কাইযেন—জাপানি ব্যবস্থাপনা

মোনেম অপু
Published : 30 Dec 2014, 12:17 PM
Updated : 30 Dec 2014, 12:17 PM

জাপানি শব্দ 'কাই' অর্থ চিন্তন, সংশোধনমূলক পরিবর্তন, ক্ষুদ্র, চলমান, ভাল; এবং 'যেন্' অর্থ ভাল, সবচেয়ে ভালর জন্য। 'কাইযেন' শব্দটি 'কাই' ও 'যেন্' শব্দ দুটির সমবায়ে তৈরি, যার অর্থ ধারাবাহিক উন্নতিসাধন। আধুনিক ব্যবস্থাপনায় কাইযেন অর্থ দাঁড়িয়েছে, 'ছোট ছোট কিন্তু ধারাবাহিক পরিবর্তন, যার ফলশ্রুতিতে সবচেয়ে বেশী কার্যকরভাবে অপচয় কমে ও উৎপাদনশীলতা বাড়ে'। মাসাকি ইমাই 'কাইযেন' নামক উন্নয়ন প্রক্রিয়াটির তাত্ত্বিক ডেভেলপার হিসেবে অধিক পরিচিতি পেয়েছেন। টার্মটি জাপানে ব্যাপকভাবে প্রচলিত; এবং ১৯৮৫ সালে ইমাই'র বই 'কাইযান: দি সিক্রেট টু জাপান'স কম্পিটিটিভ সাকসেস' প্রকাশিত হবার পর থেকে আমেরিকায় ব্যবসা-ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত একাডেমিক ভাষায় তা দ্রুত অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে। কাইযেনকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে ইমাই ১৯৮৫ সালে কাইযেন ইনস্টিটিউট গঠন করেন। বর্তমানে এর ৩০টিরও বেশী দপ্তর ৪০টিরও বেশী দেশে পেশাগত কন্সাল্টেন্সি কাজ করে যাচ্ছ। প্রডাকশন ইন্ডাস্ট্রিতে কাইযেনের জন্ম হলেও এর অনেক নীতি ও টুল সমভাবে নন-প্রডাকটিভ আর্গানাইজেশনেও প্রয়োগ করা সম্ভব। এভাবে অফিস কাইযেন নামে আরেকটি শাস্ত্রও বিকশিত হয়েছে।জাপানের টয়োডা পরিবার বিশ শতকের শুরুর দিকেই তাদের অটোমেটিক লুম ফ্যাক্টরি ব্যবস্থাপনায় 'জিদোকা' নামের একটি পরিচালনা নীতি প্রবর্তন করে। ১৯৩০ সালে টয়োডা পরিবার অটোমোবাইল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান টয়োটা মোটর কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে এবং সেখানে জাস্ট-ইন-টাইম (জেআইটি) নামে আরেকটি নতুন নীতি গ্রহণ করে। এই দুই স্তম্ভের উপর তারা গড়ে তোলে তাদের টয়োটা প্রডাকশন সিস্টেম (টিপিএস) নামক একটি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম। এর মধ্যে কানবান, জিদোকা, জেটিআই, টোটাল কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট, ৫এস, প্ল্যান-ডু-চেক-এক্ট (পিডিসিএ) ইত্যাদি অনেকগুলো নীতি, কৌশল ও টুল বিদ্যমান। টিপিএস'কে ভিত্তি করেই পরে কাইযেন শাস্ত্রের বিকাশ ঘটেছে। ষাটের দশকে জাপানের শিল্পজগতে কাইযেন একটি আন্দোলনে পরিণত হয়। টয়োটা ও অন্যান্য জাপানি শিল্প-প্রতিষ্ঠান সমবেতভাবে টিপিএস'য়ের ব্যাপক উন্নতি সাধন ক'রে এটিকে একটি পরিণত অবস্থায় নিয়ে যায়। এতে করে জাপান সৌভাগ্যক্রমে সত্তরের দশকে আপতিত তেল সংকট (১৯৯৩) ও জ্বালানী সংকট (১৯৭৯) সফলভাবে মোকাবেলা ক'রে শিল্পে, বিশেষত অটোমোবাইল শিল্পে, একটি বড় শক্তি হয়ে আবির্ভূত হয়। মার্কিনীরাও জাপানের এই অবিশ্বাস্য সাফল্য দেখে কাইযেন জানার এবং তা আত্মস্থ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রশাসনও কাজের পরিবেশ ও পারফরমেন্স বাড়াতে কাইযেন প্রোগ্রাম/ইভেন্ট প্রণয়নে জাপানের সহায়তায় কাজ করছে এবং সরকারী অফিসগুলোতে তা পরিচালনা করছে।

