নিরীশ্বরবাদিতার স্বাধীনতা

মোনেম অপু
Published : 29 July 2015, 06:25 PM
Updated : 29 July 2015, 06:25 PM

আমাদের দেশে নিরীশ্বরবাদিতা একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সমস্যার সাথে ইসলাম ধর্ম, যৌক্তিকতা ও স্বাধীনতার নীতির যেমন সম্পর্ক রয়েছে, তেমনই তা জড়িত হয়েছে ফৌজদারি অপরাধের সাথেও। সমস্যাটির উৎস হচ্ছে ধর্মত্যাগ সংক্রান্ত ঐতিহ্যগত ধর্মীয় বিধান, তা সেটি সুন্নিদের হোক বা শিয়াদের। মুসলিম সমাজে ধর্ম-সচেতনদের অধিকাংশ ব্যক্তি ধর্ম অনুসারে নিজের জীবন গড়ে তুলতে চান, এবং—আরেকটু এগিয়ে—ধর্ম প্রচারে যুক্ত হন। তারা এ ইস্যু নিয়ে নড়াচড়া করেন না। ইস্যুটি সারফেসে আসে ধর্মীয় নেতৃত্বের একাংশের প্রতিক্রিয়ায়। বিষয়টি আমাদের জন্য তৈরি করেছে নানা সংকট: যুক্তির সংকট, আইনের সংকট ও রাজনীতির সংকট।

মুসলিম পরিবারের কোনো সদস্য জীবনের কোনো এক পর্যায়ে এসে যদি কেবল চিন্তাগত কারণে ধর্মে বিশ্বাসটি বজায় রাখতে না পারেন, কিন্তু তিনি যদি তার নতুন ধর্ম বা মতাদর্শ অনুসারে চলেন ও অন্যের উপর আক্রমণ বা অত্যাচার না করেন, তবে তার উপর আক্রমণ করার বৈধতা যুক্তি-বিচারে অসম্ভব। একজন ব্যক্তি অন্যের সাথে বিবাদে নামতে পারেন তখনই যখন তার জীবন, সম্পদ ও সম্মান আক্রান্ত হয়। কিন্তু এ নিয়মটি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্যই সমভাবে প্রযোজ্য। কোন মুসলিম আক্রান্ত হলে যেমন ও যতটুকু অপরাধ হয়, একজন মুসলিম আক্রমণ করলেও তেমনটি ততখানি অপরাধ হয়। কোরানে বিধৃত ন্যায়বিচার সংক্রান্ত ধারণা অনুসারে কোনো ইস্যুতেই পক্ষপাতের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু ধর্ম ত্যাগ করার ক্ষেত্রে আমরা পক্ষপাতকে কেন প্রশ্রয় দেবো?

এ ইস্যুতে আমাদের একাংশের যৌক্তিক অসঙ্গতিটা তুলে ধরার জন্য দুটো উদাহরণ দিচ্ছি।

ক. আমরা ইসলাম ধর্ম প্রচার করে থাকি। কেউ যদি ধর্মান্তরিত না হবে তবে প্রচার কেন? কোনো ব্যক্তির ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কারণে যদি তার সম্প্রদায় আমাদের মতোই ধর্মত্যাগী ব্যক্তিকে হুমকি দেয়, নির্বাসনের দাবী তোলে বা হত্যা করে তবে আমরা মুসলিমরা তো সেটি মেনে না নিয়ে বরং পারলে শক্তি দিয়ে বাধা দেবো। আমাদের যুক্তি হবে চিন্তা-মতের স্বাধীনতা এবং ব্যক্তির নিরাপত্তা লাভের অধিকার। আমরা স্পষ্ট করে উচ্চারণ করবো, "তোমরা তাকে কেন হত্যা করতে চাও? সে তো তোমাদের কারও জীবন, সম্পদ ও সম্মানে আক্রমণ করেনি।" কিন্তু বিপরীত ক্ষেত্রে যুক্তি-বুদ্ধি ধ্বংস করেই কেবল আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব, "অতশত বুঝি না, আমাদের নিয়ম একতরফা, শক্তিই এখানে মীমাংসার পন্থা।"

