সম্পর্কগত আত্মসত্ত্বা (relational self)
যত্নপ্রবাহী সম্পর্ক যত্ন-নৈতিকতাবাদীদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নেল নোডিংসের মতে, অহম বা আত্মসত্ত্বা কোনো দ্রব্য নয়, ইচ্ছা, চিন্তা ইত্যাদির মতো কোনো মানসিক কিছুও নয়—ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি দিয়েও এটিকে পর্যাপ্তভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। বরং অহম হচ্ছে সম্পর্ক থেকে উদ্ভূত কিছু—ব্যক্তির অন্যদের মুখোমুখি হওয়া ও সাড়াদান থেকে অভিব্যক্ত হওয়া কিছু। বহুকাল ধরেই আত্মসত্ত্বার প্রকৃতি (nature of the self) ও ব্যক্তির অভিন্নতা-সমস্যা (problem of identity) নিয়ে দার্শনিকদের কৌতূহলের শেষ নেই। কিন্তু তাদের কাছে সত্ত্বা মূলত হয় বস্তুগত নয়তো ভাবগত একটা কিছু। কিন্তু নেলের মতে, সত্ত্বা আসলে সম্পর্ক জালের গ্রন্থির ধারক। প্রত্যেকটি সত্ত্বা অন্য সত্ত্বাদের সাথে সম্পর্কিত ও প্রত্যেকে অন্যদের উপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতাই হচ্ছে সত্ত্বার ভিতগত কন্ডিশন। সত্ত্বার বিকাশ পারস্পরিক যত্নের উপর নির্ভরশীল। সেমতে যত্ন হয়ে দাঁড়ায় একই সাথে আত্মসত্ত্বার বিকাশের ও অন্যদের প্রতি নৈতিক কর্তব্যের মূল নীতি।
নেল নোডিংসের কাছে শৈশব, অন্যান্য মানুষেরা, ঘর, এলাকা, বাসস্থানের প্রতি মানুষের ভালবাসা-আকর্ষণ, স্থানের সাথে একজনের পরিচয়ের সম্পর্ক-সংযোগ ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্ব ব্যক্তির আত্মসত্ত্বা তৈরির সাথে সম্পর্কিত এবং সম্পর্কিত শিক্ষার সাথেও। অন্য দেহ, অন্য সত্ত্বার সাথে আমাদের সাক্ষাত ঘটে স্থানে। নেল মনে করেন, শৈশবে পিতা-মাতা, ভাই-বোন, পড়শি, শিক্ষক, সহপাঠীদের সাথে নিত্য সাক্ষাৎ মিথোস্ক্রিয়া (encounter) হওয়া এবং তাদের সাথে সম্পর্ককে আবিষ্কার করার মধ্য দিয়েই শিশুর আত্মসত্ত্বা, আত্মচেতনা গড়ে উঠতে থাকে। ঘর (home) হচেছ অনুবিশ্ব—মানুষের প্রথম বিশ্ব, প্রথম শিক্ষালয়। একজনের বসবাসের স্থান তার পরিচয়কে একটি আকার দিয়ে থাকে। ঘর ছেড়ে গেলে আমরা যেমন হোম-সিকনেসে ভুগি, তেমনই স্থান ছেড়ে গেলে গুরুতরভাবে পরিচয়-সংকটেও ভুগি। নেলের আত্মসত্ত্বা হচ্ছে সম্পর্কমূলক আত্মসত্ত্বা বা relational/dependent self—যা free/autonomus self থেকে ভিন্ন। স্বাধীন সত্ত্বারা প্রত্যেকে এক একটি একক সত্ত্বা; কিন্তু নির্ভরশীল/সম্পর্কিত সত্ত্বারা একের পর এক আবির্ভূত হয়, বিকশিত হয় ও টিকে থাকে সম্পর্ক ও পারস্পরিক যত্নের মধ্য দিয়ে। নেলের মত মেনে নিলে বলতে হয় যে, আত্মসত্ত্বা কোনো দ্রব্য (substance) নয়, বরং সম্পর্ক। নেল সম্পর্কের বিস্তারকে কোনোভাবেই সংকুচিত করার পক্ষপাতী নন; আমরা বলতে পারি সম্পর্কের সংকোচন