তাৎক্ষণিক ত্বরণপ্রসূ পরিবর্তন

কাইযেনের মূল কথা হচ্ছে, যা আছে তা নিয়েই এবং তার মধ্যেই সহজসাধ্য ধারাবাহিক পরিবর্তন। কাইযেন মানেই পরিবর্তন, ছোট ছোট পরিবর্তন, সহজসাধ্য পরিবর্তন, ধারাবাহিক বর্ধনশীল পরিবর্তন, ক্রমাগত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উন্নয়ন। এতে বিপুল অর্থের সংশ্লেষ নেই; বিশাল ক্ষমতার জন্য অপেক্ষায় থাকার আবশ্যকতাও নেই। কাজের সমগ্র ক্ষেত্রের মধ্যে ছোট ছোট যে ইউনিটগুলো রয়েছে তাদের মধ্যে প্রায়োরিটি ঠিক করতে হয়, কোথায় কোন পরিবর্তন আনা দরকার তা নির্ধারণ করতে হয়, ইভেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রেও প্রায়োরিটি ঠিক করতে হয়, পরিবর্তন কাজটি সম্পন্ন করার টাইম ফ্রেইম তৈরি করতে হয়। যেহেতু এটি একটি সামগ্রিকভাবে একক মেকানিজমের ভেতর আংশিক আংশিক পরিবর্তন, সেহেতু প্রায়োরিটি সেটিং এবং অন্য অংশগুলোর সাথে সমন্বয় বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি এমনভাবে করতে হয় যেন সামগ্রিক আউটপুটে গতিবৃদ্ধি হয়। অর্থাৎ কাইযেনকে অবশ্যই তাৎক্ষণিকভাবে ত্বরণপ্রসূ হতে হয়। এই ত্বরণই ফল। কাইযেন হারে হারে তাৎক্ষণিক ফলমূখী। কাইযেনের লক্ষ্য হচ্ছে এমন পরিবর্তন সাধন যা ছোট হলেও বিপুল কিন্তু অব্যবহিত সুফল বয়ে আনে, যা পরবর্তী পরিবর্তনটির জন্য ইতিবাচক হয়। ফলে, কইযেন মানেই যোগাযোগ, সমন্বয়, সহযোগিতা ও ত্বরণ—ঠিক যেভাবে প্রাণীদেহের বিভিন্ন সিস্টেম আলাদা-আলাদাভাবে ক্রমাগতভাবে বদলাচ্ছে যোগাযোগ, সমন্বয় ও সহযোগিতার মাধ্যমে, কিন্তু দেহটি কোনোরূপ সমস্যায় আক্রান্ত না হয়েই বর্ধিত হচ্ছে। সুপরিচালিত কাইযেন ইভেন্ট দ্রুত ফল প্রদান করে এবং তা করে অভূতপূর্ব গতিতে ও আয়তনে: উৎপাদনশীলতা বাড়ায়, পণ্যের মান উন্নত করে, ব্যয় কমিয়ে আনে, ভোক্তাদের সন্তুষ্টি বাড়ায় ইত্যাদি।

