নারীবাদী যত্ন নৈতিকতা—৭ম অংশ
দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ জন ডিউঈ মানুষকে সামাজিক প্রাণী ও পরস্পরের সাথে যোগাযোগে আগ্রহী হিসেবে দেখেছেন এবং এই পর্যবেক্ষণকে ভিত্তি হিসেবে নিয়ে তার শিক্ষা-দর্শন তৈরি করেছেন। নেল নোডিংস একধাপ এগিয়ে বলছেন, মানুষ অস্তিত্বে আসে যত্নের মধ্য দিয়ে এবং সমস্ত জীবন ধরেই সে যত্ন পাওয়ার বাসনা লালন করে। মানুষের জন্মের সাথে সম্পর্কের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে—মানুষ সম্পর্ক নিয়েই জন্মায়; এবং সর্বত্রই সব মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই ইতিবাচকভাবে সম্পর্ককে বজায় রাখতে ইচ্ছুক। যত্ন ও সম্পর্ক বিষয়ক এই বাস্তবতা এবং এই বাসনার সার্বজনীনতা থেকেই যত্নবান হওয়ার ও সম্পর্ক বজায় রাখা সম্বন্ধীয় ঔচিত্যবোধের উন্মেষ ঘটে। যত্ন-সম্পৃক্ত এই ঔচিত্য ধারণাই নৈতিকতার সবচেয়ে মৌলিক ও ভিতগত ঔচিত্য ধারণা। নেল এই যত্ন-নৈতিকতাকে বাড়ি, বিদ্যালয় ও কর্মক্ষেত্র—সর্বত্রই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষার উপাদান হিসেবে বাস্তবে প্রয়োগ করারও জোর সুপারিশ করেন। কিন্তু এরিস্টটল, কান্ট, মিল, ডিউঈ বা নীটশের দর্শনের মতো নেলের কারিকুলাম কেবল চিন্তা ও মননের মধ্যে, ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডের সাফল্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি তত্ত্বজ্ঞানের চেয়ে বাস্তব সামাজিক শিক্ষণের উপরই বেশী জোর দিয়েছেন। এই শিক্ষণকেও তিনি দুভাগে বিভক্ত করেছেন। মমতা ও পরার্থপরতার সমর্থক আমরা সাধারণেরা যত্ন দিতে পারার শিক্ষাকেই যত্নশিক্ষা বলে চট করে ধারণা করে থাকি এবং আমাদের করা অযত্নমূলক কাজকেই সমস্যা বলে মনে করে থাকি। কিন্তু এটি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক—নেলের মতে, যত্ন দিতে যেমন শিখতে হয়, তেমনই যত্ন নিতেও শিক্ষণের আবশ্যকতা রয়েছে।
যত্ন শিক্ষণ একটি ব্যাপক ডেভেলপমেন্টাল টাস্ক। যত্ন-শিক্ষণের গুরুত্ব উপস্থাপন করতে গিয়ে নেল বলেন, জীবনের নানা ক্ষেত্রে—দার্শনিক চিন্তন ও লিখন, শিল্প-সাহিত্য, ব্যবসা, চাকুরী, ক্রীড়া, নাটক-সিনেমা, সাইবার দুনিয়া ইত্যাদি—বিপুল সাফল্য অর্জনকারীদের মধ্যে এমন অনেকেই রয়েছেন যারা মানুষের যত্নকাজে নিদারুণভাবে অক্ষম থেকে গিয়েছেন। আমরা জানি, উইটগেনস্টাইন মানবজাতির ভালর ভাবনায় সার্বিকভাবে নিষ্ঠাবান ছিলেন; মানুষের যন্ত্রণা ও কষ্টের কারণে গভীরভাবে চিন্তিতও ছিলেন। কিন্তু তিনি নিজ সম্বন্ধে—নেল তার বইতে উল্লেখ করেন—নিজেই বলেছেন যে, তিনি মমতা চান বটে, কিন্তু দিতে অক্ষম। প্রসঙ্গত বলা যায়, মমতার প্রচারক অনেক পুরুষই অন্তরে মমতা অনুভব করেন না; মমতাকে তারা একটি চিন্তা ও নীতির মধ্যেই মাত্র জানেন। যত্নকে অনেক সময় দাদাগিরি বলে মনে হয়, স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে ভাণ বলে মনে হয়, উপর্যুপরি আঘাতের ও তীব্র শোষণের পর প্রলেপ দান বলে মনে হয়; আবার অনেকেই হতাশ হয়ে বলে ওঠেন, স্বার্থপর এই দুনিয়ায় যত্নের আশা দুরাশা মাত্র। