি ফ্রিকোয়েন্সিতে যোগাযোগের চেষ্টা করে। এই পাইলটের বর্ণনায় জানা যায়, যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল বটে, কিন্তু অপর পক্ষের কথা কিছুই বুঝা যায়নি ও স্ট্যাটিক নয়েজ ছিল প্রচুর—এটি রাত ১টা ৩০ মিনিটের ঘটনা হিসেবে বর্ণিত হয়েছে।

৩.২। সিভিল রাডার সার্ভিল্যান্স

দক্ষিণ চীন সাগরে ভিয়েতনামি এয়ার স্পেসে জাহাজটি প্রবেশ করার পর এবং কোপাইলটের বিদায় সম্ভাষণের মাত্র দুই মিনিটের মাথায় (০১:২১) জাহাজের ট্রান্সপন্ডার—যা ভূমিতে স্থাপিত সার্ভিল্যান্স সিস্টেমের সাথে যোগাযোগ করে—বন্ধ হয়ে যায়। সেকেন্ডারি সার্ভিল্যান্স রাডার (SSR) ট্রান্সপন্ডার এবং অটোমেটিক ডিপেন্ডেন্ট সার্ভিল্যান্স ব্রডকাস্ট (ADS-B) ট্রান্সমিটার উভয়েই একসাথে বন্ধ হয়। ফলে মালয়েশিয়ার এরিয়া কন্ট্রোলারের SSR/ADS-B সমন্বিত সার্ভিল্যান্স স্ক্রিন থেকে জাহাজটি অপসৃত হয়। এসময়ে এটি নির্ধারিত পথে ওয়েপয়েন্ট IGARI-তে ছিল; ৩৫ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়ছিল ঘণ্টায় ৫৪২ মাইল বেগে। এই স্থানটিই মালয়েশিয়ান সিভিল এভিয়েশন কর্তৃক শেষ দৃষ্ট অবস্থান। শেষ অবস্থান সংক্রান্ত এই তথ্যের ভিত্তিতেই মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামের মধ্যবর্তী থাই উপসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগরে প্রথম সার্চ অপারেশন শুরু করে মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ও চীন।

উড়ার পর প্রায় সোয়াঘন্টা জাহাজটি কন্ট্রোলারের নজরদারীতে ছিল।

৩.৩। মিলিটারি প্রাইমারি রাডার ডাটা

এরপর জাহাজটির গতিপথ নিয়ে নতুন তথ্য পাওয়া যায় মিলিটারি প্রাইমারি রাডার থেকে। প্রাইমারি রাডার কোন ট্রান্সপন্ডারের সাহায্য নেয় না। এটি মাইক্রোওয়েভ ট্রান্সমিট করে ও উড়োজাহাজের গা থেকে প্রতিফলিত হয়ে ফেরত আসা অংশের সাহায্যে সেটিকে ডিটেক্ট করে। মালয়েশিয়ার মিলিটারি রাডার উপাত্ত থেকে জানা যায়, শেষ দৃষ্ট অবস্থান IGARI থেকে জাহাজটি অস্বাভাবিকভাবে গতিপথ পরিবর্তন করে পশ্চিমে যায়। রাডারটি জাহাজটিকে ০২:১৫ মিনিট পর্যন্ত ট্রেস করে; জাহাজটির তখনকার অবস্থান ছিল থাইল্যান্ডের ফুকেট থেকে দক্ষিণ বরাবর মালাক্কা প্রণালীতে। এটিকেই তার শেষ জ্ঞাত অবস্থান হিসেবে ধরা হয়। থাইল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ তাদের মিলিটারি রাডার লগ থেকে দাবী করেছে যে, জাহাজটি ঘুরে প্রথমে পশ্চিম দিকে ও পরে উত্তরে আন্দামান সাগরের দিকে যায়। এই দুই কর্তৃপক্ষের কথার মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে। কিন্তু এই তথ্য পেতে বিলম্ব হয়েছিল ও এই তথ্যের ভিত্তিতে ৯ মার্চ অনুসন্ধান কাজ মালাক্কা প্রণালী ও আন্দামান সাগরে সম্প্রসারিত করা হয়।

