শুনেছি পদার্থ বিজ্ঞানের সব কিছুই নাকি রিভার্সিবল, কেবল এনট্রপি ছাড়া। যে নিয়মে বস্তু সামনে যায়, পেছনে যাওয়ার বেলায়ও তা সে নিয়মই মেনে চলে। যে পথে যে গতিতে বস্তু সামনে যায়, পেছনে যাওয়ার সময়ও তা সে পথ-গতিই অনুসরণ করে। কালের হিসাবেও বস্তুর সামনে যাওয়াটা পেছনে যাওয়াও হতে পারে। ফলে কোনটা সামন আর কোনটা পেছন তা যেমন জ্ঞান করা অসম্ভব, তেমনই পেছনটা অতীত নাকি সামনটা তাও ঠাহর করা চলে না। আপনি যদি এখানে চাপ বাড়ান তবে সেখানে চাপ কমবে এবং সেখানে চাপ বাড়ান তো এখানে চাপ কমবে। শুধুমাত্র এনট্রপি-ই নাকি বিপরীত, অর্থাৎ এটাই জগতের টাইম স্ট্যাম্প বা এরো অব টাইম। এই তীরের লেজ-মাথা দেখেই নাকি বুঝা যায় দুনিয়া কোন দিকে যাচ্ছে। এক জায়গায় কুঁড়েঘর ভেঙে তাজমহল গড়লে অন্য জায়গায় তাজমহল ভেঙে কুঁড়েঘর হয়; আবার সেই বানানো তাজমহলে গাইতি লাগালে ভাঙা কুঁড়েঘরে আগুন লাগে। আপনি এখানে শৃঙ্খলা বাড়ান তো ওখানে বিশৃঙ্খলা বাড়বে, আবার এখানে বিশৃঙ্খলা বাড়ান তবেও ওখানে বিশৃঙ্খলাই বাড়বে—নিঃসঙ্গ সিস্টেমে বিশৃঙ্খলা কমানোর কায়দা নেই। ইহলোক-পরলোক পারাপার থার্মোডায়নামিকস নয়, ডায়নামিকস। ফলে, যেহেতু ইহলোকে মরে মানুষ পরলোকে যায়, সেহেতু পরকালে মরলে মানুষ ইহকালে আসে। এ নিয়মেই বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ওরফে বনফুল ওপারে ওকালে মরে একালে এপারে এলেন। দেখামাত্র ভক্তিতে গদগদ হয়ে জোড়হাতে দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী সৌভাগ্য! কী সৌভাগ্য! ফুলবাবু মহাশয় যে! কেমন আছেন?
নাগপাশে জড়িয়ে মরার সংখ্যা যেহেতু কিঞ্চিৎ, সেহেতু রবীন্দ্রপাশে জড়িয়ে মরার সংখ্যা অধিক। আমি আজন্ম নীতিতে গণতন্ত্রী ও বাসনায় আধিক্যলোভী, কাজেই অধিকের পক্ষ কখনো ছাড়িনি। ফলে রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ না-পড়াদেরকে আমার বরাবরই অভাগা মনে হয়। তবে যে দেশে রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই, সে দেশে খোদ কথার রাজ্যে শেষ কথা থাকে কী করে? আপনি তো আর সংখ্যার রাজ্যে সংখ্যার দঙ্গলকে সংখ্যার দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে পারবেন না। তাই কথা বাড়ানো যায় এবং বাড়ালেও দোষের হয় না। বনফুল এমনই এক রসে ভরা চিন্তায় ভরা অতিছোটগল্পকার যে, রবীন্দ্রনাথের মতো বড় বড় রুই-কাতলাও যদি বনফুল-পড়া না হন তবে তাদেরও অ-অভাগা হওয়ার যো নেই। রবীন্দ্রনাথ, জগদীশ গুপ্তরা যদি ছোটগল্পকার হন তবে আমাদের বনফুল অতিছোটগল্পকার। তাঁর