নারীবাদী যত্ন নৈতিকতা—১য় অংশ
এথিকস অব কেয়ার বা যত্নের নৈতিকতা বা যত্ন-নৈতিকতার সূত্রপাত হয় ১৯৮০'র দশকের শুরুর দিকে। এর নামটি এসেছে 'যত্ন' নামক প্রপঞ্চটিকে নৈতিকতার কেন্দ্রে স্থাপন করা থেকে। মানুষের অস্তিত্ব নানা রকম অনৈময়িক ও ঘরোয়া যত্নে বিশিষ্টভাবে মণ্ডিত হয়ে আছে; কিন্তু চিন্তার রাজ্যে এই দিকটিকে খতিয়ে দেখা হয়নি। যত্ন মানবজাতির জন্য যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, তাকে সে পরিমাণেই অবমূল্যায়ন ও অবজ্ঞা করা হয়েছে। মানুষেরা নানা সম্পর্কে আবদ্ধ ও পরস্পরের উপর নির্ভরশীল হবার কারণে যত্নকে গ্রহণ করা যেতে পারে নৈতিকতার সবচে মৌলিক ও ভিতগত উপাদান হিসেবে। সনাতন ঐতিহ্যবাহী চিন্তায় মানুষকে মনে করা হয় স্বায়ত্বশাসিত ইচ্ছাবান যুক্তিশীল কিছু হিসেবে এবং ন্যায়কে ধরা হয় সমাজের প্রথম পুণ্য হিসেবে। এ থেকে তৈরি হয়েছে পাহাড়সম "উচ্চ" ও সাধারণ মানুষের নিকট নিতান্তই দুর্বোধ্য বিমূর্ত চিন্তা-রাজ্য। যত্ন-নৈতিকতাবাদীরা এই অবস্থান থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন; সম্পর্ক ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে তারা বড় করে দেখেন ও যত্নকে স্থাপন করেছেন মানুষের প্রথম পুণ্য হিসেবে। যত্ন-নৈতিকতা ব্যক্তির আচরণ ও কর্মকাণ্ডকে একটি প্রশস্ততর ফ্রেমওয়ার্কে স্থাপন করেছে। তা আমাদেরকে বলে অন্যের প্রতি মনোযোগী ও দায়িত্বশীল হতে, অন্যের প্রয়োজন ও অবস্থাকে বুঝার চেষ্টা করতে, যত্ন প্রদানের ক্ষেত্রে সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়াতে। যত্নের দুটি প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে অন্যকে আঘাত না করা ও অন্যের প্রয়োজন পূরণ করা। নারী মনস্তত্ত্বের সাথে এর প্রগাঢ় সম্পর্ক ও নারীদের মধ্যে এর বিস্তৃত প্রভাবের কারণে যত্ন-নৈতিকতা ও নারী-নৈতিকতা সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্লেটো আদর্শ বা সর্বোত্তম রাষ্ট্র নিয়ে ভেবেছেন, আলোচনা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ইত্যাদি করেছেন এবং পরিবারের ভূমিকা নিয়েও কথা বলেছেন— কিন্তু সেখানে পরিবারকে দেখা হয়েছে রাষ্ট্রের সমর্থক ও সহায়ক হিসেবে। এখানে চিন্তার গতির দিক হচ্ছে রাষ্ট্র থেকে পরিবার। এখনও চিন্তার এই ধারাটি প্রবল হয়ে আছে—যদিও পরিবারের গুরুত্ব পশ্চিমে হ্রাস পেয়েছে ও সারা বিশ্বে ক্রমেই পেয়ে চলেছে, এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য গুরুত্ব লাভ করেছে। পরিবারকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হোক, কি ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য নিয়ে হৈচৈ করা হোক—কোন ক্ষেত্রেই নারীর অবস্থান ও অবস্থাকে বিশেষ কোন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। পরিবারে নারী প্রধানত সেবিকা এবং স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে নারী দুর্বল একটি সত্ত্বা হিসেবেই কার্যত