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই যত্ন পাওয়া, যত্ন দেয়ার পূর্বপ্রয়োজন। তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে: অনেক অবহেলিত, অনাথ শিশু নিজের ভেতর থেকেই যত্নবীর হিসেবে আবির্ভূত হয়; আবার অনেককেই প্রচুর যত্ন পেয়েও কারও যত্ন নিতে দেখা যায় না। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, শিক্ষকরা তাদের যত্ন নেন না। এসবই যত্ন দিতে ও নিতে না শেখার ফল।
নেল আরও বলেন, আমাদের সমাজের একটি বড় বৈলক্ষণ্য হচ্ছে ভায়োল্যান্স ও এলিয়েনেশন। হিংসা ও বিচ্ছিন্নতাবোধ দ্বারা কেবল যে প্রাপ্তবয়স্করাই আক্রান্ত হচ্ছেন তা নয়—স্কুলের শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে। বড়দের এবং কোনোকোনো ক্ষেত্রে শিশুদের হাতেও শিশুরা নির্যাতিত হচ্ছে, আহত ও নিহত হচ্ছে। তার উপর রয়েছে ড্রাগ সেবন ও নিজেকে ভুল পথে চালিত করা। সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও অন্যান্যরা এজন্য দারিদ্র্য, পড়াশোনায় ভাল না করা, সামাজিক দক্ষতার অভাব, বেকারত্বজনিত হতাশা, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের প্রভাব, মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদিকে প্রধানত দায়ী করে থাকেন। অনেক স্কুলেই এখন প্রতি বছর লক্ষাধিক ডলার খরচ করা হচ্ছে নিরাপত্তা রক্ষী, মেটাল ডিটেক্টরের মতো নিরাপত্তা যন্ত্রপাতি, গেইট, দেয়াল ও ফেন্সের পেছনে। কিন্তু এসব প্রিভেন্টিভ প্রোগ্রাম সত্ত্বেও অবস্থার সন্তোষজনক উন্নতি হচ্ছে না।
নেল ভার্চু এথিকসের দৃষ্টিভঙ্গিকেও অসম্পূর্ণ বলে দাবী করেছেন। সবসময় মিথ্যা কথা বলে বেড়ালে একজনের কী ক্ষতি হয়?—এ প্রশ্নের উত্তরে তারা বলবেন, এতে অন্যরা মিথ্যা-কথকের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন বা শিথিল করে ফেলবে, ফলে সে নিজেই সামাজিকভাবে সংকটে পড়বে। এর বিপরীতে নেল বলছেন, আমরা আসলে কার্যকে কারণে ও কারণকে কার্যে পরিণত করেছি। একজন মানুষ মিথ্যা ব'লে সম্পর্ক নষ্ট করে না, বরং সম্পর্ক যথাযথা না হলেই একজন অন্যের কাছে মিথ্যা বলতে সক্ষম হয়। আমরা নেলের সাথে আরও একটি উদাহরণ যুক্ত করতে পারি। অন্যের দোষ তার আড়ালে বর্ণনা করাকে আমরা গীবত বলে থাকি। গীবতকালে আমরা সত্য কথাই বলে থাকি। গীবতেও সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে, যদি