গল্পে বিরাট কাহিনী নেই বিরাট চরিত্র নেই, নেই আকাশী ভাব বা বাতাসী রস; আছে মিলেমিশে কেবল তেঁতো রসের সাথে চিন্তা ভয়ংকর। এক পাতায়, দুপাতায়, তিন চার পাতায় গল্প শেষ। আর ভাষা? সেটি আপনি নিজেই চেখে দেখুন। আমাদের একালে উপন্যাস পড়া তো দূরের কথা ছোটগল্প পড়ারইবা সময় কই! কাজেই অতিছোটগল্প নিয়ে বনফুল আবার বেঁচে উঠলে একালের আমাদের বড়ই সুবিধা হয়। অতএব, আপনার এখন আর বুঝতে বাকী রইলো না কেন আমি তাঁকে দেখে গদগদ হয়ে কী সৌভাগ্য করতে করতে দৌড়চ্ছিলাম।
আগের বারের বনফুল যেকালে বাস করতেন সেকালে চালাকেরা দুধের স্বাদ দুধেই মেটাতেন, ঘোলে মেটাতেন শুধু বেকুবেরা। কিন্তু আমাদের একালে যারা অতিশয় বুদ্ধিমান বনেদি তারা মেটায় ঘোলের পাতিলের ছবি দেখে, আর বেকুবেরাই শুধু দুধ খুঁজে বেড়ায়। চারদিকে এতো পরিবর্তন দেখে এক কালের চেনা জায়গাকেও বনফুল চিনতে পারছিলেন না। তবে আমাকে দেখে এদিক ওদিক চাওয়া চাওয়ি বন্ধ করে শান্ত হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর তাঁহাতে আমাতে যা বিনিময় হলো তা সংলাপাকারে নীচে লিখে দেয়া গেল।
আমি: মহাশয়, সে কবরের সন্ধান আমার জানা নেই। আপনি তো স্বপ্নের দুনিয়ায় ছিলেন। সেখানে আপনার বিবেক "প্রকাণ্ড একটা কলসি" হাতে যে দড়ি "খুঁজিতেছিল" সেটুকু বলেই তো গল্প শেষ করে সটকে পড়লেন। দড়িটা খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল কিনা, আর পাওয়া গেলেও তা কাজে লাগানো গিয়েছিল কিনা তা তো আর বলে যাননি। একে তো স্বপ্ন, তার উপর দ্বিবিধ দড়ি-অনিশ্চয়তা। কাজেই খোঁজ নিতে যাব কোন ভরসায়? কবরের কথা রেখে মহাশয় আগে বলুন, কখন এলেন? জার্নিতে কোন বিঘ্ন-কষ্ট হয়নি তো?
বনফুল: এই তো প্রথম ট্রেনে। ওপার থেকে এপারের ডাইরেক্ট ট্রেন। সব তাতে বেজায় উন্নতি। তাইতো! বিবেকের খোঁজ নিয়ে আর কাজ কী! এখন নিচ্চয় "রামের গাছ হইতে শ্যাম জোর করিয়া আম পাড়িয়া লইয়া সরিয়া পড়িতেছে" বলে দেখতে হয় না।
আমি: কী যে বলেন মহাশয়! আপনি যদি আগের মতো "দেখিতে থাকেন এবং শুনিতে থাকেন" তবে যেকোন দিন আপনার চোখ বলে বসবে, দেখ দেখ, জামালের গাছ থেকে কামাল ফন্দি করে আম পেড়ে নিয়ে গেড়ে বসেছে।
বনফুল: হুম! তাহলে এখন আর কেউ জোরও করে না সরেও পড়ে না। তা বেশতো! এখন নিচ্চয় আগের মতো আর কামাল "বড়লোক বলিয়া সকলে তাহার পক্ষাবলম্বন করিয়া জয়ধ্বনি"ও দেয় না। অন্তত প্রমিত-বাক হতে শিখেছো বিলক্ষণ।