অথবা ফলত পরিগণিত হয়েছে। এরিস্টটল বন্ধুত্ব ও ভালবাসাকে একটি উৎকৃষ্ট নৈতিক গুণ হিসেবে নিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি এটিকে নৈতিকতার কেন্দ্রে বসাননি, এবং এমনকি এটিকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ গুণ বলেও মনে করতেন না। প্রাচীনকাল থেকে অদ্যাবধি নৈতিকতা-চিন্তার যে ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে তাতে চৈতন্য, চিন্তা, বুদ্ধি, ইচ্ছা, স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, অধিকার ইত্যাদি ধারণা প্রধান হয়ে আছে। এরকম সব ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে সাধারণ ও সার্বজনীন বিমূর্ত সব সূত্র। এখানে মানুষের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, সম্পর্ক, দৃশ্যমান অবস্থাগত প্রেক্ষিত ইত্যাদি যথাযথভাবে বিশ্লেষিত হয়নি। নৈতিকতা-চিন্তাকে পুরুষ মনস্তত্ত্বই গঠন করেছে এবং নারী মনস্তত্ত্ব হয় বিবেচিত হয়নি, নয়তো ইনফেরিয়র বলে সাব্যস্ত হয়েছে। মদ্দা কথা, সচেতনভাবেই হোক বা অসচেতনভাবেই, পুরুষরূপই পূর্ণ বা পূর্ণতর মানবরূপ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
গত কয়েক দশক ধরে নারীবাদী নারী চিন্তকেরা ট্র্যাডিশনাল নৈতিকতার বিভিন্ন ভিত্তি ও উপাদানকে চ্যালেঞ্জ করছেন বিভিন্ন দিক থেকে। তারা নারী মনস্তত্ত্ব, পরিবার, সম্পর্ক এবং ধারণা হিসেবে যত্নকে ভিত্তি করে নতুন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ নৈতিকতা-দর্শন নির্মাণে অগ্রসর হয়েছেন এবং ইতোমধ্যেই অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছেন। তাদের ইচ্ছার পেছনে আছে চিন্তার নতুন প্যারাডাইম নির্মাণের উচ্চাভিলাষ। এজন্য তারা একই সাথে ঐতিহ্যবাহী পুরাতন তত্ত্বগুলোর সমস্যাগুলো চিহ্নিত করছেন ও যত্নতত্ত্বকে পরিবার থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পর্যায়ে এবং যত্নকে ন্যায়বিচার পর্যায়ে উন্নীত করার পথে মাইলস্টোন কাজ সম্পন্ন করেছেন। যত্নবাদীরা নৈতিকতা-চিন্তার ভবনের বিন্যাসের দিককে বৈপ্লবিকভাবে বদলে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। নৈতিকতা চিন্তার যাত্রাস্থল হিসেবে তারা পুরুষ মনস্তত্ত্বের বদলে নারী মনস্তত্ত্বকে, পুরুষের চিন্তার বদলে নারীর অভিজ্ঞতাকে, রাষ্ট্রের বদলে পরিবারকে, দূর বিমূর্ত নীতির বদলে নিকট মূর্ত সম্পর্ককে, ইচ্ছা-চিন্তা ইত্যাদির বদলে মমতা-ভালবাসাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন—অর্থাৎ তারা এখন যত্ন থেকে ন্যায়বিচারে, পরিবার থেকে রাষ্ট্রে, সম্পর্ক থেকে সূত্রে উপনীত হতে চাচ্ছেন। তারা ইতোমধ্যেই মমতা, যত্ন ও পরিবার ভিত্তিক সম্পর্ক থেকে ন্যায়বিচারে এবং রাষ্ট্র হয়ে রীতিমতো আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অবধি পৌঁছানোর প্রাথমিক রূপরেখা সাফল্যের সাথেই এঁকে ফেলেছেন।