খ. কাউকে ভয় দেখিয়ে, শক্তি দেখিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা যে বৈধ নয়, তা মুসলিমদের প্রধান প্রধান সব ধর্মীয় উপসম্প্রদায় কর্তৃক গৃহীত নীতি হয়ে আছে। কাজেই ইসলাম গ্রহণ একটি স্বাধীন নির্বাচন এবং এ কারণেই তা বুদ্ধি-চিন্তা-বিচার সাপেক্ষ কাজ। যখন আমরা কাউকে হত্যার নীতিটা মেনে নিয়ে মুসলিম হতে আহ্বান করবো তখন আমরা তাকে প্রকারান্তরে কি এটাই বলছি না যে, "সাবধান! আগে বুঝে দেখ, এখন যে বৌদ্ধিক-চৈন্তিক বিচারে তুমি মুসলিম হচ্ছো তা যদি বজায় রাখতে না পারো এবং পরে যদি তুমি নতুন বিচার-বিবেচনায় এ ধর্মকে ত্যাগ কর তবে যত ভাল মানুষই হও না কেন তোমাকে হত্যা করা হবে। কাজেই আগেই ভেবে দেখ, নইলে আমাদের থেকে দূরে থাক।" একজন চিন্তাশীল ব্যক্তির পক্ষে এরূপ শর্ত আগাম মেনে নিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা কতখানি সম্ভব? যে ব্যক্তি ধর্ম গ্রহণ না করা সত্ত্বেও নিরাপত্তা পাচ্ছেন, তিনিই গ্রহণের পর ছেড়ে দিলে তা হারাচ্ছেন: অথচ মানুষ হিসেবে তিনি আগে যেমন ছিলেন পরেও তেমনই আছেন এবং যে কারণে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, ঠিক সেই কারণেই ইসলাম ছাড়ছেন।

যারা এ ধরণের ধর্মপরিত্যাগকারীদেরকে হত্যা করতে চান, তাদের যুক্তি একটিই। তাদের মতে, ধর্ম হচ্ছে রাষ্ট্র এবং ধর্মত্যাগ করা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্র। এটাই তাদের যুক্তি। খুবই অদ্ভুত যুক্তি বটে। ধরে নেয়া হচ্ছে, কেবল ইসলাম ধর্মই রাষ্ট্র, অন্য ধর্মগুলোর এ মর্যাদা নেই। এর অর্থ হচ্ছে এ দাবী কর যে, অন্য ধর্মের নাগরিকেরা কোনো রাষ্ট্রের অংশীদার নয়, সমমর্যাদার নাগরিকই নয়। তা না হলে, কেউ অন্য ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তাকেও তারা রাষ্ট্রদ্রোহীতা, বিশ্বাসঘাতকতা, ষড়যন্ত্রের অপরাধে অভিযুক্ত করতো। তাদের কাছে আরেকটি সমাধান হলো যুক্তি-বুদ্ধির তোয়াক্কা না করে 'শাস্ত্রে আছে তাই মানি' বলা। কিন্তু শাস্ত্রে আছে তাই মানি বলে একজন ব্যক্তি সেগুলোই মানতে পারেন, যেগুলো অন্যের উপর অত্যাচারমূলক নয় বা অন্যের জন্য ক্ষতিকর নয় বলে যুক্তিসঙ্গতভাবে গণ্য হয় বা গণ্য করা যায়। অন্যের উপর অত্যাচার করছেন না এমন ব্যক্তির জীবন-মরণ নিয়ে তো 'আমার শাস্ত্রে আছে তাই মানি' বলা সম্ভব নয় আর দ্বিতীয় ব্যক্তি তো অন্য ধর্মে চলেই গেছেন।