আমি: মহাশয়ের যেমন বিজ্ঞতা। আপনি সহি ধরেছেন। এখন আর সকলেই জয়ধ্বনি দেয় না, মুখ গোমরা করে চোখ ফিরিয়ে নির্বাক হয়ে শুধু "স্বকীয় চরকায় নির্বিকারভাবে তৈলনিষেক" করে। তা এতে কতটুকু প্রজ্ঞাজনিত প্রমিতকরণ আর কতটুকু ভীতিজনিত সীমিতকরণ তার সমীক্ষাকরণের নিমিত্তে কান্টের ন্যায় দার্শনিক প্রয়োজন।
পাঠক! কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না? বুঝবেন কী করে—আমি বুঝাতে জানলে তো! তাহলে একটি বুদ্ধি করা যাক। মানে চুরি করা আর কি! আংশিক চুরিকরণে তেমন দোষ নেই। আগের জনমে 'বিবেক' নামক গল্পটি বনফুল যেভাবে শুরু করেছিলেন—
সেদিন চক্ষু বলিল, দেখ দেখ, রামের গাছ হইতে শ্যাম জোর করিয়া আম পাড়িয়া লইয়া সরিয়া পড়িতেছে।
কর্ণ বলিল, শুধু তাহাই নহে, ওই শুন শ্যাম নিজেকেই সুদক্ষ বীর বলিয়া ঘোষণা করিতেছে, এবং শ্যাম বড়লোক বলিয়া সকলে তাহার পক্ষাবলম্বন করিয়া জয়ধ্বনি দিতেছে।
রসনা চুলবুল ও হাত নিশপিশ করিয়া উঠিল।
তর্জনী আস্ফালন করিয়া বিবেক কহিল, খবরদার, কিছু বলিও না বা করিও না। কেবল নীরবে দেখিয়া যাও এবং শুনিয়া যাও।
এরপর অনেক ঘটনা। বিবেকের কামড়ে বিবেকের হুশিয়ারি অগ্রাহ্য হলো। বনফুল দিলেন মামলা ঠুকে। এক মাস কেটে গেল। "বিনা মেঘে বজ্রপাত কথাটা নিতান্ত বাজে কথা নয়।" শত্রু-মিত্রের মধ্যে "হরিহর-আত্মা-জাতীয় মিলন" শুদ্ধ বিচারে অশুদ্ধ নয়। পরিণামে বিবেকের কপালে কী লেখা হলো তার ইতিহাস পাঠক নিশ্চয় আগেই বুঝেছেন। এবার পরের কথা বলি। একটি পূর্ণ ইহজীবনের পূর্ব-অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও বনফুল আক্কেল দোষে দ্বিতীয় জীবনের প্রথম দিনটিতেও টিকতে পারলেন না। এবারের বিপদটিকে জানান দেয়ার জন্য তিনি 'বিবেক' নামক গল্পটি গেলবার যেভাবে শেষ করেছিলেন এবার তার কিছুটা বদলে দিয়ে লিখলেন এবং কাগজটা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে শেষ ট্রেনে দ্বিতীয় পরলোক যাত্রা করলেন। কাগজটিতে যা লেখা ছিল—
একটা ভীষণদর্শন বলিষ্ঠ লোক কী যেন খুঁজিয়া বেড়াইতেছে। এইবার তাহার হাতে প্রকাণ্ড একটা কলসির বদলে গলায় প্রকাণ্ড একটা শাঁখের করাত—এদিকে গেলেও কাটিতেছে, ওদিকে গেলও কাটিতেছে। প্রশ্ন করিলাম, আপনি কি দড়ি খুঁজিতেছেন?
আমার প্রতি অগ্নিদৃষ্টি হানিয়া সে বলিল, কোন জনমেই তোমার কোন বুদ্ধি হইল না। দড়ি দিবার জায়গা কোথায়? ওপারে যাওয়ার জন্য এবার একখানা পিস্তল দরকার।
পিস্তল? আপনি কে?
তোমার বিবেক, রাস্কেল।
[ডবল কোটেশন মার্কের মধ্যকার কথাগুলো বনফুলের 'বিবেক' নামক গল্প থেকেই নেয়া। তবে পূর্বাপর পদের সাথে মেলাতে গিয়ে কোন কোন স্থানে শব্দের রূপ বদলাতে হয়েছে।]