অতীতের প্রভাবশালী দার্শনিকেরা একথাই বলতেন যে, পুরুষ ও নারীর নৈতিকতা ভিন্ন। এর সাথে তারা প্রায়শই যুক্ত করে দিতেন যে, নারীর নৈতিকতা নিম্ন মানের। এই দাবী অত্যন্ত ন্যায্যভাবেই নারীদেরকে সংক্ষুব্ধ করেছে। কিন্তু নারীদের উপর পুরুষের চাপিয়ে দেয়া শিক্ষাগত পরিস্থিতির কারণে তারা বৌদ্ধিকভাবে অগ্রসর হতে পারেননি। তাছাড়া তাদের কণ্ঠকে কখনোই ভাল চোখে দেখা হয়নি এবং বিবেচনায়ও আনা হয়নি। অনগ্রসরতার কারণে তারা তাদের স্বকীয়তা যেমন হারিয়ে ফেলেছিলেন, তেমনই পুরুষ কণ্ঠের ডামাডোলে অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষদের পথই ধরেছিলেন। পুরুষরূপ পূর্ণ মানবরূপ—এই ধারণা স্বাধীনচেতা নারীদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছিল। মানুষ হওয়ার অর্থ হচ্ছে পুরুষের মতো হওয়া, স্বাধীন হওয়ার অর্থ হচ্ছে পুরুষের মতো হওয়া—এরূপ ভাবনা নারীকে শেষতক আরও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলেও যত্নবাদীদের কেউ কেউ মনে করেন। কিন্তু বিগত তিন দশকে নারীবাদীদের একাংশ—এবং তারা ক্রমাগত প্রভাবশালীও হয়ে উঠছেন—এ দাবী করছেন যে, আসলেই নারী ও পুরুষের নৈতিকতা এক নয় এবং মানবসমাজের সকলেই পুরুষ নয়। তারা এটিও দেখাতে সক্ষম হয়েছেন যে, নারীর নৈতিকতা পুরুষের নৈতিকতার চেয়ে কোন অংশেই কম শক্তিশালী নয়। এমনকি তাদের কেউ কেউ এমনটিও বলছেন যে, নারীর নৈতিকতা পুরুষের নৈতিকতা থেকে উন্নত।
আগেই বলা হয়েছে যে, যত্নবাদীরা রীতিমতো প্যারাডাইম শিফটের অভিলাষ নিয়ে এগুচ্ছেন। আপাতদৃষ্টিতে বা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ামূলক ভাবনায় মনে হতে পারে যে, এতে প্যারাডাইম শিফট হলেও তাকে নতুন প্যারাডাইম বলা চলে না; এটি তো সেই অতীতে ফিরে যাওয়া, যেখানে নারী কেবল হেঁসেল ঠেলার কাজেই নিয়োজিত ছিল। কিন্তু বিষয়টি সেরকম নয়, যত্ন-নৈতিকতা কোন গার্হস্থ্য নীতি মাত্র নয়, বরং বৈপ্লবিকভাবে নতুন একটি সিস্টেম—নৈতিকতা বিষয়ক দার্শনিক সিস্টেম। এটি একটি সুগভীর ও ন্যায্য অবস্থান এবং নারীর প্রকৃত বিকাশ ও সাফল্য যেমন এই প্যারাডাইমে সম্ভব হতে পারে, তেমনই এই প্যারাডাইমে পুরুষরা নিজেদেরকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে তারাও সত্যিকারের অগ্রগতি লাভ করবে। যত্ন-নৈতিকতা নারী মনস্তত্ত্ব থেকে উদ্ভূত হলেও আদতে—অনেকের বিবেচনায়—এটি জেন্ডার নিরপেক্ষ ও সমগ্র মানবজাতির জন্য গ্রহণীয়। এ কথায় আবার মনে হতে পারে যে, এর মাধ্যমে পুরুষকে নারী হওয়ার চেষ্টা করার সুপারিশ করা হচ্ছে। কিন্তু এ রকম ভাবলেও আবার ভুল হবে। প্রকৃত কথা হচ্ছে, পুরুষকে তার নৈতিকতায় নারীবাদী যত্ন-নৈতিকতাকে সঙ্গতি বিনষ্ট না করেই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, সন্নিবিষ্ট করতে হবে। তাহলে ট্র্যাডিশনাল পুরুষ নৈতিকতার সাথে কিভাবে নতুন যত্নবাদী নারী নৈতিকতাকে সন্নিবিষ্ট করে একটি পরিপূর্ণ সমগ্র তৈরি করা যায় তা নিয়ে ভাববার দায়িত্ব পুরুষেরই এবং এজন্য প্রয়োজনীয় একাডেমিক কাজগুলো তাদেরকেই করতে হবে।
