আমাদের জীবনে কত মজার মজার কত ঘটনাই-না ঘটে। ঘটে যাওয়া এ রকম কিছু ঘটনা লিখতে পারলে একটা পোস্ট তৈরি হতে পারে। এতে সংখ্যা একটা বাড়ে। সংখ্যাবৃদ্ধিতেই ব্লগারের সমৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধি। এটাই ব্লগ-জিডিপির সূচক-নিয়ামক। কাজেই চেষ্টা করলে মন্দ কী?
০.
আমার নামের বানান-বিভ্রাট সেই ছোটবেলা থেকেই। 'মোনেম' শব্দটা 'মোমেন' শব্দের কাছাকাছি। আমাদের দেখাটা—মানে কী দেখবো সেটা—কেবল দৃশ্যের স্বগত অবস্থার উপর নির্ভর করে না, করে মনের উপরও, ইচ্ছার উপরও, পিতৃপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া চিন্তাগত স্ট্রাকচারের উপরও। যারা দর্শন পড়েছেন তারা জানেন এ নিয়ে দার্শনিকদের দৌড় কতদূর! তবে এদের নানা মতের মধ্যে অদ্ভুত একটি মতের নাম সলিপসিজম। অবশ্য এ মতের কোনো প্রবক্তা-দার্শনিক আছেন বলে এখনও জানতে পারিনি। কাজেই এটিকে একটি দাবীদারবিহীন উদাহরণ-মাত্র হিসেবে উল্লেখ করা সম্ভাব্য মত হিসেবেই দেখা যেতে পারে। রাসেল বলেন, মতটা বাস্তবে অসম্ভব নয়, তাই বলে তা-ই ঘটেছে বলে মানতেই হবে তার জন্যও তো কোনো মাথার দিব্যি নেই। এ মতে বলা হয় যে, কেবল নিজের অস্তিত্ব সম্বন্ধেই নিশ্চিত হওয়া যায়। আরেকটু এগিয়ে বলা যায়, কেবল আমিই বাস্তব, আমিই সত্য—আর সবকিছু স্বপ্নের দুনিয়ার ভেতর দৃশ্যমান জিনিসগুলোর মতোই ফ্যান্টম। সে যা-ই হোক, বাস্তব কথা হচ্ছে, কোনো লেখা পড়ার সময় কী পড়বো তা কী লেখা আছে তার উপর পুরোটাই নির্ভর করে না; কী পড়বো তার উপর মনেরও আসর থাকে, থাকে ইচ্ছার, থাকে স্ট্রাকচারের।
যেহেতু 'মোমেন' নামটি আমাদের দেশে বেশী প্রচলিত তাই আমরা প্রায়শই 'মোনেম'কে 'মোমেন' পড়ে থাকি। আমি নিজেও এ নিয়মের ব্যতিক্রম নই। কোনো উপন্যাস বা গল্প পড়ার সময় যদি এ নামটি আসতো তবে আমিও সেখানে এ ভুল করতাম। কিন্তু নিজের নামের বেলায় আমি ভুলটা করি না। ফলে আমার এসএসসি পরীক্ষার সনদপত্রটি হাতে পেয়ে যথারীতি ভুলটা দেখতে পেলাম। কিন্তু সনদখানা আমি যত্ন করে ঠামিয়েই রেখে দিলাম। মতলব ছিল এইচএসসি'রটা নিয়ে একবারে বোর্ড অফিসে যাবো। ঘটলোও তাই। কিন্তু বোর্ড-অফিসের কর্মকর্তা দিনমতো আমার সংশোধিত সনদ দুটো দিতে পারলেন না। আমাকে দেখে প্রৌঢ় বয়সী কর্মকর্তা সস্নেহে বলছিলেন, বাবা, তুমি যে কী বদলাতে বলেছো তার কিছুই তো বুঝতে পারিনি। নাম প্রকৃতপক্ষে মোমেন, ভুলবশত মোমেনের স্থলে মোমেন লিখা হয়েছে—ইত্যাদি। অর্থাৎ আবেদন পত্রে লেখা 'মোনেম'কেও তিনি সমানে 'মোমেন' পড়েই যাচ্ছিলেন।
০০.
