লস্ট এন্ড ফাউন্ড এয়ার লাগেজ

মোনেম অপু
Published : 27 Dec 2014, 06:30 PM
Updated : 27 Dec 2014, 06:30 PM

আমাদের দেশে যারা আকাশ পথে আসেন তাদের লাগেজ অনেক সময়ই যথা-ফ্লাইটে আসে না, আসে পরের কোনো ফ্লাইটে। এতে কয়েকদিন লেগে যেতে পারে। কিন্তু সময়মত লাগেজ আসাটা যাত্রীর অধিকারের মধ্যে পড়ে বলেই গণ্য করা হয়। এ কারণে লাগেজ না এলে যাত্রীকে তাৎক্ষণিকভাবে একটি অনুদান দেয়া হয়, যেন প্রয়োজনীয় জামা-কাপড়, প্রসাধন সামগ্রী ইত্যাদি কেনা সম্ভব হয়। শুধু এটুকুই নয়, লাগেজ আসার পর এয়ারলাইন নিজ খরচে তা যথাশীঘ্রসম্ভব যাত্রীর বাসস্থানে পৌঁছে দেয়। বিদেশী এয়ারলাইনগুলো অন্য দেশে এসব নীতি অনুসরণ করে থাকলেও তাদের অনেকেই এদেশে তা অনুসরণ করে না। বাংলাদেশী এয়ারলাইনগুলোকেও বিদেশে এসব নিয়ম মেনে চলতে হয়, কিন্তু নিজ দেশে তারা তা মেনে চলে না। কম্পেনসেশন তো নেই-ই; তার উপর, লাগেজ পাওয়া গেলে যাত্রীদেরকে নিজ খরচে বিমানবন্দরে এসে তা নিয়ে যেতে হয়। এই প্র্যাকটিস যাত্রীর জন্য এক বিড়ম্বনা। অনেক দেশেই বিলম্বিত, ক্ষতিগ্রস্ত বা হৃত লাগেজের জন্য ক্ষতিপূরণের বিধান রয়েছে। তবে রাষ্ট্রের বিধি-বিধান থাকুক আর না-ই থাকুক, এয়ারলাইনগুলোর তো আন্তর্জাতিক এয়ার ট্রান্সপোর্ট এসোসিয়েশনের (IATA-আয়াটা) নিয়ম-কানুন মেনে চলার কথা। আয়াটা'র কিন্তু কম্পেনসেশনের বিধি-বিধান রয়েছে। তা সত্ত্বেও আমাদের দেশের যাত্রীদের কাছ থেকে দাবী না ওঠায় এয়ারলাইনগুলো এ ব্যাপারে উদাসীন থাকার সুযোগ পাচ্ছে।

হারানো লাগেজের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব ট্রান্সপোর্টেশনের বিধি অনুসারে সর্বোচ্চ তিন হাজার ডলারের চেয়েও বেশী অর্থ পাওয়া সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রে বিলম্বিত লাগেজের জন্য দৈনিক পঞ্চাশ ডলার করে সর্বোচ্চ পাঁচদিন স্টাইপেন্ড দিতে হয়। তবে স্টাইপেন্ড দেয়ার অনুশীলন সর্বত্র একরকম নয়। কোথাও এককালীন টাকা দিয়ে দেয়া হয়, কোথাও একটি নির্দিষ্ট হারে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক দিনের জন্য দেয়া হয়, আবার কোথাও চলার জন্য ক্রয়কৃত অত্যাবশ্যক জিনিসপত্রের মূল্য ভাউচারের বিপরীতে পরিশোধ করা হয়। পরিশোধের মোড ও অর্থের পরিমাণ যাই হোক, কোনো না কোনোভাবে টাকা দেয়ার রীতি রয়েছে। ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (ICAO-আইকাও) সদস্য-রাষ্ট্রগুলো মন্ট্রিল কনভেনশন (কনভেনশন ফর দি ইউনিফিকেশন অব সারটেইন রুলস ফর ইন্টারন্যাশনাল ক্যারেজ বাই এয়ার) পরিগ্রহণ করে। সেপ্টেম্বর, ২০১৪'র মধ্যে আইকাও'য়ের ১৯১টি সদস্য-রাষ্ট্রের ১০৭টি কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে। এই কনভেনশন অনুসারে প্যাসেঞ্জার ও লাগেজের ক্ষতির জন্য এয়ারলাইনকে স্ট্রিক্টলি লায়াবল গণ্য করা হয়েছে, একুশ দিনের মধ্যে লাগেজ পাওয়া না গেলে সেটি হারিয়ে গেছে বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং প্রমাণিত সকল ক্ষতির বিপরীতে এয়ারলাইন কর্তৃক ক্ষতিপূরণ দেয়াকে বিধিবদ্ধ করেছে।