সিভিল রাডার থেকে হারিয়ে যাবার পর প্রায় ঘন্টাখানেকের পথ মিলিটারি রাডার থেকে জানা গিয়েছে।


.
৩.৪। ACARS ও ডাটা কমিউনিকেশন

এয়ারক্রাফট কমিউনিকেশনস এড্রেসিং এন্ড রিপোর্টিং সিস্টেম (ACARS) একটি ডিজিটাল ডাটালিংক প্রটোকল। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে গ্রাউন্ড স্টেশনের কাছে মেসেজ, পজিশন রিপোর্ট ইত্যাদি পাঠানোর জন্য এই প্রটোকল ব্যবহৃত হয়। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স বহুজাতিক তথ্য প্রযুক্তি কোম্পানি SITA'র কাছ থেকে স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন সার্ভিস গ্রহণ করে, আর ডাটালিংকের জন্য SITA চুক্তি করেছে ব্রিটিশ স্যাটেলাইট টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি INMARSAT'য়ের সাথে—যার রয়েছে এগারটি জিয়োস্টেশনারি কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটের কনস্টেলেশন। ACARS-সংশ্লিষ্ট পুরো সিস্টেমটির দুটি প্রধান অংশের একটি হচ্ছে ACARS-সিস্টেম, যা মেসেজ প্রেরণ করে, ও অন্যটি SATCOM টার্মিনাল, যা স্যাটেলাইটের সাথে কমিউনিকেশন লিংক স্থাপন করে। গ্রাউন্ড স্টেশন মোটামোটি প্রতি ঘণ্টায় একবার SATCOM টার্মিনালের কাছে 'লগ-অন/লগ-অফ' মেসেজ পাঠায়—এটি ping নামে বেশী পরিচিত, আর পুরো প্রসেসটিকে বলা হয়ে থাকে হ্যান্ডশেক। এই প্রসেসটি সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়। MH370 ০১:০৭ মিনিটে ACARS এর মেসেজ পাঠায় এবং এরপর আর কোন মেসেজ পাঠায়নি। ফলে ধারণা করা হয়, রাডার ট্রান্সপন্ডার বন্ধ হবার সময় ACARS সিস্টেমটিও বন্ধ হয়েছিল। তবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, এরপরও ACARS-এর SATCOM টার্মিনাল থেকে নির্ধারিত সময় মতো হ্যান্ডশেক ঘটছিল, যার তথ্য স্যাটেলাইটে সংরক্ষিত হয়। সময়োচিত ছয়টি পূর্ণ হ্যান্ডশেকের—প্রথমটি ০২:২২ মিনিটে ও সর্বশেষটি ০৮:১১ মিনিটে—তথ্য INMARSAT কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে পাওয়া যায়। তারপর থেকে আর কোন হ্যান্ডশেক হয়নি। অবশ্য ০৮:১৯ মিনিটে একটি অনির্ধারিত ও ব্যাখ্যাহীন আংশিক হ্যান্ডশেক ঘটেছিল বলে জানা যায়, কোন গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে ping করা হয়েছিল তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে জানা গিয়েছিল।