কিছু বহুল প্রচলিত কিন্তু অত্যন্ত প্রভাবশালী পূর্বতঃগৃহীত তত্ত্ববিদ্যিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক সিদ্ধান্ত (presupposition) রয়েছে। ধরা হয় যে, একটি আত্মসত্ত্বা (self) যতটা স্বাধীন, আত্মনির্ভরশীল ও স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত—অর্থাৎ অন্যদের থেকে যত বেশী দূরবর্তী—সত্ত্বাটি তত বেশী উন্নত, বিকশিত ও পূর্ণতাপ্রাপ্ত। একইভাবে ধরা হয়ে থাকে, জ্ঞান যত সার্বজনীন, বিমূর্ত, নিষ্পক্ষ, ও যৌক্তিক হবে, ততই তা বাস্তবতার প্রকৃততর প্রতিফলন ঘটাবে। প্রচলিত নৈতিকতা তত্ত্বগুলোতে এই পূর্বধারণাগুলো বিদ্যমান রয়েছে। আঠার-উনিশ শতকের নারীবাদীরা এই উভয় সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেয়া থেকে বিরত থাকেন। তারা বরং উল্টো মত পোষণ করে বলেন যে, একটি আত্মসত্ত্বা যত বেশি অন্যদের সাথে যুক্ত থাকে, তা তত বেশী উন্নত; এবং জ্ঞান যত বিশেষ, মূর্ত, পক্ষপাতযুক্ত ও আবেগসমৃদ্ধ হয়, তা তত বেশি করে জগতাভিজ্ঞতার প্রকৃত পন্থাকে উপস্থাপন করে। এখানে দুটি বিষয়ে সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে: সম্পর্ক (relation) ও অবস্থাগত প্রেক্ষিত (situational context)। প্রচলিত নৈতিকতা পুরুষ মনস্তত্ত্ব থেকে উদগত হয়েছে এবং নারীর চ্যালেঞ্জ এসেছে নারীর মনস্তত্ত্ব থেকে। নারীর ধারণা সামূহিক বা সাংঘিক এবং পুরুষের ধারণাকে বলা যায় স্বায়ত্তশাসন প্রধান। কাজেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, 'যূথবদ্ধ/সম্পর্কিত নারী' (communal women) ক্রমেই 'স্বায়ত্বশাসিত পুরুষ'য়ের (autonomous men) স্থান দখল করে নিচ্ছে।
এরিস্টটল থেকে ফ্রয়েড, প্লেটো থেকে কান্ট, উপযোগবাদীরা (Utilitarian) বা এমনকি সমতাবাদী (egalitarian) উদারনৈতিকরা পর্যন্ত নারীর মনস্তত্ত্বকে ও তা থেকে উদ্ভূত জগতজীবনবীক্ষা ও নৈতিকতাকে যথেষ্টভাবে আমলে নেয়নি। এরিস্টটল নারীকে অধীন করলেন। ফ্রয়েড নারীর নৈতিকতাকে ইনফেরিয়র সাব্যস্ত করলেন। তিনি বললেন, ছেলেরা পিতা থেকে দ্রুত দূরে সরে যায়, যদি পিতা তাকে খোজা করে দেয় এই ভয়ে। কিন্তু মেয়েদের সে ভয় না থাকায় তারা মায়ের সাথেই থেকে যায়। ফলে ছেলেরা স্বায়ত্বশাসিত নৈতিক এজেন্ট হয়ে উঠে, আইন-কানুন মেনে চলতে শেখে। অর্থাৎ আইন-কানুনকে ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে বেশী শ্রদ্ধা করে। এসব কথাকে দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করলেন ক্যারল গিলিগান। তার মতে, ফ্রয়েড আর দশটা পুরুষ পণ্ডিতের মতোই, যারা নারীর নৈতিকতাকে হেয় চোখে দেখেছে। লরেন্স কোহ্লবাগের মতে নারীরা নৈতিকতার সর্বোচ্চ স্তরে খুব কম সংখ্যকই উঠতে পারে। তিনি কোহ্লবার্গের তত্ত্বকেও একচোখা বললেন। গিলিগান ভিন্ন একটি তত্ত্ব—যা নারীদের বেলায় প্রযোজ্য—উপস্থিত করে দেখালেন, সেখানে বহু সংখ্যক নারীই নৈতিকতার উচ্চ স্থানে উপনীত হতে পারে। কিন্তু তার তত্ত্ব নারী মনস্তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি বলেন, নারীর নৈতিকতাবোধ পুরুষের চেয়ে হীন নয় বরং সমান শক্তিসম্পন্ন।