সম্পর্ক ছিন্নকরণেরই নামান্তর। তিনি উদারনৈতিকদের এবং এমনকি কমিউনিটারিয়ানদের আত্মসত্ত্বা সম্বন্ধীয় ধারণাকে বিপদজনক বলে আখ্যায়িত করেছেন। উদারনৈতিকদের আত্মসত্ত্বা স্বাধীন একক সত্ত্বা; এবং কমিউনিটারিয়ানদের আত্মসত্ত্বার ধারণায় অন্যদের সাথে "সংযোগ" (connection, not relation) থাকলেও তা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী ইত্যাদি ভিত্তিক সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
অরিজিনাল কন্ডিশন
সম্পর্কগত সত্ত্বার বিকাশের সূচনা হয় গর্ভ থেকে; আর এটিই হচ্ছে প্রত্যেকটি মানুষের উৎস বা অরিজিন। মানুষের এই আদি, উৎসগত, মূল অবস্থা—তথা অরিজিনাল কন্ডিশন—হচ্ছে পরিপূর্ণ নির্ভরশীলতা। নেলের মতে, যে জায়গাটি মানব সত্ত্বার অরিজিনাল কন্ডিশনের সাথে অন্বিত বা যুক্ত তা হচ্ছে ঘর অর্থাৎ পরিবারের বাসস্থান। ঘর কোনো নিবাস-কেন্দ্র মাত্র নয়, কোনো ডাইনিং-মেস মাত্র নয়—বরং সবচেয়ে কার্যকর নৈতিক শিক্ষালয় ও জীবন বিকাশের মূল ভূমিও। পরিবার হচ্ছে মৌলিক প্রাকৃতিক সংগঠন—যেখানে আমরা মমতাকে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হিসেবে পাই, যেখানে আমরা জীবনের পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে দেখতে পাই, এবং যেখানে আমরা যত্ন শিখতে পারি ও যত্নদক্ষতাকে প্রয়োগ করতে পারি। ঘরই একাধারে আমাদের বাসস্থান এবং সেই কেন্দ্র যেখান থেকে আমরা বাইরের পৃথিবীতে আমাদের সব অভিযান, সব উদ্যোগে অংশ নিতে গিয়ে থাকি। হাইডেগার বলেন, একটি উত্তম ঘরের অধিবাসী শিশু একটি উত্তম বিশ্ব-ভ্রমণকারী, তথা বিশ্ববাসী। ঘরেই আমাদের মধ্যে স্ফুরিত হয় যত্নের মনোভাব, প্রবণতা এবং এখানেই আমরা শিক্ষা ও চর্চার মাধ্যমে বাড়াতে পারি যত্নদক্ষতা, যার প্রভাব পড়ে ঘরের বাইরে, বিশ্বসংসারে। নেল মাতৃত্বের প্রেক্ষিত থেকেই ধারণাগতভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, যত্নের সম্পর্কই মানব অস্তিত্ব ও চৈতন্যের বনিয়াদ।
নেল যত্নের ক্ষেত্রে অরিজিনাল কন্ডিশনের ধারণাকে এনেছেন ও এর স্বরূপ এঁকেছেন জন রলসের অরিজিনাল পজিশন এর ধারণার বিপরীতে। রলসের অরিজিনাল পজিশন একটি কল্পিত আদি অবস্থা যেখানে ব্যক্তিরা কোনোরূপ বৈষম্য ছাড়াই সমরূপ অবস্থায় বিরাজ করে ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সকলে সমভাবে অজ্ঞ অবস্থায় থাকে। অজ্ঞতার চাদরে আবৃত সাম্যাবস্থায় বিদ্যমান এই ব্যক্তিদের পক্ষে ন্যায়ের নীতি সম্বন্ধে সর্বসম্মতভাবে যেসব যৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব সেগুলোকে রলস মনে করেন প্রকৃত ন্যায়নীতি বা নিষ্পক্ষ সমদর্শী ফেয়ার নীতি। অন্যদিকে, নোডিংস মানব শিশুর পরিপূর্ণ নির্ভরশীলতার অরিজিনাল কন্ডিশনকে যত্ন