৪। INMARSAT ও দুটি প্রকল্পিত বৃত্তচাপ


.
Ping/হ্যান্ডশেক নিজ থেকে জাহাজের অবস্থান সংক্রান্ত কোন উপাত্ত দেয় না। এটি গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে জাহাজের স্যাটকম টার্মিনাল পর্যন্ত কমিউনিকেশন লিংকের সচলাবস্থা নিশ্চিত করে। কিন্তু ping-এর জবাব থেকে সময়ের হিসাব-কিতাব করে প্রকৌশলীরা স্যাটেলাইট থেকে জাহাজের দূরত্ব নির্ণয় করতে পারে। সর্বশেষ ping'য়ের উপর ভিত্তি করে নির্ণীত দূরত্ব বিবেচনা করে তারা দুটি বৃত্তচাপ এঁকেছেন। সেই সাথে মওজুদ জ্বালানীতে জাহাজটির পক্ষে সোজা যতদূর উড়া সম্ভব (৫৩শ কিমি) ছিল তা হিসেবে এনে একটি বৃত্ত আঁকা হয়। এই বৃত্তের পরিধির যেখানে সেই চাপ দুটি মেলে সেখান পর্যন্ত প্রলম্বিত ফ্লাইট করিডোর দুটি জাহাজটি বিধ্বস্ত হবার সম্ভাব্য স্থান বলে ধারণা করা হয়। যে দুটি করিডোর নির্ধারণ করা গিয়েছে তাদের উত্তরেরটি দক্ষিণ থাইল্যান্ড থেকে কাজাখস্তান পর্যন্ত প্রলম্বিত ও অপরটি বিপরীত দিকে ইন্দোনেশিয়া থেকে দক্ষিণ ভারতীয় মহাসাগরে অস্ট্রেলিয়ার পার্থ থেকে আরও দক্ষিণ পর্যন্ত। তবে পরবর্তীতে সংশোধিত হিসাব অনুসারে উত্তরের অংশটিকে বাদ দেয়া গিয়েছে। এটি খুব ভালভাবেই দাবী করা হয়েছে যে, MH370 দক্ষিণ ভারতীয় মহাসাগরেই পড়েছে—যা অনুসারে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী টেলিভিশনে ঘোষণা দিয়েছিলেন। ৫৩শ কিমি ফ্লাইট হিসেবে নিলে বলা যায় পার্থের নিকটবর্তী সমুদ্রগর্ভই যাত্রীদের সমাধিস্থান।

মিলিটারি রাডার থেকে হারিয়ে যাবার পর থেকে শেষ ACARS হ্যান্ডশেক পর্যন্ত জাহাজটি ছয় ঘণ্টা উড়েছে। তারপর তেলের হিসেবে আরও এক ঘণ্টা উড়া সম্ভব।

৫। বিভিন্ন তত্ত্ব

৫.১। পাসপোর্ট তত্ত্ব

চোরাই পাসপোর্টধারী ২ জন ইরানী—১৯ বছরের পোরিয়া নুর আহমেদ মেহেরদাদ ও ২৯ বছরের দেলওয়ার সাইয়েদ মোহাম্মদ রেজা—বেইজিং হয়ে ইউরোপ যাচ্ছিলেন। পাসপোর্ট দুটির একটি এক ইতালীয় ও অপরটি এক অস্ট্রীয় নাগরিকের যারা বছরখানেক আগে থাইল্যান্ডে তাদের পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলেন। আন্তর্জাতিক পুলিশ এজেন্সি ইন্টারপোল তাদের বিশ্বব্যাপী হারানো পাসপোর্টের ডাটাবেস থেকে এই তথ্য নিশ্চিত করে। তবে কোন সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে এই দুই যাত্রীর জড়িত থাকার আলামত পাওয়া যায়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি একটি শঙ্কার বিষয় যে, দুজন যাত্রী অন্যের পাসপোর্ট ব্যবহার করে জাহাজে উঠতে পেরেছিল—মালয়েশিয় নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ তাদেরকে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।