শ্রোতা কথাটি গীবতকৃত ব্যক্তির কাছে প্রকাশ করে—যা নিজেই আরেকটি নতুন গীবত হয়ে উঠে। মিথ্যা বা গীবত দ্বারা সম্পর্ক যেটুকু আছে তা অবধারিতভাবে বিনষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। বরং নেলের সাথে আমরা একমত হয়ে জোরালো অবস্থান নিতে পারি: বিনষ্ট, ক্ষতিগ্রস্ত, অযথাযথ, তথা অযত্নশীল সম্পর্কের ফলেই মানুষ মিথ্যা বলতে বা গীবতে লিপ্ত হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে কোরানের সুরা বাকারার ২৭নং আয়াত উল্লেখ করা যেতে পারে। এটিতে বলা হয়েছে, "যারা আল্লাহর কাছে দৃঢ় অঙ্গিকার ক'রে তা ভঙ্গ করে, আল্লাহ যা অক্ষুণ্ণ রাখতে আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে বিপর্যয়-অশান্তি সৃষ্টি ক'রে বেড়ায়, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।" আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সামাজিক সব ধরণের বিপর্যয়, অশান্তি ও বিশৃঙ্খলার মূলে রয়েছে সম্পর্ককে ক্ষুণ্ণ করা, ছিন্ন করা। আর, সম্পর্ক ছিন্ন করার অর্থই হচ্ছে আল্লাহর নিকট করা অঙ্গিকার ভেঙ্গে ফেলা। যদি বিষয়টিকে নিরেট প্রকৃতির দিক থেকে দেখি, তবে বলা যায়, মানুষের অস্তিত্বে আসার অরিজিনাল কন্ডিশন ও গর্ভজাত সম্পর্ক সম্বন্ধে মানুষ অজ্ঞ নয়। এই প্রকাশ্য প্রাকৃতিক অবস্থাকে আমলে না নেয়াই, তা সম্বন্ধে অসচেতন হয়ে ওঠাই হচ্ছে প্রকৃতির স্রষ্টা আল্লাহর আদেশ লঙ্ঘন করা, তাঁর সাথে করা অঙ্গিকার ভেঙে ফেলা। অন্যদিকে, সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা, মমতা, জ্ঞান, বিচক্ষণতা, ক্ষমতা, ধৈর্য, সাহস, অধ্যবসায়, সৃজনশীলতা, নিষ্ঠা, দানশীলতা ইত্যাদি সকল গুণ যত্নকে রূপায়িত করলেই সদগুণ হয়ে উঠে এবং এসব গুণের অভিব্যক্তি ঘটে যত্নশীল সম্পর্ক থেকে। কোরানের নিসা (নারী) নামক পরিচ্ছদের শুরুতেই—প্রথম আয়াতে—মানবজাতিকে একই নারী-পুরুষ যুগল থেকে আসা জাতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে, "সচেতন হও আল্লাহ সম্বন্ধে, যার ভিত্তিতে তোমারা পরস্পরের নিকট দাবী উত্থাপন করে থাক, এবং গর্ভ সম্বন্ধে।" এখানে যুক্তিটির এগোনোর ধারাটিও লক্ষণীয়। আমরা প্রথমে পাই দাবীর প্রসঙ্গটি। এটি প্রধানত পুরুষের ডিঅন্টোলজিক্যাল নৈতিকতাবোধজাত দাবী—যার ভিত্তি হিসেবে তারা খোদ আল্লাহকেই গ্রহণ করেছে। কিন্তু মানুষের এই দাবীর বিপরীতে, যার নামে দাবী করা হচ্ছে, সেই ঈশ্বর সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠার আবেদন করা হয়েছে। তারপর আল্লাহ বলছেন তার নিজের কথা: "গর্ভ সম্বন্ধে সচেতন হও।" অর্থাৎ, আল্লাহ সম্বন্ধে সচেতনতার প্রকাশ হচ্ছে গর্ভজাত সম্পর্ক সম্বন্ধে সজাগতা ও সেমতে