প্রবীণ দিবস: সম্পর্ক-জটিলতা এবং ওল্ডহোম

মোনেম অপু
Published : 1 Oct 2015, 05:31 PM
Updated : 1 Oct 2015, 05:31 PM

এককালে যারা যুবাবয়সী ছিলেন তারা সেকালে পিতা-মাতা হয়েছেন। সন্তানের জন্য করতে পারতেন এমন কোনো কাজ তারা না করে বসে থাকেননি। সন্তান যখন শিশু তখন মা নিজেকে ভেজা কাপড়ে জড়িয়ে সন্তানের জন্য খুঁজেছেন শুকনো অংশটি। নিজে না খেয়ে হলেও সন্তানকে খাইয়েছেন। মা-বাবার স্নেহ ও মমতা ছাড়া, তাদের কষ্ট স্বীকার করা ছাড়া কোনো শিশু-সন্তানের পক্ষে জীবন টিকিয়ে রাখা এক প্রকার অসম্ভব ব্যাপার। নিজের জীবন যদি মূল্যবান হয়, নিজের জীবন যদি এমন একটি জিনিস হয়, যার জন্য ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ হওয়া যুক্তির বিচারে আবশ্যক গণ্য করা হয়, আত্মহত্যা যদি একটি অনভিপ্রেত বিষয় হয়, রোগ-ব্যাধিতে আমরা যদি ডাক্তারের কাছে গিয়ে থাকি, মৃত্যুকে এড়ানোর জন্য যদি আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করে থাকি, তবে পিতামাতার প্রতি স্বীয় জীবনের কারণেই কৃতজ্ঞ হওয়া ও থাকা আবশ্যিকভাবে নিঃসৃত অনুসিদ্ধান্ত।

মানবজাতি বিশ্ব জুড়ে পহেলা অক্টোবর প্রবীণ দিবস হিসেবে পালন করছে। এধরণের দিবস পালন এবং কোনো একটি নির্দিষ্ট দিনে প্রতিবছর প্রাতিষ্ঠানিক বার্ষিক সম্মেলন জাতীয় কাজ ভিন্ন প্রকৃতির। বার্ষিক সম্মেলন ইতিবাচক ও প্রো-একটিভ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য প্রবীণ দিবস পালনের প্রথা তৈরি করতে হয়েছে একারণে যে, প্রবীণরা অবহেলিত ও বিপন্ন হয়ে উঠেছেন, আমাদের মূল্যবোধে কোথাও ঘাটতি তৈরি হয়েছে এবং সে ঘাটতি ক্রমে দ্রুতগতিতে শূন্যতায় গিয়ে উপনীত হচ্ছে। একারণে দিবস পালন কর, মানুষের বোধকে জাগ্রত কর ইত্যাদি। কিন্তু এ ক্ষয়ের কারণ কী, উৎস কী? মানুষ এভাবে বদলে যাচ্ছে কেন? কেন এরকম বদলের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে? এ প্রশ্নগুলো গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা দরকার। কেউ যদি উজানে বসে মানুষকে নদীতে ফেলতে থাকে তবে ভাটির মানুষদেরকে ভেসে আসা মানুষগুলোকে পাড়ে তুলতে উৎসাহ দিয়ে দিবস পালন করে গেলে কিছু উপকার হবে বটে, কিন্তু এতে ভাসমান মানুষের প্রবাহ থামবে না।

প্রবীণগণের সমস্যা আসলে বয়সের সমস্যা নয়, সমস্যাটি পিতা-মাতার সাথে সন্তানদের সম্পর্কের সমস্যা, মনোগত অবস্থার সমস্যা। সন্তানেরা সাধারণত নিজের পিতামাতার প্রতি সহজে নির্মম হয় না। তাহলে নিজের পিতা-মাতা থেকে আজকাল সন্তানেরা বিমুখ হয়ে উঠছে কেন? তাহলে কি আমাদের জীবনবীক্ষা, শিক্ষাব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে কোনো ত্রুটি তৈরি হয়েছে? নিশ্চয়ই হয়েছে। তা না হলে জাতিসংঘ দিবস পালন প্রবর্তন করতো না। তা হলে এর জন্য দায়ী কারা? এ প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত জীবনের ছোট্ট একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। একবার কন্যাকে এ-মর্মে বলেছিলাম যে, তার ভাল-মন্দ নিয়ে আমার চিন্তা আছে, উদ্বেগ আছে; কাজেই সে যেন অসতর্ক না হয়। তার উত্তর ছিল অনেকটা এরকম: "তুমি কি আমার কিড ফ্রেন্ডদের কাছ থেকে হার্ম এন্টিসিপেট কর?" কঠিন প্রশ্ন। আসলে আমার মাথায় ঘুরঘুর করছিল প্রধানত ইন্টারনেট ভিত্তিক সিস্টেমটা, ভিডিও গেম, সিনেমা-গান-নাটক-ফাটকের দুনিয়াটা—যা শিশুদের মনোজগতটা গড়ে তুলছে। আইডিয়ার সমস্যার কথা বললে সে বলে বসলো, "কিন্তু এই হার্মফুল দুনিয়াটা কি কিডরা তৈরি করছে? নাকি তোমার মতো বড়রা?"

