কেয়ার ফর সেলফি! কেয়ার এবাউট ফেসবুক!

মোনেম অপু
Published : 15 Oct 2014, 07:49 PM
Updated : 15 Oct 2014, 07:49 PM

শিরোনামের বাক্য দুটিতে ছটি পদ—একটি কমোন এবং ভার্ব: 'কেয়ার', দুখানা প্রিপজিশন: 'ফর' ও 'এবাউট', বাকি দুখানা নাউন: 'সেলফি' আর 'ফেসবুক'। কর্ম দুখানেই 'কেয়ার' করা। কিন্তু সেলফির বেলায় ফর আর ফেসবুকের বেলায় এবাউট কেন? কারণ সেলফি কাছের, ফেসবুক দূরের; একটা আমার, আরেকটা ওদের; একটা আমি তুলি, আরেকটা ওরা চালায়। সেলফি তুলতে কত যে মনোযোগ লাগে! কত যে যত্ন লাগে! একবার এ্যামনে পোজ, একবার ওমনে। একবার এ্যামনে দেখি, একবার ওমনে। চোখের চাহনি, মুখের হাসি—সব পছন্দ হলে তবেই না ক্লিক করি। তারপর তুলে দেই ফেসবুকে। ক্যামেরায় নিজের ছবি নিজে তুললেই কি সেটা সেলফি হয়ে যায়? টিপিক্যালি হয় না। অনলাইন অক্সফোর্ড ডিকশনারি selfie'র সংজ্ঞায় লিখেছে, "A photograph that one has taken of oneself, typically one taken with a smartphone or webcam and shared via social media।" কাজে কাজেই তোল ছবি, তুলে দাও ফেসবুকে। তবেই না নিজের তোলা ছবি সেলফি হবে।

জেমেসন নামে এক অস্ট্রেলীয় পণ্ডিতের সাথে আমার কথা হয়েছে বার কয়েক। 'এ'য়ের পরে 'বি' আসে বলে অস্ট্রেলিয়ার পরে আসে বাংলাদেশ। ইংরেজি বর্ণমালার সুবাদে এবং এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে 'এ' বা 'বি' দিয়ে শুরু হওয়া দেশের নামের আকাল থাকায় অস্ট্রেলীয়দের পাশে বসার সুযোগ হয় আমাদের। তিনি ইএম ফ্রিকোয়েন্সি ও রেডিও কম্যুনিকেশন বিষয়ে পারদর্শী। এতোই পারদর্শী যে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের সভা-সেমিনার-ওয়ার্কশপে তাকে প্রায়ই ডেকে আনা হয়। ভদ্রলোক বৃদ্ধ হয়েছেন, কিন্তু ভেঙে পড়েননি। দেখা হতেই ডাক দিলাম, হাই জেমেসন! তিনি খুশিই হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আমার নাম তুমি মনে রেখেছো? বললাম, আমি তোমার নাম সহজে ভুলে যাব না। চোখ দুটো সামান্য কুচকে ঠোঁট দুটোতে আমোদের রেশ মাত্র টেনে জিজ্ঞেস করলেন, কেন? ফ্রেড্‌রিক জ্যামেসন নামে একজন মার্কিন চিন্তাবিদ আছেন যিনি পোস্টমডার্ন ক্রিটিক্যাল চিন্তার বিশেষজ্ঞ ক্রিটিক। অনেকেই জানেন যে, নামে নামে যমে টানে। আবার অনেকেই হেসে কুটি কুটি হয়েছেন খবরের কাগজ পড়ে—নামে এক হওয়ায় আমাদের দুই মন্ত্রীর একের বিয়ের খবরে আরেকের ঘর 'ভাঙে ভাঙে অবস্থা'। কাজেই দুজনের নামের বানানে সামান্য হেরফের থাকলেও উচ্চারণে সাযুজ্যের কারণে জেমেসনের নাম ভুলে যাওয়া এতো সহজ নয়।