এভিয়েশন জগতে লাগেজ বিলম্বে আসা বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বা হারিয়ে যাওয়া এখনও স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে আছে। প্রতিবছর প্রায় চব্বিশ মিলিয়ন সুটকেস হারিয়ে যায়। এর জন্য অবশ্য যুক্তিসঙ্গত কারণও রয়েছে। লাগেজ হ্যান্ডলিং সম্পূর্ণরূপে এয়ারলাইনের আওতায় নেই। লাগেজকে নানারকম সিকিউরিটি স্ক্রিনিং সিস্টেমের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ট্যাগের রুট ইনফরমেশন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পাঠের অযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। অপারেটরের ভুলে লাগেজ ভুল এয়ারক্রাফটে উঠে পড়তে পারে। কানেক্টিং ফ্লাইটে লাগেজ তোলার জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের অভাব ঘটতে পারে। রয়েছে লাগেজ চুরির জন্য অনেক বিমানবন্দরে সংঘবদ্ধ চোরের দল। এয়ারলাইন, সিকিউরিটি ও হ্যান্ডলিং এজেন্সির মধ্যে লাগেজের নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর হয়, কিন্তু কোথাও এজন্য বুঝিয়ে-দেয়া/বুঝে-নেয়ার ব্যাপার থাকে না। ফলে বিশ্বাস-আস্থা ও চুরি নিরোধী ব্যবস্থার উপরই নির্ভর করতে হয়। লাগেজ চুরি হয়ে গেলে তাই কাউকে দায়ী করা সহজ হয় না। ফলে হারানো লাগেজ খুঁজে বের করার বেস্ট এফোর্টের উপরই নির্ভর করতে হয় এয়ারলাইনকে। এসব কারণে লাগেজ বিলম্বে আসলে বা হারিয়ে গেলে শুধু একারণেই এয়ারলাইনের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠারও যুক্তি নেই। কোনো এয়ারলাইনই ইচ্ছাকৃতভাবে বা গাফিলতি করে লাগেজ হারিয়ে ফেলে না।

আমাদের দেশে লাগেজ হারানো নিয়ে আরেকটি প্রপঞ্চ রয়েছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে বা অন্যত্র চাকুরিরত স্বল্পশিক্ষিত বাংলাদেশী যাত্রীদের অনেকেই লাগেজ তৈরি করেন দড়ির নেট দিয়ে; ফলে একাধিক যাত্রীর এরূপ লাগেজ দেখতে একই রকম হয়। কদাচিৎ এমন ঘটে যায়—একজন আরেক জনের লাগেজ বাসায় নিয়ে গিয়ে খোলার পর বুঝতে পারেন যে এটি তার নয়। এ অবস্থায় অন্য যাত্রীটি লাগেজ হারানোর রিপোর্ট লিখে বাড়ি চলে যান। আর প্রথম যাত্রীটিও হয় অবস্থা বেগতিক দেখে অন্যের লাগেজ হজম করে বসে থাকেন অথবা পরিচিত লোকের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেন। এতে কোনোকোনো সময় প্রকৃত মালিককে খুঁজে বের করে লাগেজ এক্সচেঞ্জ করাও সম্ভব হয়; কারণ অন্য লাগেজটি তো লস্ট এন্ড ফাউন্ড অফিসে পড়ে থাকে সেই প্রথম দিনটি থেকেই। এরকমটি না ঘটলে পড়ে থাকা লাগেজটি তো নিলামে উঠে, আর অন্য লাগেজের মালিককে লাগেজ হারানোর বেদনা নিয়েই থাকতে হয়।