জীবন পরিচালনা করা। তা ছাড়াও, পুরুষের বহুকালের লালিত ঔরসজাত সম্পর্কের বদলে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে গর্ভজাত সম্পর্কের উপর। আয়াতের প্রথম অংশের সাথে মেলালে এর অর্থ হয়, সমগ্র মানবজাতি গর্ভজাত সম্পর্কে আবদ্ধ, যা এমন একটি বিষয়গত ও প্রত্যক্ষ বাস্তবতা যা মানুষের চিন্তা, অনুমোদন বা নির্বাচনের অধীন বা মুখাপেক্ষী বা নির্ভরশীল নয়।
কোরোনে মানুষের সাথে ভাল ব্যবহার করার কথা সার্বিকভাবে বলার মধ্যেই সীমিত নয়; নানা স্থানে এর পরিসরের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়—পিতামাতা, সন্তান, নারী সন্তান, আত্মীয়, নিকট প্রতিবেশী, দূরবর্তী প্রতিবেশী, সহযাত্রী, প্রার্থী ইত্যাদি নানা ক্যাটাগরি আলাদা-আলাদাভাবে উল্লেখিত হয়েছে। এই সকল ক্যাটাগরিই সম্পর্ককে প্রকাশ করে এবং পারস্পরিক কর্তব্যকে দান, সহায়তা, অন্নদান, সম্পদব্যয়, সদাচার, সুভাষণ, মমতাপূর্ণ আচরণ ইত্যাদি কাজের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে। আমরা যদি নবীর জীবনের দিকে তাকাই কিভাবে তিনি এই কাজগুলো বাস্তবে সম্পন্ন করতেন তবে দেখতে পাব, তিনি যত্নের সাথেই তা সম্পাদন করতেন। নবী কেবল এজন্যই বিরাট পুরুষ নন যে, তিনি মানবসমাজের উপর সবচেয়ে বেশী প্রভাব বিস্তারকারী বীরপুরুষ, যে প্রভাব তার মৃত্যুর পর বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হয়েছে। তিনি তার জীবদ্দশায় তার চারপাশের মানুষের যত্ন যেভাবে প্রত্যক্ষভাবে নিজ হাতে করেছেন তা-ই হচ্ছে তার বিরাটত্বের মূল বুনিয়াদ। তিনি এক-থেকে-এক সম্পর্কভিত্তিক যত্নের রোল মডেল। বীরোচিত গুণে ও অর্জনে যেমন কোনো পুরুষ তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি, তেমনই নার্সের মতো যত্নকাজেও কোনো নারী তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। তার ব্যক্তিত্বের বিরাটত্ব এই দুই দুনিয়ার একীভবনের মধ্যে নিহিত।
নেল কগনিটিভিস্টদের শিক্ষানীতিকেও সুস্থ মানুষ ও সুস্থ সমাজ গড়ার জন্য অযথেষ্ট বলে মনে করেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এবং মনোবিদ্যা, রাজনীতি, ব্যবস্থাপনাবিদ্যা ইত্যাদিতে প্রভূত উন্নতি সাধনের এই যুগে কগনিটিভিস্টরা চিন্তা, মূল্যায়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদিতে দক্ষতা অর্জনকে শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছেন, যেন বৈজ্ঞানিক পরিবেশে উৎপাদনশীলতা বাড়ে, মানুষ একটি পেশাগত দক্ষতার অধিকারী হয়ে নিজেকে, প্রজাতিকে, সমাজকে ও সব প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখতে এবং বিকাশমান রাখতে পারে। তারা এ-ও মনে করেন