এটাকে চুক্তি-মতবাদ দিয়েও রক্ষা করা যায় না। মেনে নিলাম একজন মুসলিম হবার সময় মুসলিম সমাজের সাথে চুক্তিবদ্ধ হলো। এরকম চুক্তি-তত্ত্ব তো অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বেলায়ও প্রযোজ্য। তারাও তো বলতে পারে, আমাদের সমাজ থেকে যে বের হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে সে তার সম্প্রদায়ের সাথে কৃত চুক্তি ভঙ্গকারী হিসবে সাব্যস্ত হবে। মোট কথা, ধর্ম ও মতের স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের ধারণার সাথে ধর্মত্যাগের জন্য শাস্তি বা মৃত্যুদণ্ড সঙ্গতিপূর্ণ করা যায় না।

অন্যদিকে, এ নিয়ে আইনগত ও রাজনৈতিক সংকট দুটির একটি অপরটির সাথে সংবদ্ধ হয়ে আছে। রাজনৈতিক সুবিধা-চিন্তা ও কৌশলগত কারণে চাপ সামাল দিতে গিয়ে কখনো কখনো আমাদেরকে এমন একটি পথ গ্রহণ করতে হয়, যা আইনের বিপরীতে সকলের নিরাপত্তা লাভের অধিকারটি অস্পষ্ট করে তোলে ও প্রশ্নবিদ্ধ করে।

নিরীশ্বরবাদ সংক্রান্তে অনেক সামাজিক সমস্যাও রয়েছে। নেতিবাচক চাপের কারণে নিরীশ্বরবাদীদের অনেকেই তাদের বিশ্বাসটি প্রকাশ করার ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত বা দ্বিধাগ্রস্ত হন। তারা সমাজে মুক্ত ও স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পারেন না। ফলে বিবাহ, শেষকৃত্য, সম্পদে উত্তরাধিকার ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট একটি টানাপড়েন নিয়ে তাদেরকে জীবন যাপন করতে হয়। কিন্তু মুসলিম, হিন্দু ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মতো একটি স্বতন্ত্র স্বীকৃত সম্প্রদায় হিসেবে বিরাজ করার অধিকার নিরীশ্বরবাদিদেরও রয়েছে এবং ধর্মীয় মহল থেকে এ অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হলে মুসলিম, হিন্দু ইত্যাদি ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোও নিজেদেরকে কার্যকরভাবে সংরক্ষণ করতে পারবে।

এ গেল আমাদের, অর্থাৎ আমরা যারা কোনো না কোনো ধর্ম অনুসারে চলতে চাই তাদের, দায়িত্বের কথা। এবার নিরীশ্বরবাদীদের দায় নিয়ে কিছু কথা বলতেই হয়। নবীকে বা ধর্মকে নিয়ে উপহাস করা কোনো প্রাজ্ঞজনের কাজ নয়। যারা অন্য ধর্ম বা নিরীশ্বরবাদ ছেড়ে মুসলিম হন তারা ছেড়ে আসা ধর্মকে বা মতবাদকে কটাক্ষ বা ব্যঙ্গ করে কথা বলেন না। ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করতে চান বলেই এ ধর্মের শিক্ষা অনুসারেই তারা তা করেন না। বিশ্রী ভাষায় কারও সম্বন্ধে কথা বলা এমনিতেই একটি মন্দ কাজ। এ মন্দ কাজটি নিরীশ্বরবাদীদের করার প্রয়োজন কী? আজ যদি রাষ্ট্র ও সমাজের চাপ অপসারণ করা হয় তবে আমাদের দেশের নিরীশ্বরবাদীদের অনেকেই কী যা-তা সব লিখতে থাকবেন তা অনুমান করা শক্ত নয়। বাইরের চাপে পড়ে যে মন্দ কাজটি থেকে দূরে থাকতে হয়, স্বাধীন পরিবেশেও স্বপ্রণোদিত হয়ে তা থেকে দূরে থাকাই আদতে নৈতিক-মূল্য-যুক্ত কাজ।