স্বীকৃতিহীন নারী-অবদান এবং দীপু মনির ঝাড়ু-পাণি

মোনেম অপু
Published : 26 Oct 2014, 05:48 PM
Updated : 26 Oct 2014, 05:48 PM

আমরা সবাই জানি, আমাদের দেশে গ্রামের নারীরা তো অবশ্যই, এমনকি শহরের নারীরাও সংসারের নানাবিধ কাজ করে থাকেন। চাকুরীজীবী নারীরাও চাকুরীহীন কেবল-গৃহিনীদের মতোই গৃহস্থালি কাজগুলোও করে থাকেন। চাকুরীজীবী নারীদের ক্ষেত্রে এই গৃহস্থালি কাজগুলো থেকে মুক্তি তো দূরের কথা বরং তা সেকেন্ড শিফট হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে সম্পন্ন নারীরা গৃহস্থালি কাজে বেতনের বিনিময়ে অন্যের সাহায্য নেন সেই সহায়তাকারী অন্যরাও নারী। নামমাত্র বেতনে নিয়োজিত গৃহকর্মীদের কাজের হিসাব সরকারের কাছে আছে বলে মনে হয় না। মোট কথা, নারীরা সমস্ত গৃহস্থালি কাজ করে যাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু এই কাজ জাতীয় জিডিপি'র হিসাবে আসছে না। এই গৃহস্থালি কাজগুলোর মধ্যে কেবল যে রান্নাবান্না, ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার মতো কাজগুলোই রয়েছে তা নয়, সন্তান প্রতিপালনের মতো গুরুত্বপূর্ণ নার্সিং কাজটিও এর অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়াও রয়েছে বাড়ীর আশপাশে সবজি চাষের মতো কাজগুলো। গ্রামের নারীরা আরও যে বড় কাজগুলো করেন তার মধ্যে রয়েছে শস্য মাড়ানো, রোদে শুকানোর মতো কাজগুলো। এইসব কাজই ঘরের নারীরা করে থাকেন কোনোরকম পারিশ্রমিক ছাড়াই। এগুলোকে তাদের দানমূলক কাজ হিসেবেই দেখতে হয়। কারণ দেশের আইন-ই হোক বা ইসলাম ধর্মের বিধিমালা অনুসারেই হোক, গৃহস্থালি এসব কাজ করতে নারীরা বাধ্য নন।

দেশের অর্থনীতিতে নারীদের স্বীকৃতিহীন এসব কর্ম ও অবদানের আর্থিক মূল্য নিরূপণের উদ্দেশ্যে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন যৌথভাবে চলতি বছরের মার্চ থেকে মে মাসে একটি জরিপ সম্পাদন করেছে। জরিপে দেশের ৭টি বিভাগে ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের মোট ১৩ হাজার ৬৪০ জন ব্যক্তির কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়, যাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ৮ হাজার ৩২০ জন এবং পুরুষের সংখ্যা ৫ হাজার ৩২০ জন; এবং সম্পৃক্ত পরিবারের সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৬৭০টি। সিপিডির দাবী, জরিপটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি অনুসরণ করেই সম্পন্ন করা হয়েছে। একাজে তারা গবেষক, শিক্ষক, পরিসংখ্যানবিদ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সহযোগিতাও নিয়েছে বলে জানিয়েছে। গত শনিবার রাজধানীর গুলশানে আমারি হোটেলে আনুষ্ঠানিকভাবে "জাতীয় অর্থনীতিতে নারীদের অবদান নিরূপণ: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত" শীর্ষক এই জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয় ও তার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়।

এ গবেষণায় দেখা যায়, নারীদের এসব কাজের আর্থিক মূল্য ১১ লক্ষ কোটি টাকারও উপরে, যা বিস্ময়করভাবে জিডিপি'র ৮৭ শতাংশ। অথচ জাতীয় অর্থনীতিতে এই অবদান আর্থিক মূল্য হিসেবে বিবেচনায় আসে না। নারীরা ঘরোয়া ও গৃহস্থালি দৈনন্দিন কাজগুলো করার মাধ্যমে আমাদের জীবনে যে অবদান রাখছেন তার আর্থিক মূল্য মোট দেশীয় উৎপাদন বা জিডিপিতে যুক্ত হওয়ার সুযোগও নেই—বিষয়টি অর্থনীতিতে বিশ্বে একাডেমিকভাবে স্বীকৃতও নয়। তবে সিপিডি নারীদের অবদানকে জিডিপি'র সাথে তুলনা করার মাধ্যমে বিষয়গতভাবে তুলে ধরার জন্য এই জরিপ পরিচালনা করে আন্তরিক ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ যে করেছে তাতে সন্দেহ নেই। জরিপে দেখা যায়, ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের একজন নারী গড়ে প্রতিদিন একজন পুরুষের তুলনায় প্রায় তিনগুণ সময় কাজে নিয়োজিত থাকে। যে ধরনের কাজে একজন নারী দৈনিক গড়ে সাড়ে সাত ঘণ্টারও বেশী সময় ব্যয় করেন, সে ধরনের কাজে একজন পুরুষ গড়ে মাত্র আড়াই ঘণ্টা সময় ব্যয় করে থাকেন। সংসারে নারীরা মোট ১২ ধরনের কাজ করেন আর পুরুষরা করেন মাত্র ৩ ধরণের কাজ।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন যে, জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর কাজের অবমূল্যায়ন করা হয়। সিপিডি'র এই জরিপ-ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে তিনি আরও বলেছেন, "আমার স্ত্রী যদি ঘরে একটি কেক বানায়, সেটির আর্থিক মূল্য জিডিপিতে যোগ হয় না। অথচ আমি যখন দোকান থেকে একই কেক কিনি, সেটির আর্থিক মূল্য জিডিপিতে যোগ হয়।" সিপিডি'র দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, যেহেতু নারীর কাজকে অর্থনৈতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি সেহেতু তার কাজ আনপেইড রয়ে গেছে; এসব কাজ অর্থনীতিতে পরিমাপ করা হয়নি; শেষ পর্যন্ত যা অদৃশ্যই থেকে যায়। তিনি আরও বলেছেন, "নারীদের এ অ-অর্থনৈতিক কাজের স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে নারীর ক্ষমতায়ন সুদৃঢ় হবে এবং সমাজব্যবস্থা সামাজিক ন্যায্যতার ওপর দাঁড়াবে।"