তৃণমূল কর্মশক্তির সৃজনশীল ও সক্রিয় অংশগ্রহণ

প্রথাগত নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলো নেতৃত্ব ও উপদেষ্টাদের উপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল। তারা নিজেদের জ্ঞান ও বিবেচনার উপর ভিত্তি করে পলিসি, প্রসেডিউর, প্রক্রিয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনেন। কিন্তু এই নির্বাহী ও উপদেষ্টাবৃন্দ একাডেমিক উচ্চ জ্ঞানের অধিকারী হলেও তারা তৃলমূল কর্মকাণ্ডের প্রত্যক্ষ্যভাবে অংশ নেন না। কিন্তু কর্মীরা বাস্তব অভিজ্ঞতার কারণে অনেকসময়ই প্রকৃত সমস্যা ও সমাধানগুলো সম্বন্ধে বেশী সচেতন হয়ে উঠতে পারেন। কোথায় পরিবর্তন বা উন্নতি প্রয়োজন তা উৎপাদনের প্রসেসগুলোর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত কর্মীরা ভাল বলতে পারেন। কাজেই বড় বড় চিন্তার বদলে কর্মীদের ক্ষীণ চিন্তা (lean thinking) কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হতেও পারে। প্রতিদিন ছোট ছোট চিন্তা কর এবং ছোট ছোট গুণগত পরিবর্তন আনো—এটাই কাইযেনের কথা। বড় কর্তারা বা বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টারা নিঃসন্দেহে অতি প্রয়োজনীয়; কিন্তু প্রথাগত প্রতিষ্ঠানে কর্মীবাহিনীর জন্য পরিবর্তন-পরিকলপনায় সৃজনশীল ভূমিকা রাখার কোনো প্ল্যাটফর্ম রাখা হয় না। কাইযেন ইভেন্ট ডিজাইন ও বাস্তবায়নে বাস্তবে কর্মরত কর্মীদেরকেই টিম সদস্য হিসেবে রাখা হয় এবং তাদের মতামত আহ্বান করা হয় ও গ্রহণ করা হয়। এতে ফ্রন্ট লাইন ওয়ার্কারা চিন্তা করতে ও সমাধান খুঁজতে উৎসাহিত হয়, এক্সেকিউটিভের একের অগাধ জ্ঞানের সাথে ওয়ার্কারদের দশের প্রজ্ঞার সম্মিলন ইনক্লুসিভ ডিসিশন মেকিংকে সম্ভব করে; এতে সকলের উৎসাহ ও উদ্দীপনাও বাড়ে। কাইজেন প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব ও কর্মবল উভয়েই নিজ নিজ ক্ষেত্রে উৎসাহী ও উদ্ভাবনী হয়ে উঠে এবং দুয়ের সমন্বয় ঘটে।
.


.
ক্রস-ফাংশনাল টিম

প্রথাগত ব্যবস্থাপনায় চিন্তাকে বাস্তবে প্রয়োগ করার চেষ্টার প্রাধান্য থাকে এবং পরিবর্তনটি যেখানে দরকার, পরিবর্তন কাজ পরিকল্পনায় ও বাস্তবায়নের ক্রিয়াকাণ্ড সেখানটিতেই সীমিত থাকে। কিন্তু কাইযেন কাজ করে ক্রস-ফাংশনাল টিমের মাধ্যমে। টিমে প্রসেসের সাথে প্রত্যক্ষ্যভাবে কর্মজড়িত ইউনিটের সকলেই সদস্য হন এবং একই সাথে এই প্রসেসের সাথে ভেতরের 'সরবরাহকারী' ও 'গ্রাহক', এবং বাইরের 'সরবরাহকারী' ও 'গ্রাহক'দের এবং এমনকি নিরপেক্ষ 'দর্শক'দের মধ্য থেকেও প্রতিনিধিত্বকারী সদস্য গ্রহণ করা হয়। এতে পরিবর্তন কাজটি যেমন সুচারু হয়, তেমনই এর আভিঘাত কোথায় কিভাবে পড়ছে, নেতিবাচক হলে তার সমাধান কী হতে পারে তাও তৃণমূল থেকে উঠে আসে।
.