চাকুরীর সুবাদে আমাকে অনেকদিন রাতের বেলায় দেখভাল করার দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। এক রাতে চলে গেল বিদ্যুৎ; এমনভাবে যে আর তার দেখা নেই—পনের মিনিট গেল, তিরিশ মিনিট গেল, কিন্তু সবই ফকফকা অন্ধকার। ইমার্জেন্সি প্রাইমারি জেনারেটর ভাল, স্ট্যান্ড-বাই জেনারেটরও বিকল নয়—ফেঁসে গেছে সুইচগিয়ার। ফলে বিদ্যুৎ যাওয়ার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সে ফিরে আসলেও আলো আসলো না। মেইনস না জেনারেটর কোনোদিকেই 'মারো ঠেলা হেইওও' বলেও কাজ হচ্ছে না। খবর নিয়ে নিরাপত্তা সুপারভাইজার হাজির; কিছু যুবাবয়েসি ছেলে নাকি রেগে কাই, কাঁচ-কুচ ভেঙ্গে ফেলতে ধরেছে। তার আবদার, স্যার, তাড়াতাড়ি আনসার ডাকেন। তার কান-কথায় মন-ভারী না হয়ে আমি তাকে নিয়ে হাজির হলাম জনতার সামনে। ছেলেগুলোও বুঝতে পারল, দপ্তরের কর্মচারী নিজেই হাজির হয়েছে। ফলে উত্তেজনা আরও গেল বেড়ে। সবাইকে শান্ত হবার অনুরোধ করলে এক যুবকের কাছ থেকে পাল্টা শুনতে হলো, আমি গত বিশ বছর ধরে এখানে আসি, কোনোদিন কারেন্ট গিয়ে এতক্ষণ থাকেনি। আজ এ কী অবস্থা! ইঞ্জিনিয়াররা সব কী করে—ইত্যাদি। বক্তৃতা শেষ হলে ধীরে ধীরে বললাম, ভাই এবার একটু ভেবে দেখেন। বিশ বছর এই ইঞ্জিনিয়াররাই সিস্টেম মেইনটেইন করে এসেছে। বিশ বছরের ক্রেডিটটা দেবেন না? একটু শান্ত হোন। যন্ত্রপাতি বিশ বছরে একবার কি ফেইল করতে পারে না? দেখলাম ছেলেগুলো শান্ত হয়ে পাশের চেয়ারে বসে পড়লো। আমি সুপারভাইজারকে বললাম, এবার চলেন, আনসার ডাকার আপাতত দরকার নেই।
০০০.
চাকুরীর সুবাদেই বিরান ভূমিতে বসানো কিছু যন্ত্রপাতি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হয়েছে। ভূমি এতোই বিরান ও বিস্তীর্ণ যে সাপ-খোপের অভাব নেই। ওঝা ডেকে ঘর থেকে সাপ ধরার ঘটনাও বার দুয়েক ঘটেছে। একবার তো পত্রিকায় খবরই রটে গেল, আমার বস নাকি দরজা খুলেই ফণা তোলা গোখরা দেখে ভয়ে দৌড়ে পালাতে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেছেন। তারপর এন্তার অভিযোগ, কর্মচারীরা খালি ঘুমায়—ইত্যাদি। খবর পড়ে দেশের বাড়িতে তাঁর মা-বাবার চিন্তার শেষ নেই। আমি তো সেখানেই ছিলাম। আমরা আর যাই করি, নিয়মিত দিনে দুবার রুটিন চেক তো করি-ই, যদি অন্য কোনো সমস্যা থাকে তো অন্তত একবার হলেও তা করা হয়। সাপ যদি থাকে তো কালেভদ্রে ক্যাবল ডাক্টের ভেতরে, আসে খোলস ছাড়ার জন্যে।
সে যা-ই হোক, একবার এক ছোকরা বয়েসি ছেলে তার মেয়ে-বন্ধুকে নিয়ে কিভাবে জানি সিকিউরিটি ভেদ করে বিরান ভূমিতে একেবারে ইকুইপমেন্ট শেল্টারের কাছে গিয়ে বসে ছিলেন। আমরা তো দেখে হতবাক! ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, তারা এখানে কিভাবে এসেছেন? তা তিনি এটা ওটা বলেই চললেন। একসময় বলে বসলেন, আমার বাবা মেজর। আমি ভাবছিলাম তাদেরকে আমাদের গাড়িতেই উঠিয়ে বাইরে রেখে আসতে বলবো আমার সঙ্গীদেরকে। কিন্তু তার এই শেষ কথাটা শুনে মেজাজ গেল বিগড়ে। তিনি সত্য বলছেন, না মিথ্যা—তার কোনো হদিস করাই তো কঠিন। কাজেই একটু বাঁকা পথে যাওয়াটাই ভাল মনে হলো। আমি হম্বিতম্বি করে সিকিউরিটি তলব করলাম। তারাও হুঁশ করে এসে হাজির। তাদের গাড়িতে উঠার আগে একটু থেমে ছেলেটি জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, মেজর শুনে আপনি এতো চটে গেলেন কেন? বললাম, ভাই চটে যাইনি, ভয় পেয়েছি। আপনি জানেন এখানে কী পরিমাণ সাপ আছে? চাষা-ভুষার ছেলে মরলে আমাকে কেউই কিছু বলবে না। কিন্তু মেজরের ছেলে সাপের কামড়ে মরলে আমার সিকিউরিটির চাকরি থাকবে না।