কারও আর বুঝতে বাকি থাকার কথা নয়, আমরা বড়রাই মন্দকে ভাল বলে প্রতিষ্ঠিত করেছি, মন্দ দিয়ে শিশুদেরকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছি এবং নিজেদের কাজের ফলশ্রুতিতেই আবার শিশুদের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছি। বিষয়টি এখানেই শেষ নয়। চিন্তা করলে স্পষ্টতই দেখা যাবে, এর আরও একটি ফল রয়েছে। এই আমরা যখন বয়সে প্রবীণ হচ্ছি তখন এই শিশুরা সেদিন যুবাবয়সী হচ্ছে। তারা প্রবীণ পিতামাতাকে অবহেলা করছে, তাদের জন্য ওল্ডহোম খুঁজছে, এবং ঈদের দিনেও লজ্জায় পিতা-মাতাকে দেখতে পর্যন্ত যাচ্ছে না। প্রসঙ্গক্রমে ক'দিন আগে একটি টক-শো'র কথা মনে পড়ছে। সেখানে যুবাবয়সী এক দম্পতি, কয়েকজন প্রবীণ নারী-পুরুষও ছিলেন। সকলের মধ্যে অভিনেত্রী ডলি জহুরও ছিলেন। অফিস থেকে ফিরে বৃদ্ধ পিতামাতার সেবা ছেলে-বৌ উভয়ের জন্যই কষ্টকর, ওল্ডহোমে তারা বরং ভাল থাকেন, সেখানে তারা অন্য প্রবীণদের সঙ্গ পান, চিকিৎসা ভাল হয় ইত্যাদি নানা যুক্তির কথা শুনে ডলি জহুর খানিকটা ক্ষুব্ধ হয়েই এ-মর্মে বলেছিলেন যে, পারিবারিক শিক্ষার অভাবই প্রবীণদের এই দুরবস্থার জন্য দায়ী ইত্যাদি। এই 'পারিবারিক শিক্ষা'র গণ্ডিটিকে যদি সম্প্রসারিত করা যায় তবে জাতীয় শিক্ষা, সাংস্কৃতিক-কর্মকাণ্ড, বড়দের দ্বারা ভোগবাদী জীবনদর্শনের প্রতিষ্ঠা—এসব কিছুই 'শিক্ষা'র অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়বে।

ওল্ডহোমের পক্ষে যুক্তিগুলো বড়ই অদ্ভুত। শুনে ভাবছিলাম, পিতা-মাতা যদি বৃদ্ধকালে বিপত্তি হয়ে দাঁড়ায় এবং সেজন্য ওল্ডহোম যুক্তিযুক্ত হয়, তবে এদিগেদি বাচ্চাগুলিও তো বিপত্তি, সেজন্য কিডসহোম কেন একইভাবে যুক্তিযুক্ত হবে না? জন্ম দিয়ে শিশুদেরকে কিডসহোমে স্থানান্তর করা আর ফার্মে মুরগী আবাদ করার মধ্যে ফারাক থাকে না। সন্তানদের মন থেকে এই উপলব্ধিটাই বিদায় নিচ্ছে যে, কিডসহোম যদি তাদের জন্য সম্মানজনক না হয়, ভাল না হয় তবে বৃদ্ধ পিতামাতার জন্য ওল্ডহোমের চিন্তা তারা কিভাবে করে? সঙ্গ, নিরাপত্তা, দেখভাল ইত্যাদি দরকারি বিষয়ের জন্য ওল্ডহোম নয়, ওল্ডক্লাব যথেষ্ট হতে পারে। এধরণের ক্লাব প্রতিবেশী প্রবীণদের নিয়ে পালাক্রমে নিজেদের ঘরেই করা সম্ভব—দূরে যাওয়ার দরকার তো পড়ে না। সুস্থ মানুষেরা তো সময় কাটানোর জন্য স্থায়ীভাবে হাসপাতালে ভর্তি হয় না। তারও উপর, ওল্ডহোম তো হাসপাতালের তুল্যও নয়। স্থায়ী কিডসহোম জাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠান তৈরি করে যদি শিশুদেরকে সেখানে লালন পালন করা হতো তবে তারা বড় হয়ে পিতামাতাকে সম্পর্কচ্ছেদের দায়ে দায়ী করতো। একইভাবে পিতামাতাকে ওল্ডহোমে পাঠানোও কি একধরণের সর্ম্পকচ্ছেদ নয়?