সম্বন্ধীয় নীতিগুলোর সন্ধানে ও যত্নের স্বরূপ চিত্রণে ব্যবহার করতে চান। রলস যেখানে কথিত আদি সমদর্শিতা থেকে ন্যায্যতার অভিমুখে যেতে চান, নোডিংস সেখানে মূর্ত নির্ভরশীলতা থেকে নির্ভরশীলের প্রয়োজনকে চিহ্নিত করে যত্নের অভিমুখে যেতে চান। এবং একইসাথে এই প্রয়োজন থেকে নিরূপিত যত্নমূলক সেবাপ্রাপ্তিকে তিনি নির্ভরশীলের অধিকার হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন।
যত্নের লক্ষ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে যত্নের ধারাবাহিকতা
যত্নের লক্ষ্য কী? এর একটি উত্তর হতে পারে, যত্ন-গ্রহীতার বর্ধন-বিকাশ, সে যেন নিজেই সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। নেল এরকম লক্ষ্যের সাথে পুরোপুরি একমত নন। তিনি মনে করেন, অন্যের সাথে এমন সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎ সম্ভব যেখানে এমন সুবিশাল উদ্দেশ্যের সম্পর্ক নেই। তবে তিনি এও মনে করেন যে, দীর্ঘ মেয়াদী সম্পর্কের ক্ষেত্রে (এমনকি বছরখানেকের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও) বর্ধন-বিকাশ যত্নের উদ্দেশ্য হতে পারে। প্রসঙ্গক্রমে তিনি সারা রুডিকের তিনটি মাতৃগত আগ্রহের কথা উল্লেখ করেন: শিশুর জীবন সংরক্ষণ, তার বিকাশ-বর্ধন সাধন এবং তাকে একটি গ্রহণযোগ্য শিশুতে রূপান্তরিত করা। সারার মতে, এই তিনটি উদ্দেশ্য স্বয়ং শিশুটিরই চাহিদা। কিন্তু নেলের সাধারণ দাবী হচ্ছে, যত্নের উদ্দেশ্য নির্ধারিত হয় ও বদলায় অবস্থা ও গ্রহীতার উপর ভিত্তি করে। একই পরিবারের ভিন্ন ভিন্ন সদস্য বা একই ক্লাসের ভিন্ন ভিন্ন ছাত্রের জন্য বিভিন্ন মাত্রার যত্নমূলক মনোযোগ এবং ভিন্ন ভিন্ন যত্নকাজ দরকারি হয়ে থাকে। কাজেই যত্নের ক্ষেত্রে মনোযোগ প্রথম নিবদ্ধ হয় যত্ন-গ্রহীতা এবং গ্রহীতা ও প্রদাতার সম্পর্কের প্রতি। তাই সংরক্ষণ, বর্ধন ও গ্রহণযোগ্যকরণ যত্নের কোনো স্থিরীকৃত আদর্শ নয়। সম্পর্কের (relation) সাথে সাথে নেল সংযোগের (connection) বিষয়টিও এনেছেন। যত্নের সাথে সম্পৃক্ত পুণ্য (virtue) বলে বিবেচিত চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্যগুলো থেকেও প্রকৃত যত্নকে আলাদা করেছেন। এটি অসম্ভব নয় যে, একজন যত্নের সাথে সম্পৃক্ত পুণ্যগুলো চর্চা করছেন, গ্রহীতার সাথে কোনোরকম সংযোগ ছাড়াই। তিনি আরও বলেন, অতীত যত্নের স্মৃতিও বর্তমান যত্নের উপর প্রভাব ফেলে। তবে দীর্ঘ মেয়াদী যত্নের ক্ষেত্রেও তিনি যত্ন-গ্রহীতাদেরকে একটি সমাহারে সমরূপ একক হিসেবে দেখতে চান না।
ক্ষতি (harm)
