হি-ফর-শি প্রচারাভিযান এবং একশনএইড’য়ের জরিপ

মোনেম অপু
Published : 15 Nov 2014, 03:40 PM
Updated : 15 Nov 2014, 03:40 PM
বিশ্বব্যাপী জেন্ডার সমতা সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি ও সমতা প্রসারের লক্ষ্যে হি-ফর-শি (HeForShe) নামে একটি প্রচারাভিযান ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি সামাজিক মাধ্যমে অধুনা জোরেশোরে পরিচালিত হচ্ছে। এর সূচনা হয়েছে জাতিসংঘে এমা ওয়াটসনের দেয়া একটি বক্তৃতা থেকে। গত ২০ সেপ্টেম্বর এমা নিউইয়র্কস্থ জাতিসংঘের সদরদপ্তরে একটি ভাষণ দেন। হ্যারি পোটার সিনেমার অভিনেত্রী এমা ওয়াটসন জাতিসংঘের ইউ.এন উইমেন গুড-উইল এম্বাসেডর। তার বক্তৃতাটি থেকেই সোশাল মিডিয়ায় এই ঝড়ের সূত্রপাত। তার প্রধানতম বার্তাটিই ছিল, শুধু নারী নয় বরং জেন্ডার সমতা বাস্তবায়িত করতে নারী ও পুরুষ উভয়য়েরই ভূমিকা আবশ্যক। ভাষণে তিনি এই উদ্দেশ্যে নিজেদেরকে নিয়োজিত করতে পুরুষদেরকে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণও জানান। ইউ.এন উইমেন বিশ্বের এক লক্ষ পুরুষকে এগিয়ে আসার অহ্বান করেছিল, যে লক্ষ্য মাত্র তিন দিনেই অর্জিত হয়। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন প্রথম পুরুষ যিনি অন-লাইন শপথ গ্রহণ করেন এবং আন্দোলনে যোগ দেন। বাংলাদেশীদের মধ্যেও কেউ কেউ এ নিয়ে কাজ করছেন। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক'য়ের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদ সংস্থাটির ফেসবুক পাতায় 'HeForShe' লেখা প্ল্যাকার্ড তুলে ধরা নিজের ছবি পোস্ট করে প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন।
 
জেন্ডার সমতার উদ্দেশ্যে প্রচারাভিযানটিকে প্রথমে দেখা হয়েছিল নারীদের জন্য নারীদের সংগ্রাম হিসেবে। কিন্তু অধুনা পুরুষরাও এই অসাম্য ও বৈষম্যমূলক পার্থক্যকরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন; পুরুষ ও ছেলেরা নারী ও মেয়েদের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে। এখন দরকার সমবেত প্রচেষ্টা, প্রচেষ্টাসমূহের সমবেতকরণ। হি-ফর-শি একটি সংহতি আন্দোলনের রূপ নিয়েছে, যা মানবসমাজের অর্ধেককে অন্য অর্ধেকের সমর্থনে এগিয়ে আনতে চায় আমাদের সকলের মঙ্গলের জন্য। জেন্ডার সমতা, নারীর নিরাপত্তা কেবল নারী বিষয়ক বিষয় নয়, এটি সার্বজনীন মানবাধিকারের বিষয়ও। ফলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের প্রত্যেক পুরুষ ও ছেলের দায়িত্ব প্রত্যেক নারী ও মেয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নারীর প্রতি সহিংসতা ও অসমতার অবসান করার লক্ষ্যে সচেষ্ট হওয়া।
 
কিন্তু ফেসবুকে লাইক আইকনে ক্লিক করা বা স্ট্যাটাস দেয়া বা ছবি আপলোড করা বা একখানা ব্লগ পোস্ট করা আর বাস্তব জীবনে সত্যিই নারীদেরকে সমীহ করা এক কথা নয়। প্রতিদিন স্কুলে-অফিসে, হাটে-বাজারে, পথে-বাসে যখন নারীদের বা মেয়েদের সাথে আমাদের দেখা হয় তখন তারা আমাদের উপর আস্থা রাখতে পারেন কি? নাকি আমাদের আচরণ বা প্রবণতা তাদেরকে আরও সংশয়ী ও সতর্ক করে তোলে? তাই বিচার করে দেখতে হবে আমাদের নিজেদের বাস্তব কর্মকাণ্ডকে, মনের গতিবিধিকে। আমদের মা বা বোন বা স্ত্রী যদি রান্নার সময় ভুলে লবণ বেশী দিয়ে ফেলেন তবে কি আমরা ক্ষুণ্ণ হই? নাকি মা. বোন বা স্ত্রী অত্যধিক লবণযুক্ত খাবার কিভাবে খাবেন তা নিয়ে চিন্তিত হই এবং ভাল খাবার যোগার করার চেষ্টা করি? রান্না করাকে নারীর কর্তব্য বলে মনে করা হয়? নাকি তাদের জন্য প্রস্তুত-খাবারের সমুদয় ব্যবস্থার দায়িত্ব পুরুষ হিসেবে আমাদের নিজেদের বলে জ্ঞান করা হয়?
 