পাশ্চাত্যে পারিবারিক সংস্থা অত্যন্ত শিথিল। শিশুর সংখ্যা কমছে। এক চতুর্থাংশ শিশুও আবার বাস্তবে সিঙ্গেল প্যারেন্ট। সেখানকার স্কুলগুলোতে পুরুষ শিক্ষক নিয়োগকে উৎসাহিত করা হচ্ছে, শিশুদের জীবনে পিতার অভাব পূরণে সহায়ক ব্যবস্থা হিসেবে। প্রবীণরা থাকতে বাধ্য হচ্ছেন ওল্ডহোমে, অবাঞ্ছিত হিসেবে—ভাবটা এমন, যত তাড়াতাড়ি বিদায় হয় ততই মঙ্গল। কে জানে অনাগত ভবিষ্যতে তাদেরকে মরে যাওয়ার অপশনও দেয়া হতে পারে। স্বেচ্ছায় মরে গেলে অপ্রয়োজনীয় মানুষ থেকে সমাজেরও যেন মুক্তি মিলবে! পাশ্চাত্যের এই অবস্থা একদিনে হয়নি এবং এ অবস্থার সাথে তাদের জীবনদর্শনের প্রত্যক্ষ ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আমরা তাদের পথকে আদর্শ হিসেবে নিয়েছি বলেই আমাদেরকেও একই পরিণতির দিকে যেতে হচ্ছে।

এবার অন্য একটি বিষয়ের দিকে লক্ষ্য করা যাক। সন্তানেরা প্রবীণ তথা পিতামাতাকে নিজেদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে মূলত পরিবার সংক্রান্ত তাদের ধারণার কারণে। এখন পরিবার, দায়-দায়িত্ব বলতে বুঝা হচ্ছে স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান। পরিবারের পত্তন হয় দুই পরিবার থেকে আসা একজন পুরুষ ও একজন নারী দ্বারা। একজনের পিতামাতা স্বভাবতই অন্যজনের পিতামাতা নন। ফলে পুরুষটির পিতামাতাকে নারীটি সহজে গ্রহণ করতে চান না। এতে অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষটি অসহায় হয়ে পড়েন। শ্বশুর-শ্বাশুড়ীদের সাথে পুত্রবধূর সম্পর্কের জটিলতা ওল্ডহোম সমাধানের প্রবণতার একটি অন্যতম প্রধান কারণ। খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, এ সমস্যা গ্রাম-নগর শিক্ষিত-শিক্ষাবঞ্চিত নির্বিশেষে সর্বত্রই রয়েছে। এবং এটি অস্বাভাবিক নয়। যেকোনো সংস্থায়, প্রতিষ্ঠানে এধরণের সমস্যা রয়েছে। যেখানেই দুজন মানুষ একত্র হয়, সেখানে দ্বন্দ্বও তৈরি হয়। তাই বলে আমরা বলি না যে, প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙ্গে দাও—তাহলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এ তো মাথা ব্যথা থেকে বাঁচার জন্য মাথা কেটে ফেলার মতো সমাধান।

এখনও আমাদের গ্রামের মেয়েরা ভাবতেও পারেন না যে, স্বামীর বাপ-মা অন্যত্র থাকবে। সেখানে বিরোধ-দ্বন্দ্ব নিয়েই তারা একসাথে বসবাস করেন। কিন্তু প্রবীণদের নিয়ে সমস্যা শিক্ষিত ও শহুরে পরিবারগুলোতেই প্রধান ও প্রকট হয়ে উঠছে। পিতামাতা সংক্রান্ত এ সমস্যা নগরের উচ্চ শিক্ষিত পরিবারগুলোতেই দেখা দিচ্ছে। কেউ পছন্দ করুক আর না-ই করুক, করুণ ও কঠিন সত্য হচ্ছে এই যে, এ সংকট তৈরিতে একপেশে ও উৎকট নারীবাদী প্রবক্তাদের শিক্ষা পরোক্ষভাবে হলেও ইন্ধন হিসেবে কাজ করছে। আর রয়েছে জীবনকে যৌনতাসর্বস্বতায় পর্যবসিত করতে আগ্রহী সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্ররোচনা। নাটক-নভেল-কবিতা যৌন প্রেম-পিরিতির যে মহিমা নিয়ে টালমাটাল হয়ে আছে, তার তুলনায় মানুষের অন্য সম্পর্কগুলো নিয়ে সেখানে আপনি কতটুকু ইতিবাচক উপস্থাপনা দেখতে পান? তার উপর রয়েছে হিন্দি-বাংলা সোপ অপেরাগুলোর অত্যাচার।

আমাদের এই সমস্যার দ্বিতীয় প্রধান কারণ বা উৎস হচ্ছে জেনারেশন গ্যাপ। আগের কালে পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা এবং নাতি-নাতনি—সকলেই মোটামোটি এক ধারায় চিন্তা করতো। ফলে নাতি-নাতনিরাও সহজে দাদা-দাদী-নানা-নানীর সাথে মিশতে পারতো এবং তারা একে অপরকে বুঝতে পারতো। এখন শিশুরা তাদের দাদা-নানা প্রজন্মকে আউটডেটেড-ব্যাকডেটেড মনে করলে অবাক হবার কিছু থাকে না। এ অবস্থাটিও দাদা-প্রজন্মকে অসম্মানিত হবার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এর প্রভাব থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে, যথাযথ শিক্ষা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা মানুষ হবার শিক্ষাব্যবস্থা, নাকি একটি উন্নত মেশিন হবার শিক্ষাব্যবস্থা মাত্র, সে প্রশ্নটিও একটি বড় প্রশ্ন।