৫.২। পাইলটের আত্মহত্যা তত্ত্ব

পাইলট কর্তৃক আত্মহত্যার তত্ত্ব প্রথমদিকে বেশ আলোচিত বিষয় ছিল। কিন্তু এই তত্ত্বের সমর্থনে কোন প্রমাণ মেলেনি। এফবিআই ও মালয়েশিয় পুলিশ পাইলট ও কোপাইলটের বাড়ি তল্লাশি করে। এফবিআই পাইলটের হোম ফ্লাইট সিমুলেটরে মুছে ফেলা তথ্য উদ্ধার করে এবং তাদের মতে ওতে সন্দেহজনক কিছু ছিল না। তবে বৈমানিকের বিমানসহ আত্মহত্যার সন্দেহ এটিই প্রথম নয়। ১৯৯৯ সালে ইজিপ্ট এয়ার ফ্লাইট ৯৯০ এবং ১৯৯৭ সালে সিল্ক এয়ার ফ্লাইট ১৮৫ বিধ্বস্ত হবার জন্য পাইলটের আত্মহত্যাকে কারণ হিসেবে দেখা হয়। অবশ্য এই দাবীকে অনেকেই চ্যালেঞ্জও করেছেন। এভিয়েশন সেফটি নেটওয়ার্কের দাবী মতে, ১৯৭৬ সাল থেকে এভাবে আত্মহত্যার ছয়টি ঘটনা রয়েছে। বিশেষজ্ঞের মতে, মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে এই তত্ত্ব অন্য তত্ত্বগুলোর মতোই একটি তত্ত্ব মাত্র, যা প্রমাণিত হয় নি, আবার অপ্রমাণিতও হয়নি।

৫.৩। ককপিটে সাময়িক আগুন তত্ত্ব

ককপিটে আগুন লেগে যাওয়া একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। আগুনের কারণে ভয়েস কমিউনিকেশন ভেঙ্গে পড়ে। পাইলট অন্যান্য ইলেকট্রনিক সিস্টেম নিরাপত্তার স্বার্থে বন্ধ করে দিতে পারেন, অথবা আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। দ্রুত আগুন নিভিয়ে ফেলাও সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু ককপিটের ক্ষতি এতদূর হয়ে উঠে যে, পাইলট এয়ারক্রাফট পুরো নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হন। পাইলট দ্রুত ফেরার সিদ্ধান্ত নেয় ও লংকাবির ধারেকাছে পানিতে নামতে চান। নিয়ন্ত্রণের অভাবে শেষতক নামতে পারেনি। জাহাজ নিজে নিজে উড়ে শেষে যখন তেল ফুরিয়ে যায় তখন দক্ষিণ ভারতীয় মহাসাগরে নেমে সাগরের তলায় চলে যায়। যদি এরকমটি ঘটে থাকে তবে একথা বলা যায়, যাত্রীরা এতই দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছেন যে, ভালভাবে 'গুড নাইট' বলার পরপরই দ্রুত এমনসব কাণ্ড ঘটতে থাকে যার ফলশ্রুতিতে 'মে-ডে' কল করার সুযোগ ক্রু'রা পায়নি। সেই সাথে ধীরে ধীরে জাহাজের ভেতরে বাতাসের চাপ কমেও থাকতে পারে—যার ফলশ্রুতিতে যাত্রী ও ক্রুরা নিজেদের অজ্ঞাতেই হয়তো অজ্ঞান হয়েও পড়েছিলেন।

৫.৪। যান্ত্রিক গোলযোগ তত্ত্ব

মেকানিক্যাল ফেইলিওরকেও সম্ভাব্য কারণ হিসেবে দেখা হয়েছে। তবে এখানে একটি বড় প্রশ্ন হতে পারে এই যে, সে ক্ষেত্রে যোগাযোগ বন্ধ হবে কেন? ককপিটে আগুনের কারণে মেকানিক্যাল সমস্যাও হতে পারে। কাজেই আগুন তত্ত্বটিই বেশ মজবুত তত্ত্ব।

৫.৫। স্যাবোটাজ, হাইজ্যাক ইত্যাদি

পরপর কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে যাদের উপযুক্ত ও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা মিলছে না—ব্ল্যাক স্পট থেকে ঘটনার সূত্রপাত হওয়া, স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সব যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়া, এয়ারক্রাফটের গতির দিক বদল করে পশ্চিমে উড়তে থাকা, জাহাজের কোন চিহ্ন না পাওয়া। ফলে মানুষের হাত থাকার সন্দেহও করা হয়েছে। হাইজ্যাকের সন্দেহ প্রথমে গিয়ে পড়েছিল দুই ইরানীর উপর। সুইস জেট চার্টার কোম্পানির ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার পদে চাকুরে এক যাত্রীকেও অবশ্য খুবই স্বল্পকালের জন্য সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছিল, যেহেতু সে অভিজ্ঞ ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার হবার সুবাদে সিস্টেম বিকল করার বিদ্যা তার ছিল।