.
টিম ওয়ার্ক ও কাজের স্বীকৃতি

কাইযেন অঙ্গনে বাস্তব অবস্থার মূল্যায়ন, কাণ্ডজ্ঞান ও বিচক্ষণতার কোনো বিকল্প নেই। শেষ বিচারে কাইযেন ইভেন্ট তৈরি ও পরিচালনা প্রত্যেকের নিজস্ব চিন্তা ও সকলের উদ্ভাবনী শক্তির উপরই নির্ভর করে। এজন্য তাই প্রথম প্রয়োজন প্রত্যেকের উদ্দীপনা ও সকলের অংশগ্রহণ। কাইযেন পুরাদস্তুর সাম্যবাদী ও গণতান্ত্রিক। প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকে চিন্তা করতে হয়, মতামত ও প্রস্তাব পেশ করতে হয়, সকলের মতকেই মূল্যবান মনে করা হয়, সব নতুন চিন্তাকেই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। তৃণমূলের ভাবনা থেকেই ইভেন্টের ধারণাগত আকার তৈরি হয়, সকলেই টিমের সদস্য হয় এবং টিম ওয়ার্কের মধ্য দিয়েই ইভেন্ট বাস্তবায়িত হয়। এখানে সকলেই সমান—তাই নেতা ও অনুসারীর মধ্যে ফারাক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এটি প্রথাগত আমলাতান্ত্রিক আদেশ-আনুগত্যের মডেল থেকে ভিন্ন এবং এমনকি গ্রুপ ওয়ার্ক থেকেও তা ভিন্ন। এখানে প্রত্যেকেরই সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ ও অবদান রাখার সুযোগ বিদ্যমান। এখানে র‍্যাঙ্ক নেই, রাজনীতি নেই, এবং প্রস্তাব অব্যবহিতভাবে বাস্তবায়িত হয়। প্রথাগত প্রতিষ্ঠানে নিচের পদের কর্মীদের কাজের কৃতিত্ব উঁচু পদের অধিকারীর ঝুলিতে গিয়ে পড়ে। কিন্তু কাইযেন ইভেন্টে প্রকৃত কর্মীটিই টিমের সদস্যদের কাছ থেকে স্বীকৃতি পায়ে থাকে। সকলেই সমভাবে অংশ নেয় বলে এবং অবদানের স্বীকৃতি সমভাবে মেলে বলে কাইযেন ইভেন্টে কেউই হারে না, সকলেই জেতে; কাজ হয়ে উঠে সহজ, আনন্দের, এবং কর্ম-সন্তোষ বৃদ্ধি পায়। কাইযেন কর্মস্থল ও কর্মপ্রক্রিয়ার অধিকতর মানবিকীকরণের দিকে মনোযোগী। কাইযেনের কারবার প্রধানত মানুষ, মানবিক মর্যাদা ও আন্তঃব্যক্তি সুস্থ সম্পর্ক নিয়ে; কোনো কর্মপ্রক্রিয়ার ডিজাইন নিয়ে নয়। কিন্তু জীবনের উন্নয়নের সাথে সাথে এর ফল হিসেবে পাওয়া যায় উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি।

সাংস্কৃতিক পরিবর্তন

কাইযেনের প্রবর্তন সনাতন সংস্কৃতিতে বিরাট পরিবর্তন আনতে পারে। অথবা এও বলা যায় যে, কাইযেন প্রবর্তন করতে হলে সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা আবশ্যক হয়। আমলাতান্ত্রিক সাংগঠনিক কাঠামোয় উচ্চপদস্থরা ট্যাকটিক্যাল বিষয়গুলোতেও সিদ্ধান্ত প্রদান ক'রে থাকে। তাছাড়া আদেশ-আনুগত্যের সম্পর্ক তাদেরকে রাশভারি প্রভুসদৃশ ক'রে তোলে এবং কর্মীদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। আদেশের অনুবর্তনে অভ্যস্ত কর্মীরা দাসবৎ হয়ে উঠে, সমস্যার সামাধান বের করার বা করণীয় নির্ধারণের কাজে বৌদ্ধিকভাবে জড়াগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, কাজের স্বীকৃতি বড়সাহেবরাই লুটে নেয় বলে কর্মীরা প্রোএক্টিভভাবে তৎপর থাকে না। কাইযেন পরিবেশে ব্যর্থতার দায় ব্যক্তির উপর বর্তানো হয় না বলে সকলেই সদিচ্ছা নিয়ে কর্মতৎপর থাকে। নেতৃত্বের আসনে থাকা কর্তারা স্ট্র্যাটেজিক অঙ্গনে এবং টিম সদস্যদের সমস্যাদি ও তাদের কাজের ক্ষেত্রে বাধাগুলো দূরীকরণে অধিক মনোযোগ দেয়ার সময় পায়। কাইযেনে পারস্পরিক আস্থা ও স্বচ্ছতা তৈরি হয়, সমস্যা গোপন করার প্রবণতা দূর হয়, ব্লেইম গেইম বন্ধ হয়, ব্যক্তিগত দায় এড়ানোর পিংপং খেলার অবসান হয় এবং যোগাযোগে প্রভূত উন্নতি ঘটে।

অসমাপ্ত

সূত্র:
Geoffrey Mika – Kaizen Event Implementation Manual
Karen Martin and Mike Osterling – The Kaizen Event Planner