যে, বিজ্ঞান, গণিত, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, সাহিত্য ইত্যাদি বুদ্ধিদীপ্ত শাস্ত্রগুলো অধ্যয়ন যেহেতু মানুষের জ্ঞান বাড়ায় ও চিন্তাশক্তিকে প্রখর করে সেহেতু তা মানুষকে ব্যক্তিজীবনে সুখী ও নৈতিক জীবনে উন্নত করবে। এই দৃষ্টিভঙ্গির ফলশ্রুতিতে আমাদের কালে বুদ্ধি-নির্ভর কাজে যারা দক্ষ তারা সমাজে উচ্চ মর্যাদায় আসীন হয়েছে। নেল এই শিক্ষাব্যবস্থাকে যত্নদক্ষতা সৃষ্টির সহায়ক তো মনেই করেন না, বরং এটিকে অসাম্যের ভিত্তি ও নয়া অভিজাততন্ত্রের উৎস মনে করেন। তিনি শাস্ত্রগুলো অধ্যয়ন করা থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যত্নদক্ষতা তৈরি হওয়ার প্রত্যাশাকে অবাস্তব বলে মনে করেন।
নেল তাই যত্ন নেয়া ও দেয়ার শিক্ষণকে নৈতিক শিক্ষার ও নৈতিক হয়ে উঠার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দেখেন। যত্ন নিতে শেখার ব্যাপারটি তাত্ত্বিক দিক থেকে নেলের উভয়মুখী সম্পর্ক, যত্নগ্রহীতার সাড়াদান ও ডায়ালগের সাথে যুক্ত। এবং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে যত্ন-গ্রহীতাকে বুঝতে পারা, গ্রহীতা কর্তৃক ইতিবাচকভাবে ইচ্ছুক হওয়া ও প্রদাতার সাথে সংযুক্ত হওয়া এবং সর্বোচ্চ যত্নপ্রবাহ সম্ভব করা। যত্নগ্রহীতাকে গ্রহণে শিক্ষিত করে তুলতে হলে যত্নপ্রদাতা কর্তৃক প্রদানে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা প্রয়োজন। নেল যত্নের এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখাকে গ্রহণের শিক্ষণের প্রথম উপাদান হিসেবে দেখেছেন এবং একে সারা রুডিকের "ধারণ করা"র ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। রুডিকের মতে, "ধারণ করা"র অর্থ হচ্ছে ঝুঁকি কমিয়ে আনা ও মতপার্থক্যকে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ইতিবাচক পর্যায়ে নামিয়ে আনা—তাদেরকে উৎকটভাবে প্রকাশ করা নয়। বিচ্ছিন্ন যত্নকাজ বা বিচ্ছিন্ন যত্নকাজের ধারা থেকে "ধারণ ক'রে ধারাবাহিক যত্ন প্রদান"য়ের মধ্যে ফারাক রয়েছে। প্রথমটি "ধারণ" না করেই করা যত্নসদৃশ কাজ; কিন্তু পরেরটি হচ্ছে প্রকৃত যত্ন; একটি প্রকল্প ও পরিকল্পনা—যা সচেতনতা ও উদ্বেগ সম্বলিত। তবে নেল এই ধারাবাহিকতার মধ্যে যে শক্তি প্রয়োগের সম্ভাবনা নিহিত আছে তা নিয়েও আলোচনা করেছেন। একজন যত্ন প্রদাতা নিজের ইচ্ছাকে গ্রহণকারীর মধ্যে প্রয়োগ করতে চেয়ে বসতে পারেন এবং প্রভুর মতো বলে উঠতে পারেন, "আমি তোমার ভালোর জন্যই করছি, একদিন এজন্য তুমি আমাকে ধন্যবাদ দেবে।" মনোযোগিতা, ধৈর্য, আন্তরিকতা ও সংলাপ যত্নগ্রহীতার মনে আস্থা তৈরি করতে সক্ষম হয়—সে উদ্দেশ্যকে বুঝতে পারে, উদ্দেশ্যে মধ্যে নিজের কল্যাণকে দেখতে সক্ষম হয়। এই আস্থাকে—এরকম নেতিবাচক অবস্থায়—নেল খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন।