যত্নের প্রথম মৌলিক লক্ষ্য হচ্ছে, যার সাথেই আমাদের সাক্ষাৎ হয়, যার সাথেই আমরা কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কিত তার ক্ষতি সাধন না করা, ক্ষতিকে প্রতিহত করা, ক্ষতির উৎসগুলোকে সাধ্যমতো ধারাবাহিকভাবে বিদূরিত করা। সকলেই এ বিষয়ে একমত যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও করণীয় কাজ। উদারনৈতিকরাসহ সকলেই অন্য ব্যক্তির ক্ষতি সাধনের প্রচেষ্টা থেকে প্রচেষ্টাকারী ব্যক্তিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শক্তিসহ প্রতিরোধের প্রয়োজনকে স্বীকার করে থাকেন। তবে উদারনৈতিকরা আত্মহত্যার মতো চরম কাজটি ছাড়া অন্য সব কাজে ব্যক্তি কর্তৃক নিজের ক্ষতি করার অধিকারকে স্বীকার করে থাকেন। কিন্তু নেল নোডিংসের মতে, যত্নতত্ত্বে স্ব-আরোপিত ক্ষতি থেকে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির নিজেকে রক্ষা করার বিষয়টিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। এই শেষের বিষয়টি যত্নবাদীদের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং এবং স্পর্শকাতর, যদি তা সামাজিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তবে তাদের কথা হচ্ছে, যথাযথ যত্নের অভাব, সম্পর্কে শিথিলতা ইত্যাদি দূর করা গেলে, এবং যত্নকেন্দ্রীক শিক্ষা ও সামাজিক পলিসি গ্রহণ করা গেলে ব্যক্তির স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করেও অবস্থার উন্নতি সাধন সম্ভব।
প্রয়োজন (need) ও অধিকার (right)
আমরা যখন কারও যত্ন নিতে চাই তখন ইতিবাচক বা গঠনমূলকভাবে তার প্রয়োজন পূরণে সাড়া প্রদান করি। নেল নোডিংস প্রয়োজনের সাথে অধিকারের ধারণাটিকে যুক্ত করেছেন। সাধারণত অধিকারকে দেখা হয় প্রয়োজন-নিরপেক্ষ কিছু হিসেবে। কিন্তু নেল দাবী করেছেন, অধিকার উদ্ভূত হয় প্রয়োজন থেকে। কারও জন্য যদি কোনোকিছু প্রয়োজনীয় বলে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়, অন্যদের পক্ষে তাকে তা দেয়া সম্ভবপর হয়, অন্যেরা এই প্রয়োজনকে অনুমোদন করে, ও এই প্রয়োজন পূরণকে কর্তব্য জ্ঞান করে, তবে একটি অধিকার প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কারও যদি কোনো বিশেষ একটি কিছুর প্রয়োজন না থাকে তবে সেটির জন্য তার দাবী একটি দুর্বল দাবী। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পিতা-মাতা ও তাদের সন্তানদের প্রয়োজন এক নয়, কাজেই সন্তানদের কাছ থেকে প্রাপ্য পিতা-মাতার অধিকারের সেট এবং পিতা-মাতার কাছ থেকে প্রাপ্য সন্তানদের অধিকারের সেট এক হয় না। কাজেই অধিকারের সমতা বলতে অধিকারের একরূপতা নয়, প্রয়োজনানুগ সমরূপতাকে বুঝায়। প্রয়োজনের সাথে সম্পর্কিত নেলের এই অধিকারের ধারণার মধ্যে যুক্তি থাকলেও এর ন্যায্য বাস্তবায়নে গুরুতর সমস্যাও রয়েছে। প্রয়োজন কিভাবে নির্ধারিত হবে, অধিকারে সমতা কিসের ভিত্তিতে মূল্যায়িত হবে?—এই সমস্যাগুলোর সমাধান আমাদের জন্য একটি কঠিন কাজই বটে।
অসমাপ্ত