৫.৬। কন্সপিরেসি থিওরি

এই ঘটনা নিয়ে নানা রকমের ষড়যন্ত্র তত্ত্বেরও প্রসার ঘটেছে। এর সাথে আবার যুক্ত হয়েছে বৈজ্ঞানিক কল্পকথাও। ডিয়েগো গার্সিয়ায় লুকিয়ে রাখা, ফ্রিস্কেল'য়ের আবিষ্কার ছিনতাই করার প্রচেষ্টা, আল কায়েদা, ব্ল্যাক হোল, এশিয়ান বারমুদা ট্রায়াঙ্গল, এলিয়েন এবডাকশন, ইলিউমিনাটিদের এনার্জি ভর্টেক্স কোনটাই বাদ যায়নি। পরপর অনেকগুলো ঘটনা/দুর্ঘটনার একসাথে ঘটা, জাহাজের কোন ধ্বংসাবশেষের সন্ধান না পাওয়া, মালয়েশিয়দের গাফিলতি, তাদের ভিন্ন ভিন্ন কর্তৃপক্ষের তথ্যে গরমিল, বেশ কয়েকদিন বিলম্বে ACARS তথ্য প্রকাশিত হওয়া ইত্যাদি নানা বিষয় মিলে এরূপ নানা উদ্ভট তত্ত্বের উদ্ভব ঘটিয়েছে।

৬। পর্যালোচনা

কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জন্য যতটুকু জমি গ্রহণ করা হয়েছে তার মাত্র ১০ শতাংশ কাজে লাগানো হয়েছে, বাকীটা ভবিষ্যতের জন্য রেখে দেয়া হয়েছে (এখন সেখানে পাম চাষ করা হচ্ছে, এজন্য একটি লিমিটেড কোম্পানিও বানানো হয়েছে)। কিন্তু এতটুকুতেই ইতোমধ্যে তা একটি অত্যাধুনিক ও সুবিশাল বিমানবন্দর হয়ে উঠেছে। মালয়েশিয়রা তাদের বিমান পরিবহণ অবকাঠামোর জন্য বেশ গর্বিতও। এই অঞ্চলে এভিয়েশন সেক্টরে ব্যস্ততম হাব হবার উচ্চাভিলাষ নিয়েই তারা এগুচ্ছে। প্রয়োজনীয় এভিয়েশন টেকনোলজির জন্যও তাদের ব্যয় প্রচুর। তাদের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল সেন্টার অত্যাধুনিক সিস্টেম সমৃদ্ধ। এই সেক্টরে মানব সম্পদ উন্নয়নে তারা সিঙ্গাপুরের সাথে পাল্লা দিয়ে এগুতে চাচ্ছে। কোঅর্ডিনেশনের জন্য কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে রয়েছে বিরাট কমান্ড-কন্ট্রোল সেন্টার। কিন্তু এতদস্বত্বেও তারা নগ্ন হয়ে পড়লো; প্রমাণ করলো, তাদের মানবশক্তি কতখানি অমনোযোগী—কি সিভিল, কি মিলিটারি। এবং তাদের সিভিল-মিলিটারি-এয়ারলাইন্স কোঅর্ডিনেশন কোন কাজেই লাগলো না।