এরপর আরেক অন্যতম যত্ন-নৈতিকতাবাদী নেল নোডিংস এক ধাপ এগিয়ে দেখালেন যে, নারীর নৈতিকতা পুরুষের নৈতিকতা থেকে বরং উন্নত। তিনি মনে করেন পরিবারই যত্ন-নৈতিকতার সূতিকাগার; এবং যত্ন-নৈতিকতার নীতিগুলোকে তিনি সামাজিক পরিমণ্ডলে নীতি নির্ধারণে প্রয়োগ করেন। নেল হচ্ছেন ক্যারলের সার্থক পরিপূরক। মার্কস-এঙ্গেলস যেভাবে সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রে যুগল হয়ে আছেন, তেমনই গিলিগান-নোডিংস হচ্ছেন যত্নতত্ত্বের ক্ষেত্রে—তবে নোডিংস এঙ্গেলসের চেয়েও বেশী কিছু বলেই মনে হয়। নেলের কাজকে আরও সম্প্রসারিত করার জন্য আরেক যত্ন-নৈতিকতাবাদী ফিওনা রবিনসন যত্নকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মধ্যে প্রয়োগ করেছেন। তিনি মনে করেন, যত্ন-নৈতিকতার নীতিগুলোকে অবলম্বন না করলে পৃথিবী থেকে হানাহানি, দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি দূর করে শান্তি আনা সম্ভব হবে না। তাছাড়া স্যানড্রা বার্তকি, ইভা ফেদের কিটেয়, সারা রুডিক, ভার্জিনিয়া হেল্ড, জোয়ান ট্রোন্টো সহ অনেকেই নারীবাদী নৈতিকতা ও যত্ন-নৈতিকতার নানা দিককে বিশ্লেষণ করছেন। বিগত ত্রিশ বছরে গিলিগানের সূত্রপাত করা যত্ন-নৈতিকতা নিয়ে বহু নারী চিন্তক বিরামহীনভাবে লিখে চলেছেন এবং এই তত্ত্বকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তারা সামাজিক আন্দোলনও গড়ে তুলেছেন।
যত্নবাদীদের প্রধান ধারণাগুলো হচ্ছে যত্ন, সম্পর্ক, সিচুয়েশনাল কন্টেক্সট, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, রেসপন্স, আত্মীয়করণ ইত্যাদি। তাদের মোটিভেশনাল স্টেটমেন্ট হচ্ছে এরকম, "everyone will be responded to and included, that no one will be left alone or hurt"। তারা সবধরনের ডিওন্টোলজিক্যাল নীতিতত্ত্বের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন; কান্টীয় নৈতিকতা, উদারনৈতিকতা, উপযোগবাদ, ইচ্ছাবাদ, বুদ্ধিবাদ ইত্যাদিকে তারা মানবজাতির নিরাপত্তা ও উন্নতির জন্য যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন। অনেক সময় 'যত্ন-নৈতিকতা'র বিপরীত ধারণাকে বুঝোতে 'নীতি-নৈতিকতা'কে ব্যবহার করা হয়, আবার কেউ কেউ বৈপরীত্যটিকে "যত্ন বনাম ন্যায়" বলে থাকেন।
নীচে কিছু তুলনামূলক ধারণা দেয়া গেল যা থেকে যত্ন-নৈতিকতার স্বরূপটি পরিষ্কার হতে পারে।
নীতি-নৈতিকতা | যত্ন-নৈতিকতা |
বিমূর্ত ধারণা | মূর্ত সম্পর্ক |
অহংবাদী | সম্পর্কবাদী |
সার্বিকতা | বিশেষতা |
সার্বজীন নীতি | সিচুয়েশনাল কন্টেক্সট |
স্বাধীনতা | নির্ভরশীলতা |
ন্যায়বিচার/অধিকার | যত্ন/প্রয়োজন |
ডিডাকটিভ | ইনডাকটিভ |
প্রতিষ্ঠা | প্রতিপালন |
আত্মনির্ধারণ | সাড়াদান |
চিন্তা | আবেগ |
মমতা একটি লজিক্যাল ডিডাকশন | মমতা একটি ড্রাইভিং ফোর্স |
মমতা একটি নীতি | মমতা একটি অনুভূতি |
অসমাপ্ত