নারীদের কাজের মূল্যায়ন ও প্রতিদান কিভাবে সম্ভব? আমরা পুরুষরা আমাদের মানসিকতাকে বদলাতে পারি। নারীদের এই অবদানের বিপরীতে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে পারি, তাদের প্রতি সম্মানবোধ বজায় রাখতে পারি এবং তাদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে অহমিকা পরিহার করে চলতে পারি। অথচ আমরা পুরুষরা সনাতন কাল থেকে মনে করে আসছি যে, এসব কাজ তুচ্ছ এবং এসব কাজের তুচ্ছতা থেকে নারীকে অসম্মান করার যুক্তিও খুঁজে নিয়েছি।

অন্যদিকে, কালের কণ্ঠ পত্রিকা অনুসারে, গত শনিবার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি চাঁদপুর মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলের প্রথম নবীনবরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তৃতা দেবার সময় বলেছেন, "বর্তমান যুগে নারীরা ঘরে বসে না থেকে সবকিছুই শেখেন। আর ছেলেরা ঘরের কিছু ধরে না। এমনকি নিজের ঘরও যদি ঝাড়ু দিতে বলা হয়, তাদের পৌরুষে লাগে। ঝাড়ু দেওয়াটা তাদের কাজ না। তাই আমি মাঝে মাঝে কৌতুক করে বলি, বাংলাদেশের পুরুষ মানুষ শুধু ঝাড়ু ধরেন বউ পেটানোর সময়। এ ছাড়া তাঁরা ঝাড়ু ধরেন না।"

দীপু মনি তাঁর কথার মধ্যেই প্রকাশ করেছেন যে, তাঁর এই ঝাড়ু-পাণি সংক্রান্ত অভিযোগটি আলংকারিক বা রূপকধর্মী; আক্ষরিক নয়। তিনি অভিমানী পুরুষের অহমিকায় সরাসরি আঘাত করতে চাননি বিধায় রূপকাশ্রয়ীভাবে কথাটি বলে থাকলেও তাঁর কথার মধ্যে যে একটি সত্য বা বাস্তবতা রয়েছে তা আমাদেরকে মানতেই হয়। এখনও আমাদের পুরুষসমাজে আমরা অনেকই হাঁড়িপাতিল ধোয়া, ঘর মোছা, ঘর ঝাড়ু দেয়ার মতো কাজগুলো তুচ্ছ কাজ বলে মনে করি। এমনকি অনেক স্ত্রীও তার স্বামীকে ঝাড়ু হাতে নিতে দিতে চান না। আবার দীপু মনির উপমাটির মধ্য থেকে আমরা আরও তাৎপর্য বের করতে পারি। আমরা কোনো ধর্মগ্রন্থ পাঠরত কাউকে তার হাতের গ্রন্থটি দিয়ে আঘাত করি না। কারণ ধর্মগ্রন্থটিকে আমরা সমীহ করে থাকি, ধর্মগ্রন্থপাঠকে একটি মূল্যবান কাজ হিসেবে দেখি। কিন্তু যখন কোনো নারীর হাত থেকে তার ঝাড়ুটি কেড়ে নিয়ে খোদ তাকেই আঘাত করি তখন আমরা নারীকে, কাজকে ও কাজের হাতিয়ারকে একসাথে আঘাত করি, অবমূল্যায়ন করি, অবমাননা করি।

আমরা পুরুষরা গৃহস্থালি কাজকর্মে আরও বেশী করে সম্পৃক্ত হতে পারি। ঘর ঝাড়ু দেয়া, হাঁড়িপাতিল ধুয়ে দেয়ার মতো পরিশ্রমের কাজগুলো করার ভার বহনে আমরা অংশীদার হতে পারি। এতে নারীদের কর্মভার লাঘব হবে। জাতীয় আয়ে অপ্রদর্শিত অবদানে অংশহীন হওয়ার কলঙ্ক দূর হবে।

[ব্যবহৃত সংবাদ, উপাত্ত ও উদ্ধৃতির জন্য কালের কণ্ঠ পত্রিকার সাংবাদিকের নিকট লেখক কৃতজ্ঞ]