এদিকে গত মাসের শেষের দিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের 'নিরাপদ নগর কর্মসূচি' বিষয়ক একটি জরিপ করে তার ফল প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের দুজন গবেষক এ জরিপে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল শহরের ৪০০ নারী ও কিশোরী (১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী) এবং ৪০০ পুরুষের (২০০ জনের বয়স ১৮ বছরের কম) সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। উত্তরদাতাদের ৪৮০ জন দরিদ্র শ্রেণির, ৪৮০ জন মধ্যম আয়ের এবং ২৪০ জন উচ্চ আয়ের। জরিপে দেখা যায়, দেশে নারীরা নগরগুলোকে তাদের জন্য নিরাপদ বলে মনে করেন না। ফুটপাথ, দোকান, গণপরিবহণ, স্টেশন, পার্ক সর্বত্রই তারা নানাভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সহযাত্রী-কন্ডাক্টর, ক্রেতা-বিক্রেতা সকলেই হয়রানিকারীর তালিকায় রয়েছে। অশ্লীল কথা, ভঙ্গি, ছবি প্রদর্শন, গায়ে ধাক্কা দেয়া, আগ্রাসী ভঙ্গিতে কাছে আসা ইত্যাদি সবই যৌন হয়রানিমূলক কাজ হিসেবে ধরেছেন গবেষকরা। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, জরিপে অংশ নেয়া ৮৫% নারী মর্যাদাহানিকর উক্তির শিকার হয়েছেন, ৪৬% যৌনতাপূর্ণ অশ্লীল ভাষার মুখোমুখি হয়েছেন, আর ৪৮% বাসের চালক বা কন্ডাক্টরের মুখ থেকে অবমাননাকর ভাষা শুনেছেন। ৮৮% নারীর অভিযোগ, বাজার ও বিপণিবিতানগুলোতে সাধারণ পুরুষেরাও নারীদের উদ্দেশে অশ্লীল কথা বলেন। ৮৫% নারী ও ৭৭% পুরুষ বলেছেন, নারী সবচে বেশী হয়রানির শিকার হন রাস্তায় ও ফুটপাতে।যৌন হয়রানির প্রাত্যহিক এই ঘটনাগুলো অন্যদের অজানাই থেকে যায়। অনেক নারী বা তার পরিবার কারও কাছে অভিযোগ করতে চান না এবং করেনও না—তারা ভয় পান অথবা নিষ্ফল হবে আশঙ্কায় অভিযোগ করাকে নিরর্থক মনে করেন। জনসমক্ষে যৌন হয়রানির শিকার হয়েও নারীরা পুলিশের কাছে যেতে অনেক ক্ষেত্রেই আগ্রহী হন না। ৮১% উত্তরদাতা বলেছেন, তারা পুলিশের সহায়তা নিতে দ্বিধাগ্রস্ত। এদের ৯৫% পুলিশকে ঘটনা জানালে সমস্যা বাড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তবে হয়রানি থেকে বাঁচার জন্য কৌশল হিসেবে নারীরা কিভাবে তাদের স্বাধীনতাকে স্বেচ্ছায় বিসর্জন দিচ্ছেন তার করুণ চিত্রটিও জরিপে উঠে এসেছে। নিচে তার হিসাব দেয়া গেল।

যৌন হয়রানি এড়াতে নারীর কৌশল
রাতে ঘরের বাইরে যেতে চান না ৬২%
একা ঘরের বাইরে যেতে চান না ৬০%
নির্দিষ্ট এলাকা এড়িয়ে চলেন ৪৭%
জনবহুল ও নির্জন স্থান এড়িয়ে চলেন ২৩% ও ২৬%
গণপরিবহন ব্যবহার করা বন্ধ করেছেন ১৩%
রঙিন পোশাক পরা ছেড়ে দিয়েছেন ২১%
আত্মরক্ষায় অস্ত্র বা যন্ত্রপাতি সঙ্গে রাখেন ৩%


[জরিপের তথ্য-উপাত্ত ও ভাষা প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত সাংবাদিক শিশির মোড়লের প্রতিবেদন থেকে নেয়া। এজন্য লেখক তাঁর নিকট কৃতজ্ঞ।]