বিমান হারিয়ে যাওয়ার এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক সমালোচকরা এমনভাবে নয়া টেকনোলজি প্রবর্তনের কথা বলছেন যেন মালয়েশিয়রা উন্নত টেকনোলজির পুরো সুবিধা সর্বোচ্চ দক্ষতার সাথে ব্যবহার করা স্বত্বেও জাহাজটি হারিয়ে গিয়েছে। কিন্তু দৃশ্যতই স্পষ্ট যে, মালয়েশিয়ার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল ও বিমান বাহিনী কিছুটা অসজাগতার পরিচয় দিয়েছে বলা যায়। সিভিল রাডার থেকে বিমানের অপসৃত হবার ক্ষণটাও এটিসি ঠিক মতো রিপোর্ট করতে পারেনি। অন্যদিকে, বিমান বাহিনী এভাবে একটি অফ-ট্র্যাক জাহাজ তাদের নিজস্ব আকাশ সীমায় এক ঘন্টা ধরে উড়লো অথচ রিয়াল টাইম মনিটর পর্যন্ত করলো না। এতে মালয়েশিয়ার ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়েছে। সম্ভবত অর্থনৈতিকভাবেও তাদেরকে কিছুটা ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।

৭। ঘটনার সম্ভাব্য প্রভাব

MH370-এর হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি যে বিষয়গুলোকে এখন আলোচিত-সমালোচিত করে তুলেছে তাদের মধ্যকার প্রধানগুলো হচ্ছে সিকিউরিটি স্ক্রিনিং সিস্টেম, সার্ভিল্যান্স সিস্টেম, কমিউনিকেশন সিস্টেম এবং সার্চ এন্ড রেসকিউ সহায়ক সিস্টেম। সিকিউরিটি সামনে এসেছে একারণে যে, দুজন ইরানী যাত্রী চুরি করা পাসপোর্ট নিয়ে এয়ারক্রাফটে উঠতে সক্ষম হয়েছে বলে জ্ঞাত হওয়া; সার্ভিল্যান্স ও কমিউনিকেশন এসেছে দুই ফ্লাইট ইনফরমেশন রিজিওন (FIR)-এর মধ্যবর্তী ব্ল্যাক স্পট থেকে জাহাজটির যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়া ও সেকেন্ডারি সার্ভিল্যান্স রাডার (SSR) ট্রান্সপন্ডারের নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া থেকে; এবং সার্চ এন্ড রেসকিউ এর বিষয়টি এসেছে জাহাজটির পরিবর্তিত পথের হদিস সহজে বা নিশ্চিতভাবে না পাওয়া এবং ব্ল্যাক বক্স থেকে সুফলদায়ক কোন সাড়া না পাওয়া থেকে। ঘটনাটি আর নিছক একটি এয়ারক্রাফটের হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে সীমিত নেই, এটি এখন হয়ে উঠছে এভিয়েশন টেকনোলজি ও এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টে মিসিং লিংক অন্বেষণের ঘটনা। এই ঘটনা সম্ভবত ভবিষ্যৎ এভিয়েশন টেকনোলজি ও প্রসেডিওরে বিরাট পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে।

আমরা জাহাজের হদিস হয়তো নিকট ভবিষ্যতে পাবো; কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেক রহস্যই সম্ভবত রহস্য হয়েই থেকে যাবে। দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বিমান চলাচল সিস্টেমে ফাঁক রয়ে গেছে এবং এই ফাঁক পূরণে এখন বিশ্বের সব দেশকে দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে। তবে এগিয়ে আসার সাথে জড়িয়ে আছে উন্নত বিশ্বের, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য শেয়ার করা ও বিপুল পরিমাণে আর্থিক সংশ্লেষ। এই অর্থ কে যোগান দেবে?—যাত্রী, এয়ারলাইন, নাকি রাষ্ট্র, তা-ও একটি বড় প্রশ্ন। ৯/১১-এর ঘটনার মতোই এঘটনাটিও একালের এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিতে পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে আরেকটি মাইল ফলক ঘটনা হতে যাচ্ছে—এটি অনুমান করা যায় সহজেই।

তথ্য সূত্র:

1. Wikipedia – Malaysia Airlines Flight 370
2. BBC – Missing Malaysia Airlines plane 'a mystery'
3. BBC – Missing Malaysia plane: What we know
4. BBC – Deep sea challenge for MH370 search
5. Mirror, UK – Missing Malaysia Airlines flight: 13 conspiracy theories
6. India Times – MH370 conspiracy theories re-emerge as search sputters