আমরা বাঙালীরা সাধারণত 'জ্যাক অব অল ট্রেডস এক্সসেপ্ট পলিটিক্স এন্ড মাস্টার অব নান এক্সসেপ্ট এগেইন পলিটিক্স।' কিন্তু বিদেশীরা সাধারণত 'জ্যাক অব নান বাট মাস্টার অব ওয়ান' হয়ে থাকে। স্বভাবতই জেমেসন নিজ বিষয়ে এত বড় পণ্ডিত হলেও জ্যামেসনের নাম তিনি আগে কখনো শুনেননি বলে জানালেন। শোনা যায় আমেরিকায় এমন অনেক লোকই নাকি আছে যারা তুরান কোথায় ইরান কোথায় তো দূরের কথা নিজ দেশের বর্তমান প্রেসিডেন্টের নামটিও নাকি বলতে পারেনা। তার অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে গিয়ে পোস্টমডার্ন কন্ডিশন, ছবি, সিমুলেশন ইত্যাদি প্রসঙ্গ চলে আসে। এবার তিনি আমাকে তার অভিজ্ঞতার একটি উদাহরণ দিতে লেগে গেলেন; তাজমহল দেখতে গিয়ে তিনি ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন বা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। মানুষেরা যত যত্ন করে ও আগ্রহ ভরে কেবল ছবির পর ছবি তুলছিল, খোদ তাজমহলটির প্রতি তাদের তত যত্ন বা আগ্রহ ছিল না। বললাম, আমার ধারণা এই ছবি হলো সেকেন্ড অর্ডার সিমুলেশন। তাহলে ফার্স্ট অর্ডার কোনটা? উত্তরে বললাম, স্বয়ং তাজমহলটা। তাহলে রিয়াল কোনটা? বললাম, যাদেরকে ঠকিয়ে তাজমহলটা বানানো হয়েছিল তারা, তাদের কষ্ট ও তাদের সাথে করা প্রতারণাটা।

সেলফ নিয়ে ভাবতে গিয়ে বড় বড় রাঘব-বোয়াল রুই-কাতলারা মাথা ঘামাতে ঘামাতে হয়রান। কেউ বলেন সেলফ এই, কেউ বলেন সেলফ সেই; আবার রেগেমেগে কেউ বলেন, আরে ধ্যাৎ! সেলফ বলে কিছু আছে নাকি! যত্তোসব ভূতের খোঁজে সময় নষ্ট! কিন্তু সেলফি আছে, সেলফিই এখন সেলফ—নিজ হাতের ফটো আর অপরের হাতের লাইক দিয়ে গড়া। তাই, আই কেয়ার ফর সেলফি। কিন্তু সেলফির জন্য আমার যত যত্ন লাগে ফেসবুকের জন্য আমার যত্ন তত লাগে না। ফেসবুকে তুলতে না পারলে আবার সেলফিও হয় না। সেলফি তুলতে না পারলে ফেসবুকে কাজ কী? তাই সেলফির 'জন্য' কেয়ারের মতো, ফেসবুক 'সম্বন্ধে'ও কেয়ার লাগে। যদি ফেসবুক সিস্টেম ওয়ালারা সিস্টেম ডাউন করে আবেদন করে, টাকা চাই টাকা চাই, নইলে যে সিস্টেম আপ হচ্ছে না, তবে আমাদের দেয়া টাকা দিয়ে তারা দিব্যি নতুন সিস্টেম বসাতে পারবে। কারণ, উই কেয়ার এবাউট ফেসবুক।

এই 'জন্য' আর 'সম্বন্ধে'র মধ্যে যেমন সম্বন্ধ আছে, তেমনই বিচ্ছিন্নতাও সম্ভব হতে পারে। এই দেখুন, আমরা সবাই পলিটিক্স মাস্টাররা গরীব সম্বন্ধে, শ্রমিক সম্বন্ধে, নারী সম্বন্ধে, শিশু সম্বন্ধে কত চিন্তিত, কত কেয়ারফুল। এই 'সম্বন্ধ'ওয়ালা কেয়ার মগজে, মুখে, কাগজে, ব্লগে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাহাড় হয়ে আকাশে উঁকি দিচ্ছে, ঝুঁকি মারছে। কিন্তু 'জন্য'ওয়ালা কেয়ারের অভাবে পাহাড় সব পাহাড় হয়েই থাকছে—বৃষ্টি-ছাড়া, ঝর্ণা-ছাড়া, নদী-ছাড়া, বাগান-ছাড়া।

সাম্প্রতিক পোস্টসমূহ