এবার যত্ন দিতে শেখার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যাক। নেল বলেন, মানুষ এখনও শেখেনি যুদ্ধকে কিভাবে এড়ানো যায়; এখনও শেখেনি যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলার উদ্দেশ্যে যেসব সুপরিচিত মনস্তাত্ত্বিক ছলা-কলা-কৌশলগুলো রয়েছে সেগুলোকে প্রয়োগ করার প্রলোভন থেকে নিজেকে দূরে রাখতে। সম্ভবত আমরা পারিবারের পরিমণ্ডলেও আনন্দ (joy) ও আবেগগত সহায়তা (emotional support) দিতে ও নিতেও ভালভাবে শিখতে সমর্থ হইনি। এসবই হচ্ছে যত্ন শিক্ষণের বিভিন্ন আকার, এবং এগুলো অর্জন করা খুব সহজ নয়। মে সারটনের একটি উপন্যাসের চরিত্র বলে, "Family life! The United Nations is child's play compared to the tugs and splits and need to understand and forgive in any family. That's the truth, I am sure, but, like every hard truth, we all try to pretend it isn't true". আমাদের কাছে এটি বিস্ময়কর ঠেকতে পারে—যদি গভীরভাবে বিচার করে দেখি—যে, স্কুলের শিক্ষা কারিকুলামে যত্নদক্ষতা সৃষ্টি ও বিকাশের উপর কোনো বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয় না, যত্ন দিতে শেখানো হয় না। আমরা সবাই জ্যামিতি, ক্যালকুলাস শিখি, কিন্তু এই বিদ্যার প্রয়োগ বাস্তব জীবনে কজনের কতটুকু হয়? অথচ আমরা সকলেই বাবা-মা হই, পরিবার পরিচালনা করি, অফিস-আদালতে, বাসে-ট্রেনে, হাটে-বাজারে সবসময় অন্যদের সাথে বসবাস করি। অথচ স্কুলে শিশুদেরকে যত্ন শিক্ষা দেই না—যে শিক্ষা আমাদের প্রত্যেকের জীবনে, সারা জীবন ধরে প্রযুক্ত হতে পারতো। যত্নদক্ষতার অভাবে আমি ও আমাদের অনেকেই যত্ন দেয়াকে কর্তব্য জ্ঞান করলেও, যত্ন করতে প্রয়াসী হওয়া সত্ত্বেও বাস্তবে তা সন্তোষজনকভাবে সম্পাদন করতে পারছি না। যত্নকে প্রেক্ষিত হিসেবে নিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন শীঘ্রই সম্ভব হবে—এমন আশা নেল করছেন না। তবে তার প্রত্যাশা হচ্ছে, শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তত এর প্রতি ছাত্রদেরকে আগ্রহী করে তোলার মতো একটি অংশ প্রবর্তন করা সম্ভব। তিনি ছাত্রদের মধ্যে আত্মজিজ্ঞাসা—আমি কে? ইত্যাদি—তৈরি করাকেও ইতিবাচক মনে করেন; এবং আত্মসম্মান ও আত্মভাবমুর্তি সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টি করাকেও স্কুলের উচিত বলে মনে করেন। যত্নশিক্ষা জ্যামিতি বা বিজ্ঞান শিক্ষার মতো সিস্টেমেটিক নয়; এটি ব্যবহারিকভাবে অনুশীলনমূলক, যা বাস্তব জীবনে প্রকৃতই যত্নবান শিক্ষকের নেতৃত্বেই সম্ভব; অর্থাৎ শিক্ষক যদি রোল মডেল হতে না পারেন, তবে যত্নশিক্ষা সফল হবে না।
অসমাপ্ত